রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও বিএনপির রাজনীতি


বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিএনপি যুক্ত হয়েছে। প্রবীণ আইনজীবী ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন এই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোক্তা। গত ২২ সেপ্টেম্বর মহানগর নাট্যমঞ্চে ‘নাগরিক সমাবেশে’ ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় চার নেতা যোগ দেন। সেই সঙ্গে রয়েছে বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টও। এর মধ্য দিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলো বিএনপি। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেক। প্রথমত, এই ঐক্যপ্রক্রিয়ার কারণে বিএনপি কি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করবে? দ্বিতীয়ত, এই ঐক্যপ্রক্রিয়ার ব্যাপারে কি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নেতারা সবাই খুশি হলেন? তৃতীয়ত, এই ঐক্যপ্রক্রিয়ার কারণে বিএনপিকে এখন আন্দোলনের নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে হবে। এতে কি তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপিকর্মীরা খুশি হবে? চতুর্থত, এই ঐক্য কি একটি নির্বাচনী ঐক্য হবে? এখানে মালয়েশিয়ান ফর্মুলা আদৌ কাজ করবে কি?
এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা শুধু একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে এই জোট গঠনের কথা বলছেন। নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনো আলোচিত হয়নি। বলা হচ্ছে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠনের কথা। তবে এই আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যদি ভেঙে যায়, আমি অবাক হব না! কেননা বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী প্রকাশ্যেই বলেছেন, তাঁরা ১৫০ আসন চাচ্ছেন ঐক্যপ্রক্রিয়ার নেতাদের কাছে, পরোক্ষভাবে বিএনপির কাছে। অন্যদিকে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না চাচ্ছেন দুই বছরের জন্য তাঁদের ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে! শুধু নেতারা একটি ঐক্যে মিলিত হয়েছেন। এরই মধ্যে ১৫০ আসন চাওয়া কিংবা দুই বছরের জন্য ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব চাওয়া—বিষয়গুলো উত্থাপিত হওয়ায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা খুব ভালো চোখে দেখবেন বলে আমার মনে হয় না। এটা ঠিক, বিএনপি একটি বড় ‘সংকটে’ আছে। খালেদা জিয়ার জেল থেকে ‘মুক্ত’ না হওয়া ও তাঁর অসুস্থতা, তারেক রহমানের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্ভাব্য শাস্তি, শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নামে শত শত মামলা দলটিকে বড় সংকটে ফেলে দিয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে তাঁরা নির্বাচনে যাচ্ছেন। তবে চূড়ান্ত কথা বলার সময় বোধ হয় এখনো আসেনি।
এর আগে বিএনপির মহাসচিব জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। দেখা করেছেন একজন সহকারী মহাসচিবের সঙ্গে। গত কয়েক দিন রাজনৈতিক ময়দান এটা নিয়ে ছিল উত্তপ্ত। মির্জা ফখরুল এটা নিয়ে কথা বলেছেন। সিনিয়র মন্ত্রীরা বলেছেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করেছে। এখানে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। কথা উঠেছে বিএনপির মহাসচিব এই সফরে কী পেলেন? বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বিএনপি মহাসচিবের বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হয়েছে কি না—এটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন যে চলমান রাজনৈতিক সংকটের বিষয়টি তিনি জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, জাতিসংঘ সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। তিনি আরো জানিয়েছেন, তাঁকে বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল এবং যেহেতু অতীতেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটে সহকারী মহাসচিবকে (জাতিসংঘের) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেহেতু এবার তিনি তাঁর সঙ্গেই দেখা করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে তিনি দেখা করেননি। মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন, খুব শিগগির তাঁর দল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের রূপরেখা প্রকাশ করবে। তিনি মনে করেন, বর্তমান সমস্যার একটি বড় সমাধান হলো বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা। তা বৃহত্তর জোটের মাধ্যমে এখন সম্পন্ন হয়েছে। তবে বিএনপি যুগপৎ কর্মসূচির কথাও বলেছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বিএনপি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘে নালিশ দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা আরেক দফায় নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ দিয়েছে। তাঁর মতে, মির্জা ফখরুল জাতিসংঘে একজন ডেস্ক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন (সমকাল, ১৮ সেপ্টেম্বর)। তোফায়েল আহমেদ এটা জানিয়ে দিতে ভোলেননি যে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই এবং সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এই দুজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অস্থিরতা, আস্থাহীনতা, পরস্পরকে অবিশ্বাস করার যে ‘রাজনীতি’, তা এখনো রয়ে গেছে। অথচ জাতীয় নির্বাচনের বাকি আছে তিন মাসেরও কম সময়। এ মাসেই শিডিউল ঘোষণা করা হবে। অথচ দুটি বড় দলের ‘অবস্থান’ পরস্পরবিরোধী।
মির্জা ফখরুল জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। এটা কোনো ধরনের ‘নালিশ’ জানাতে নয়, বরং তাঁর মতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অবহিত করতেই তিনি জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনকারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে জাতিসংঘ আদৌ স্ব-উদ্যোগে কোনো দেশে নির্বাচন আয়োজন করতে পারে না। এটা সত্য, জাতিসংঘের অধীনে ‘ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স ডিভিশন’ নামে একটি শাখা আছে। এটি ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই শাখা পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে নির্বাচন আয়োজন করে আসছে। এরা বিভিন্ন দেশে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে ‘টেকনিক্যাল সহযোগিতা’ দেয়, সেখানে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে, নির্বাচন যে ‘সুষ্ঠু’ হয়েছে, তা ‘সার্টিফাই’ করে ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এককভাবে স্ব-উদ্যোগে ‘ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স ডিভিশন’ কোনো দেশে নির্বাচনের আয়োজন, পর্যবেক্ষণ বা নির্বাচন মনিটর করতে পারে না। শুধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুমোদনই নয়, বরং ওই দেশের এবং বিবদমান গোষ্ঠীরও অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। নেপালের দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারি। ২০০৬ সালের নভেম্বরে নেপাল সরকার ও মাওবাদীদের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই সময় সরকার ও মাওবাদীরা জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানায় সেখানে সংবিধান প্রণয়নের জন্য যে সাংবিধানিক পরিষদ (সংসদ) গঠিত হবে, তা আয়োজন করে দেওয়ার জন্য। জাতিসংঘ মিশন সেই কাজটি শুরু করে ২০০৭ সালে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে সেখানে সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের ‘ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স ডিভিশন’ তাদের লোকবল দিয়ে, পর্যবেক্ষক দিয়ে এই নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করে। কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধের পর জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল ১৯৯২-৯৩ সালে। সেখানে ওই সময় প্রায় ৪৬ দেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল (বাংলাদেশসহ)। এই কর্তৃপক্ষ সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে নির্বাচনে সহযোগিতা করেছিল জাতিসংঘ। গৃহযুদ্ধের পর নামিবিয়ায় (১৯৮৯-১৯৯০) জাতিসংঘ একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন পরিচালনা করেছিল এবং সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশে জাতিসংঘের ‘ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স ডিভিশন (ইএডি)’ নির্বাচন পরিচালনা করেছে (UNOWAS News, 14 December 2017)। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে ওই সব দেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। ওই সব দেশে গৃহযুদ্ধ চলছিল, তারপর বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সমঝোতা হয়, শান্তিচুক্তি হয় এবং জাতিসংঘ সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে এটা তো সত্য, অতীতে জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে কথাও বলেছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখন মির্জা ফখরুল নিজে গেলেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাঁদের অবহিত করলেন। জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিরা কি এসব বিষয়ে অবগত নন? নিশ্চয়ই তাঁরা জানেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে তাঁদের করার কিছু নেই। এটা ঠিক একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা শুধু বিএনপিই বলছে না, বলতে গেলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বাদে প্রতিটি দলই একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট কিংবা ঐক্যপ্রক্রিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর তিন মাস ছুটি’ শীর্ষক একটি ফর্মুলার কথা মাঝেমধ্যে বলা হয়। কিন্তু এটাও অসম্পূর্ণ। তাহলে ওই সময় সরকার পরিচালনা করবে কে? উপরন্তু সরকার একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান তাদের পক্ষে। সংবিধান তো প্রধানমন্ত্রীর ‘তিন মাস ছুটি’ অনুমোদন করে না! সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে। কিন্তু সরকার এই শেষ সময়ে সংবিধান সংশোধন করবে, এটা মনে হয় না। তাহলে ‘সমঝোতাটা’ হবে কিভাবে?
এখন বিএনপির জন্য ‘কাজটি’ সহজ হয়ে গেল। বিএনপির ‘নেতৃত্ব’ এখন চলে গেল ড. কামাল হোসেনের কাছে! বিএনপি যখন নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছিল তখন ড. কামাল হোসেন আর বি চৌধুরীর সঙ্গে ‘ঐক্য’ করে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার এবং না যাওয়ার বিভ্রান্তি দূর করল। বিএনপি এখন নির্বাচনে যাবে। সরকারের জন্যও এটা বড় ‘পাওয়া’, অন্তত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো ‘পরিস্থিতি’ হয়তো এড়ানো সম্ভব হবে! জাতীয় ঐক্যজোট এবং প্রকারান্তরে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে একটি ‘বৈধতা’ দেবে। তবে সব কথা বলার সময় এখনো আসেনি। বিএনপির শীর্ষ পদগুলোতে কট্টরপন্থীরা এখনো আছেন। তথাকথিত ‘মালয়েশিয়ান ফর্মুলা’ কাজ না-ও করতে পারে। উপরন্তু ২০ দলীয় জোটে স্পষ্টতই অসন্তোষ আছে এবং তা জোটের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। জাতীয় ঐক্যজোট হয়েছে। এতে বিএনপি কতটুকু লাভবান হলো, সে প্রশ্ন থাকলই।
Daily Kaler Kontho
01.10.2018

ঐক্য প্রক্রিয়ায় অনৈক্যের সুর!




বিএনপি গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্টের সাথে ঐক্য করেছে। কিন্তু এটি একটি নির্বাচনী ঐক্য হবে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। সংসদীয় নির্বাচনে বিকল্প ধারায় কোনো ভিত্তি নেই। মাহী বি. চৌধুরীর নিজস্ব কোনো সংসদীয় এলাকা নেই। বাবা বি. চৌধুরীর নির্বাচনী আসনই তার আসন। দেশের ৬৪টি জেলার সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে তিনি যখন বিএনপিকে একধরনের ‘মুচলেকা’ দিতে বলেন, তখন তার ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী ও বাংলাদেশ বিরোধী হিসেবে জামায়াতকে সাথে নিতে চান না। কিন্তু তার নিজ দলের মহাসচিবকে নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে এবং যখন স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে, তখন এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চুপ। তিনি উচ্চাকাঙ্খী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার সেই ‘ইমেজ’ নেই। জাতীয় ঐক্য জোটের ব্যাপারে তিনি সুবিধা নিতে চাইছেন। এতে করে বিএনপিকে বাধ্য করতে পারে ঐক্য প্রক্রিয়ার বিরোধী অবস্থান নিতে । দ্বিতীয়ত, নাগরিক ঐক্যের কোনো নিবন্ধন নেই। মাহমুদুর রহমান মান্না একজন ব্যক্তি। তার হয়তো ‘ ইমেজ’ আছে, কিন্তু নেই সাংগঠনিক ভিত্তি। এমতাবস্থায় তিনি দাবি করে বসলেন, দু’বছরের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তাদের দিতে হবে! কোথায় নির্বাচন? কোথায় নির্বাচন বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা! দিল্লি তো অনেক দূর! এরই মাঝে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব? মাহী বি. চৌধুরী ও মান্নার বক্তব্য প্রকারন্তরে বিএনপিকে ঐক্য বিরোধী অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে। এদের দু’জনেরই বোঝা উচিত, তাদের শক্তি কতটুকু? ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করেন কীভাবে?



এ ধরনের বক্তব্যের পাশাপাশি ড. কামাল হোসেন একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিনি দলের নয়, জনগণের ঐক্য চান। তার এ ধরনের কথা শুনতে ভালোই শোনা যায়। কিন্তু বিকল্প ধারার ওপর তার কোনো ‘নিয়ন্ত্রণ’ নেই। এমনিতেই নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে ড. কামাল হোসেন নাকি বি. চৌধুরীর হাতে, এটা নিয়ে ঐক্যজোটে একধরনের আস্থাহীনতা আছে। ড. কামাল যৌথ নেতৃত্বের কথা বললেও। মাহী বি. চৌধুরী এটা মানছেন না! তিনি চান বি. চৌধুরীকে মূল নেতৃত্বে দেখতে। স্পিরিটটি হচ্ছে, সরকার বিরোধী সকল শক্তিকে একটি প্লাটফর্মে আনা। এ থেকে বিএনপি বড় দল হলেও ড. কামালের নেতৃত্ব তারা মেনে নিয়েছে। যদিও ২০ দলীয় জোটে এই ঐক্য নিয়ে একধরণের অস্বস্তি রয়েছে। এলডিপি, অন্যান্য পার্টি কিংবা ন্যাপের মতো সংগঠন জাতীয় ঐক্যজোটের ব্যাপারে খুব উৎসাহী তা বলা যাবে না। এই দলগুলো দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে আছে। এখন বিএনপি যদি ‘নতুন মিত্র’ পেয়ে এদের ‘পরিত্যাগ’ করে, তাহলে বিএনপির গ্রহণযোগতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। বিএনপির উচিত হবে ২০ দলীয় জোটকে সাথে রেখেই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়া।

জাতীয় ঐক্যজোট গঠিত হওয়ায় সরকারেরও এতে লাভ। কেননা শেষ পর্যন্ত ঐক্যজোটের ব্যানারে বিএনপি হয়তো নির্বাচনে অংশ নেবে। আর বিএনপির একটি প্লাসপয়েন্ট, নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্তটি তুলেছিল কামাল হোসেনর কাছে। কিন্তু দু‘টো পক্ষ এখনো অমীমাংসিত। এক. নির্বাচনকালীন সরকার, দুই. সংসদ ভেঙে দেওয়া। ড. কামালও এ দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারের মনোভাব এখনো অনমনীয়। সরকার বারবার সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। সরকারের দাবি মেনেই কি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাচ্ছে? এবং বিএনপি বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে ‘মাইনাস’ করেই কী নির্বাচনে যাচ্ছে! এসব প্রশ্ন বারবার আলোচিত হতে থাকবে।

