রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিইসি কি শেষ কথাটা বলে ফেলেছেন




সিইসি বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা আবারও নিজেকে ‘বিতর্কিত’ করলেন। ১৭ আগস্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপের পর সংবাদ সম্মেলনে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা আবারও নতুন করে ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি করেছে। তিনি এসব মন্তব্য করলেন এমন একসময়, যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া অনেকটাই শুরু হয়ে গেছে এবং বিভিন্ন মহল থেকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন কোনো ধরনের মধ্যস্থতা করবে না। এটা ইসির কাজ নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘কারও চাওয়া বা না চাওয়ার ওপর সেনা মোতায়েনের বিষয় নির্ভর করে না।’ অপ্রসাঙ্গিকভবে তিনি এমন অনেক কথা বলেছেন, যা তার বলা উচিত ছিল না। তিনি কৌশলী হলে এ ধরনের কথা বলতেন না। তার ভাষায়, ‘আমরা তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর নির্ভরশীল নির্বাচন দেখেছি। বলুন তো, শেষের দিকের অবস্থা কেমন ছিল? শেষদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দেশে টেকেনি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি সেট করে দেয়, ওই নিয়মেই আমাদের নির্বাচন করতে হয়।’ সিইসি মনে করেন, ‘বর্তমানে আমরা শতভাগ অনুকূল ও আস্থাশীল অবস্থানে রয়েছি। কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করেনি। কেউ কমিশনে দাবি-দাওয়া নিয়ে আসেনি।’ দেশের মানুষ যখন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, বিদেশিরা যখন সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন দেখতে চায়, সুশীল সমাজ যখন সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলে, তখন সিইসির আগ বাড়িয়ে এসব কথা বলা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়াবে। তিনি ‘কম’ কথা বললে ভালো করবেন। তাকে সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন তিনটি ‘সংলাপ’ করেছে। সুশীল সমাজ, সিনিয়র সাংবাদিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। সবাই মোটামুটি সেনাবাহিনী মোতায়েন আর ‘না’ ভোটের বিধান রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু সিইসির কথায় আমার কাছে এটা মনে হয়নি যে, তিনি সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে সিরিয়াস। এক্ষেত্রে তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন সরকারের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। আর যদি সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবে সরকারের অসহযোগিতা নিয়ে। কেননা নির্বাচন কমিশন এককভাবে নির্বাচন পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে না। নানাবিধ কাজে তার সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। ডিসি, এসপি, ওসিÑ এরা তত্ত্বগতভাবে নির্বাচনের আগে তিন মাস সময় নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন থাকে। এটাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা (সংবিধানের ধারা ১২৬)। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা ইসি নয়, বরং মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রিত হন। তারা সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যেতে পারেন না। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা না হয় না-ইবা বললাম। উপজেলা নির্বাচনে কী হয়েছিল? মিডিয়ার বদৌলতে আমরা দেখেছি ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা হচ্ছে, পুকুরে ব্যালট পেপার ভাসছে কিংবা আরও আগে প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি, কেউ কেউ তাকে ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। ওই সময় তো শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল! তারা কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন? ডিসিরা ছিলেন; কিন্তু তাদের ভূমিকা কী ছিল? সুতরাং সেনা মোতায়েনের প্রশ্নটা বিবেচনায় নেয়া জরুরি। ইসি এককভাবে এটা পারে না। সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার। এ সহযোগিতা ইসি সব সময় পেয়েছে, তা বলা যাবে না। তাই সুধী সমাজের অনেক প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কাগজে-কলমেই থেকে যেতে পারে। এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসিকে একটা ‘সমঝোতা’য় যেতে হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসির সাত দফাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বড় আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। মূল আলোচনা হতে হবে বিএনপির সঙ্গে। এক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। যদিও এটা সত্য, ‘সহায়ক সরকার’র যে কথা বিএনপি বলে আসছে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন নয়। তবে দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। এটা কঠিন কিছু নয়। সিইসির আর জীবনে পাওয়ার কিছু নেই। পূর্ণ সচিব না হয়েও কিংবা সচিব হিসেবে সচিবালয়ে কাজ না করেও তিনি সিইসি হয়েছেন। থাকবেন ৫ বছর। এরপর তো তার আর পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু জাতি তাকে