রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

নির্বাচন কমিশনের সংলাপ, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ও বিবিধ প্রসঙ্গ


নির্বাচন কমিশন সুধী সমাজের সঙ্গে সংলাপ করেছে। নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার, তারা একটি গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন উপহার দিতে চান জাতিকে। ৩১ জুলাইয়ের সংলাপে উপস্থিত সুধী সমাজ প্রায় সবাই এক বাক্যে এ কথাই বলেছেন, আগামীতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো যেন একটি নির্বাচন না হয়। আর সে জন্য যা দরকার তা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের শক্ত অবস্থান গ্রহণ। ওইদিন সুধী সমাজের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেখানে অন্তত তিনটি ইস্যুতে বিশিষ্টজনরা ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এই তিনটি হচ্ছেÑ ‘না’ ভোট পুনঃপ্রবর্তন, নির্বাচনের দিন সর্বত্র সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং তফসিল ঘোষণার আগেই সব দলের জন্য সমান ক্ষেত্র তৈরি। সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে ইতোমধ্যেই ‘বড়’ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। স্পষ্টতই দুটি বড় দল (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি যেখানে সেনা মোতায়েনের পক্ষে, সেখানে আওয়ামী লীগ এর বিরুদ্ধে। ফলে নির্বাচন কমিশন যে সুপারিশমালা প্রণয়ন করবে এবং সরকারের কাছে তাদের দাবি উত্থাপন করবে, তাতে সেনা মোতায়েনের সুপারিশটি থাকবে কিনা সে প্রশ্ন থাকলই। এটা একটা বড় ইস্যু এবং ইসির জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। চলতি আগস্ট মাসেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসছে নির্বাচন কমিশন। সেনা মোতায়েনের বিষয়টি যে সেখানে আলোচিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যদি তাদের প্রস্তাবনায় অথবা সুপারিশে (সবার মতামত নিয়ে) নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের ইস্যুটি না রাখে, তাহলে প্রশ্ন উঠবে সিইসির সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। আর যদি রাখে, তাহলে প্রশ্ন উঠবে নির্বাচনে সরকারের অসহযোগিতা নিয়ে! কেননা নির্বাচন কমিশন এককভাবে নির্বাচন পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে না। নানাবিধ কাজে তার সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। ডিসি, এসপি, ওসিÑ তারা তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন-পূর্ব তিন মাস সময়ে নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন থাকবেন। তারা নির্বাচন কমিশনের কথামতো চলবেন। এটাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা (সংবিধানের ধারা ১২৬)। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা দেখি ভিন্নচিত্র। জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা ইসি নয়, বরং মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রিত হন। তারা সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যেতে পারেন না। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা না হয় নাই বা বললাম। উপজেলা নির্বাচনে কী হয়েছিল? মিডিয়ার বদৌলতে আমরা দেখেছি ভোটকেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা হচ্ছে, পুকুরে ব্যালট পেপার ভাসছে কিংবা তারও আগে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি কেউ কেউ, তাকে ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইত্যাদি। ওই সময় তো শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল! তারা কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন? ডিসি সাহেবরা ছিলেন। কিন্তু তাদের ভূমিকা কী ছিল? সুতরাং সেনা মোতায়েনের প্রশ্নটা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। ইসি এককভাবে এটা পারে না। সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার। এই সহযোগিতা ইসি সব সময় পেয়েছে, তা বলা যাবে না। তাই সুধী সমাজের এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কাগজ-কলমেই থেকে যেতে পারে। এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসিকে একটা সমঝোতায় যেতে হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসির ৭ দফাকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বড় আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। মূল আলোচনা হতে হবে বিএনপির সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। যদিও এটা সত্য, ‘সহায়ক সরকার’-এর যে কথা বিএনপি বলে আসছে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন নয়। তবে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। এটা কঠিন কিছু নয়। সিইসির আর জীবনে পাওয়ার কিছু নেই। পূর্ণ সচিব না হয়েও কিংবা সচিব হিসেবে সচিবালয়ের কাজ না করেও তিনি সিইসি হয়েছেন। থাকবেন ৫ বছর। এর পর তো তার আর পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু জাতি তাকে