মানুষ একটি ভালো নির্বাচন চায়। চায় তার ভোট সে নিজে তার মনোনীত প্রর্থীকে দেবে। ভোট কেন্দ্র দখল, সিল মারা সংস্কৃতিক প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাঁধা দান এই ‘সংস্কৃতি’ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। তা থেকে বের হয়ে আসা দরকার। এটা আওয়ামী লীগের জন্য যেমনি ভালো, তেমনি ভালো বিএনপিসহ অন্যান্য দলের জন্যও। একটা সুযোগ এসেছে। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার একটি ভূমিকা রাখছে। এখন যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে ঐক্যকে ধরে রাখা। ঐক্য প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত হলে বিএনপি আবারও নির্বাচন বয়কটের ডাক দিতে পারে, যা কারও জন্যই কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
প্রবীন রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হলেও, এক সপ্তাহ পেরুনোর আগেই একটি অনৈক্যের সুর শোনা যাচ্ছে। বিকল্প ধারাকে নিয়েই ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এখন বিকল্প ধারার নেতারাই বলছেন উল্টো কথা। বিশেষ করে বিকল্প ধারার যুগ্ম-মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীর নানা বক্তব্য ঐক্য প্রক্রিয়ার বড় ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তার দুটো বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এক. তিনি বলেছেন, বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সাথে একাশ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করে ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসতে হবে। এটা মুখে বললে চলবে না। পত্রিকায় বিবৃতি ও লিখিত অঙ্গীকার করতে হবে। দুই. বিকল্প ধারা তথা যুক্তফ্রন্টকে একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে ১৫০টি আসন ছেড়ে দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় ঐক্যজোট যখন ‘কাজই’ শুরু করতে পারল না, এর আগেই বিকল্প ধারা শর্ত জুড়ে দিল! এর ফলে ঐক্য প্রক্রিয়া কী বাধাগ্রস্ত হবে না? যদিও ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য একটু ভিন্ন। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, তিনি যে ঘোষণাপত্র দিয়েছেন, তাতে জামায়াত নিয়ে কোনো বক্তব্য ছিল না। যুক্তফ্রন্টকে দেড়শ আসন দেওয়া কিংবা দুই বছরের জন্য তাদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া, এগুলো কোনো সমস্যা না। বিএনপি বড় দল সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করেই একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। রাজনীতির দুটি ধারাই এই দুটি দল প্রতিনিধিত্ব করে। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে একটি রাজনৈতিক ধারা তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেটা সফল হয়নি। ১৯৯৬ সালে পর থেকেই আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। গত প্রায় দশ বছর যাবৎ আওয়ামী লীগ সমতায়। তবে নিঃসন্দেহে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য একটি টেস্ট কেস। অন্যদিকে বিএনপিই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি শক্তি জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টির ভুল রাজনীতি, দলের নেতাদের মাঝে একধরনের সুবিধাবাদীতা, সুনির্দিষ্ট রাজনীতি প্রণয়নে ব্যর্থতা জাতীয় পার্টিকে বিএনপির বিকল্প হিসাবে দাঁড় করাতে পারেনি। ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদে এরকম একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টি এই সুযোগটি নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। একদিকে সরকারে থাকা, আবার বিরোধী দলে থাকা, দলীয় প্রধানের মন্ত্রীর পদ-মর্যাদায় সুযোগ-সুবিধা নিয়েও সরকারের বিরোধীতা করা সব মিলিয়ে জাতীয় পার্টির এই ‘ভূমিকা’ সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে নেয়নি। ফলে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে ঘুরে ফিরে বিএনপিই আলোচনায় আছে এবং বিএনপিকে কেন্দ্র করেই এখন প্রধান বিরোধী দলের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। ফলে নির্বাচনের বিএনপির অংশগ্রহণটা জরুরি। প্রশ্ন হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এই দায়িত্বটি পালন করতে পারবে কি?
Daily Amader Somoy.com
30.09.2018

অথঃ ‘উইপোকা’ তত্ত্ব!


ভারতের অত্যন্ত ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ ও বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ আসামে বসবাসরত বাঙালি মুসলমানদের ‘উইপোকার’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। সম্প্রতি রাজস্থানের এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, “আসামে অবৈধ অভিবাসীরা ‘উইপোকা’, এদের শিগগিরই ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে।” তার ভাষায়Ñ এই ‘অবৈধ অভিবাসীরা’ বাংলাদেশি! তার এ মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এর ইউরোপীয় শাখার পরিচালক এন্ড্রু স্ট্রোহলেইন বলেছেন, ‘অমিত শাহর মন্তব্য গণহত্যার প্রস্তুতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (আলজাজিরা, শীর্ষ নিউজ, ২৬ সেপ্টেম্বর)। বলা ভালো, চলতি বছরের ৩০ জুলাই আসামের রাজধানী গৌহাটি থেকে খসড়া নাগরিক নিবন্ধন তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে নিবন্ধের জন্য আবেদন করা ৩ কোটি ২৯ লাখ মানুষের মধ্যে ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৮ জন বাদ পড়েন, যাদের একটা বড় অংশ মুসলমান। এনআরসি এই তালিকা প্রকাশ করে।
সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, এনআরসির বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন। ২০১৯ সালে ভারতে জাতীয় নির্বাচন। বিজেপি সরকার এটাকে ইস্যু করতে চায়। ভুলে গেলে চলবে না, আসামসহ ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলোর প্রায় সব ক’টিতে বিজেপি ও বিজেপি মিত্ররা ক্ষমতায়। অতি সম্প্রতি সেখানে যে বিধানসভার নির্বাচন হয়ে গেল, তার মধ্য দিয়ে বিজেপি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তার অবস্থান অনেক শক্তিশালী করেছে। আসামে বিজেপির নেতৃত্বাধীন একটি সরকার রয়েছে।
আসামের নাগরিকত্ব তালিকা নিয়ে যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে সেখানে বাঙালি মুসলমানরা যে এক ধরনের আতঙ্কের মাঝে আছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও ভারতের সুপ্রিমকোর্ট বলেছেন, এখনই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নয়, তারপরও কথা থেকে যায়। আগামী লোকসভা এবং পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি এ ইস্যু তুলে রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করে নিতে চায়। এতে করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সময় পার করছে। তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ইস্যুতে বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং তাতে করে লাভবান হবে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় দুই দেশের সম্পর্ক ভালো এবং একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার (বিবিআইএন) আলোকে দেশ দুটি নতুন এক সম্পর্কে উন্নীত হয়েছে। এমনি একসময় অমিত শাহরা মুসলমানদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে।
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার জন্ম হয়। বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা হচ্ছে নয়া বিশ্বব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা যেখানে কমে এসেছিল, সেখানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিতে দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের মাঝে দেশগুলো এমন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, যা কিনা নয়া বিশ্বব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। একুশ শতকে এসে সেই ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। জন্ম হয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি নতুন; কিন্তু এ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বিপুল এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা মূলত গড়ে ওঠে পাশাপাশি দুটি বা তিনটি রাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে। সেখানে পুরো রাষ্ট্রটি জড়িত থাকে না, জড়িত থাকে কিছু অঞ্চল। আর অঞ্চল ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশ সার্ক কিংবা বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় জড়িত থাকলেও বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএমের মতো উপ-আঞ্চলিক সংস্থায় নিজেকে জড়িত করেছে। বিবিআইএন (ইইওঘ) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা প্রথম জানা যায় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ ঘোষণাপত্রটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ৪১নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, উভয় প্রধানমন্ত্রী বিবিআইএনের আওতায় বিদ্যুৎ, পানি সম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি খাতে সহযোগিতার সুযোগ কাজে লাগাতে সম্মত হয়েছেন। এ বিবিআইএন হচ্ছে ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত (সাতবোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গোহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা বাস সার্ভিস। যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিসও চালু হবে। কলকাতা-খুলনার মধ্যে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনও এরই মধ্যে চালু হয়েছে। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহনে এখন এই সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এর সবই হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। ১৫ জুন (২০১৫) বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর ভুটানের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনেও চারটি দেশের মাঝে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের সময় ভুটান এতে রাজি হয়েছিল। তবে ভুটানের সংসদ আপত্তি তুলেছিল। সংসদে তা অনুমোদিতও হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমেই আমরা প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোট নিয়েও আলোচনা করতে পারি। বিসিআইএম (ইঈওগ) হচ্ছে অপর একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এ জোটে আছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাতবোন রাজ্যগুলো) ও মিয়ানমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তার চীন সফরের সময় এ বিসিআইএম করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটাকে একসময় ‘কুনমিং উদ্যোগ’ বলা হতো। চীন ২০০৩ সালে এ ধরনের একটি সহযোগিতার কথা প্রথম বলেছিল, যা পরবর্তী সময় বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করে। এ জোটটি কার্যকর হলে কুনমিং (চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। ফলে চীনা পণ্যের দাম কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে আসিয়ানে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার, যার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। বিসিআইএম জোটের সম্ভাবনা বিশাল। কারণ এ চারটি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) ও সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামীতে, যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই; বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে এ জোট। বলাই বাহুল্য, এ চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ২৮৮ কোটি মানুষের বাস এ বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশে। পূর্বে কুনমিং আর পশ্চিমে কলকাতা। মাঝখানে মান্দালয় ও ঢাকা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে, এতে করে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়া সহজ হয় এবং তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ানের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। আমরাও এ সুযোগটি নিতে পারি।
কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। বিবিআইএন জোট যদি সফল হয়, তাহলে জোটভুক্ত চারটি দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে। সিলেট হয়ে উঠতে পারে অন্যতম একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। একই কথা প্রযোজ্য বিসিআইএমের ক্ষেত্রেও। সড়কপথ যদি প্রশস্ত হয়, যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ তথা কৃষি ও মৎস্যসম্পদ ব্যবহার করে তা বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে আমাদের অর্থনীতিতে। তাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করতে হবে আমাদের সবার স্বার্থে। আমরা দেখতে চাই আমাদের স্বার্থ। কানেকটিভিটি ব্যবহার করে কোনো একটি দেশ লাভবান হবে, তা হতে পারে না। আমরাও চাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করে আমাদের পণ্য নেপাল ও ভুটান যাক। সড়কপথে আমরা যেতে চাই কুনমিংয়ে। কিন্তু এজন্য যা দরকার, তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা যদি গড়ে ওঠে, তাহলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভারতের সদিচ্ছা নিয়ে। মোদির খুব ঘনিষ্ঠ অমিত শাহ। এখন তিনি বাঙালি মুসলমানদের, যারা আসামে বংশ পরম্পরায় বাস করে আসছেন, যারা সেখানে ভোট দেন, তাদের পোকামাকড়ের সঙ্গে তুলনা করে প্রকারান্তরে তিনি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিলেন। মোদির ঢাকা সফরের সময় তার বক্তব্য প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু এখন অমিত শাহরা উল্টো কথা বলছেন। ফলে বিজেপি সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নের মুখে থাকবেই। বাংলাদেশ ভারতকে যথেষ্ট দিয়েছে। সর্বশেষ ক্যাবিনেট মিটিংয়ে বাংলাদেশ ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। এটা ভারতের জন্য বড় পাওয়া। কিন্তু যেখানে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে, সেখানে বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা, তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার ঘোষণা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এরই মধ্যে আসামের বাদ পড়া নাগরিকরা ফের নিবন্ধন করার সুযোগ পাচ্ছেন। আমরা আশা করব এ তালিকায় বাদ পড়া ৪০ লাখ মুসলমানের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা হবে। এ ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করবে না, আমরা এটা প্রত্যাশা করি। তথাকথিত ‘উইপোকা’ তত্ত্ব যতবেশি কম ব্যবহার করা হবে, ততই মঙ্গল।
Daily Alokito Banglaesh
30.09.2018

