নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আমাদের জন্য একটা আশার আলো জাগিয়েছিল। যে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে ভোট কেন্দ্র দখল, প্রতিপক্ষ শিবিরে হামলা ও আহত করা, সিল মারা একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা, সেখানে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে এরকম কিছুই হয়নি। নির্বাচনে তিনটি পক্ষ- সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দল সবাই কমিটেড ছিল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার, এ তিনটি পক্ষ, বিশেষ করে সরকার যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কমিটেড থাকে, তাহলে এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। এটা নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে যখন জেলা পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হল, তখন এ স্পিরিটটি আর থাকল না। জেলা পরিষদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। উপরন্তু অনেক কারণে ওই নির্বাচনটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। প্রথমত, পাকিস্তানি জমানার ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’ অর্থাৎ মৌলিক গণতন্ত্রী মডেলে ওই নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকারের কোনো সুযোগ ছিল না। ভোট দিয়েছে স্থানীয় সরকার, অর্থাৎ উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা। দ্বিতীয়ত, ওই নির্বাচনে শুধু আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই অংশ নেন। বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এরপরও একদলীয় নির্বাচনে ২৩ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তৃতীয়ত, ভোট কেনাবেচার একটি অভিযোগ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। চতুর্থত, জেলা পরিষদের এ নির্বাচন ছিল সংবিধানের স্পিরিটের (১১নং অনুচ্ছেদ) সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যেখানে ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের’ কথা বলা হয়েছে। এমনকি সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, জেলা পরিষদের নির্বাচন ছিল এই স্পিরিটের পরিপন্থী। ফলে একটা আস্থার সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল, তা নষ্ট হয়ে যায়।
এরপর এলো ৫ জানুয়ারির ঘটনা। বিএনপির ‘কালো পতাকা’ মিছিলে পুলিশি হামলা প্রমাণ করল ‘আস্থার সম্পর্ক’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত সহজ নয়। আস্থার সম্পর্কের পূর্বশর্ত হচ্ছে বিএনপিকে ‘স্পেস’ দেয়া। অর্থাৎ বিএনপিকে তার কর্মসূচি পালন করতে দেয়া। এটা তো সত্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল, তার দায়ভার বিএনপি এড়াতে পারে না। বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারার সংস্কৃতি আর যাই হোক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য মানানসই নয়। ওই ঘটনায় বিএনপি তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল বিএনপি ও ১৪ দল। কিন্তু আন্দোলন তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। অর্থাৎ সরকারের পতন হয়নি। কিন্তু সহিংসতায় অনেক মানুষ মারা গেছে। অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের করুণ কাহিনী সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। টিভি পর্দায় তাদের আর্তি দেখে সাধারণ মানুষ কেঁদেছে। মানুষ বিএনপিকেই দোষারোপ করেছে। এটা থেকে বিএনপি বের হয়ে আসতে পারেনি। তারপরও কথা থেকে যায়। বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। এটা সরকারের জন্য একটা প্লাস পয়েন্টও বটে। সরকার বিএনপিকে মূলধারায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এটাকে ধরে রাখতে হবে, যাতে করে বিএনপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি অংশ না নিলে(?) জটিলতা থেকে যাবে। তাতে করে কেউই লাভবান হবে না।
বড় কথা হল, আমাদের মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। বিএনপি নিঃসন্দেহে এখন যথেষ্ট দুর্বল। মামলা-মোকদ্দমা আর কোর্টে যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে তাদের দিন যাচ্ছে। সিনিয়র অনেক নেতা এখন আর সক্রিয় নন। কোনো বড় আন্দোলনও তারা গড়ে তুলতে পারছেন না। তারপরও বিএনপির একটা বড় জনসমর্থন আছে। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমার বিবেচনায় সার্চ কমিটি নয়, বরং বিএনপি যদি সিইসিসহ কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করে, সেখান থেকে অন্তত দুটি নাম বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। আর যদি সার্চ কমিটি গঠন করতে হয়, সেক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদে যারা আছেন, তাদেরসহ সাবেক বিচারপতি ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সাবেক বা এখনও রাষ্ট্রীয় পদে আছেন, এমন আমলাদের সার্চ কমিটির প্রধান করা ঠিক হবে না। আমলাদের অনেকের মধ্যে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেয়ার একটা প্রবণতা থাকে। এমনকি অবসরের পরও এরা সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। এ বাস্তবতায় একজন বিচারপতিকে সার্চ কমিটির প্রধান করা শ্রেয়। এখনও বিচারপতিরা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়।
