নির্বাচন
কমিশনার দেশের সুশীল সমাজের সঙ্গে তাদের প্রথম সংলাপ শেষ করেছে। আগামী
নভেম্বর পর্যন্ত তারা পর্যায়ক্রমে সাংবাদিক সমাজ, নির্বাচন পর্যবেক্ষক
সংস্থার প্রতিনিধি, নারী প্রতিনিধি এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গেও
সংলাপ করবেন। এর মধ্যে দিয়ে নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের
একটি প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা
করেন_ তা হচ্ছে এর মধ্যে দিয়ে নির্বাচন কমিশন কী সবার পূর্ণ আস্থা অর্জন
করতে পেরেছে? নির্বাচন কমিশন, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি)
নিয়ে একটা 'বিতর্ক' ছিল। বিএনপি তার নিয়োগের বিরোধিতা করে আসছিল। এখন
প্রথম 'সংলাপ' শেষ হবার পর তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠবে নির্বাচন কমিশন তার
আস্থার জায়গাটা ফিরে পাবে কি-না? সংলাপে অনেক অভিমত দেয়া হয়েছে। যা একটা
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের মাঝে
একটা ঐকমত্যও আমরা লক্ষ্য করেছি। সুতরাং প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, নির্বাচন
কমিশন এমন প্রস্তাব বাস্তবায়নে কতটুকু আন্তরিক হবে। সংলাপে বেশ কিছু অভিমত
দেয়া হয়েছে। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে 'না' ভোটের ব্যবস্থা
পুনঃপ্রবর্তন করা। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা। নির্বাচন কমিশনকে
সরকারের প্রভাব বলয়ের বাইরে গিয়ে তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করা, সবার
জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, অবৈধ আয়, ও প্রার্থীদের হলফনামা যাচাই বাছাই
করা, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণে সুযোগ করে দেয়া, দ্বৈত
নাগরিক, যারা নির্বাচনে প্রার্থী হবেন, তাদের ব্যাপারে বিধি নিষেধ আরোপ
ইত্যাদি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এগুলোই আমার কাছে বেশি
গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। সবার জন্য সমান সুযোগ এর বিষয়টি বেশি গুরুত্ব
পেয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সিইসির বক্তব্য সমালোচিত হয়েছে বেশি। তিনি কদিন
আগে বলে ছিলেন তফসিল ঘোষণার আগে এ ব্যাপারে তার করণীয় কিছু নেই। তখন এইচএম
এরশাদ নয়া দিলি্ল থেকে ফিরে এলে, দল তাকে গণসংবর্ধনা দেয়, আর পুলিশ তাতে
অনুমতি দেয়। কিন্তু বিএনপি সভা-সমাবেশ করতে চাইলে তাতে বাধা দেয় এতে করে তো
লেভেল প্লেইং ফিল্ড হবে না।
সবার জন্য সমান সুযোগ থাকা উচিত। বিএনপি যদি বেগম জিয়াকে দেশে আসার পর গণসংবর্ধনা দিতে চায় সরকার কী তার অনুমতি দেবে? এটা সত্য ইসির এ ক্ষেত্রে করার কিছু নেই। এটা সরকারও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। তবে ইসি বলতে পারে তফসিল ঘোষণার আগে কোনো বড় সমাবেশ নয় এবং কোনো নির্বাচনী জনসভা নয়।
দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আস্থার সম্পর্ক। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেই। আমরা খুব অতীতমুখী। অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি বেশি। দোষারোপের রাজনীতির বিত্ত থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এখনই একটি উদ্যোগ নিতে পারে। এমন একটি মেকানিজম ইসি বের করতে পারে, যেখানে দলগুলো এখন থেকে বিদ্বেষমূলক কোনো কথাবার্তা বলবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে সিইসি বিষয়টি উত্থাপন করতে পারেন। এতে কতটুকু ফল তিনি পাবেন তা আমি নিশ্চিত নই। তবে এ ধরনের একটি উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন।
বলা ভালো ইসির ৭ দফায় এ সংক্রান্ত কিছু নেই। নির্বাচনে সিল মারা সংস্কৃতি, ভোটকেন্দ্র দখলের সংস্কৃতি, কিংবা বিরোধী দলের প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না দেয়া_ এই যে প্রবণতা বিগত দশম সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন কিংবা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমরা দেখেছি, এই প্রবণতা সুষ্ঠু নির্বচনের পথে অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে ইসির করণীয় আছে। ইসি এ ক্ষেত্রে বেশ কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। যেমন ১. স্থানীয়ভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি একটি পর্যবেক্ষক টিম গঠন করতে পারে। যাদের কাজ হবে নির্বাচন কেন্দ্রগুলো মনিটর করা এবং সরাসরি কেন্দ্রে রিপোর্ট করা, ২, মিডিয়ার মাধ্যমে যেখান থেকেই জাল ভোট, ভোটকেন্দ্র দখলের খবর আসবে, সেখানে ওই কেন্দ্র নয়, বরং পুরো নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন স্থগিত যোষণা করা, ৩. মনোয়নপত্র একই সঙ্গে স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ে