মনে রাখবে, যদি তিনি দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন। একমাত্র তার আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ তিনি যদি আদৌ কোনো উদ্যোগ না নেন, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? সব সময় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সাংবিধানিকভাবে সরকারের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সরকারি দলের জন্য এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। তারপরও ‘যে কোনো ফর্মুলায়’ বিএনপিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে আনতে হবে। এরই মধ্যে আদালতের অনুমতি না নিয়ে খালেদা জিয়া দেশ ছেড়েছেন বলে দুদক আদালতের কাছে আরজি জানিয়েছে। খালেদা জিয়ার লন্ডন গমন নিয়ে মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই মঙ্গল। আমরা চাই, আস্থার সম্পর্ক। এ আস্থার সম্পর্কই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। সাত দফা ‘রোডম্যাপ’ কিংবা রংপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে, তা নিশ্চিত করা যাবে না।
সরকারি দল প্রকাশ্যে এবং গোপনে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। খালেদা জিয়াও লন্ডন যাওয়ার আগে ‘ধানের শীষে’ ভোট চেয়েছেন। এরশাদও সক্রিয়। সুতরাং বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও যাতে সভা-সমাবেশ করতে পারে, এটা নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা কোনো দলই নির্বাচনী তফসিলের আগে কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারবে না। ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ করছে, তাতে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ থাকবে না। কেননা নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। জামায়াত হিসেবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও কীভাবে এবং বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী, এ ব্যাপারেও আগ্রহ থাকবে অনেকের। নতুন কয়েকটি ইসলামিক দল তথা জোটকে নতুন করে নিবন্ধন দেয়া হবে। হেফাজতের সমর্থকরা তাতে থাকবেন। এটাও রাজনীতিতে নতুন একটি দিক। তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের আদৌ কোনো ভূমিকা থাকবে কিনা, এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা।
আমরা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। যেখানে ভারতের মতো দেশে মাত্র তিনজন কমিশনার দিয়ে নির্বাচনের সব কর্মকা- পরিচালিত হয়, সেখানে আমরা পাঁচজন কমিশনার (একজন সিইসিসহ) নিয়ে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করছি। কিন্তু এতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকারের নিরপেক্ষ থাকা যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনই নির্বাচন কমিশনেরও ‘ক্ষমতা প্রয়োগ’ করার বিষয়টি জরুরি। নির্বাচন কমিশন কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, আমরা তা কেউই চাই না। একটি অর্থবহ, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন প্রয়োজন। তা হলেই আমরা গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব। আর না হলে এ দেশে গণতন্ত্রের ‘মৃত্যু’ ঘটবে। নির্বাচন কমিশন যদি বিষয়টি উপলব্ধি করে, তাহলে তা আমাদের সবার জন্য মঙ্গল।
এ দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুইটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফটপাওয়ার’ হিসেবে এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই ‘অর্জন’ মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুইটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি নেই। কিন্তু সময় এসেছে এ ব্যাপারে কথা বলার এবং একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার। এ কারণেই ইসি সংলাপে বলা হয়েছেÑ এখনই সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হোক। মামলা-মোকদ্দমা থাকতেই পারে; এজন্য দেশে আইন আছে, আদালত আছে। আইন ও আদালতকে ‘ফেস’ করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা সবাই চাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। চাই একটি শক্তিশালী পার্লামেন্ট। আর এভাবেই গণতন্ত্রের ভিতকে আমরা আরও শক্তিশালী করতে পারব। না হলে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারব না আমরা। যে কথাগুলো সুধী সমাজ বলেছে, তার মাঝে কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ নেই বা কোনো রাজনৈতিক দলের মনোভাবও তাতে প্রতিফলিত হয়নি। তবে সুশীল সমাজ নয়, বরং সিদ্ধান্ত নেবে রাজনৈতিক দলগুলো। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে আদৌ সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কিনা, কিংবা ‘না’ ভোট কীভাবে পুনঃস্থাপিত হবে। আমরা চাই, এ ব্যাপারে একটা সমঝোতা হোক। কিন্তু আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি, যখন সিইসি বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলেন। তিনি যদি তার ‘মাইন্ড সেটআপ’ পরিবর্তন করতে না পারেন, তাহলে বড় দলগুলোর আস্থা তিনি পাবেন না। তাকে কথাবার্তায় সংযত হতে হবে এবং বড় দলগুলোকে আস্থায় নেয়ার লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে।
 Daily Alokito Bangladesh
27.08.2017

0 comments:

Post a Comment