একটি সিদ্ধান্ত ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


মন্ত্রিসভা ভারতকে দুটি বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। ভারত এখন থেকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। এর ফলে কলকাতা থেকে ১ হাজার ৫৫৯ কিলোমিটার দূরত্বের আগরতলায় এতদিন যে পণ্য পরিবহনে সময় লাগত আট দিন, তা এখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পৌঁছে যাবে আগরতলায়। ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলোর আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রেও ব্যবহূত হবে এই দুটি পোর্ট। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পৃথিবীর অনেক দেশই, এমনকি ইউরোপের অনেক দেশ অন্য দেশের পোর্ট ব্যবহার করে থাকে। এটি একটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতীয় পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ওই বন্দর দুটি যদি ব্যবহূত হয়, তাতে করে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা? কিংবা চট্টগ্রাম ও মোংলা পোর্টের সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণ না করার ফলে এই দুটি পোর্টের সক্ষমতা আছে কিনা ভারতীয় পণ্য হ্যান্ডলিং করার? ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের আমদানি-রফতানি বেড়েছে। এই আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহূত হয় বেশি। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে ‘নেক্সট ইলেভেন’-এর অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ। অর্থাৎ, যে ১১টি দেশ আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে অবির্ভূত হচ্ছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এর অর্থ পরিষ্কার- আগামীতে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাড়বে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর ‘চাপ’ বাড়বে। মোংলা বন্দরের ব্যবহার কম। কেননা পলি জমে যাওয়ায় মোংলা বন্দরে জাহাজ তেমন একটা ভিড়তে পারে না। ফলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের তাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরকেই ব্যবহার করতে হয়। এখানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আরেকটি সমস্যা- বাংলাদেশে কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা। কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কথা ছিল। চীনের এখানে অর্থায়ন ও বন্দরটি নির্মাণ করার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় (২০১৪) ওই চুক্তিটি স্বাক্ষরের কথা ছিল, কিন্তু স্বাক্ষর হয়নি। পরে জানা গেল, ‘একটি দেশের’ আপত্তির কারণে চুক্তিটি আমরা স্বাক্ষর করতে পারিনি। অথচ সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হলে তাতে করে আমরা এবং সেই সঙ্গে ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো ওই গভীর সমুদ্রবন্দরটি ব্যবহার করতে পারত। এমনকি চীনও এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারত। কেননা বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য এই গভীর সমুদ্র পোর্টের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি ছিল। চীন যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, বিসিআইএম করিডোর তার একটি অংশ। এর মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং শহরের সঙ্গে কক্সবাজার সড়ক পথে সংযুক্ত হবে। এতে করে চীনা পণ্য সড়ক পথে কক্সবাজারে এসে গভীর সমুদ্রপথ ব্যবহার করে বিদেশে রফতানি হবে। এর ফলে চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। বাংলাদেশ সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ না করায় চীন এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে কাইয়াউকপিউতে (Kyaukphyu) একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। চীনের স্বার্থ এখানে অনেক বেশি।
সোনাদিয়ায় যদি আমরা একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারতাম, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর থেকে আমরা ‘চাপ’ কমাতে পারতাম। সময় ও দেশের প্রযোজনে পণ্য হ্যান্ডলিং ক্রমাগত বেড়ে গিয়ে বন্দরের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫.৫ শতাংশ। অথচ সেই সমানুপাতে জেটি-বার্থ, টার্মিনাল, ইয়ার্ড, ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের মতো সুবিধাগুলো দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। মূল জাহাজ চলাচল চ্যানেলের দীর্ঘদিন ড্রেজিং না হওয়ায় ভরাট হয়ে নাব্য হারাচ্ছে বন্দর। এ কারণে বহির্নোঙরে বড় জাহাজ বহর থেকে আমদানি পণ্য লাইটারিং করতে গিয়েই সময় ও আর্থিক অপচয় বেড়ে যাচ্ছে। পোর্ট-শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় ভারত যদি এ পোর্ট ব্যবহার করে, তাহলে আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে চট্টগ্রাম বন্দরটি। কেননা নিজের সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছে বন্দরটি। ২০২০ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে প্রায় ২৮ লাখ টিইইউএস (Twenty-Foot Equivalent unit, ২০ ফুট চওড়া ও ৮ ফুট উঁচু কনটেইনার)। তখন বন্দরের সক্ষমতায় ঘাটতি থাকবে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টিইইউএস কিংবা আরো বেশি। আজ কেবিনেটে ভারতকে এ বন্দর ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বটে। কিন্তু ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়েই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছিল। ভারত অনেক আগে থেকেই এ ব্যাপারে প্রস্তুত নিয়ে রেখেছিল। যে কারণে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। যাতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি সড়কপথে এবং ভবিষ্যতে রেল পথে ত্রিপুরা দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবাহিত হতে পারে। দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুমেব আনন্দপাড়া থেকে রামগড়ের মহামুণি পয়েন্ট পর্যন্ত ৪১২ মিটার দীর্ঘ এবং ১৪.৮ মিটার চওড়া মৈত্রী সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পে ভারত সরকার ১২৫ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছে। তা ছাড়া ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে আখাউড়ার সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথ তৈরি করা হচ্ছে, যা বন্দর থেকে সরাসরি কন্টেইনার আগরতলায় পৌঁছানোর প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসের ব্যাপারে ‘চাপ’ কীভাবে বাড়ছে, তা একটি পরিসংখ্যান দিলে বোঝা যাবে। ২০১২-১৩ সালে এই বন্দর ব্যবহার করে আমদানি হয়েছে ৩,৮৩,১২,০২৮ টন, আর রফতানি হয়েছে ৫০,৫৯,৬৪০ টন। ২০১৪-১৫ সালে এর পরিমাণ ৪,৮৯,৪১,৪০৬ টন (আমদানি) ও ৫৮,৩৯,৯৮৬ টন (রফতানি)। ২০১৬-১৭ সময়সীমায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬,৬৪,৬৪,২৮৫ টন (আমদানি) ও ৬৭,০৯,৭৫৯ টন (রফতানি)। এর অর্থ একদিকে আমদানির পরিমাণ যেমনি বেড়েছে, ঠিক তেমনি রফতানির পরিমাণও বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, কার্গো হ্যান্ডলিং (টন) এ ২০১২-১৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৯৫ শতাংশ, ২০১৪-১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫.২১ শতাংশে, আর ২০১৫-১৬ সালে ১৫.২৮ শতাংশে। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় আগামীতে কার্গো হ্যান্ডলিং কীভাবে বাড়বে। আরো কিছু পরিসংখ্যান দিই। ২০১৪ সালে এই বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ১৮ লাখ ৬৭ হাজার টিইইউএস। তখন জাহাজ আসা-যাওয়া করে ১ হাজার ৪৭টি। ২০১৫-১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩৯ টিইইউএস (জাহাজ এসেছে ১১৯৩টি)। আর ২০১৬-১৭ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৪ লাখ ১৯ হাজার ৪৮১টি টিইইউএস (জাহাজের সংখ্যা ১২৩০টি)। এর অর্থ কী? কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়ছে দিনে দিনে। সমুদ্রপথে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। এর মধ্যে আমদানি বাণিজ্যের প্রায় ৮৫ ভাগ ও রফতানি বাণিজ্যের ৮০ ভাগই পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। অথচ গত সাত বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন কোনো কনটেইনার টার্মিনাল ও ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়নি। অর্থাৎ পণ্য হ্যান্ডলিং বাড়লেও অবকাঠামো আগের জায়গাতেই রয়ে গেছে। তুলনামূলক বিচারে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা কম। ২০১৬-১৭ সালে মাত্র ৮৭টি বিদেশি জাহাজ এখানে ভিড়েছে (মোট জাহাজের সংখ্যা ৬২৩)। আর কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে মাত্র ৭৫.১১ লাখ টন (২০১৬-১৭)। এই বন্দরে নাব্য সঙ্কট রয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে ঝুঁকছেন চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে। মোদির ঢাকা সফরের পর ভারত কর্তৃক পাঠানো স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরে (এসওপি) বাংলাদেশের বন্দর সুবিধার আওতায় ‘অগ্রাধিকার’ ভিত্তিতে তাদের জাহাজ জেটি-বার্থে ভেড়ানো ও পণ্যসামগ্রী ট্রানজিট মজুতের জন্য ‘বিশেষায়িত’ ইয়ার্ড চাওয়া হয়েছে। এখন অব্দি ‘ফি’ও নির্ধারিত হয়নি। কেবিনেটের সিদ্ধান্তের আগেই ২০১৫ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় জাহাজ এমভি ইরাবতী স্টার ও এমভি ওশান গ্রুপ। এ সময় কোনো ধরনের ট্যারিফ, ফি, চার্জ, মাসুল কিংবা শুল্ক-কর পরিশোধ করা হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমাদের তাই সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা জরুরি। পায়রাতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে বটে, কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের ‘চাপ’ কমাতে হলে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। পায়রাতে একটি ভারতীয় কোম্পানি (আদানি গ্রুপ) গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। চীন এখন কোনো ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী। কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। চট্টগ্রাম বন্দর শুধু ভারত কেন, অদূর ভবিষ্যতে নেপাল-ভুটান, এমনকি চীনও ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই। বিষয়টি নিয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা প্রচুর। চীন এ অঞ্চলে হামবানতোতা ও কলম্বো (শ্রীলঙ্কা) এবং গাওদারে (পাকিস্তান) গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে মিয়ানমারের কাইয়াউক পিউতে ছয়টি চীনা কোম্পানি এখন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানির অভিজ্ঞতা কম। তারপরও চীন ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হতে পারে। এতে ভারত ও চীনের উভয়েরই লাভ।
বাংলাদেশ ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে কাজটি করা দরকার, তা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো।
Daily Bangladesher Khobor
 ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮
 

মির্জা ফখরুলের জাতিসংঘ দর্শন!


মির্জা ফখরুল জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। এটা কোনো ধরনের নালিশ জানাতে নয়, বরং তার মতে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি অবহিত করতেই তিনি জাতিসংঘের সহকারী সেত্রেুটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনকার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জাতিসংঘ কী স্ব-উদ্যোগে কোনো দেশের নির্বাচন করতে পারে? এটা সত্য জাতিসংঘের ‘ইলেকট্ররাল অ্যাসিসট্যান্স ডিভিশন (ইএডি)’ নামে একটি শাখা আছে। এটি ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই শাখা পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে নির্বাচন করে আসছে। এরা বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের আয়োজনের ক্ষেত্রে ‘টেকনিক্যাল সহযোগিতা’ দেয়, সেখানে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে, নির্বাচন যে ‘সুষ্ঠু’ হয়েছে তা ‘সার্টিফাই’ করে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এককভাবে, স্ব-উদ্যোগে ‘ইলেকট্ররাল অ্যাসিসট্যান্স ডিভিশন’ কোনো দেশে নির্বাচনের আয়োজন, পর্যবেক্ষণ বা নির্বাচন মনিটরিং করতে পারে না। শুধুমাত্র জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুমোদনই নয়, বরং ওই দেশের এবং বিবাদমান গোষ্ঠীরও অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। নেপালের দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারি।
২০০৬ সালের  নভেম্বরে নেপাল সরকার ও মাওবাদীর সাথে একটি শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয়। ওই সময় সরকার ও মাওবাদীরা জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানায় সেখানে সংবিধান প্রণয়নের জন্য যে সাংবিধানিক পরিষদ (সংসদ) গঠিত হবে, তা আয়োজন করে দেখার জন্য। জাতিসংঘ মিশন সেই কাজটি শুরু করে ২০০৭ সালে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে সেখানে সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের ‘ইলেক্ট্ররাল অ্যাসিসট্যান্স ডিভিশন’ তাদের লোকবল দিয়ে, পর্যবেক্ষণ দিয়ে এই নির্বাচনের কাজটি সম্পন্ন করে। কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধের পর জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল ১৯৯২-৯৩ সালে, সেখানে ওই সময় প্রায় ৪৬ দেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল (বাংলাদেশসহ)। এই কর্তৃপক্ষ সেখানে নির্বাচর্নে আয়োজন করেছিল। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে নির্বাচনে সহযোগিতা করেছিল জাতিসংঘ। গৃহযুদ্ধের পর নামিবিয়ায় (১৯৮৯-৯০) জাতিসংঘ একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন পরিচালনা করেছিল এবং সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশে জাতিসংঘের ‘ইলেক্ট্ররাল অ্যাসিসট্যান্স ডিভিশন’ (ইএডি) নির্বাচন পরিচালনা করেছে (দেখুন, টঘঙডঅঝ ঘবংি, ১৪ উবপবসনবৎ ২০১৭)। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে ওইসব দেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। ওইসব দেশে গৃহযুদ্ধ চলছি, তারপর বিবাদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সমঝোতা হয়। শান্তিচুক্তি হয় এবং জাতিসংঘ সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে এটা তো সত্য, অতীতে জাতিসংঘের ্উর্ধতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের উতপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সফর গেছেন। সরকার ও বিরোধী দলের সাথে কথাও বলেছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখনও মির্জা ফখরুল গেলেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাদের অবহিত করলেন। জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিরা এসব বিষয়ে অবগত নন? নিশ্চয়ই তারা জানেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে তাদের কিছু করার নেই। এটা ঠিক একটা নির্বাচনকালীন সরকারের কথা শুধু বিএনপিই বলছে না, বলতে গেলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বাদে প্রতিটি দলই একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট কিংবা ঐক্য প্রক্রিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর তিন মাস ছুটি’ শীর্ষক একটি ফর্মুলা মাঝেমধ্যে বলা হয়। কিন্তু এটাও অসম্পূর্ণ। তাহলে ওই সময় সরকার পরিচালনা করবে কে? উপরুন্তু সরকার একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান তাদের পক্ষে। সংবিধান তো প্র্রধানমন্ত্রীর ‘তিনমাস ছুটি’ অনুমোদন করে না! সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে। কিন্তু সরকার এই শেষ সময়ে এসে সংবিধান সংশোধন করবে, এটা মনে হয় না। তাহলে সমঝোতাটা হবে কীভাবে?
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় হয়ে গেছে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রচার বিষয়ক কর্মসূচি। তাতে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান। বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট ও যুক্তরাজ্যের হাই কমিশনার অ্যালিসন ব্লেইক। অনুষ্ঠানে এইচটি ইমাম বলেছেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই’। মঈন খান বলেছেন, ‘সুবিচার ছাড়া রাজনীতিতে শান্তি সম্ভব নয়’। বার্নিকাটের বক্তব্য, ‘গণতান্ত্রিক দেশে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ’। আর ব্লেইকের বক্তব্য ছিল এরকম, ‘নির্বাচন সহিংসতামুক্ত হওয়া প্রয়োজন’।
এসবই হচ্ছে আসল কথা। নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। এবং সবার কাছে  গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে আলোচনাটাই আসল। একটি সংলাপ প্রয়োজন। জাতিসংঘে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
Daily Amader Somoy.com
23.09.2018