গ্রহণ করা। এতে করে প্রার্থীর পক্ষে একাধিক জায়গায় মনোনয়পত্র জমা দেয়া যাবে। মনোনয়পত্র জমা দিতে বাধা দেয়ার খবর এলে ওই এলাকার নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করতে হবে, ৪. গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সশস্ত্র বাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। ৫. সংসদ নির্বাচনে ভোট গণনায় যদি প্রার্থীরা সমানসংখ্যক ভোট পান, তাহলে লটারির পরিবর্তে সেখানে পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে, এবং কোনো প্রার্থী যদি শতকরা ৫০ ভাগের নিচে ভোট পেয়ে বিজয়ী হন, তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা যাবে না। সেখানেও পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের নিয়ম আছে। ৬. সংসদ সদস্যের যোগ্যতার প্রশ্নে নূ্যনতম যোগ্যতা যুগোপযোগী হওয়া উচিত। দেশে উচ্চ শিক্ষার হার বেড়েছে। যারা দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন, তারা যদি শিক্ষিত না হন, তাহলে সঠিক ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করবেন কীভাবে? এতে করে সংসদ সদস্যরা বেশি মাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে যাবেন। আমলারা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন। বর্তমান আইনে সুুবিধাবাধী ও ধান্দাবাজ ঊর্ধ্বতন আমলা, সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা অবসরের তিন বছর পর নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। এটা একটা দুর্বল আইন। এটা পরিবর্তন করে নূ্যনতম ৫ বছর করা প্রয়োজন। অর্থাৎ একজন আমলা ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যাবেন। এবং ৬৫ বছর বয়সে তিনি সংসদ নির্বাচন প্রার্থী হতে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে শর্ত থাকলে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ওই সংসদীয় এলাকায় দল তাঁকে মনোনয়ন দেবে। এটা না হলে দেখা যাবে সুযোগ সন্ধানী আমলারা সচিবালয়ে থাকাকালে মন্ত্রণালয়ের প্রভাব খাটিয়ে তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা-ে অংশ নিচ্ছেন। এতে করে পরোক্ষভাবে তিনি সরকারকে ব্যবহার করছেন। পাঁচ বছরের একটি গ্যাপ থাকলে এই কাজটি করতে তিনি অপারগ হবেন। সংলাপেও এসব প্রশ্নই উঠেছে।
এখন সময় এসেছে নির্বাচন কমিশনকে এটা প্রমাণ করতে যে তারা সত্যি সত্যিই 'স্বাধীন'। বেশ ক'জন প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার, একাধিক নির্বাচন পর্যবেক্ষব এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে, নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে। না হলে যে, 'বিতর্ক' নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার যাত্রা শুরু করেছিল, সেই 'বিতর্ক' আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী গত ২৬ জুলাই ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। আমাদের সংবিধানের ১১৮ (৪) ধারায়ও বলা আছে স্পষ্ট করে 'নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন' এবং সংবিধানের ১২৬ এ বলা আছে 'নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে'। এটাই হচ্ছে আসল কথা। নির্বাচনের তিন মাস আগে সমস্ত প্রশাসন চলে যায় নির্বাচন কমিশনদের হাতে। অর্থাৎ ডিসি, এসপি, ওসিরা থাকেন নির্বাচন কমিশনের আওতায়। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তা কী বলে? জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা থাকেন জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন নয়। ফলে যা হবার তাই হয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে, আর জেলা প্রশাসকরা 'নিয়ন্ত্রিত' হন মন্ত্রণালয় থেকে। এ ক্ষেত্রে প্রায় ক্ষেত্রেই সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রতিফলিত হয়।
আমরা চাই 'সকল দলের অংশগ্রহণ' নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তাই সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায় দায়িত্বটি অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয়। এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সেই 'দায়িত্ব' সিইসি কীভাবে পালন করেন, তার অপেক্ষায় লাকসাম। তবে একটা বিষয়ে বোধহয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন-আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহুমন্ত্রী বার বার বলছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যে সরকার থাকবে তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকার প্রধান থাকলে, সেই সরকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিএনপি সেই প্রশ্নটিই তুলেছে। এটা ঠিক ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারের অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ওই সরকারের যোগ দেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কী বিএনপিকে সে রকম একটি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ২০১৪ সালে বিএনপি পার্লামেন্টে ছিল। কিন্তু এখন তো তারা পার্লামেন্টে নেই। তাহলে মন্ত্রিসভায় বিএনপি অন্তর্ভুক্ত হবে কীভাবে? বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিএনপি একটি ফ্যাক্টর। বিএনপিকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। বিএনপি বড় দল। জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এ দলটির প্রতি। বিগত নির্বাচনগুলোর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা দেখব শতকরা ৩২ থেকে ৩৬ ভাগ জনগণের সমর্থন রয়েছে এই দলটির প্রতি। সুতরাং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দলটিকে নিয়ে আসতে হবে। এতে করে একদিকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা যেমনি বাড়বে, তেমনি ক্ষমতাসীন দলও উপকৃত হবে। গণতন্ত্রের জন্য, দুটি বড় দলের মাঝে (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) 'অস্থার সম্পর্ক' থাকা দরকার। না হলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকেই এ কথাটা বুঝতে চান না। তারা মনে করেন বিএনপিকে বাদ দিয়েই তারা আবারও নির্বাচনে যাবেন। ২০১৪ সালে নির্বাচন হয়েছিল। এতে করে সরকার কী খুব লাভবান হয়েছে? ইসি রোডম্যাপ দিয়েছে। অতীতেও ইসি এমনটি দিয়েছে। বর্তমান কমিশনও দিয়েছে। সংলাপ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে। সেটা এখন আবার শুরু হলো। কিন্তু সংলাপ করে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ জন্য চাই আন্তরিকতা। চাই সদিচ্ছা। যদি সব দলের অংশগ্রহণ আমরা নিশ্চিত করতে চাই। তাহলে সরকারের সদিচ্ছাটাই হলো আসল। সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে তেমন কিছু কথা বলা হয়নি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় এই বিষয়টি আসবে।
ইসি সংলাপ করেছে। বেশ কিছু মতামত পেয়েছে। এখন ইসির দায়িত্ব এই মতামতগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া। কোন একটি মতামতও যদি ইসি বাস্তবায়ন করতে না পারে, তাহলে ইসি শেষ পর্যন্ত একটি 'কাগুজে সংগঠন' হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। বর্তমান সিইসির জন্য তা মঙ্গলজনক নয়। তার যাত্রাটা ভালো হয়নি। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে! এখন দেখার পালা তিনি কীভাবে নির্বাচন কমিশনকে পরিচালনা করেন? শুধু সংলাপ করে, মিডিয়ায় বক্তব্য রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি যে 'সিরিয়াস', এটা তাকে প্রমাণ করতে হবে। আমরা তাকিয়ে থাকলাম তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ওপর। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমরা সবাই চাই। এ ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকা বড়। তার ক্ষমতা আছে। তাকে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। সবার আস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সুশীল সমাজের আস্থা অর্জন করলেই চলবে না। বরং রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপির আস্থা অর্জন করতে হবে। এটা করতে নির্বাচন কমিশন যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থই বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কৃতি নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু থাকবে না।Daily Jai Jai Din05.08.2017
সবার জন্য সমান সুযোগ থাকা উচিত। বিএনপি যদি বেগম জিয়াকে দেশে আসার পর গণসংবর্ধনা দিতে চায় সরকার কী তার অনুমতি দেবে? এটা সত্য ইসির এ ক্ষেত্রে করার কিছু নেই। এটা সরকারও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। তবে ইসি বলতে পারে তফসিল ঘোষণার আগে কোনো বড় সমাবেশ নয় এবং কোনো নির্বাচনী জনসভা নয়।
দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আস্থার সম্পর্ক। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেই। আমরা খুব অতীতমুখী। অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি বেশি। দোষারোপের রাজনীতির বিত্ত থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এখনই একটি উদ্যোগ নিতে পারে। এমন একটি মেকানিজম ইসি বের করতে পারে, যেখানে দলগুলো এখন থেকে বিদ্বেষমূলক কোনো কথাবার্তা বলবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে সিইসি বিষয়টি উত্থাপন করতে পারেন। এতে কতটুকু ফল তিনি পাবেন তা আমি নিশ্চিত নই। তবে এ ধরনের একটি উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন।
