পাকিস্তানের রাজনীতিতে নওয়াজ শরিফ বরাবরই একজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি কোনো রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসেননি। একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পাকিস্তানে তার পরিচিতি আছে। পাকিস্তানে সাবেক সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের শামনামলে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান এবং তারই ছত্রছায়ায় তিনি রাজনীতিতে আসেন। তার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও আমলা ও জেনারেলদের কাছে তিনি কখনও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না। তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। প্রতিবারই তিনি অপসারিত হয়েছেন। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, এপ্রিলে (১৯৯৩) বরখাস্ত হন, এক মাস পর মে মাসে (১৯৯৩) তিনি কোর্টের আদেশে পুনর্বহাল হন। তবে একই বছর জুলাই মাসে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে তিনি এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইসহাক খান পদত্যাগ করেন। দ্বিতীয়বার তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত। তৃতীয়বার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০১৩ সালের ৫ জুন। সেবারও তার দল মুসলিম লীগ (এন) বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। যদিও এবারের সরকার ছিল কোয়ালিশন সরকার, কিন্তু এবারও তিনি পুরো ৫ বছরের টার্ম পূরণ করতে পারলেন না। ২৮ জুলাই (২০১৭) পদত্যাগ করলেন কেলেঙ্কারির বোঝা মাথায় নিয়ে। শুধু তার ক্ষেত্রেই নয়, বেনজির ভুট্টোর ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছিল। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও বেনজির ও নওয়াজ শরিফ কখনও তাদের ৫ বছরের টার্ম পূরণ করতে পারেননি। বেনজিরের মতো নওয়াজ শরিফও দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। আবার দেশে ফিরেও এসেছিলেন। একসময় লন্ডনে বসে বেনজির, নওয়াজ শরিফ গণতন্ত্র উদ্ধার কমিটি গঠন করেছিলেন। তখন ছিল জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সময়কাল। এখন পারভেজ মোশাররফ নিজেই দেশান্তরিত। কেন এ রকমটি হয়? এর কারণ হচ্ছে, অত্যন্ত ক্ষমতাবান সেনাবাহিনী তথা সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি। বেনজির ভুট্টো তো আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারাই গিয়েছিলন। অভিযোগের তীর ছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার দিকে! জেনারেল পারভেজ মোশররফ যখন সেনাপ্রধান ছিলেন, তখনও নওয়াজ শরিফ তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। অনেকের মনে থাকার কথা, ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশারফকে বহনকারী বিমানকে করাচির মাটিতে নামতে দেননি নওয়াজ শরিফ। এরপরই এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। অনেক ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিচার বিভাগের একটা পরোক্ষ সম্পর্ক লক্ষ করা যায়! এরই মধ্যে পাকিস্তানে যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে সেনাবাহিনী কী বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে নওয়াজকে উৎখাত করল? পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মাঝে সন্দেহ জাগার অন্যতম কারণ হচ্ছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে যে যৌথ তদন্ত কমিটি (Joint Investigation Committee গঠিত হয়েছিল, তাতে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার দুইজন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার ব্যক্তি এ প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ফলে একটা প্রশ্ন তো থাকলই। তবে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে তো নওয়াজ শরিফই মনোনীত করেছিলেন। তিনজন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্যে থেকে নওয়াজ শরিফ তাকে বেছে নিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল একজন নন-পাঞ্জাবি জেনারেল যদি সেনাপ্রধান হন, তিনি নিশ্চিন্তে থাকবেন। জেনারেল বাজওয়া পাঞ্জাবি নন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবি আধিক্য বেশি। শীর্ষ পাঞ্জাবি জেনারেলরা কোর কমান্ডগুলোর নেতৃত্ব দেন। অথচ দেখা গেল, একজন নন-পাঞ্জাবি জেনারেলকে সেনাপ্রধান করেও তিনি ‘পার’ পেলেন না। আসলে এখানে কাজ করে সেনাবাহিনীর গোষ্ঠীস্বার্থ। এ গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে নওয়াজ শরিফ হেরে গেলেন।
তাহলে কোন পথে এখন পাকিস্তান? অনেক সম্ভাবনা আছে এখন এক. নিয়মমাফিক নির্বাচন হবে আগামী বছর। যে কারণে নওয়াজ শরিফ তার ছোট ভাই শাহবাজ শরিফকে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার রাজনীতিতে নওয়াজ শরিফের ‘ক্যামব্যাক’। দুই. মুসলিম লীগের ওপর নওয়াজের কর্তৃত্ব বজায় রইল। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘অযোগ্য’ ঘোষিত হলেও দল পরিচালনায় অযোগ্য ঘোষিত হননি। অর্থাৎ দলকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আবার ফিরে আসার চেষ্টা করবেন। দল যদি আগামী নির্বাচনে ভালো করে, তিনি ২০১৮ বা ২০১৯ সালের দিকে যদি ফের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন, আমি অবাক হব না। উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে একটা ধূম্রজাল আছে। তিনি শুধু চলতি সংসদে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন, নাকি আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। উচ্চ আদালত ট্রায়াল কোর্ট নয়। তাকে আজীবন নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার রাখে না উচ্চ আদালত। সুতরাং নওয়াজ শরিফ আইনি লড়াইয়ে যাবেন এবং ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশও নিতে পারেন! তিন. তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা রয়েছে। তার দলও শক্তিশালী। বর্তমানে পাকিস্তানের সংবাদের উচ্চকক্ষ সিনেটে (মোট আসন ১০৪) মুসলিম লীগের আসনসংখ্যা ২৫। কিন্তু নিম্নকক্ষে (মোট আসন ৩৪২) মুসলিম লীগের আসনসংখ্যা ১৮৯। নিম্নকক্ষে মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের আসনসংখ্যা ২০৯, আর বিরোধী দলের ১৩১ আসন। সর্বশেষ নির্বাচনে মুসলিম লীগ পেয়েছিল শতকরা ৩২ দশমিক ৭৭ ভাগ। আর পিপিপি ও তেহরিক-ই ইনসাফ পেয়েছিল শতকরা ১৫ দশমিক ২৩ ভাগ ও ১৬ দশমিক ৯২ ভাগ। এর অর্থ রাজনীতিতে মুসলিম লীগের একটা অবস্থান আছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই ইনসাফ পার্টি; পিপিপির ভূমিকা দৃশ্যত স্পষ্ট নয়। নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের পরপরই ইমরান খানের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠেছে। ফলে পাকিস্তানের রাজনীতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন শহিদ আব্বাসি। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে আগামী সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন শাহবাজ শরিফ। এজন্য তাকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করতে হবে এবং উপনির্বাচনে (নওয়াজ শরিফের আসনে) বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে যেতে হবে। শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করলে তার স্থলাভিষিক্ত হবেন তার বড় সন্তান হামজা শরিফ। আসলে নওয়াজ শরিফ পদত্যাগ করলেও তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে চান। এ কারণেই একদিকে শাহবাজ শরিফকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, অন্যদিকে ভাইপো হামজা শরিফকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছেন। এটা হিতে বিপরীতও হতে পারে। দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। নওয়াজ শরিফ পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফ একাই নন, পানামা পেপারসে আরও অনেকের নাম এসেছিল। কিন্তু এদের সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কিনা, তা-ও স্পষ্ট নয়। ফলে নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে বৈকি! পাকিস্তানের রাজনীতি এখন কোন দিকে যায়, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Alokito Bangladesh
06.08.2017
0 comments:
Post a Comment