রাষ্ট্রপতি অনেক ছোট ছোট দলের সঙ্গে সংলাপ করছেন। আসলে তাদের কি আদৌ কোনো গণভিত্তি আছে? ন্যাশনাল ফ্রন্ট, বিজেপি, তরিকত ফেডারেশন- এদের গণভিত্তি কী? কিংবা ওয়ার্কার্স পার্টি? বিগত সংসদ নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে এদের ভোটের প্যাটার্ন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। তাই আস্থাটা রাখা দরকার দুই বড় দলের মাঝে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যদি ন্যূনতম ইস্যুতে ‘এক’ হয়, তাহলে এ দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। তাই প্রয়োজন এ দুটি দলের নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতায় যদি পরির্তন না আসে, তাহলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়।
দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা সফট পাওয়ার হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেনে’ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এসব ‘অর্জন’ মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুই বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এ আস্থার সম্পর্ক শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুই বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এ প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক। একুশ শতকে বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চায় দলগুলো, কীভাবে তা বাস্তবায়ন করবে, তা দেখতে চায় সাধারণ মানুষ। সেজন্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের কথা। কিন্তু তা যদি ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়, তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। তাই আস্থার সম্পর্ক থাকাটা জরুরি।
চলতি ২০১৭ সালটি হবে এ আস্থার সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করার সময়। চলতি জানুয়ারি মাসেই বোঝা যাবে এ আস্থার সম্পর্কটি কোন দিকে যায়। রাষ্ট্রপতির সংলাপ প্রমাণ করবে এ আস্থার সম্পর্কটি চলতি বছর রাজনীতিতে আদৌ কোনো গুণগত পরিবর্তন ডেকে আনবে কিনা। এ ক্ষেত্রে গত ৫ জানুয়ারি (২০১৭) বিএনপিকে কালো পতাকা মিছিল করতে না দেয়া আস্থার সম্পর্কে এখন চিড় ধরাবে। বিএনপি এটাকে রাজনৈতিকভাবে পুঁজি করার চেষ্টা করবে। আমরা ৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে একটি নির্বাচন কমিশন পেতে যাচ্ছি। রাষ্ট্রপতি এদের নিয়োগ দেবেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৪৮ ধারা মাথায় রাখবেন, এটা সত্য। তবে রাষ্ট্রপতির ওপর আস্থা রাখতে হবে। আরও একটা কথা। আগামী বছর বাংলাদেশ নতুন একজন রাষ্ট্রপতি পাবে। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে ২০১৮ সালের ২০ মার্চ। তবে চলতি বছর এ নিয়ে আলোচনা হবে। বর্তমান রাষ্ট্রপতিও স্বপদে থেকে যেতে পারেন।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা দক্ষিণ আয়োজিত এক জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, বিএনপি যদি কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র কি থেমে থাকবে? (যুগান্তর, ৫ জানুয়ারি)। বিএনপি সংঘাতের উসকানি দিচ্ছে- এমন কথাও বলেছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে কি তিনি কোনো মেসেজ দিলেন? ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়। এটা সত্য, কোনো একটি দল যদি কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেমে থাকবে না। নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ারই অংশ। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যে দলের পেছনে ৩২ থেকে ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে (নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনেও এর কমতি ছিল না), সেই দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আর থাকে না বিধায় আমরা দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে বারবার শুনতে থাকি ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচনের কথা।
৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন নিয়ে আমরা যত কম কথা বলব, ততই মঙ্গল। আস্থার সম্পর্কটা বাড়ানো দরকার। না হলে ওবায়দুল কাদের যেভাবে বলেছেন- ‘কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নিলে গণতন্ত্র থেমে থাকবে না’- সেভাবে আবারও হয়তো একটি নির্বাচন হবে। কিন্তু তাতে সংকট দূর হবে না।
Daily Jugantor
08.01.2017
0 comments:
Post a Comment