রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ট্রাম্প আমলে কেমন হবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক


ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন এক সপ্তাহের উপরে। এরই মধ্যে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন এবং তাতে করে ওবামা প্রশাসনের আমলে গৃহীত কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে। এর একটি হচ্ছে ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত স্বাস্থ্যসেবা স্থগিতাদেশ সংক্রান্ত একটি নির্বাহী আদেশ। অপরটি হচ্ছে টিপিপি বা ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ নামে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে আসা। নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প বারবার বলে আসছিলেন- তিনি নির্বাচিত হলে এগুলো বাতিল করবেন। এখন তিনি তার কথা রেখেছেন। যদিও ওবামা প্রশাসনের আমলে টিপিপি স্বাক্ষরিত (১২ দেশের মধ্যে) হলেও মার্কিন কংগ্রেসে অনুমোদিত না হওয়ায় তা তখন আইনে পরিণত হয়নি। এখন ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই টিপিপির প্রসঙ্গ এসে যায়।

ট্রাম্প চুক্তিটি বাতিল করায় বাংলাদেশের এতে লাভই হল। আমি এর আগে যুগান্তরে আমার কলামে উল্লেখ করেছিলাম, টিপিপি যদি কার্যকর হয়, তাহলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কেননা চুক্তিটি কার্যকর হলে ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক নিয়ে প্রবেশ করত। এর ফলে ঝুঁকির মুখে থাকত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। এখন চুক্তিটি বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত লাভবান হবে। এখানে বলা ভালো, টিপিপি ছিল একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিল। এতে মোট ১৮ হাজার পণ্যের শুল্ক হ্রাস করার কথা ছিল। চুক্তিটি কার্যকর হলে বিশ্ব বাণিজ্যের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করত এই জোট। বিশ্বের মোট জিডিপির ৪০ ভাগ ছিল এই চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর হাতে (মোট জিডিপি ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার)। অভিযোগ উঠেছিল, এ চুক্তির ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লাভবান হবে। তারা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। চুক্তিবদ্ধ কোনো দেশের জাতীয় স্বার্থ যদি ক্ষুণ্ণ হয়, তাহলেও ওই চুক্তির বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা এতে লাভবান হবে না। বেকার সমস্যা বাড়বে। চাকরি চলে যাবে অন্যত্র। তাই ট্রাম্প এটি বাতিল করলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো কোনো দেশ ইতিমধ্যেই নিজেদের মধ্যে এ চুক্তি বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। এ দেশগুলো এখন কী করবে? এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে যে চুক্তি, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আমাদের একটা উৎকণ্ঠার জায়গা ছিল এই টিপিপি। এখন এটি বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশে স্বস্তি ফিরে আসবে।

তবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক শুধু একটি চুক্তি বাতিলের ওপর নির্ভর করবে না। বেশ কিছু ইস্যুতে দু’দেশের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। ট্রাম্প জমানায় এ সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা দেখার বিষয়। বাংলাদেশের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। ১৯৭২ সালেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এরপর থেকে গত ৪৪ বছরে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্য, দুই দেশের মাঝে কোনো বড় ধরনের বিরোধ না থাকলেও কোনো কোনো ইস্যুতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক নয়। তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিএসপি সুবিধা পায় না। এ নিয়ে বাংলাদেশে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে এবং বাংলাদেশ মনে করে বিষয়টি সম্পূর্ণ ‘রাজনৈতিক’। বাংলাদেশে আইএসের তথাকথিত উত্থান নিয়ে দু’দেশের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশে আইএস আছে, এটা বাংলাদেশের স্বীকার করা উচিত। অথচ বাংলাদেশ মনে করে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। তবে আইএসের সমর্থক কিছু জঙ্গি সংগঠন থাকতে পারে, যারা এ দেশে বিদেশীসহ বেশকিছু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। মার্কিন দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল অফিসার জুলহাস ও তার ‘বন্ধু’ তনয় হত্যাকাণ্ডের পর দেশে গত বছর এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। ঢাকায় নিশা দেশাই যে মন্তব্য করেছিলেন, যে কোনো বিবেচনায় তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তখন বলেছিলেন, জুলহাস-তনয় হত্যাকাণ্ডে আইএস যেভাবে দায় স্বীকার করছে, তা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ নিশা দেশাইয়ের ভাষায়, বাংলাদেশ স্বীকার করে নিক এ দেশে আইএস আছে! তবে জঙ্গি দমনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবে এমন কথাও তিনি বলে গিয়েছিলেন।

