রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সংলাপ, অনাস্থা ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে



  নির্বাচন কমিশনের দ্বিতীয় সংলাপ শুরু হচ্ছে চলতি আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। প্রথম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সুশীল সমাজের সাথে গত ৩১ জুলাই। দ্বিতীয় সংলাপে নির্বাচন কমিশন কথা বলবে গণমাধ্যম ব্যক্তিদের সাথে। পর্যায়ক্রমে কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, নির্বাচনি পর্যবেক্ষণ সংস্থা, নারী নেতৃবৃন্দ, সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সাথেও কথা বলবে। প্রতিটি সংলাপে তারা যেসব মতামত পাবেন, তা একত্রিত করে একটি সুপারিশমালা প্রণয়ন করবেন নভেম্বরে। নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য পরিষ্কারÑ তারা সকল শ্রেণির মানুষের মতামত নিয়ে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চান। নির্বাচন কমিশনের এই উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে ভাল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের বিভিন্ন মতামত থাকে। এসব মতামত দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা যাবে না। সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য যা প্রয়োজন, তা হচ্ছেÑ ১. সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা, ২. নির্বাচনে সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, ৩. নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার পূর্ণ প্রয়োগ, ৪. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক স্থাপন, ৫. নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য ইত্যাদি।
প্রথম সংলাপ এ কিছু মতামত পাওয়া গেছে। এ ধরনের মতামত আগামীতেও পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে মতের ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছেÑ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ এবং সেখানে একটি ঐকমত্যে উপনীত হওয়া। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ন্যূনতম ইস্যুতে ঐকমত্যে উপনীত হতে না পারে তাহলে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। নির্বাচন নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভাল নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। কিন্তু নির্বাচন হয়েছে। এটা একটা সাংবাবিধানিক বাধ্যবাধকতা। নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে আয়োজন করতে না পারলে, নানা জটিলতা তৈরি হতো। কিন্তু দুটি বড় দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই নির্বাচনকে নিয়ে খুব কি লাভবান হয়েছে? নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি যেমনি খুব একটা লাভবান হয়নি, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগও নির্বাচন আয়োজন করে খুব লাভবান হয়েছে, তা বলা যাবে না। তারা সরকারে আছে। কিন্তু দুটি বড় দলের মাঝে বড় অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। তাই প্রথম সংলাপে, যেখানে আমি নিজেও আমন্ত্রিত ছিলাম, সেখানে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে (সেনাবাহিনী মোতায়েন, না ভোট, আস্থার সম্পর্ক পুনঃস্থাপন), তা যুক্তিযুক্ত। সবাই এসব প্রশ্নে একমত হয়েছিলেন এবং সংলাপ শেষে সিইসি এটা স্বীকারও করেছেন। কিছু বিরোধিতা আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু তা সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো বড় প্রভাব ফেলেনি। দু’একজন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, যাদেরকে সমাজ আওয়ামী লীগ ঘরনার বলেই মনে করে, তারা সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রশ্নে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে এটা বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে, অন্যান্য ফোর্স, বিশেষ করে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে! কিন্তু এই মন্তব্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। প্রায় সবাই একবাক্যে ‘না ভোট’ পুনঃস্থাপন করার কথা বলেছেন, যা একসময় চালু হলেও, বর্তমানে তা নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তা বাতিল হয়। নির্বাচন কমিশনকে শক্ত অবস্থানে থাকার কথা বলা হয়েছে সংলাপ থেকে। আমি আমার নিজের বক্তব্যে এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি সংবিধানের ১১৮(৪) ও ১২৬নং অনুচ্ছেদের কথা। ১১৮(৪) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন’। আর ১২৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য’। এর অর্থ পরিষ্কার একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে এই দায়িত্বটি পালন করতে হবেÑ এটাই ছিল সবার অভিমত। সংলাপে এমন অভিমত দেওয়া হয়েছে যে, নির্বাচনপূর্ব তিনমাস তিনটি মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব (জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য) নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। তাহলে ওই সময় যে সরকার থাকবে, তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব খাটাতে পারবেন না। আর এভাবেই নির্বাচন কমিশন তার অবস্থান শক্তিশালী তথা সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবেন।