কোরীয় উপদ্বীপে শান্তির সুবাতাস



কোরীয় উপদ্বীপে এখন শান্তির সুবাতাস বইছে। গেল জুন মাসে সিঙ্গাপুরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ঐতিহাসিক বৈঠকের পর ১৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া সফরে যান দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন। এ সফরে দুই কোরিয়া যে ক’টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তা এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী একটি শান্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সম্পর্কে পশ্চিমাবিশ্বে এক ধরনের ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল। কিম ক্ষ্যাপাটে, যুদ্ধবাজ বদরাগী, নিজের আত্মীয়স্বজনকে মেরে ফেলতে তিনি দ্বিধা করেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি এক ধরনের ‘ইমেজ’ সংকটে ভুগছিলেন। বলা হচ্ছিল, যে-কোনো সময় তিনি কোরীয় উপদ্বীপে ‘যুুদ্ধ’ বাধিয়ে ফেলতে পারেন! কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তার বৈঠক, উত্তর কোরিয়ার কয়েকটি পারমাণবিক উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ধ্বংস করে দিয়ে তিনি ‘শান্তির পক্ষে’ তার কমিটমেন্ট প্রকাশ করেছিলেন। এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেন। এ নিয়ে তিনি তিন-তিনবার দক্ষিণ কোরিয়ার নেতার সঙ্গে মিলিত হলেন। দুই কোরিয়ার শীর্ষ নেতাদের মধ্যকার বৈঠক শেষ অবধি কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি কতটুকু নিশ্চিত করবে, তা এই মুহূর্তে বলা না গেলেও, এটা বলাই যায়, একটা শুভ সূচনা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো।
দক্ষিণ কোরিয়ার নেতা মুন জায়ে ইনের পিয়ং ইয়ং সফরের সময় উত্তর কোরিয়া দেশটির প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা স্থাপনা বন্ধ করে দিতে সম্মত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কোরিয়া যুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সিউল সফরে যেতে রাজি হয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, উত্তর কোরিয়ার নেতা উনের সঙ্গে বৈঠকের পর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়া এক ধরনের নিরস্ত্রীকরণেই সম্মত হয়েছে। ২০৩২ সালে একসঙ্গে দুই কোরিয়া অলিম্পিক গেমসের আয়োজন করবে বলেও তারা জানান। দুই কোরিয়ার মধ্যে এ ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটি প্রশ্নকেই এখন সামনে নিয়ে এলো,  আর তা হচ্ছে দুই কোরিয়ার মধ্যে একত্রীকরণের সম্ভাবনা কতটুকু? দুই জার্মানি একত্রিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর। দুই কোরিয়া কি এখন সেদিকেই যাচ্ছে?
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই উত্তর কোরিয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে অষ্টম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয় কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা সম্ভব। এক পর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইতানস্থ (ুড়হমনুড়হ) পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমাবিশ্বের ধারণা, উত্তর কোরিয়া ছয়টি থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান ও সেখানে উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক গ্রাম পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলে ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে আর দুই কোরিয়ার নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশগত কারণে কোরিয়াকে দুইভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী ও অপর অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কম্পিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও দেখা গেল, নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে যায়। জাতিসংঘ এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় দুই বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এরপর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি বলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গেল  ৭০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে দুইবার, ১৯৯৪ সালে কিম উল মুংয়ের মৃত্যুর পর তার ছেলে কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন কিম জং ইল অসুস্থ ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ২০১১ সালে কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্বে আসেন। মাত্র ৩০ এর ঘরে তার বয়স। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তার অভিজ্ঞতা কম। গেল বছরের শেষের দিকে উত্তর কোরিয়া একের পর এক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এক পর্যায়ে কিম গুয়ামে মার্কিনি স্থাপনার ওপর পারমাণবিক হামলারও হুমকি দিয়েছিলেন। সেই অবস্থান থেকে জুনে কিম যখন সিঙ্গাপুরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন, সেটা ছিল একটা উল্লেখ করার মতো ঘটনা। অনেক পর্যবেক্ষকই এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে, উত্তর কোরিয়ার এ মনোভাব পরিবর্তনের ব্যাপারে চীনের একটা ভূমিকা ছিল। চীন হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার সামরিক ও আর্থিক ক্ষমতার উৎস। আন্তর্জাতিকভাবে উত্তর কোরিয়ার ওপর এখনও অর্থনৈতিক অবরোধ বজায় রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার জ্বালানির উৎস হচ্ছে চীন। উত্তর কোরিয়ায় প্রচ- জ্বালানি ও খাদ্য সংকট রয়েছে। এ সংকট মোকাবিলায় চীন উত্তর কোরিয়ার পাশে আছে। সুতরাং ট্রাম্পের  সঙ্গে বৈঠকের আগে কিম চীনে গিয়েছিলেন ‘পরামর্শ’ নিতে। এখন কিম দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যাচ্ছেন, সেখানেও চীনের সমর্থন রয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্নটিকেও এক পাশে ফেলে রাখা যাবে না। দক্ষিণ কোরিয়া তার দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে মার্কিনি ঞঐঅঅউ (ঞবৎসরহধষ ঐরময অষঃরঃঁফব অৎবধ উবভবহপব) ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। এ ক্ষেপণান্ত্র উত্তর কোরিয়া কর্তৃক নিক্ষেপিত যে-কোনো ক্ষেপণাস্ত্র মহাশূন্যে ধ্বংস করে দিতে পারবে। ফলে ওইসব ক্ষেপণাস্ত্র আর দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো হামলা চালাতে পারবে না। ঞঐঅঅউ ক্ষেপণাস্ত্র দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে বসানো হলেও এর খরচ কে বহন করবে, এটা নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের এক ধরনের মতানৈক্য চলে আসছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুক্তি যেহেতু এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দক্ষিণ কোরিয়ার স্বার্থে নেওয়া হয়েছে, সুতরাং দক্ষিণ কোরিয়াকেই এ অর্থ বহন করতে হবে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার নেতার আপত্তি ছিল তাতে। তারপরও সেখানে ঞঐঅঅউ ক্ষেপণাস্ত্র বসানো হয়েছে। এটা উত্তর কোরিয়ার ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ। ট্রাম্প-কিম বৈঠকের পর ঞঐঅঅউ ক্ষেপণাস্ত্র দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রতাহার করে নেওয়া হয়নি। এরপরও কিম যখন কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ নেন, তখন তার উদ্যোগকে স্বাগত জানাতেই হবে।
দুই কোরিয়া পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অনেক কিছুই এখন নির্ভর করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের উত্তর কোরিয়া সফরের সময় তিনি কিম জং উনের সঙ্গে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। সংবাদ সম্মেলনে মুন জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়া তাদের ইয়ংবিয়ানের পরমাণু ক্ষেত্র বন্ধ করে দিতে সম্মত হয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকেও যথাযথ সাড়া দিতে হবে। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। দুই কোরিয়ার সব ভালো ভালো উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে তাদের মনোভাবের পরিবর্তন না করে। উত্তর কোরিয়ার নেতা দ্বিতীয়বারের মতো ট্রাম্পের  সঙ্গে বৈঠকের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান। তার এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি ও খাদ্য সাহায্য দরকার। পশ্চিমা বিশ্বকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারও জরুরি। কোরীয় উপদ্বীপে যে শান্তির সুবাতাস বইছে, তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে পশ্চিমাবিশ্বকেও আজ এগিয়ে আসতে হবে।
Daily Alokito Bangladesh
 সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮
 

আইসিসিতে গণহত্যার বিচার স্রেব্রেনিচা থেকে রাখাইন


আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সম্প্রতি। আইসিসির (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১ গত ৬ সেপ্টেম্বর এক যুগান্তকারী রায়ে বলেছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বহিষ্কার করে বাংলাদেশে পাঠানোসহ অন্যান্য অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর অর্থাৎ রাখাইনে বসবাসরত মিয়ানমারের নাগরিকদের ওপর সংঘটিত ভয়াবহ সব অপরাধের বিচারের পথ উন্মুক্ত হলো। অনেকের মনে থাকার কথা—আইসিসির অন্যতম প্রসিকিউটর ফাতুউ বেনসউদা কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকার ও মিয়ানমার সরকারকে এ ব্যাপারে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ওই চিঠির জবাব দিলেও মিয়ানমার জানিয়ে দিয়েছিল তারা এই চিঠির জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। কেননা মিয়ানমার রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর করেনি। রোম স্ট্যাটিটিউটের ওপর ভিত্তি করেই আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষরদাতা দেশ। এখন রাখাইনে গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ প্রশস্ত হলো। আমরা যদি অতি সাম্প্রতিককালের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে স্রেব্রেনিচার গণহত্যার কথা অনেকের মনে থাকার কথা। স্রেব্রেনিচা বসনিয়া-হার্জেগোভিনার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ছোট্ট শহর, যার বেশির ভাগ নাগরিক ছিল মুসলমান। বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে রাটকো ম্লাদিকের নেতৃত্বাধীন ‘আর্মি অব রিপাবলিকা স্রাপসকা’ দুই মাস শহরটি ঘেরাও করে রেখেছিল। এরা ছিল সার্ব সম্প্রদায়ভুক্ত এবং মুসলমানবিরোধী। এরপর ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সেখানে গণহত্যা চালানো হয় এবং প্রায় আট হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল আর প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে সেখান থেকে উত্খাত করা হয়েছিল। আইসিসির বিচারে ‘বসনিয়ার কসাই’ হিসেবে পরিচিত রাটকো ম্লাদিকের বিচার হয়েছিল। ৩০ বছরের জেল হয়েছিল তাঁর। একই অপরাধে আজ মিয়ানমারের শীর্ষস্থানীয় জেনারেলরাও দায়ী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অপরাধের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা প্রতিটি ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; যেখানে রোম স্ট্যাটিটিউটের ৫ নম্বর ধারায় ‘অপরাধের’ কথা বলা হয়েছে। এই অপরাধগুলো পরে আবার ৬, ৭ ও ৮ নম্বর ধারায় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন—৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে Genocide বা জাতিগত গণহত্যার কথা। ৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে Crime against humanity  বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে War crime ও Crimes of aggression-এর কথা। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধ ও আগ্রাসন সংক্রান্ত অপরাধ। আইসিসির প্রসিকিউটররা যদি মনে করেন ৬, ৭ ও ৮ নম্বর ধারাবলে কোনো একটি দেশে, কোনো একটি বিশেষ শ্রেণি ‘অপরাধ’ সংঘটন করেছে, তাহলে তাদের শাস্তির আওতায় এনে বিচার করতে হবে। সার্বিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা রাদোভান কারাদিচ, লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেইলর, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বসির, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা (অভিযোগ পরে প্রত্যাহার) সবার বিচার হয়েছিল ওপরে উল্লিখিত ধারাবলে। ৬ নম্বর ধারায় Genocide বা গণহত্যার ক্ষেত্রে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে হত্যা, তাদের মানসিক কষ্ট দেওয়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই জনগোষ্ঠীর লোকদের উচ্ছেদ, পরিকল্পিতভাবে এই জনগোষ্ঠীর জন্মহার নিয়ন্ত্রণ, শিশুদের অন্যত্র স্থানান্তর ইদ্যাদি। ৭ নম্বর ধারায় ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’-এ যেসব ‘অপরাধ’ ও অপরাধের ধরন উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে খুন (Murder), পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করা বা বিনাশ সাধন (Extermination), দাসত্ব (Enslavement), জোরপূর্বক বিতাড়ন (Deportation), অত্যাচার (Torture), ধর্ষণ (Rape), যৌন দাসত্ব (Sexual Slavery), বর্ণবাদী নীতি (Apartheid) ইত্যাদি। ‘যুদ্ধাপরাধ’ (৮ নম্বর ধারা) ধারায় যেসব অপরাধের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সুপরিকল্পিত হত্যা (Willful Killing), অত্যাচার (Torture), অমানবিক আচরণ (Inhumane treatment), বিচার অস্বীকার করা (Denying a fair trail), আইন বহির্ভূতভাবে বিতাড়ন (Unlawful deportation), সম্পত্তি ধ্বংস করা (Destruction of Property) ইত্যাদি। এখন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিবেদনের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে তারা মিয়ানমারে তাতমাদোররা (মিয়ানমার সেনাবাহিনীর স্থানীয় নাম) যেসব ‘অপরাধ’ সংঘটিত করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেসব ‘অপরাধ’ আইসিসি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেমন—প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নির্বিচারে হত্যা, নারীদের গণধর্ষণ, শিশুদের হত্যা এবং পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে কখনোই সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করা যায় না। হত্যা, ধর্ষণ, শিশু হত্যা, রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রাম থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদি ‘অপরাধ’ আইসিসির ৬, ৭ ও ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষস্থানীয় জেনারেলদের অভিযুক্ত করে তাঁদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর সুপারিশ করেছে ওই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। প্রশ্নটা এখানেই। নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের বিচারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আইসিসি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বিচার নিশ্চিত করতে পারবে কি? এরই মধ্যে মিয়ানমার সরকার আইসিসির এই উদ্যোগকে নাকচ করে দিয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট বিচারের এখতিয়ার আইসিসির নেই বলে অভিমত দিয়েছেন। অতীতে আমরা দেখেছি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এ ধরনের একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাবেক যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, কেনিয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল। গত ২৯ আগস্ট সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসসহ আরো কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গাদের গণহত্যার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় জেনারেলদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। এখন আদালতের এই রায়ের ফলে বিচারের পথ প্রশস্ত হলো। এর আগেও মিয়ানমার জানিয়েছিল আইসিসির কোনো অধিকার নেই মিয়ানমারের নাগরিকদের বিচার করার। এখন আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১ যে রায় দিয়েছে, তাতে বিচারকরা বলেছেন, তাঁরা রাখাইনে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার বিচার করার ক্ষমতা রাখেন। এখানে বলা ভালো, বিশ্বের ১৩৯টি দেশ রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর করেছিল। এবং ১১৮টি দেশ এরই মধ্যে তা অনুমোদনও করেছে। বাংলাদেশ রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষরকারী দেশ ও এরই মধ্যে আমরা এটি অনুমোদনও করেছি। কিন্তু বড় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, এমনকি ভারতও রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর করেনি। এটি ১৯৯৮ সালের ১২ জুলাই গ্রহণ করা হয়েছিল এবং ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। সুদান রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু দারফুরের গণহত্যার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বসিরের বিচার করেছিল আইসিসি। কিন্তু আইসিসি কখনোই ওমর আল বসিরকে বিচারের জন্য হেগের ডিটেনশন সেন্টারে রাখতে পারেনি। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্র অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইসিসির আদালতের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু সুদান সেটা করেনি। ফলে ওমর আল বসিরের বিচার হলেও তিনি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করাও সম্ভব হয়নি। তবে স্রেব্রেনিচা গণহত্যার জন্য আদালত যখন বসে তখন সার্বিয়া (যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটিয়ে সার্বিয়া হিসেবে দেশটি আত্মপ্রকাশ করে) বসনিয়ার কসাই রাটকো ম্লাদিককে আদালতের হাতে তুলে দিয়েছিল।
আইসিসি বর্তমানে বুরুন্ডি, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, আইভরি কোস্ট, দারফুর, কঙ্গো, জর্জিয়া, কেনিয়া, লিবিয়া, মালি ও উগান্ডায় যে ধরনের যুদ্ধাপরাধ হয়েছে তার বিচার করছে। এর বাইরে আফগানিস্তান, কলম্বো, গ্যাবন, গিয়েনা, ইরাক, নাইজেরিয়া, ফিলিস্তিন, ফিলিপাইন, কমোবোস, গ্রিস, কম্বোডিয়া, ইউক্রেন ও ভেনিজুয়েলায় যেসব ‘অপরাধ’ সংঘটিত হয়েছে তার তদন্ত করছে। কোর্ট এরই মধ্যে ৪২ ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, যাদের সবাই একেকজন যুদ্ধবাজ নেতা। বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে আফ্রিকায় জাতিগত দ্বন্দ্বের রেশ ধরে এসব যুদ্ধবাজ নেতা যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছেন। কোর্টের (হেগে) ডিটেনশন সেন্টারে আটজন যুদ্ধবাজ নেতা বিচারের অপেক্ষায় আছেন। ১২ জন যুদ্ধবাজ নেতা, যাঁদের শাস্তি হয়েছে তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিছু রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছিল। যেমন—কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তা। তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ছিল। তাঁকে বিচারের জন্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে ডাকাও হয়েছিল। কিন্তু তিনি আসেননি। পরে তদন্তের পর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
আইসিসি কোনো যুদ্ধবাজের বিরুদ্ধে বিচারের সিদ্ধান্ত নিলে ১০টি স্টেজে এই বিচারকার্য সম্পন্ন হয়। ১৮ বছরের নিচে বয়সের কোনো অপরাধীর আইসিসি বিচার করে না। প্রথমে অনুসন্ধান চালানো হয়, প্রসিকিউটররা প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। যিনি অভিযুক্ত, তাঁকে নির্দোষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং একমাত্র সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলেই তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়। একমাত্র প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযুক্ত হলেই বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। প্রাথমিক বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেও দোষী ব্যক্তি আপিল করার সুযোগ পান। ফলে একজনকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে বিচার করা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন আইসিসি মিয়ানমারের যুদ্ধাপরাধের বিচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে না। পাঁচ-ছয়জন শীর্ষস্থানীয় জেনারেল এরই মধ্যে অভিযুক্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রধান ও মিয়ানমারের অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি সিনিয়র জেনারেল মিন আউং সাইয়ংও রয়েছেন। ২০১৭ সালের মার্চে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রাখাইনে গণহত্যার বিষয়টি তলিয়ে দেখার জন্য ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মারজুকি দারুসমানের নেতৃত্বে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করেছিল। কমিটি গত ২৬ আগস্ট জেনেভায় তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটি জেনারেল সাইয়ংকে পদত্যাগেরও আহ্বান জানায়। কমিটি অলিখিত সরকার প্রধান অং সান সু চিকেও তিরস্কার করে। এখন অভিযুক্ত জেনারেলদের আইসিসির বিচারের মুখোমুখি কতটুকু করা যাবে, সে প্রশ্ন থাকলই। উপরন্তু মিয়ানমার আইসিসির তদন্তদলকে মিয়ানমারের রাখাইনে যেতে দেবে কি না কিংবা রাখাইনে ২৫ আগস্টের (২০১৭) সহিংসতার প্রমাণ সেখানে কতটুকু দেখতে পাবে, সে প্রশ্ন আছে। ফলে যুদ্ধবাজদের বিচার শেষ পর্যন্ত হবে—তাতে আমি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছি না। ভুলে গেলে চলবে না, মিয়ানমার হচ্ছে সেই দেশ, যে দেশটি একসময় জাতিসংঘ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল; যদিও আইসিসি জাতিসংঘের কোনো অঙ্গসংগঠন নয়। মিয়ানমার রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রশ্নে আইসিসিকে সহযোগিতা না-ও করতে পারে। এর পরও আইসিসির সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট।
Daily Kaler Kontho
20.09.2018