এর আগে জিএসপি সুবিধা বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশ বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি। রানা প্লাজা ও তাজরিন গার্মেন্টসে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা জিএসপি সুবিধা বাতিলের পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। এই কর্মপরিকল্পনা পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। অসংখ্য নারী শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর প্রভাব পড়ে জিএসপি সুবিধা বাতিলের ক্ষেত্রে। যদিও এটা সত্য, শুধু তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ বেশি। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমরা ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অবস্থান ধরে রেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে এখন ভিয়েতনাম। আর এই ভিয়েতনামের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র গেল বছর টিপিপি স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে তার তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে পারত। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঝুঁকির মুখে থাকত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা ভালো, চীনের পরই ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বড় রফতানিকারক। অর্থাৎ চীন বেশি রফতানি করে। তারপর ভিয়েতনাম। পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাকে ভিয়েতনামের রফতানি বাড়ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হারে। টিপিপি’র ফলে এটা আরও বাড়ার সম্ভাবনা ছিল। ২০১৫ সালেই ভিয়েতনাম পোশাক রফতানি খাতে ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। দেশটি ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিক রফতানি ৫০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। টিপিপি বাতিলের ফলে এটি কতটুকু সহজ হবে বলা মুশকিল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সমস্যা রয়েছে। দেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ব্রিটেন এখন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। গেল বছর গণভোটে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন যুক্তরাজ্যকে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে। ফলে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলাদা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। অন্যত্র আমাদের বাজার খুঁজতে হবে। টিপিপি না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের চাহিদা আরও বাড়বে। আমাদের যেতে হবে বৈচিত্র্যে, ফ্যাশনে। বাংলাদেশ তার রফতানি বাড়াতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি বাড়াতে হলে তাকে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে হবে। আর জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে হলে ওয়াশিংটনে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন যেহেতু বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে এবং প্রতিটি দেশের স্বার্থকে আলাদা করে দেখতে চায়, সেহেতু বাংলাদেশ তার যৌক্তিক দাবিটি ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে উপস্থাপন করতে পারে। এ জন্য ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকে আরও তৎপর হতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল নতুন প্রশাসনের সঙ্গে ‘সম্পর্ক তৈরির’ ব্যাপারে ওয়াশিংটন ডিসি সফর করতে পারে। কংগ্রেস সদস্যদের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করা জরুরিও বটে।

জিএসপি সুবিধা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার শর্ত কার্যকর করতে রাজি হয়েছিল। এতে করে এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, অনুন্নত বিশ্ব পশ্চিমা উন্নত দেশে তাদের রফতানি পণ্যের আওতা বাড়াতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল পণ্যের মান ও উৎস নির্ধারণ নিয়ে। এ দুটো বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে। হংকং সম্মেলনের দীর্ঘ ৮ বছর পর ২০১৩ সালের ৩-৭ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সর্বশেষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক)। বালি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বটে; কিন্তু ‘বালি ঘোষণায়’ কোন পক্ষ কী পেল, কিংবা বাণিজ্যবৈষম্যের শিকার অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন হবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। বাস্তবে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নগুলোই আবারও উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকে কোনো জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তারপরও অন্যান্য পণ্যে যতটুকু সুবিধা পেত বাংলাদেশ, তাও গত জুন (২০১৩) থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে। জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এক. শ্রমমান, দুই. শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত ও বিচার, তিন. ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। ঢাকায় টিকফার প্রধান বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র আকার-ইঙ্গিতে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল।

শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ‘রুলস অব অরিজিনের’ কঠিন শর্তে আটকে আছে। ধনী দেশগুলো এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের মোট রফতানির ৬১.৩ ভাগ জিএসপি সুবিধার আওতায়। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে মোট রফতানির প্রায় ৬০ ভাগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে বাংলাদেশ। বলা ভালো, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৭৮ ভাগ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এ তৈরি পোশাকের ৬০ ভাগ যায় ইউরোপে, আর ২৫ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাক আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত নানা ‘প্রশ্নের’ ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে পারেনি। দরকষাকষিতে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। আমলানির্ভর আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমলারা ‘বিদেশ সফর’, ‘সম্মেলনে অংশগ্রহণ’ ইত্যাদিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। এখানে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিজিএমইএ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাদের গবেষণা সেলও শক্তিশালী নয়। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সঙ্গে ‘রুলস অব অরিজিন’, ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ ও ‘কাউন্টারভেইলিং ব্যবস্থা’, প্রেফারেন্স ইরোসন, শ্রমমান ইত্যাদি নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন জড়িত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায়ও আমরা এসব প্রশ্নে শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।

বাংলাদেশ যখন জিএসপি সুবিধায় আটকে আছে, তখন ‘আকসা’ ও ‘সোফা’ চুক্তির ব্যাপারেও কোনো সমাধান হয়নি। ওবামা প্রশাসনের আমলে সোফা (Status of Forces Agreement) এবং আকসা (Acquisition and Cross Servicing Agreement) এ দুটো চুক্তি করতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। দুটোর ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বেশি। এই চুক্তি দুটোর বলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্যরা ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে আসা, অবস্থান, প্রোটোকল সুবিধা ইত্যাদি পাবে। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তারা যদি কোনো ক্রিমিনাল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়, তাদের বাংলাদেশে বিচার করা যাবে না। বাংলাদেশ এসব কারণেই ওই দুটো চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়নি। এখন এটা স্পষ্ট নয়, বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন এ ধরনের চুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা। তবে আগামী দিনগুলোতে মার্কিন স্ট্র্যাটেজিতে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব বাড়বে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ফলস্বরূপ এ অঞ্চলে ভারতকেন্দ্র্রিক যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তা আরও শক্তিশালী হবে। ভারতকে সঙ্গে নিয়ে চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ার যে উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছিল, তা ট্রাম্প পরিত্যাগ করবেন বলে মনে হয় না। এ কারণেই ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব থাকবেই। ইতিমধ্যে ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে একটা বার্তা তিনি দিলেন। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। এটা ট্রাম্প অস্বীকার করতে পারবেন না। ট্রাম্প তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, এখন আমরা আমাদের স্বার্থ কতটুকু আদায় করতে পারব, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Jugantor
29.01.2017

0 comments:

Post a Comment