বলা ভালো ইসির ৭ দফায় এ সংক্রান্ত কিছু নেই। নির্বাচনে সিল মারা সংস্কৃতি, ভোটকেন্দ্র দখলের সংস্কৃতি, কিংবা বিরোধী দলের প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না দেয়া_ এই যে প্রবণতা বিগত দশম সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন কিংবা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমরা দেখেছি, এই প্রবণতা সুষ্ঠু নির্বচনের পথে অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে ইসির করণীয় আছে। ইসি এ ক্ষেত্রে বেশ কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। যেমন ১. স্থানীয়ভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি একটি পর্যবেক্ষক টিম গঠন করতে পারে। যাদের কাজ হবে নির্বাচন কেন্দ্রগুলো মনিটর করা এবং সরাসরি কেন্দ্রে রিপোর্ট করা, ২, মিডিয়ার মাধ্যমে যেখান থেকেই জাল ভোট, ভোটকেন্দ্র দখলের খবর আসবে, সেখানে ওই কেন্দ্র নয়, বরং পুরো নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন স্থগিত যোষণা করা, ৩. মনোয়নপত্র একই সঙ্গে স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ে গ্রহণ করা। এতে করে প্রার্থীর পক্ষে একাধিক জায়গায় মনোনয়পত্র জমা দেয়া যাবে। মনোনয়পত্র জমা দিতে বাধা দেয়ার খবর এলে ওই এলাকার নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করতে হবে, ৪. গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সশস্ত্র বাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। ৫. সংসদ নির্বাচনে ভোট গণনায় যদি প্রার্থীরা সমানসংখ্যক ভোট পান, তাহলে লটারির পরিবর্তে সেখানে পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে, এবং কোনো প্রার্থী যদি শতকরা ৫০ ভাগের নিচে ভোট পেয়ে বিজয়ী হন, তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা যাবে না। সেখানেও পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের নিয়ম আছে। ৬. সংসদ সদস্যের যোগ্যতার প্রশ্নে নূ্যনতম যোগ্যতা যুগোপযোগী হওয়া উচিত। দেশে উচ্চ শিক্ষার হার বেড়েছে। যারা দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন, তারা যদি শিক্ষিত না হন, তাহলে সঠিক ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করবেন কীভাবে? এতে করে সংসদ সদস্যরা বেশি মাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে যাবেন। আমলারা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন। বর্তমান আইনে সুুবিধাবাধী ও ধান্দাবাজ ঊর্ধ্বতন আমলা, সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা অবসরের তিন বছর পর নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। এটা একটা দুর্বল আইন। এটা পরিবর্তন করে নূ্যনতম ৫ বছর করা প্রয়োজন। অর্থাৎ একজন আমলা ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যাবেন। এবং ৬৫ বছর বয়সে তিনি সংসদ নির্বাচন প্রার্থী হতে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে শর্ত থাকলে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ওই সংসদীয় এলাকায় দল তাঁকে মনোনয়ন দেবে। এটা না হলে দেখা যাবে সুযোগ সন্ধানী আমলারা সচিবালয়ে থাকাকালে মন্ত্রণালয়ের প্রভাব খাটিয়ে তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা-ে অংশ নিচ্ছেন। এতে করে পরোক্ষভাবে তিনি সরকারকে ব্যবহার করছেন। পাঁচ বছরের একটি গ্যাপ থাকলে এই কাজটি করতে তিনি অপারগ হবেন। সংলাপেও এসব প্রশ্নই উঠেছে।
এখন সময় এসেছে নির্বাচন কমিশনকে এটা প্রমাণ করতে যে তারা সত্যি সত্যিই 'স্বাধীন'। বেশ ক'জন প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার, একাধিক নির্বাচন পর্যবেক্ষব এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে, নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে। না হলে যে, 'বিতর্ক' নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার যাত্রা শুরু করেছিল, সেই 'বিতর্ক' আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী গত ২৬ জুলাই ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। আমাদের সংবিধানের ১১৮ (৪) ধারায়ও বলা আছে স্পষ্ট করে 'নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন' এবং সংবিধানের ১২৬ এ বলা আছে 'নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে'। এটাই হচ্ছে আসল কথা। নির্বাচনের তিন মাস আগে সমস্ত প্রশাসন চলে যায় নির্বাচন কমিশনদের হাতে। অর্থাৎ ডিসি, এসপি, ওসিরা থাকেন নির্বাচন কমিশনের আওতায়। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তা কী বলে? জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা থাকেন জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন নয়। ফলে যা হবার তাই হয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে, আর জেলা প্রশাসকরা 'নিয়ন্ত্রিত' হন মন্ত্রণালয় থেকে। এ ক্ষেত্রে প্রায় ক্ষেত্রেই সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রতিফলিত হয়।