সড়ক নিরাপত্তা আইন ও বাস্তবতা

গত বৃহস্পতিবার সড়ক নিরাপত্তা আইনটি সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিলটি সংসদে উত্থাপন করলে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। সংসদে এই বিলটি উত্থাপন হলো এমন একটি সময়ে যখন এই সেপ্টেম্বর মাসেই ডিএমপির উদ্যোগে ঢাকায় ‘সড়ক সচেতনতা মাস’ পালিত হচ্ছে। এমনি একসময় সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৮ সংসদে উত্থাপিত হলো। গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে এসেছিলেন। বেশ কয়েক দিন তারা রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিলেন। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আর সে কারণেই খুব দ্রুততার সঙ্গে আইনটি তৈরি হয়, কেবিনেটে অনুমোদিত হয় এবং শেষ অব্দি তা সংসদে উত্থাপিত হয়। এখন আইনটি পাস হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু যে প্রশ্নটি অনেকেই করেন তা হচ্ছে- এই আইন সড়কে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করবে? ডিএমপির কমিশনার সেপ্টেম্বর মাসকে ট্রাফিক সচেতনতা মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তার নির্দেশনা কি শতকরা একশ ভাগ পলিত হচ্ছে? তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, সড়কে লেগুনা চলবে না। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। ভেতরে, লেনে এগুলো চলুক। কিন্তু আমি দেখলাম ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশ উপেক্ষা করে লেগুনা কোনো কোনো সড়কে চলছে! এরা এই সাহসটি পায় কোথায়? সড়কে এখন দেখি প্রকাশ্যেই রিকশা চলছে। রিকশা চালকরা সড়কে এসে স্ট্যান্ড বানিয়ে ফেলছে! কমিশনার সাহেব কি রিকশা চালানোর এই নির্দেশ দিয়েছেন? তিনি যদি নির্দেশ দিয়ে না থাকেন, তাহলে কার নির্দেশে সড়কে রিকশা চলছে? অবৈধ রিকশা উচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তা কি তিনি উপলব্ধি করেন? যানজটের জন্য পথচারীরাও দায়ী। তারা আইন মানেন না। ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক প্রশাসন যদি শক্ত না হয়, তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা আনা যাবে না। ডিএমপির উদ্যোগকে আমি প্রশংসা করি, কিন্তু কোথায় যেন শৈথিল্য আছে। ঢাকার ফার্মগেট ব্যস্ততম এলাকার একটি। এখানে রাস্তার পাশে বাজার বসে কীভাবে? এটা কি আইনে অনুমোদিত? রাত ৮টার মধ্যে শেরেবাংলা নগরে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের আশপাশের এলাকা শ্যামলী কল্যাণপুরে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে শত শত দূরপাল্লার বাস। কার অনুমতিতে এ বাসগুলো রাস্তায় থাকে? ডিএমপি কমিশনার কি এসবের অনুমতি দিয়েছেন? এটা তো ‘নিরাপত্তা এলাকা’। এখানে বাস থাকে কীভাবে? এই সেপ্টেম্বর মাসে এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানা জরুরি।
বড় প্রশ্ন এখন, প্রস্তাবিত সড়ক আইন আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কি? ‘গরু-ছাগল চিহ্নিত করতে পারা’ চালকদের অষ্টম শ্রেণি পাস ও সহকারীর পঞ্চম শ্রেণি পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সমস্যা হবে অনেকগুলো। ভুয়া অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেটে সয়লাব হয়ে যাবে দেশ। নীলক্ষেতের বাকুশা মার্কেট এখন পরিণত হবে ‘সার্টিফিকেট উৎপাদন’ কেন্দ্রে! এটা আমরা নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে? এখানে একটা ‘ক্লজ’ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে এবং ভুল তথ্যের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। সহকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এই সহকারীরাই পরে বাসচালক হয়। তাহলে? ওই পঞ্চম শ্রেণি ‘পাস’ নিয়েই তো সে বাস চালক হচ্ছে! এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ জরুরি। প্রতিটি চালককে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এর ব্যবস্থা করবেন মালিকরা। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করতে হবে প্রতিটি উপজেলায়। প্রতিটি উপজেলায় যে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, তা ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সার্টিফিকেট ছাড়া কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। এজন্য মালিক ও ড্রাইভারের শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বেসরকারি সংস্থাকে প্রয়োজনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ঢাকার বিআরটিএ নিয়ে অভিযোগ স্বয়ং যোগাযোগ মন্ত্রীর। এলাকা ভিত্তিতে ঢাকায় আরো ন্যূনতম ১০টি বিআরটিএর শাখা গঠন করা প্রয়োজন। এটা যুগের চাহিদা। ফিটনেস মেশিনের পরিবর্তে ব্যক্তিনির্ভর। যেখানে ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা থাকে, সেখানে দুর্নীতি হবেই! সুতরাং গাড়ির ফিটনেস মেশিন দিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
প্রস্তাবিত সড়ক আইনের একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে এর শাস্তির বিধান। বলা হয়েছে, ‘দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত বা প্রাণহানি ঘটলে, এ সংক্রান্ত অপরাধ পেনাল কোডের ৩০২, ৩০৪ ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যেকোনো দুর্ঘটনায় ‘অপরাধ’ সংঘটিত হয়েছে কি না, তা কে নির্ধারণ করবে? কোন প্রক্রিয়ায় তা নির্ধারিত হবে? একজন পুলিশ পরিদর্শক যখন এর ‘তদন্ত’ করবেন, তার ওপর কি আস্থা রাখা যাবে? তাই দুর্ঘটনায় হত্যাকাণ্ডে আদৌ কোনো চালককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া যাবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর (আগে ছিল তিন বছর) করা হয়েছে। এটা যথেষ্ট নয়। তার লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মিম ও রাজীবের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। নিহতদের পরিবারকে এই অর্থ সাহায্য করবে সন্দেহ নেই, কিন্তু যা প্রয়োজন ছিল তা হচ্ছে মালিকদের বাধ্য করা এ টাকা দিতে। চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, চালকদের নিয়োগপত্র দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। কিন্তু আমরা দেখলাম গাড়িগুলো চলছে আগের মতোই। রুটে গাড়িপ্রতি মালিকরা অর্থ নির্ধারণ করে দেন। এটা বন্ধ না হলে প্রতিযোগিতা থাকবেই। একটি শক্তিশালী চক্র এই পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার অসহায়। এরাই মালিক। এরাই আবার শ্রমিক। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা এরা চাঁদা তোলে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা এর সঙ্গে জড়িত। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে (যা আন্দোলনকে উেক দিয়েছিল) তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। হয়ত আগামী দিনে প্রমাণিত হবে ওই মন্ত্রী সরকারের জন্য ‘বোঝা’ না আশীর্বাদ। মানুষ এটা বোঝে- একসঙ্গে মালিক ও শ্রমিক নেতা হওয়া যায় না। শ্রমিক নেতা, আবার  মন্ত্রীও- এটা বোধকরি বাংলাদেশেই সম্ভব!
ছোট্ট শিশু আকিফার ‘ঘটনা’ নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের সবার। মায়ের কোলেও নিরাপদ ছিল না আকিফা। জীবনটা শুরু করার আগেই তার পরিসমাপ্তি ঘটল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, গ্রেফতারকৃত মালিক ও চালককে আদালত জামিন দিলেন! যদিও পরবর্তী সময়ে গাড়িচালককে আবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু মালিক সম্ভবত এখনো দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হননি! ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গেছে, চালক বাস অতিক্রম করা মায়ের কোলে আকিফাকে দেখেও বাসটি তাদের ওপর উঠিয়ে দিয়েছে। এটা তো পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। এখন পেনাল কোডের ৩০২ ও ৩০৪ ধারা কতটুকু প্রয়োগ হবে? যে পুলিশ পরিদর্শক এই মামলা এখন অনুসন্ধান করবেন, তিনি কি ‘অপরাধ’ সংঘটিত হয়েছে বলে নিশ্চিত হতে পারবেন? এখানে ‘তদবিরে’র বিষয়টি আমরা যেন ভুলে না যাই। মিম ও রাজীবের হত্যাকাণ্ড ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। মিডিয়া সচেতন ছিল। ওই ‘হত্যাকাণ্ড’ একটি গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু শিশু আকিফার ‘হত্যাকাণ্ড’ ঘটে কুষ্টিয়ায়। একটি শিশুর ‘হত্যাকাণ্ড’ যেভাবে আলোচিত হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। কুষ্টিয়ার একজন মন্ত্রী আছেন। তিনি আদৌ কোনো সমবেদনা জানিয়েছিলেন বলে আমার মনে পড়ে না।
এই সমাজ, এই জাতি ‘জিম্মি’ হয়ে পড়েছে একশ্রেণির পরিবহন মাস্তানদের কাছে। সড়কে মৃত্যু যেন স্বাভাবিক ঘটনা। ছোট্ট শিশু আকিফার বেঁচে থাকারও নিশ্চয়তা দিতে পারছে না এই সমাজ। আমরা কত অসহায়! স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন। সেটা ছিল ১৯৭৪ সালের কথা। আজ নির্মল সেন বেঁচে থাকলে কী লিখতেন তিনি? ‘পরিবহন মাস্তানমুক্ত’ বাংলাদেশ? পরিবহন মাস্তানদের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। এরপর পরিবহন শ্রমিকরা শহীদ মিনারে মিছিল করে মামুন ভাইয়ের ছবিতে জুতো মেরে মেরে মিছিল করেছিল। সেই সংবাদ পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। এরপর মুনতাসীর মামুন আর পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে লেখেননি।
আমাকে ক্ষমা করবেন ডিএমপি কমিশনার। আপনি অনেক ভালো ভালো কথা বলেন। শুদ্ধভাষায় কথা বলেন, যা অনেক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাও পারেন না। আপনি অবসরে যাবেন আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে। আপনি পদোন্নতি পেয়েছেন। এই জাতি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে যদি ‘বিদায়ে’র আগে আপনি যে সাত দফা দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। কিন্তু আমি জানি, আপনিও ব্যর্থ হবেন! মিম ও রাজীবের ‘হত্যাকাণ্ডের’ পর সমাজ জেগে উঠেছিল, কিন্তু সড়কে বিশৃঙ্খলা যা ছিল, তা-ই আছে। এখন সড়ক নিরাপত্তা আইন সংসদেও পাস হবে। কিন্তু এতে করে মিম, রাজীব কিংবা আকিফাদের জীবনের নিরাপত্তা কি নিশ্চিত হবে? বাসচালকরা এখনো ‘ট্রিপ’ অনুযায়ী বাস চালান। এখনো বাসচালকরা যত্রতত্র যাত্রী ওঠান। আইন হবে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ হবে কি? চালকদের কাছ থেকে যারা চাঁদা ওঠান, তা বন্ধ হবে কি? বলা হয়েছে মহাসড়কে ছোট ছোট যান চলাচল করবে না। কিন্তু চলছে এখনো। একজন প্রতিমন্ত্রী বাসে যাত্রী হয়ে অফিসে গেছেন। তার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এটা কি নিছক মিডিয়াকে দেখানোর জন্য? আমরা ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেখতে চাই, ওই প্রতিমন্ত্রী নিয়মিত বাসে টিকেট কেটে অফিস করেন। যদি তিনি এটি করেন, আমার সশ্রদ্ধ সালাম তাকে। মাঝেমধ্যে সেতুমন্ত্রী যদি এভাবে বাসযাত্রী হন, তাহলে বাসচালকরা ভয় পাবে। সচেতনতা বাড়বে।
২২ সেপ্টেম্বর একটি সংবাদপত্র প্রথম পাতায় একটি ছবি ছেপেছে। দুটি বাসের প্রতিযোগিতার ছবি! ট্রফিক পুলিশ দিয়ে এসব নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। পুলিশ সব জায়গায় যেতে পারে না, যায়ও না। এসব মানসিকতার ব্যাপার। এত কিছুর পরও চালকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি এতটুকুও। চালকরা কাউকেই ভয় পায় না। তাই ট্রাফিক সচেতনতা মাস পালন করে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারব না। শুধু বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের, যারা স্কাউট কিংবা গার্লস গাইডের সদস্য তাদের রাস্তায় নামিয়ে ট্রাফিক সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করা, তাদের কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। চালকরা, সাধারণ পথচারীরাও তাদের গ্রাহ্যের মধ্যে নিচ্ছে না। আইনের কঠোর প্রয়োগ, দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা, ৩০২ ধারায় মানুষ হত্যাকারী চালকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, যেকোনো দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা, পথচারী পারাপারে সড়কের ডিভাইডারে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সড়ক নিরাপত্তা আইনে কিছু কিছু ত্রুটি রয়েছে। এটা নিয়ে সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হোক- আমরা এমনটিই চাই
Bangladesher Khobor
18.09.2018

