রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

নতুন স্নায়ুযুদ্ধের মুখে বিশ্ব?


 

সাম্প্রতিক সময়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাকে বিশ্নেষকরা নয়া স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ এই প্রবণতাকে 'কোল্ড ওয়ার টু' আখ্যায়িত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ও সমাজতন্ত্রের 'অবসান' ঘটলে পরিসমাপ্তি ঘটেছিল স্নায়ুযুদ্ধের। এখন দৃশ্যপটে এসেছে চীন। চীনকে কেন্দ্র করে এখন স্নায়ুযুদ্ধ-২ এর সূচনা হতে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যা স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করেছিল। যেমন, বার্লিন ব্লকেড (১৯৪৮-৮৯), কোরিয়া যুদ্ধ (১৯৫০-৫৩), সুয়েজ সংকট (১৯৫৬), বার্লিন সংকট (১৯৬১) ও কিউবান মিসাইল সংকট (১৯৬২)। এসব ঘটনাবলিতে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের 'ইন্ধন' ও 'প্ররোচনা'কে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থি হিসেবে মনে করেছিলেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল জর্জ কেনানের 'কনটেইনমেন্ট পলিসি'। তিনি ছিলেন ওই সময়ে মস্কোতে নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিক। তিনি বিখ্যাত 'ফরেন অ্যাফেয়ার্স' ম্যাগাজিনে মি. এস্ট্ক্র নামে বেনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন দ্য সোর্সেস অব সোভিয়েত কন্ডাক্ট, ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬। এই প্রবন্ধই তাকে বিখ্যাত করে তোলে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে তিনি একজন স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে পরিচিতি পান। তার প্রবন্ধের মূল বিষয় ছিল 'যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিনি স্বার্থকে আঘাত করছে, সেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে হবে'- অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা (কূটনৈতিক, সামরিক, জোট) গ্রহণ করে দেশটির ক্ষমতা খর্ব করতে হবে। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা এ পলিসি গ্রহণ করেছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ সময় ধরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এক ধরনের 'যুদ্ধে' জড়িয়ে গিয়েছিল, যা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে স্নায়ুযুদ্ধ নামে। 

সাম্প্রতিক সময়ে চীন অন্যতম 'শক্তি' হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা মার্কিনি স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করছে। বিশেষ করে বিশ্বে চীনের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাব (২০৩০ সালে চীনের জিডিপি ২২.১ ট্রিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্রের ২৪.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। পিপিপিতে চীন হবে প্রথম), চীনের ওবিওআর পরিকল্পনায় ৬১টি দেশকে চীনের আওতায় আনা, ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধি (জিবুতিতে নৌঘাঁটি), আফ্রিকাতে চীনের বিশাল বিনিয়োগ (সাবসাহারা আফ্রিকাতে ২৯৯ মিলিয়ন+৬০ মিলিয়ন ডলার, ২০১৮ সালে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগে মাত্র ৪৭.৮০ মিলিয়ন ডলার) নতুন এক আফ্রিকার জন্ম দেওয়া, স্ট্র্যাটেজিক্যালি ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া, নৌশক্তি হিসেবে চীনের আবির্ভাব ইত্যাদি বিষয়গুলো মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি। ২০১৮ সালে এই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪১৯.২ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করেছে, যা জন্ম দিয়েছে এক ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধের। শুধু তাই নয়, পরিসংখ্যান বলছে চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ (২০১৮) ১.১৩ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং বোঝাই যায় চীন কেন এখন টার্গেট। 

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট অফিস 'গোয়েন্দা কার্যক্রমে' জড়িত থাকার অভিযোগে বন্ধ করে দিয়েছে। চীনও এর প্রতিশোধ হিসেবে চেংডুতে মার্কিন কনস্যুলেট অফিস বন্ধ করেছে। চীন ওয়াশিংটনে তাদের দূতাবাসে বোমা হামলার অভিযোগ এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও চীনা জনগণকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে চীনা জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো এবং যুক্তরাষ্ট্র এ কাজটিই করবে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সিনেটর জিম রিম ও সিনেটর করি গার্ডনার মার্কিন সিনেটে একটি বিল উপস্থাপন করেছেন। যেখানে চীনা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মেধাস্বত্ব চুরি করার অভিযোগ আনা হয়েছে এবং ওইসব কোম্পানিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এর আগে মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাইপে অ্যাক্টে স্বাক্ষর করেছিলেন। এই আইন বলে তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। চীন এই সিদ্ধান্তকে কোনো দিন ভালো চোখে নেবে না। তাইওয়ানকে চীন বৃহত্তর চীনের অংশ বলেই মনে করে। 'হংকং মডেলে' চীন তাইওয়ানকে বৃহত্তর চীনের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তবে বিষয়টি অত সহজ নয়। অনেক দেশের সঙ্গেই তাইওয়ানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার না করলেও, ওয়াশিংটন ডিসিতে তাইওয়ানের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে। তাইওয়ানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাইওয়ানের নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানে অত্যাধুনিক অস্ত্র, বিশেষ করে সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহ নিয়ে অতীতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি হয়েছিল। এখন নতুন করে ট্রাম্পের তাইপে অ্যাক্ট দু'দেশের মাঝে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটাবে। 

যুক্তরাষ্ট্র চীনকে টার্গেট করে একের পর এক যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ও উদ্যোগে নৌ সামরিক মহড়া। দু'দুটো নৌ সামরিক মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্র অংশ নিয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ অংশ নিয়েছে। এই নৌ সামরিক মহড়া কার্যত চীনের প্রতি এক ধরনের হুমকি। ২২ জুলাই দক্ষিণ চীন সাগরের পার্শ্ববর্তী এলাকা ফিলিপাইনস সাগরে নৌ মহড়া সম্পন্ন করেছে জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে। একই সঙ্গে ভারতের নৌবাহিনীর সঙ্গেও নৌ মহড়া সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে একটি চারদেশীয় সামরিক জোট গঠন করেছিল ২০০৭ সালে। বলা হচ্ছে, এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই ওই জোট। এই জোটের উদ্যোগে ও ভারতের আগ্রহে এই জোটের পক্ষ থেকে মাল্লাক্কা প্রণালির অদূরে প্রতিবছরই একটি নৌ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়, যা 'মালাকার' নৌ মহড়া নামে পরিচিত। যদিও গত কয়েক বছর অস্ট্রেলিয়া এই মালাকার নৌ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে না। 

আর মাত্র তিন মাস বাকি আছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের। এমনিতেই করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যর্থতায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল 'ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস' আন্দোলন, যা প্রকারান্তরে ট্রাম্পবিরোধী একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ট্রাম্প যখন তার পায়ের তলায় মাটি পাচ্ছেন না, জনপ্রিয়তা বাড়াতে 'চীনা কার্ড' ব্যবহার করতে পারেন। তার উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, চীনের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করল। একটি 'এশিয়ান ন্যাটো' গঠনের কথাও কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে। মোদ্দা কথা, ইউরোপে প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। এখন ভারত মহাসাগরে জন্ম হয়েছে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের। সঙ্গত কারণেই এশিয়ার দেশগুলো এই 'প্রভাববলয় বিস্তারের খেলায়' আক্রান্ত হবে। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। এখন দেখার পালা, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতায় এশিয়ার দেশগুলো কোন পক্ষ অবলম্বন করে

Samakal

24.8.2020

0 comments:

Post a Comment