বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত একটি গুরুত্বপূর্ণ
কথা বলেছেন গত ২১ আগস্ট। তিনি কথাটি বলেছেন এমন এক সময়, যখন নির্বাচন কমিশন
একাদশ জতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সুশীল সমাজ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও
ইলেকট্রুনিক মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এবং সাংবাদিকদের
কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তার কথাবার্তায় নতুন করে একটা
‘শঙ্কা’ তৈরি হয়েছে আগামী নির্বাচনটি কেমন হবে, সে ব্যাপারে। ইইউ
রাষ্ট্রদূত ও সিইসির বক্তব্যের মাঝে একটি যোগসূত্র আছে- আর সেই যোগসূত্রটি
হচ্ছে ‘সকল দলের অংশগ্রহণমূলক’ একটি নির্বাচন। ইইউ রাষ্ট্রদূত আশাবাদী
আগামীতে একটি ‘স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক’ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
গণতন্ত্রের স্বার্থে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সে রকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এ নিয়ে গত সাড়ে তিন বছরে অনেক ‘ঘটনা’
ঘটেছে। নিরীহ অনেক মানুষ মারা গেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। এমনকি ষোড়শ সংশোধনী
বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে যেসব মন্তব্য করেছেন, তাও
রাজনীতিতে বড় ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি করেছে। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে বর্তমান
সংসদ নিয়েও কথাবার্তা আছে।
ইইউ’র রাষ্ট্রদূত যে কথা বলেছেন, তা নতুন নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ কথাটা
বলা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণেই যে বিএনপি নীতিগতভাবে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত
নিয়েছে তারা একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে তাদের একটা ‘শর্ত’ আছে।
‘শর্তটি’ হচ্ছে নির্বাচনকালীন একটি সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে
তারা কোনো নির্বাচনে যেতে চাচ্ছেন না। রাষ্ট্রদূত তাই সাংবাদিকদের স্মরণ
করিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে সবার মধ্যে একটা আগ্রহ দেখেছেন।
তবে এ কথাটাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি, গত জাতীয় নির্বাচন (দশম
জাতীয় সংসদ, ২০১৪) অনেককেই হতাশ করেছিল। এটি এখন অতীত এবং এ থেকে শিক্ষা
হয়েছে। কিন্তু সিইসির কিছু বক্তব্য আমাদের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। ইইউ’র
বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের মাত্র কয়েকদিন আগে ১৭ আগস্ট সিইসি বলেছেন,
‘নির্বাচন কমিশন কোনো ধরনের মধ্যস্থতা করবে না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘কারও
চাওয়া বা না চাওয়ার ওপর সেনা মোতায়েনের বিষয় নির্ভর করে না।’ তার আরও একটি
বক্তব্য নিয়েও গুঞ্জন আছে। তিনি বলেছেন, ‘সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি সেট করে
দেয়, সেই নিয়মেই আমাদের নির্বাচন করতে হয়।’ সিইসি তত্ত্বাবধায়ক
সরকারবিরোধীও বক্তব্য রাখেন। ফলে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কিনা, এটা
নিয়ে একটা শঙ্কা থাকলই। নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের প্রত্যাশা বেশি।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি সরকারের সহযোগিতা পাবে? সরকারি কর্মকর্তারা
নির্বাচনপূর্ব তিন মাস সময়ে নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন থাকে। এটাই
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা (সংবিধানের ধারা ১২৬)। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা
দেখি ভিন্ন চিত্র। জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা ইসি নয়,
বরং মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রিত হন। তারা সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে
যেতে পারেন না। অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির
নির্বাচনের কথা না হয় নাই বললাম। উপজেলা নির্বাচনে কী হয়েছিল? মিডিয়ার
বদৌলতে আমরা দেখেছি ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা হচ্ছে, পুকুরে
ব্যালট পেপার ভাসছে কিংবা তারও আগে প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি।
তাকে ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইত্যাদি। ওই সময় তো ‘শান্তি-শৃঙ্খলা’
রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল। তারা কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে
পেরেছিল? ডিসি সাহেবরা ছিলেন। কিন্তু তাদের ভূমিকা কী ছিল? সুতরাং সেনা
মোতায়েনের প্রশ্নটা বিবেচনায় নেয়া জরুরি। ইসি এককভাবে এটা পারে না। সরকারের
সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার। এ সহযোগিতা ইসি সব সময় পেয়েছে, তা বলা যাবে না।
তাই সুধী সমাজের এবং সাংবাদিকদের অনেক প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কাগজ-কলমেই
থেকে যেতে পারে।
এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসিকে একটা ‘সমঝোতায়’ যেতে হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসির ৭ দফাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বড় আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। মূল আলোচনা হতে হবে বিএনপির সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। যদিও এটা সত্য, ‘সহায়ক সরকার’-এর যে কথা বিএনপি বলে আসছে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন নয়। তবে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। এটা কঠিন কিছু নয়। সিইসির আর জীবনে পাওয়ার কিছু নেই। পূর্ণ সচিব না হয়েও কিংবা সচিব হিসেবে সচিবালয়ে কাজ না করেও তিনি সিইসি হয়েছেন। থাকবেন ৫ বছর। এরপর তো তার আর পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু জাতি তাকে মনে রাখবে যদি তিনি দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন। একমাত্র তার আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যদি আদৌ কোনো উদ্যোগ না নেন, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? সব সময় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সাংবিধানিকভাবে সরকারের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সরকারি দলের জন্য এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। তারপরও ‘যে কোনো ফর্মুলায়’ বিএনপিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে আনতে হবে। ইতিমধ্যে আদালতের অনুমতি না নিয়ে বেগম জিয়া দেশ ছেড়েছেন বলে দুদক আদালতের কাছে আর্জি জানিয়েছে। বেগম জিয়ার লন্ডন গমন নিয়ে মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই মঙ্গল। আমরা চাই আস্থার সম্পর্ক। এ আস্থার সম্পর্কই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। ৭ দফা ‘রোডম্যাপ’ কিংবা রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে, তা নিশ্চিত করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর আমরা পার করেছি।
আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফটপাওয়ার’ হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই ‘অর্জন’ মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এ ‘আস্থার সম্পর্ক’ শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি নেই। কিন্তু সময় এসেছে এ ব্যাপারে কথা বলার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার। উচ্চ আদালতের একটি রায় নিয়ে (ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে) একের পর এক যেসব ‘ঘটনা’ ঘটে চলেছে, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং গণতন্ত্রের জন্য হুমকিও বটে। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবি, তার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা কিংবা তিনি যখন অবসরে যাবেন (জানুয়ারি ২০১৮) তখন তার কী হবে, এ ধরনের কথাবার্তা বলে আমরা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি শুধু নষ্টই করছি না, বরং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণারও জন্ম দিচ্ছি। দুর্ভাগ্য এখানেই যে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায় ও প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে স্পষ্টতই জাতি বিভক্ত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ যেখানে রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তাদের ঘোরতর আপত্তির কথা জানাচ্ছে, সেখানে বিএনপি অনেকটাই উৎফুল্লিত। বিএনপি যেখানে বলছে পর্যবেক্ষণ নিয়ে মন্তব্যকারী মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ‘হাইকোর্ট অবমাননা মামলা’ দায়ের করতে, সেখানে প্রধান বিচারপতি নিজে বলেছেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক ট্রাপে জড়াবেন না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ দুটি বড় দলের ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও এক পক্ষ অন্য পক্ষকে সহ্য না করার যে মানসিকতা- উচ্চ আদালতের সর্বশেষ রায়ের পর্যবেক্ষণেও তার প্রতিফলন ঘটল। বিদায়ী ইইউ রাষ্ট্রদূত যখন আবারও ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ প্রত্যাশা করেন এবং সিইসি যখন বলেন, দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করা তার কাজ নয়, তখন সত্যিকার অর্থেই তা আমাদের হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কি আদৌ হবে? বিএনপি কি আদৌ নির্বাচনে অংশ নেবে? যদি না নেয়, তাহলে কি আমরা আবারও ২০১৪ সালের জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি? এসব প্রশ্ন আমাদের ভাবায়। আমাদের শঙ্কিত করে। আমাদের আশা ভঙ্গ হয়। এ ‘পথ’ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনীতিবিদদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা তারাই দেশ চালান ‘জনগণের প্রতিনিধি’ হয়ে। এ ক্ষেত্রে সিইসি তার ‘করার কিছু নেই’ বলে যখন মন্তব্য করেন, তখন আমাদের বলতেই হয় তিনি তার ‘পদের’ প্রতি সুষ্ঠু বিচার করছেন না। ‘সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি সেট করে দেয়, সেই নিয়মেই আমাদের নির্বাচন করতে হয়’- এ কথা বলে তিনি কার্যত সাংবিধানিকভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন। এটা খারাপ নজির। প্রধান বিরোধী দল তার এ বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে! এখনও অনেক সময় বাকি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সময় তিনি তাদের সংযত আচরণ করতে বলুন, বিএনপিসহ সব দলকে সভা-সমাবেশ করার ব্যবস্থা করুন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিন। সিইসি এ কাজগুলো যদি করেন, তাহলে ইইউর বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে। একটা ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ আমরা পেতে পারি। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এটাই। প্রধানমন্ত্রী এমনটি চান বলেও আমার ধারণা।
এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসিকে একটা ‘সমঝোতায়’ যেতে হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসির ৭ দফাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বড় আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। মূল আলোচনা হতে হবে বিএনপির সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। যদিও এটা সত্য, ‘সহায়ক সরকার’-এর যে কথা বিএনপি বলে আসছে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন নয়। তবে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। এটা কঠিন কিছু নয়। সিইসির আর জীবনে পাওয়ার কিছু নেই। পূর্ণ সচিব না হয়েও কিংবা সচিব হিসেবে সচিবালয়ে কাজ না করেও তিনি সিইসি হয়েছেন। থাকবেন ৫ বছর। এরপর তো তার আর পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু জাতি তাকে মনে রাখবে যদি তিনি দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন। একমাত্র তার আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যদি আদৌ কোনো উদ্যোগ না নেন, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? সব সময় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সাংবিধানিকভাবে সরকারের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সরকারি দলের জন্য এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। তারপরও ‘যে কোনো ফর্মুলায়’ বিএনপিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে আনতে হবে। ইতিমধ্যে আদালতের অনুমতি না নিয়ে বেগম জিয়া দেশ ছেড়েছেন বলে দুদক আদালতের কাছে আর্জি জানিয়েছে। বেগম জিয়ার লন্ডন গমন নিয়ে মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই মঙ্গল। আমরা চাই আস্থার সম্পর্ক। এ আস্থার সম্পর্কই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। ৭ দফা ‘রোডম্যাপ’ কিংবা রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে, তা নিশ্চিত করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর আমরা পার করেছি।
আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফটপাওয়ার’ হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই ‘অর্জন’ মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এ ‘আস্থার সম্পর্ক’ শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি নেই। কিন্তু সময় এসেছে এ ব্যাপারে কথা বলার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার। উচ্চ আদালতের একটি রায় নিয়ে (ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে) একের পর এক যেসব ‘ঘটনা’ ঘটে চলেছে, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং গণতন্ত্রের জন্য হুমকিও বটে। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবি, তার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা কিংবা তিনি যখন অবসরে যাবেন (জানুয়ারি ২০১৮) তখন তার কী হবে, এ ধরনের কথাবার্তা বলে আমরা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি শুধু নষ্টই করছি না, বরং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণারও জন্ম দিচ্ছি। দুর্ভাগ্য এখানেই যে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায় ও প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে স্পষ্টতই জাতি বিভক্ত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ যেখানে রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তাদের ঘোরতর আপত্তির কথা জানাচ্ছে, সেখানে বিএনপি অনেকটাই উৎফুল্লিত। বিএনপি যেখানে বলছে পর্যবেক্ষণ নিয়ে মন্তব্যকারী মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ‘হাইকোর্ট অবমাননা মামলা’ দায়ের করতে, সেখানে প্রধান বিচারপতি নিজে বলেছেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক ট্রাপে জড়াবেন না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ দুটি বড় দলের ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও এক পক্ষ অন্য পক্ষকে সহ্য না করার যে মানসিকতা- উচ্চ আদালতের সর্বশেষ রায়ের পর্যবেক্ষণেও তার প্রতিফলন ঘটল। বিদায়ী ইইউ রাষ্ট্রদূত যখন আবারও ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ প্রত্যাশা করেন এবং সিইসি যখন বলেন, দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করা তার কাজ নয়, তখন সত্যিকার অর্থেই তা আমাদের হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কি আদৌ হবে? বিএনপি কি আদৌ নির্বাচনে অংশ নেবে? যদি না নেয়, তাহলে কি আমরা আবারও ২০১৪ সালের জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি? এসব প্রশ্ন আমাদের ভাবায়। আমাদের শঙ্কিত করে। আমাদের আশা ভঙ্গ হয়। এ ‘পথ’ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনীতিবিদদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা তারাই দেশ চালান ‘জনগণের প্রতিনিধি’ হয়ে। এ ক্ষেত্রে সিইসি তার ‘করার কিছু নেই’ বলে যখন মন্তব্য করেন, তখন আমাদের বলতেই হয় তিনি তার ‘পদের’ প্রতি সুষ্ঠু বিচার করছেন না। ‘সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি সেট করে দেয়, সেই নিয়মেই আমাদের নির্বাচন করতে হয়’- এ কথা বলে তিনি কার্যত সাংবিধানিকভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন। এটা খারাপ নজির। প্রধান বিরোধী দল তার এ বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে! এখনও অনেক সময় বাকি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সময় তিনি তাদের সংযত আচরণ করতে বলুন, বিএনপিসহ সব দলকে সভা-সমাবেশ করার ব্যবস্থা করুন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিন। সিইসি এ কাজগুলো যদি করেন, তাহলে ইইউর বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে। একটা ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ আমরা পেতে পারি। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এটাই। প্রধানমন্ত্রী এমনটি চান বলেও আমার ধারণা।
Daily Jugantor
27.08.2017
0 comments:
Post a Comment