ইদলিবে বিদ্রোহীদের পতন কি আসন্ন?



সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটিটি রয়েছে ইদলিবে। ইদলিব শহরটি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। আলেপ্পো থেকে ৫৯ কিলোমিটার দূরে। সিরিয়ায় একে একে যখন বিদ্রোহী বাহিনীর পরাজয় ঘটছে এবং আসাদ সরকার কর্তৃক যখন সিরিয়ায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন আসাদবিরোধী বিদ্রোহীরা এ ছোট্ট শহরটি অনেক দিন ধরেই ধরে রেখেছিল। সিরিয়ায় আরব বসন্তের ঢেউ এসে যখন লাগল, তখন ২০১১ সালে ইদলিবে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছিল। ওই সময় বারবার ইদলিবের ঘটনা, যা কিনা সামরিক সংঘর্ষের রূপ নিয়েছিল। ২০১১ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শহর ও শহরের আশপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণভার চলে যায় বিদ্রোহীদের হাতে। ২০১২ সালে সরকারি বাহিনী এটা দখল করে নেয়। ২০১৫ সালের মার্চে বিদ্রোহী বাহিনীর বড় জয় আসে। নূসরা ফ্রন্ট ও আহরার আল শাম বিদ্রোহী গ্রুপের নেতৃত্বে একটি যৌথ বাহিনী ইদলিব দখল করে নেয় এবং সেখানে বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে একটি ‘স্থানীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। একসময় আসাদবিরোধী একটি অভ্যন্তরীণ সরকারের হেডকোয়ার্টারও এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে ইদলিব বারবার আলোচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ লেগে ছিল। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নূসরা ফ্রন্টকে বিলুপ্ত করে তাহরির আল শাম নামে আরও একটি বিদ্রোহী গ্রুপের জন্ম হয়। এই গ্রুপটি ইদলিব ও এর আশপাশের এলাকা থেকে অপর বিদ্রোহী গ্রুপ আহরার আল শামকে উৎখাত করে। এখন আসাদ সরকার ইদলিবে অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নিচ্ছে। এদের সহযোগিতা করছে রাশিয়া। অপরদিকে বিদ্রোহী গ্রুপ সহায়তা পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে ইদলিবকে কেন্দ্র করে একটি ‘ছায়াযুদ্ধের’ জন্ম হতে যাচ্ছে। দুই বড় শক্তির পাশাপাশি তুরস্কও ‘সিরিয়া যুদ্ধে’ নিজেদের জড়িত করেছিল। তুরস্ক কুর্দি শহর আফরিন দখল করে নিয়েছিল। অথচ কুর্দিরা সাহায্য পেত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে তুরস্ক-রাশিয়া-ইরান ঐক্য গড়ে ওঠে। অথচ তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। তুরস্কে সম্প্রতি যেসব সন্ত্রাসী কর্মকা- হয়েছে, তা কুর্দি বিদ্রোহীদের কাজ বলে তুরস্কের অভিযোগ। কিন্তু সমস্যা ছিল কুর্দি অঞ্চল মানবিজকে নিয়ে। মানবিজ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি শহর। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থান রয়েছে, যারা সেখানে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কর্মরত রয়েছে। তুরস্ক মানবিজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ ভোগেল সিএনএনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা করছেন না। তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন, পেন্টাগন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সকে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এ ফোর্স তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আফরিন শহর মুক্ত করার জন্য ‘যুদ্ধ’ করছে। ফলে সিরিয়া সংকট নতুন একটি মোড় নিয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে আফরিন অঞ্চল থেকে কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজি উচ্ছেদ হলেও তারা পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও বিস্মিত করবে। জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে যে শান্তি আলোচনা চলে আসছিল, তা কোনো ফল বয়ে আনতে পারছিল না। অন্যদিকে রাশিয়ার সোচিতে যে বিকল্প শান্তি আলোচনা চলছিল, তাতেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ২৯ জানুয়ারি সোচিতে যে শান্তি আলোচনা আহ্বান করা হয়েছিল, সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ তাতে যোগ না দেওয়ায় কার্যত সেই উদ্যোগও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে এ প্রশ্ন সংগত কারণেই উঠবে যে, সিরিয়ার রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা কাটবে কি? সিরিয়া থেকে আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী একরকম উচ্ছেদ হয়েছে। বিশেষ করে বছর দু-এক আগে মার্কিন ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর আইএস সিরিয়ায় দুর্বল হয়ে যায়। তারা ২০১৪ সালের পর থেকে যেসব এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল এবং যেসব এলাকায় তারা তথাকথিত একটি ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ওই বিমান হামলায় তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং আইএস সিরিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাশিয়ার বিমান হামলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে, রাশিয়ার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে আসাদবিরোধী বেশকিছু বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা আইএসের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আফরিনে তুরস্ক সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। তুরস্ক তার সামরিক আগ্রাসনের জন্য যুক্তি দেখিয়েছে। তুরস্ক বলছে, তারা শহরটিকে সন্ত্রাসীদের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবে না। এই সামরিক আগ্রাসনের ঘটনা ন্যাটোভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে একধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের একদিন আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দিদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতৃত্বেই এ পরিকল্পনা করে। পিকেকে তুরস্কে নিষিদ্ধ। ওয়াইপিজি হচ্ছে পিকেকের সামরিক শাখা। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় তুরস্কের অভ্যন্তরে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে পিকেকের হাত রয়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করেছিল। আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযান সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এ হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গেল অক্টোবরে (২০১৭) সিরিয়ার রাকা শহর থেকে আইএসকে উৎখাতে ওয়াইপিজির সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকে ভালো চোখে নেয়নি। তুরস্কের ভয় ছিল কুর্দি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ নিয়ে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে! সিরিয়ার কুর্দিরা বেশিরভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পিকেকের সশস্ত্র শাখা ওয়াইপিজি বা পিপলস ডিফেনস ইউনিট (ণচএ) ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব পাড়ের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই তুরস্ক এক ধরনের অস্বস্তিতে ছিল। বলা ভালো, ১৯৮৪ সাল থেকেই পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অনেকের স্মরণ থাকার কথা, কুর্দি শহর কোবানিকে আইএসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য যদি আমরা সত্য বলে ধরে নিই, তাহলে এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি আরও অনেক দিনের জন্য রাখতে চায়। তারা আরও সিরিয়ায় ২ হাজার সামরিক উপদেষ্টা সেখানে পাঠাতে চায়! আর তাই তারা ব্যবহার করতে চায় ওয়াইপিজিকে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানে। তুরস্কের এটা পছন্দ নয়। ওয়াইপিজি যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা দেশটির (তুরস্ক) সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। একসময় ওয়াইপিজির  সঙ্গে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার উপদেষ্টারা আফরিনে ওয়াইপিজির পক্ষে কাজ করত। কিন্তু ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের  সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করায় রাশিয়া কুর্দিদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না। এখানে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা লক্ষ করার মতো। সিরিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্পষ্টই দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে, রাশিয়ার কারণে আসাদ সরকার টিকে গেল। এখানে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটি পক্ষ। আর যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিরুদ্ধে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই রাশিয়া-ইরান-সিরিয়ার শিবিরে অবস্থান করছে।
তাহলে সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কোন পথে?
আপাতত সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী নয়া স্নায়ুযুদ্ধের যে সূচনা হয়েছে, তার প্রভাব এখানেও পড়েছে। রাশিয়ার যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে সিরিয়ায়। সিরিয়ার পোর্ট আর বিমানঘাঁটি ব্যবহার করছে রাশিয়া। সীমিত আকারে রাশিয়ার সেনাসদস্যরাও সেখানে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্যরাও ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে সিরিয়ার একটি অঞ্চলে কর্মরত। তুরস্কের সেনাবাহিনী সিরিয়ার ভেতরেই অবস্থান করছে। এদিকে ইসরাইলি বিমানবাহিনী সিরিয়ার একটি বিমানঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়েছিল। এ হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের যে সমর্থন রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। এর অর্থ হচ্ছে, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবেই হোক ইসরাইল সিরীয় সংকটের একটা অংশ হয়ে গেল। তাই আপাতদৃষ্টিতে সিরিয়া সংকটের সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এমনি এক পরিস্থিতিতে ইদলিবকে নিয়ে দুই বৃহৎ শক্তির মাঝে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটেছে। গেল সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইদলিব আক্রমণ না করার জন্য রাশিয়া ও সিরিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ট্রাম্প উগ্র কনজারভেটিভদের কাছ থেকে সিরিয়ায় সরাসরি আক্রমণ চালানোর জন্য এক ধরনের ‘চাপ’ এর মুখে আছেন। তথাকথিত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে। এখন যে-কোনো  মাকিনি আগ্রাসন রাশিয়াকে সিরিয়ায় সাময়িকভাবে জড়িয়ে যেতে উৎসাহ জোগাবে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে যে ‘ছায়াযুদ্ধ’ চলছে, তা শেষ পর্যন্ত দুটি বড় শক্তিকে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে উৎসাহ জোগায় কি না সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Alokito Bangladesh
16.09.2018