প্রথম সংলাপে অংশগ্রহণকারী প্রায় সবাই এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে, ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, যা নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ এর ব্যাপারে সিইসির ইতোপূর্বকার বক্তব্য সংলাপে সমালোচিত হয়েছে। সিইসি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে তার করার কিছু নেই’। এটা অনাকাক্সিক্ষত এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করার দায়িত্ব যে নির্বাচন কমিশনের এ কথাটাও তাকে সংলাপে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এর প্রতিউত্তরে সিইসি কিছুই বলেননি। কোনো যুক্তিই তিনি খন্ডন করেননি। তিনি প্রতিটি বক্তব্যের ‘নোট’ নিয়েছেন এবং কখনো কখনো এর ব্যাখ্যাও চেয়েছেন প্রশ্নকর্তার কাছ থেকে।
সংলাপ ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা হয়নি। কোনো ফর্মূলাও উত্থাপিত হয়নি। সম্ভবত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা প্রচলন ছিল যে নির্বাচনের আগে ‘সহায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হবে, কি হবে না, এটি দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নেই। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৬, ৫৫(২) ও ৫৬(৪) প্রয়োগ করে স্বয়ং নির্বাচন কমিশন ‘সহায়ক সরকারের’ ভূমিকা পালন করতে পারে এই অভিমত ছিল অংশগ্রহণকারী সবার। মোদ্দাকথা সংলাপে অংশ নেওয়া প্রায় সবার অভিমত হচ্ছেনির্বাচন কমিশন তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করুক। এ তিনটি মূল ইস্যুর বাইরে নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার না করা, প্রার্থীদের (সংসদ নির্বাচনে) সম্পদের পরিমাণ জানিয়ে দেওয়া, রিটার্নিং অফিসারদের ভূমিকা, নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ, প্রবাসীদের ভোটাধিকার, দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, ইত্যাদি মতামত দেওয়া হয়। এর বাইরে আমার আরও অভিমত ছিল নিম্নরূপ;
আচরণ বিধিমালায় (সেপ্টেম্বর ২০০৮) সংশোধন এবং পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য না দেওয়ার বিধি অন্তর্ভুক্ত, স্থানীয় পর্যায়ে বিশিষ্ট ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ‘পর্যবেক্ষক টিম’ গঠন, যারা মনিটরিং করবে এবং সরাসরি ইসিকে রিপোর্ট করবে, স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান চালু করা। প্রার্থী অনলাইনেও মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীদের যদি সমানসংখ্যক ভোট পান, তাহলে লটারি না করে পুনরায় ভোট গ্রহণ। শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ভোট না পেলে মূল দুই প্রার্থীর মধ্যে পুনরায় ভোটগ্রহণ, এবং সংসদ সদস্যদের যোগ্যতা গ্রাজুয়েশন নির্ধারণ করা। তবে দেখতে হবে তা, যেন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। সিভিল, মিলিটারি ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন সদস্যদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অবসরের পর ৫ বছর নির্ধারণ করা এবং একই সাথে দলের স্থানীয় পর্যায় থেকে তা অনুমোদিত হওয়া। হলফনামায় দেখা তথ্য যাচাই-বাছাই করা এবং ভুয়া তথ্যের কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিধান সুস্পষ্ট করা (নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের বিষয়টি আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে পারি)। দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রার্থী পদে বিধিনিষেধ আরোপ, এবং মনোনয়ন প্রার্থীদের সবার টিআইএন নাম্বার সংযুক্ত বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি। নির্বাচন বিধিমালায় এভাবে সংস্কার আনা যায়।
সংলাপ-এর পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এসব প্রস্তাবলির কতটুকু ইসি গ্রহণ করবে এবং নভেম্বরে যে খসড়া সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হবে তাতে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে। সিইসি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন এবং আমি তার উপর আস্থাটি রাখতে চাই। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায় সরকার এর কতটুকু গ্রহণ করবে? আর সরকার যদি ইসির সুপারিশ গ্রহণ না করে, তাহলে ইসিরও বা কি করণীয় আছে? আসল কথা এটাই। সরকার সুপারিশমালা গ্রহণ না করলেও ইসি সাংবিধানিকভাবে ‘অনেক কিছু’ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় ইসি কিছুই করে না, করতে পারে না। এটাই হচ্ছে সত্য কথা। আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। নির্বাচন কমিশন যে আস্থাহীনতায় ভুগছিল, তা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে মনে হয় না। সংলাপ-এর আগের দিন পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। এখন ইসির অনেকগুলোর কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে বিএনপিকে আস্থায় নেওয়া এবং ‘সকলের জন্য সমান সুযোগ’ সৃষ্টি করা। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ যদি এক ধরনের নির্বাচনি প্রচারণা অব্যাহত রাখেন, অন্যদিকে বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবেই। আর এজন্য ইসি অভিযুক্ত হবে বৈকি! ইসি সাংবিধানিকভাবে অনেক শক্তিশালী। আমরা চাই ইসি তার সেই ‘ক্ষমতা’ প্রয়োগ করুক। এক্ষেত্রে ইসির ব্যর্থতা আমাদেরকে একটি গভীর সংকটে ফেলে দিতে পারে।
Daily Amadersomoy.com
07.08.2017

0 comments:

Post a Comment