আমরা চাই 'সকল দলের অংশগ্রহণ' নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তাই সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায় দায়িত্বটি অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয়। এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সেই 'দায়িত্ব' সিইসি কীভাবে পালন করেন, তার অপেক্ষায় লাকসাম। তবে একটা বিষয়ে বোধহয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন-আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহুমন্ত্রী বার বার বলছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যে সরকার থাকবে তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকার প্রধান থাকলে, সেই সরকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিএনপি সেই প্রশ্নটিই তুলেছে। এটা ঠিক ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারের অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ওই সরকারের যোগ দেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কী বিএনপিকে সে রকম একটি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ২০১৪ সালে বিএনপি পার্লামেন্টে ছিল। কিন্তু এখন তো তারা পার্লামেন্টে নেই। তাহলে মন্ত্রিসভায় বিএনপি অন্তর্ভুক্ত হবে কীভাবে? বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিএনপি একটি ফ্যাক্টর। বিএনপিকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। বিএনপি বড় দল। জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এ দলটির প্রতি। বিগত নির্বাচনগুলোর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা দেখব শতকরা ৩২ থেকে ৩৬ ভাগ জনগণের সমর্থন রয়েছে এই দলটির প্রতি। সুতরাং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দলটিকে নিয়ে আসতে হবে। এতে করে একদিকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা যেমনি বাড়বে, তেমনি ক্ষমতাসীন দলও উপকৃত হবে। গণতন্ত্রের জন্য, দুটি বড় দলের মাঝে (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) 'অস্থার সম্পর্ক' থাকা দরকার। না হলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকেই এ কথাটা বুঝতে চান না। তারা মনে করেন বিএনপিকে বাদ দিয়েই তারা আবারও নির্বাচনে যাবেন। ২০১৪ সালে নির্বাচন হয়েছিল। এতে করে সরকার কী খুব লাভবান হয়েছে? ইসি রোডম্যাপ দিয়েছে। অতীতেও ইসি এমনটি দিয়েছে। বর্তমান কমিশনও দিয়েছে। সংলাপ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে। সেটা এখন আবার শুরু হলো। কিন্তু সংলাপ করে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ জন্য চাই আন্তরিকতা। চাই সদিচ্ছা। যদি সব দলের অংশগ্রহণ আমরা নিশ্চিত করতে চাই। তাহলে সরকারের সদিচ্ছাটাই হলো আসল। সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে তেমন কিছু কথা বলা হয়নি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় এই বিষয়টি আসবে।
ইসি সংলাপ করেছে। বেশ কিছু মতামত পেয়েছে। এখন ইসির দায়িত্ব এই মতামতগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া। কোন একটি মতামতও যদি ইসি বাস্তবায়ন করতে না পারে, তাহলে ইসি শেষ পর্যন্ত একটি 'কাগুজে সংগঠন' হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। বর্তমান সিইসির জন্য তা মঙ্গলজনক নয়। তার যাত্রাটা ভালো হয়নি। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে! এখন দেখার পালা তিনি কীভাবে নির্বাচন কমিশনকে পরিচালনা করেন? শুধু সংলাপ করে, মিডিয়ায় বক্তব্য রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি যে 'সিরিয়াস', এটা তাকে প্রমাণ করতে হবে। আমরা তাকিয়ে থাকলাম তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ওপর। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমরা সবাই চাই। এ ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকা বড়। তার ক্ষমতা আছে। তাকে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। সবার আস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সুশীল সমাজের আস্থা অর্জন করলেই চলবে না। বরং রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপির আস্থা অর্জন করতে হবে। এটা করতে নির্বাচন কমিশন যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থই বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কৃতি নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু থাকবে না।Daily Jai Jai Din05.08.2017
0 comments:
Post a Comment