মনে রাখবে যদি তিনি দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন। একমাত্র তার আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি আদৌ এই উদ্যোগটি নেবেন কিনা? সব সময় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সাংবিধানিকভাবে সরকারের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সরকারি দলের জন্য এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। তার পরও ‘যে কোনো ফর্মুলায়’ বিএনপিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে আনতে হবে। ইতোমধ্যে আদালতের অনুমতি না নিয়ে খালেদা জিয়া দেশ ছেড়েছেন বলে দুদক আদালতের কাছে আর্জি জানিয়েছে। খালেদা জিয়ার লন্ডন গমন নিয়ে মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই মঙ্গল। আমরা চাই আস্থার সম্পর্ক। এই আস্থার সম্পর্কই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। ৭ দফা ‘রোডম্যাপ’ কিংবা রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে তা নিশ্চিত করা যাবে না। সরকারি দল প্রকাশ্যে এবং গোপনে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। খালেদা জিয়াও লন্ডন যাওয়ার আগে ধানের শীষে ভোট চেয়েছেন। এরশাদ সাহেবও সক্রিয়। সুতরাং বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও যাতে সভা-সমাবেশ করতে পারে, এটা নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা কোনো দলই নির্বাচনী তফসিলের আগে কোনো সভা-সমাবেশ কতে পারবে না। ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ করছে, তাতে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ থাকবে না। কেননা নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। জামায়াত হিসেবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও কীভাবে এবং বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী, এ ব্যাপারেও আগ্রহ থাকবে অনেকের। নতুন কয়েকটি ইসলামিক দল তথা জোটকে নতুন করে নিবন্ধন দেওয়া হবে। হেফাজতের সমর্থকরা তাতে থাকবেন। এটাও রাজনীতিতে নতুন একটি দিক। তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের আদৌ কোনো ভূমিকা থাকবে কিনা এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা।
আমরা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। যেখানে ভারতের মতো দেশে মাত্র তিনজন কমিশনার দিয়ে নির্বাচনের সব কর্মকা- পরিচালিত হয়, সেখানে আমরা ৫ জন কমিশনার (একজন সিইসিসহ) দিয়ে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করছি। কিন্তু এতে করে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকারের নিরপেক্ষ থাকা যেমনি প্রয়োজন, ঠিক তেমনি নির্বাচন কমিশনেরও ক্ষমতা প্রয়োগ করার বিষয়টি জরুরি। নির্বাচন কমিশন কাগুজে ও প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, আমরা তা কেউই চাই না। একটি অর্থবহ, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন প্রয়োজন। তা হলেই আমরা গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব। আর না হলে এ দেশে গণতন্ত্রের ‘মৃত্যু’ ঘটবে। নির্বাচন কমিশন যদি বিষয়টি উপলব্ধি করে তাহলে তা আমাদের সবার জন্য মঙ্গল। এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিকচর্চার জন্য দুটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে তা হলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তা হলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেকগুলো সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধশিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে অর্জন তা মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই আস্থার সম্পর্ক শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি নেই। কিন্তু সময় এসেছে এ ব্যাপারে কথা বলার ও একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এ কারণেই ইসিতে সংলাপে আমি বলেছি এখনই সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হোক। মামলা-মোকদ্দমা থাকতেই পারে। এ জন্য দেশে আইন আছে। আদালত আছে। আইন ও আদালতকে ‘ফেস’ করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা সবাই চাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। চাই একটি শক্তিশালী পার্লামেন্ট। আর এভাবেই গণতন্ত্রের ভিতকে আমরা আরও শক্তিশালী করতে পারব। না হলে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য কোনো মঙ্গল বলে আনতে পারব না আমরা। যে কথাগুলো ওইদিন সুধী সমাজ বলেছে, তার মাঝে কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ নেই বা কোনো রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাবও তাতে প্রতিফলিত হয়নি। তবে সুশীল সমাজ নয়, বরং সিদ্ধান্ত নেবে রাজনৈতিক দলগুলো। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে আদৌ সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কিনা কিংবা ‘না’ ভোট কীভাবে পুনঃস্থাপিত হবে। আমরা চাই এ ব্যাপারে একটা সমঝোতা হোক।
Daily Amader Somoy
09.08.2017

0 comments:

Post a Comment