একটি আত্মহত্যা ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন

ভাগের ভালো ছাত্র হয়েও অনেকে বিভাগের শিক্ষক হতে পারছেন না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। টাকার জোর এখানে বড়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্যরা বাদ পড়ছেন। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে রাজনীতি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একজন দেবাশীষ মণ্ডলের আত্মহত্যার কথা। তার আত্মহত্যার খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এই আত্মহত্যা কতগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে, যা আমাদের ভাবায়। দেবাশীষ মণ্ডল সাধারণ একজন নাগরিক নন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক। সদ্য প্রতিষ্ঠিত কুষ্টিয়ার রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। তিনি প্রভাষক হিসেবে আবেদন করেছিলেন তার নিজ বিশ্ববিদ্যালয় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু চাকরির শর্ত হিসেবে তার কাছে চাওয়া হয়েছিল ১৫ লাখ টাকা। সে টাকা তিনি জোগাড়ও করেছিলেন। ১২ মে তিনি সেখানে মৌখিক পরীক্ষায় অংশও নেন। কিন্তু যখন জানতে পারেন ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার ভায়েরার সেখানে চাকরি হয়েছে তার চাইতে অনেক কম যোগ্যতা সত্ত্ব্বেও, তখন ১৪ মে দেবাশীষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। দেবাশীষ অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এ ধরনের ঘটনা এখন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটছে। টিআইবি আইনি তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কীভাবে অর্থের বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে! আমার ধারণা ছিল, দুদক টিআইবির সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে পারে। কিন্তু দুদক তা করেনি। ফলে এই প্রবণতা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকরা জানেন বিষয়টি। এই প্রবণতা যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে দক্ষ শিক্ষকের অভাবে আমরা বিশাল জনগোষ্ঠীকে কখনোই দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব না। এ জন্য আমার আবারো সুপারিশ, শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি মঞ্জুরি কমিশনের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। অথবা পিএসসির মডেলে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। এটা খুবই জরুরি। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা যদি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকরা হবেন না কেন? একসময় এর প্রয়োজনীয়তা ছিল না, এটা সত্যি। কিন্তু এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক, প্রায় ৩৬ থেকে ৩৭টি। নতুন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ও হতে যাচ্ছে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার প্রশ্ন যখন জড়িত, তখন প্রয়োজন যোগ্য শিক্ষকের। ব্যক্তি পরিচয়, সম্পর্ক, রাজনৈতিক পরিচয় শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড হতে পারে না। বিশেষায়িত শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। বিবিএ আর এমবিএ’র ‘মাকাল ফল’ আমাদের উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা সার্টিফিকেটসর্বস্ব বিবিএ গ্র্যাজুয়েটের নামে শিক্ষিত কেরানি তৈরি করছি। ‘স্যুটেড-বু্যুটেড’ হয়ে এসব অর্ধশিক্ষিত তরুণ কোনোক্রমে বাবার কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে একখানা বিবিএ’র সার্টিফিকেট নিচ্ছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবলিকসহ) একাধিক নামের এমবিএ কোর্স আছে। যিনি কোনোদিন নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা বলে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি, তিনি অর্থের বিনিময়ে আবার ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সার্টিফিকেট কিনছেন! একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ধরনের শিক্ষা চলতে পারে না। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববাজারে যেসব শিক্ষকের চাহিদা রয়েছে (আইটির বিভিন্ন শাখা, নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, কৃষি ইত্যাদি), সেসব বিষয় চালু করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে একটি কমিশন গঠন করারও প্রস্তাব করছি।
আমাদের অনেক সিনিয়র শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পরও ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী থাকেন। তাদের স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা যেতে পারে। এতে করে নতুন প্রজন্ম তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে। বিশেষ করে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে এদের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বিশ্ববিদ্যালগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট আর পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটের মান এক নয়। ফলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার মানের উন্নতি করতে পারে। এক্ষেত্রে একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামো ভেঙে সাতটি বিভাগে সাতটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা প্রয়োজন। প্রতিটি বিভাগে অন্তর্ভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি কলেজগুলোকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এরা নিজেরাই সিলেবাস প্রণয়ন করবেন। নিজেরা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামো শিক্ষিত বেকার তৈরি করছে। একটি সার্টিফিকেটসর্বস্ব জাতিতে পরিণত করছে। মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিবেচনায় এখানে নিয়োগ হচ্ছে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্যরা ব্যস্ত থাকেন সরকারের তোষামোদে। পত্রিকায় রাজনৈতিক কলাম লিখে তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ আদায় করছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অনিয়ম হচ্ছে, তা তারা দেখছেন না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়েও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন একশ অতিক্রম করেছে। এটা ভালো কি মন্দ, আমি সেই বিতর্কে যাব না। এরা জনশক্তি গড়তে একটা ভূমিকা রাখছে, এটা অস্বীকার করি না। তবে এক্ষেত্রে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় দক্ষ জনবল নিয়োগ। আধুনিক উপযোগী বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন। ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা না করা। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল নিজেদের স্বার্থেই করা দরকার। প্রয়োজন ভালো ও সিনিয়র শিক্ষক নিয়োগ। সেই সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভাল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড ও সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আলাদা একটি ইউজিসি টাইপ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। একুশ শতকে আমরা যদি একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে এই তরুণ প্রজন্ম আমাদের জন্য একটা বড় সঙ্কট তৈরি করবে আগামী দিনে। সেই সঙ্কট আমরা মোকাবেলা করতে পারব না। মনে রাখতে হবে, একশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষাকে আমরা উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে পারব না। এজন্য দরকার দক্ষ ও বাজার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ জন্য যে পরিকল্পনা থাকা দরকার, তা নেই। পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা কোঅর্ডিনেশন থাকা দরকার, তাও নেই। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে। আবার অনেকগুলোই খারাপ করছে। এ জন্য একটা ‘ওয়াচডগ’ প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার, যা ইউজিসির নেই। ইউসিজি শুধু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। ঢালাওভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমালোচনা করে লাভ নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতাই শিক্ষার্থীদের ব্যাপক হারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমরা যেন এ কথাটা ভুলে না যাই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ যুগের বাস্তবতা।
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার একদিন আগে একটি জনপ্রিয় দৈনিকে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছে, শিক্ষার সংখ্যাগত উন্নয়ন হলেও এর গুণগত মানের উন্নতি হয়নি (বণিকবার্তা, ৫ মে)। প্রতিবেদনে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষার মানে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। আর বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে শিক্ষার মানের দিক থেকে ১৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৭। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত। তালিকায় বৈশ্বিকভাবে ভারতের অবস্থান ২৭, শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৩৮, পাকিস্তানের ৬৬ আর নেপালের অবস্থান ৭০তম। এর অর্থ, শিক্ষার মানের দিক দিয়ে আমরা নেপালের নিচে অবস্থান করছি। অথচ নেপালি ছেলেমেয়েরা কি-না বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। তাদের মান আমাদের চাইতে বেশি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্টকে হালকাভাবে নিতে চাই না। এই রিপোর্ট পক্ষপাত দোষে দুষ্ট, সে কথাও আমি বলব না। এই রিপোর্টের ভিত্তি আছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি তা শিকারও করি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘দি হিউম্যান ক্যাপিটাল রিপোর্ট ২০১৭’-এ বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, জনবহুল দেশটিতে পড়াশোনা শেষ করার পর শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ বেকার থাকে। দেশটির প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাও বিশ্বমানের। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশেষায়িত বিষয়ের সংখ্যা খুবই কম। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াই, এই মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারি না। এটা সবাই স্বীকার করবেন যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে।
আমরা মানি আর না-ই মানি, আমরা এ দেশে জিপিএ-৫ মার্কা একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছি। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীও উচ্ছ্বসিত হন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান বেড়েছে দাবি করে। কিন্তু শিক্ষার মান তো আদৌ বাড়েনি। এটা সত্য, দেশে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। সরকারি আর বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন অনেক। মানুষ বেড়েছে, তাদের উচ্চশিক্ষা দিতে রাষ্ট্র বাধ্য। সরকার তাই একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি প্রধানমন্ত্রী কিংবা শিক্ষামন্ত্রীকে কখনোই করা হয় না, তা হচ্ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যায় না। প্রতিষ্ঠানের হয়তো প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার চাইতেও বেশি প্রয়োজন তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা। ভালো শিক্ষক আমরা তৈরি করতে পারিনি। এই ব্যর্থতা একজন শিক্ষক হিসেবে আমারও। যারা এই টেক্সাসে এসেছেন, তারা দেখবেন ডালাস, অস্ট্রিন বা হিউস্টনে প্রচুর ভারতীয় বাস করেন। এরা কিন্তু সবাই অভিবাসীর সন্তান নন।  এরা সরাসরি রিক্রুট হয়েই এ দেশে এসেছেন। ভারত তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক করেছে। যুগোপযোগী করেছে। বিশেষায়িত শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। আইটি সেক্টরে প্রতিবছর ভারত যত গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে, তা স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরেও বিদেশে এই দক্ষ জনশক্তি ‘রফতানি’ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এই টেক্সাসে ভারতীয় আইটি বিশেষজ্ঞরা একটি বড় স্থান দখল করে আছে। এরা সরাসরি ভারত থেকেই রিক্রুট হয়ে আসেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া বন্ধ করতে চাচ্ছেন বটে, কিন্তু আইটি নার্সদের চাহিদা এত বেশি যে, এটা বন্ধ করা আদৌ সম্ভব হবে না। ইউরোপে আইটি জগতে জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণ করছে ভারতীয় ও চীনা ছাত্ররা। আমাদের এক বিশাল তরুণ প্রজন্ম রয়েছে। এই তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি করে আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও এদের জন্য একটা জায়গা তৈরি করে দিতে পারি। এ জন্য দরকার সুস্পষ্ট নীতি। এই নীতিটি প্রণয়ন করতে পারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। কিন্তু আমরা তা পারিনি। নতুন নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেখানে যে সব বিষয় চালু করা হয়েছে, তার আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এতে করে বরং শিক্ষিত বেকার সমস্যা বাড়ছে। আমি অবাক হয়ে যাই যখন দেখি নতুন নতুন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু ‘দলীয় ও ব্যক্তিগত’ স্বার্থরক্ষায় এমনসব বিষয় চালু করা হয়েছে যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। অথচ ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল শুধু প্রান্তিক জনপদকে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে। গোপালগঞ্জ কিংবা পাবনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এ লক্ষ্যেই। কিন্তু সেখানে সাধারণ বিষয় চালু করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু যারা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান, তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থেই সরকারের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে চলেছে। আমি অবাক হয়ে যাই এটা দেখে যে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব সাধারণ বিষয় চালু করার অনুমতিও দিয়েছে। দেশের বড় বড় যে ক’টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেখানে সাধারণ বিষয় রয়েছে। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয় চালু করার কোনো প্রয়োজন নেই।
অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি বন্ধ করা জরুরি। দেবাশীষ মণ্ডলের বিষয়টি তদন্ত করে দেখুক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এমনকি দুদকও বিষয়টি দেখতে পারে এখানে আদৌ দুর্নীতি হয়েছে কি-না। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। এটি সমর্থনযোগ্য নয়। এটি কোনো প্রতিবাদের ধরনও হতে পারে না। এ ঘটনা দুঃখজনক। একজন শিক্ষক হিসেবে এই ঘটনা আমাকে ব্যথিত করেছে।
Daily Bangladesher Khobor
11.09.2018

‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র সতেরো বছর


আজ ১১ সেপ্টেম্বর। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল, তা ১৭ বছর পার করেছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তথাকথিত এক সন্ত্রাসী হামলায় নিউ ইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘টুইন টাওয়ার’ ধসে পড়েছিল। হাইজ্যাক করা দুটি বিমান আছড়ে পড়েছিল ভবন দুটির ওপর। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভবন দুটি গলে পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। ওই ঘটনায় মারা গিয়েছিল তিন হাজার মানুষ, যাদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিল ১৪ জন। ওই সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল আল-কায়েদা নামে একটি সংগঠন আর তার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে। তার পরের কাহিনি সবার জানা। লাদেনকে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার আশ্রয় দিয়েছে—এই অভিযোগ তুলে আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলা চালিয়ে উত্খাত করা হয়েছিল তালেবান সরকারকে। সেটা ২০০১ সালের কথা। তারপর ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র রয়েছে—এই অভিযোগ তুলে দখল করা হয়েছিল ইরাক। তার ঠিক আট বছর পর একই প্রক্রিয়ায় সাদ্দাম হোসেনের মতো উত্খাত করা হয়েছিল লিবিয়ার গাদ্দাফিকে। কোনো একটি ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
মূলত ‘টুইন টাওয়ার’-এর ঘটনাবলির পর মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র নামে এক ধরনের ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ এই ‘যুদ্ধ’ শুরু করলেও বারাক ওবামা কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই ‘যুদ্ধ’ অব্যাহত রেখেছেন। বারাক ওবামা শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেও তিনি লিবিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন ২০১১ সালে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’র অংশ হিসেবে সেখানে বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এই যে ১৭ বছর, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্জন কী? সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম কি বন্ধ হয়েছে? বাস্তবতা হচ্ছে, এই সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। আল-কায়েদা পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়নি। বিন লাদেনকে পাকিস্তানে পাওয়া গিয়েছিল। অ্যাবোটাবাদ শহরে তিনি দিব্যি বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকতেন। অথচ তাঁকেই কি না যুক্তরাষ্ট্র খুঁজছিল কয়েক বছর ধরে। বিন লাদেনের অবর্তমানে জাওয়াহিরি এখন আল-কায়েদা পরিচালনা করছেন।
২০০১ সালে আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি ‘মিত্র বাহিনী’। কিন্তু তালেবানকে সেখান থেকে উত্খাত করা সম্ভব হয়নি দীর্ঘ ১৭ বছরেও। ২০১৮ সালে এসে দেখলাম তালেবান নতুন করে সেখানে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রতিদিনই সেখান থেকে আসছে আত্মঘাতী বোমা হামলার খবর। আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল এখন নিয়ন্ত্রণ করে তালেবান। আর তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সিরিয়া থেকে উত্খাত হওয়া ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। বাদাখাসান, মাগলান, ফারিয়াবসহ উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা আর পশ্চিমের ফারাহ প্রদেশ এখন নিয়ন্ত্রণ করে জঙ্গিরা, যার মধ্যে আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকাও রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই দীর্ঘ সময় ধরে সেখান থেকে তালেবানকে উত্খাত করা গেল না কেন? তাদের অর্থ ও অস্ত্র কারা জোগায়? এখানেই রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি! সেখান থেকে ‘মিত্র বাহিনী’ প্রত্যাহার করা হয়েছে বটে; কিন্তু ট্রাম্প চাচ্ছেন সেখানে আরো কিছু সেনা পাঠাতে। তথাকথিত ‘প্রশিক্ষণের’ নামে সেখানে এখনো চার হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে। পুরো আফগানিস্তান আবারও তালেবান-আইএস নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
ইরাকের কথা যদি বলি, সাদ্দাম হোসেনকে উত্খাতের পর (২০০৩), আজও সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। ইরাকে সর্বশেষ একটি নির্বাচন হয়েছে ২০১৮ সালের ১২ মে। কিন্তু আজ অদধি সেখানে কোনো সরকার গঠিত হয়নি। কার্যত ইরাক এখন অলিখিতভাবে কয়েক টুকরায় ভাগ হয়ে গেছে। ইরাকি কুর্দিস্তানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। আর গণভোটে ৯৩ শতাংশ মানুষ স্বাধীন একটি কুর্দিস্তানের পক্ষেই রায় দিয়েছে। ইরাক এখন শিয়া, সুন্নি আর কুর্দিদের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। আরো একটি উদ্বেগের খবর আমাদের জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস (৩১ জুলাই, ২০১৮)। তারা জানিয়েছে, কোনো কোনো ড্রাগ কম্পানি ইরাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে অর্থ জোগান দিচ্ছে। এখানে এক ধরনের ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করছে—যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে ওষুধের চাহিদা বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এখন বিষয়টির তদন্ত করছে। সেখানে আইএসের তৎপরতা রয়ে গেছে। ওবামা Humanitarian Intervention তত্ত্ব প্রয়োগ করে লিবিয়ায় বোমাবর্ষণের নির্দেশ দিয়ে (২০১১) গাদ্দাফিকে উত্খাত করেছিলেন। কিন্তু ফলাফল কী? গত সাত বছরে লিবিয়া একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার নেই। অস্ত্রবাজরা সেখানে একেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। গাদ্দাফিকে উত্খাতের জন্য সেখানে এসব অস্ত্র ফেলা হয়েছিল। কিন্তু অস্ত্র আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অস্ত্র এখন লিবিয়ার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সিরিয়ায় Responsibility to protect ব্যবহার করে আসাদ সরকারকে উত্খাতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে মানবতা রক্ষায় বিশ্ব শক্তির দায়িত্ব। কিন্তু মানবতা কি সেখানে রক্ষিত হয়েছে? সিরিয়ার ১০ লাখ নাগরিক দেশান্তরিত হয়েছে। ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে ইউরোপে আশ্রয় নেওয়া কত মানুষ চিরদিনের জন্য সাগরে হারিয়ে গেছে, তার হিসাব আমরা কোনো দিনই পাব না। লাখ লাখ সিরীয় নাগরিকের (যাদের মধ্যে শিশুরাও আছে) ইউরোপের বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়ার দৃশ্য আমরা টিভিতে দেখেছি। আমি পর পর দুই বছর ইউরোপে গেছি। আমি জার্মানিতে (ফ্রাংকফুর্ট) দেখেছি সিরিয়ার নাগরিকদের ভিক্ষা করতে। অথচ সিরিয়া কিংবা লিবিয়া একসময় সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র ছিল। অনেক ইউরোপীয় দেশের চেয়ে এদের অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেক শক্তিশালী ছিল। কিন্তু আজ তা একেকটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো জানা গিয়েছিল আইএসের নাম। ইসলামের নামে এদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সারা বিশ্বকে অবাক করেছিল। জনৈক বুগদাদি নিজেকে মুসলিম বিশ্বের ‘খলিফা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত আইএস সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল এলাকা নিয়ে তথাকথিত একটি ‘রাষ্ট্র’ গঠন করেছিল, যার রাজধানী ছিল রাকাতে। এদের একটি শক্তিশালী নিয়মিত সেনাবাহিনীও ছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই আইএস বা ‘দায়েস’—তাদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস কোথায় ছিল? অভিযোগ আছে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। বুগদাদি ইসরায়েলি নাগরিক—এমন কথাও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। মার্কিন ও রাশিয়ার আলাদা বিমান হামলায় আইএস সিরিয়া থেকে উত্খাত হয়েছে বটে; কিন্তু সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা আসেনি। রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতা আসাদ সরকারকে সেখানে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখছে বটে; কিন্তু আসাদবিরোধী বিভিন্ন সামরিক গ্রুপকে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করছে। সেখানে কার্যত এক ধরনের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ চলছে। একদিকে রাশিয়া (সেই সঙ্গে ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহ) আসাদ সরকারকে সমর্থন করছে। অন্যদিকে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’, ‘সুপ্রিম মিলিটারি কাউন্সিল’—যারা আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাদের সহযোগিতা করছে (অস্ত্র ও অর্থ) যুক্তরাষ্ট্র। পূর্ব ইউরোপ থেকে অস্ত্র কেনা হচ্ছে—এমন খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র (BGM-71 TOW) বিদ্রোহীরা ব্যবহার করছে, এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিমান থেকে যেসব অস্ত্র ফেলেছিল, তা বিদ্রোহী আল-নুসরা ফ্রন্টের কাছে চলে গিয়েছিল, এমন খবরও আমরা পত্রিকায় দেখেছি। সিরিয়া আজ একটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হয়েছে। দেশটি রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে বটে, কিন্তু প্রায় প্রতিটি বড় শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে নেই সুপেয় পানি, নেই বিদ্যুৎ, নেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা। শিশুরা মারা যাচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের অভাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে চলছে। কিন্তু কি পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র? ডেভিড ডি গ্রো (David de Graw) Global Research-এ একটি প্রবন্ধে স্বীকার করেছেন যে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের মোট খরচ ছয় ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। চিন্তা করা যায়, কি পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করছে এ খাতে? সাধারণ করদাতারা এই অর্থ পরিশোধ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় এই যুদ্ধের খরচের একটি হিসাব দিয়েছে। তাদের ভাষায়, এই খরচ ৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলার (Maclathy-র প্রতিবেদন, ১৫ আগস্ট ২০১১)। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই খরচ ছয় ট্রিলিয়ন ডলারের অঙ্ককে ছাড়িয়ে যাবে।
অথচ যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্য আছে। প্রতি ছয়জন মার্কিনের মধ্যে একজন দরিদ্র। পাঁচটি শিশুর মধ্যে একজন শিশু দারিদ্র্যের নিচে বাস করে। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ দরিদ্র। এশীয়দের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১২.১ শতাংশ। যুদ্ধের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় না করে তা সামাজিক খাতে ব্যয় করলে পরিস্থিতি পাল্টে যেত। নাইন-ইলেভেন একটি ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। টুইন টাওয়ারে তৈরি হয়েছে ‘ফ্রিডম টাওয়ার’, সেখানে এখন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। ইরাকে পুনর্গঠনের কাজ করছে মার্কিন কম্পানিগুলো। সেখানেও বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। ইরাক এখন অতিরিক্ত তেল উত্তোলন করে এই ব্যয়ভার মেটাচ্ছে। ফলে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ফিনিয়ান কানিংহাম একটি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘9/11 paved the way for america’s permanent war of aggression’। আর অধ্যাপক মিসেল চসুডোভস্কি তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘alleged Jihadi plotters were the product of US state terrorism’। বহুল আলোচিত চমস্কির বই 9/11 : Was There an Alternative-এ আছে নানা তথ্য ও উপাত্ত। রয়েছে নানা প্রশ্ন। দীর্ঘ ১৭ বছরেও এসব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
Daily KalerKontho
11.09.2018

আইসিসি ও মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের বিচার

 আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গণহত্যার দায়ে শীর্ষস্থানীয় মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারের পক্ষে অভিমত দিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার যেভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে করে একটা প্রশ্ন উঠেছে যে আদৌ কী রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার করা যাবে? মিয়ানমারের রাখাইনে গেল ২৫ আগস্ট (২০১৭) ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে, যার ফলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। গত এক বছরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারীদের মুখ থেকে ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডের খবর জেনেছেন। মিয়ানমার সফর করা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রধানও প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে আছেন রাখাইনে গণহত্যার।
ফলে রাখাইনে যে গণহত্যা হয়েছে, তা এখন প্রমাণিত। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিও রাখাইনে গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল মারজুকি দারুসমান এই কমিটির নেতৃত্ব দেন। গত ২৬ আগস্ট (২০১৮) তিনি জেনেভায় তার প্রতিবেদন জমা দেন। তাতে তিনি গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইংসহ আরও ৫ জন জেনারেলকে অভিযুক্ত করেন। এরপর গত ৬ সেপ্টেম্বর আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১ আদালত তাদের রায়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বকভাবে বহিঃষ্কার করে বাংলাদেশে পাঠানোসহ অন্যান্য অভিযোগ আইসিসি তদন্ত করতে পারবে। কিন্তু মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টদপ্তর এক বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছে এ ধরনের বিচার করার অধিকার আইসিসির নেই। ফলে প্রশ্নটা থাকলই, আদৌ কী এই গণহত্যার বিচার হবে?
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে তা প্রতিটি মিয়ানমারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রোম স্ট্যাটিটিউটের ৫ নং ধারায় ‘অপরাধের’ কথা বলা হয়েছে। এই অপরাধগুলো পরে আবার ৬, ৭ ও ৮ নং ধারায় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ৬ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘জেনোসাইড’ বা জাতিগত গণহত্যার কথা। ৭ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘ক্রাইম এগেইনিস্ট হিউমিনিটি’ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ৮ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘ওয়ার ক্রাইম’ ও ‘ত্রুাইম অব এগ্রেসান’ এর কথা। অর্থ্যাৎ যুদ্ধাপরাধ ও আগ্রাসন সংত্রুান্ত অপরাধ। আইসিসির প্রসিকিউটাররা যদি মনে করেন ৬, ৭ ও ৮ নং ধারাবলে কোনো একটি দেশে, কোনো একটি বিশেষ শ্রেণি ‘অপরাধ’ সংগঠন করেছেন, তাহলে তাদের শাস্তির আওতায় এনে বিচার করতে হবে। সার্বিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা রাদোভান কারাদজিক, লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেইলর, সূদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশীর কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেজিয়াত্তা (অভিযোগ পরে প্রত্যাহার) সবার বিচার হয়েছিল উপড়ে উল্লেখিত ধারা বলে।
৬ নং ধারায় জেনোসাইড বা গণহত্যার ক্ষেত্রে ৫টি সুনির্দিষ্ট ‘অপরাধ’ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে হত্যা, তাদের মানসিক কষ্ট দেওয়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই জনগোষ্ঠীর লোকদের উচ্ছেদ, পরিকল্পিতভাবে এই জনগোষ্ঠীর জন্মহার নিয়ন্ত্রণ, শিশুদের অন্যত্র স্থানান্তর ইত্যাদি। ৭ নং ধারায় ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ এ যেসব ‘অপরাধ’ ও অপরাধের ধরন উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে খুন, পরিপূর্ণভাবে ধংস করা বা বিনাশ সাধন, দাসত্ব, জোরপূর্বক বিতড়ন, অত্যাচার, ধর্ষণ,যৌন দাসত্ব, বর্ণবাদনীতি ইত্যাদি। যুদ্ধ অপরাধ (৮নং) ধারায় যে সব অপরাধের কথাবলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে অত্যাচার,অমানবিক আচরণ, বিচার অস্বীকার করা, আইন বহির্ভূতভাবে বিতাড়ন, সম্পত্তি ধ্বংস করা ইত্যাদি।
আজ রাখাইনের পরিস্থিতির দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এসব ধারা বলে অপরাধ করেছেন। এ ক্ষেত্রে সেব্রেনিকসায় (ইউরোপ) অপরাধের জন্য (১৯৯৫) যদি সার্বিয়া যুদ্ধবাজদের বিচার করা যেতে পারে, তাহলে মিয়ানমারের যুদ্ধবাজ নেতাদের বিচার নয় কেন? আইসিসির গ্রহণযোগ্যতার অবশ্যই গণহত্যার বিচার বাঞ্ছনীয়। মিয়ানমার রোম স্ট্যাটিটিউটে সাক্ষর করেনি। কিন্তু তাতে করে অপরাধীদের বিচারে কোনো বাঁধা নেই। কোনো স্ট্যাটিটিউটে (১৯৯৮) অনুযায়ী আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয় এবং বিভিন্ন স্থানে যেসব অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে (২০০২)সালে। সুদান ও রোম স্ট্যাটিটিউট সাক্ষর করেনি। কিন্তু দারফুরে গণহত্যার জন্য সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশীর অভিযুক্ত হয়েছিল এবং তার বিচারও হয়েছিল। আইনের দৃষ্টিতে তিনি এখন পলাতক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কাজ করছে। যদি আইসিসির কর্মকান্ডের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে সেখানে এখনো যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তরা হেগের (ডিটেনশন) সেন্টারে বিচারের অপেক্ষায় আছেন। সুতরাং আইসিসি রাখাইন গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের যে কথা বলা হয়েছে ,এ লক্ষেই এখন আইসিসিতে কাজ করতে হবে। মিয়ানমারের উপর আন্তজাতিক ‘চাপ’বাড়াতে হবে। অলিখিত সরকার প্রধান হিসেবে সুচিও তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। প্রয়োজনে তাকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশকেও এখন এগিয়ে আসতে হবে। বিষয়টি নিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ মতবিনিময় করতে পারে। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের কাউকে কাউকে সম্ভাব্য একটি নিষেধাজ্ঞা (মিয়ানমারের বিরুদ্ধে) চেয়ে কংগ্রেস একটি বিল উত্থাপন বিষয়টি নিয়ে কথা-বার্তা বলতে শুনেছি। বিষয়টি বাংলাদেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে। ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক বাংলাদেশ দূতাবাস সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস মতবিনিময় করতে পারে। এজন্য ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক এ বাংলাদেশ দূতাবাসকে আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ইমপার্শিয়াল অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট মেকানিজম বা আইআইআইএম এর বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে পারে। ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ আইআইআইএম সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এর আওতায় যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের ভবিষ্যত বিচারের জন্য তথ্য প্রমাণ সংগ্রহও সংরক্ষণ করা।
মূলত ২০১১ সালের পর থেকে সিরিয়ায় যেসব অপরাধ সংগঠিত হয়েছে,সেইসব অপরাধকে বিবেচনায় নিয়েই আইআইআইএম গঠন করা হয়েছিল। যদিও এটি কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সংগঠনটির চেয়ারপারসন হচ্ছেন ফ্রান্সের একজন সাবেক বিচারপতি মিস মার্চিউল।
ইরাকে ইসলামিক স্টেট কিংবা আল কায়দা যেসব অপরাধ সংগঠিত করেছে,সে ব্যাপারে তিনি অনুসন্ধান করেছেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেছেন,যাতে ভবিষ্যতে আই এস তথা আল কায়দার নেতাদেরকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যায়। এখন যেহেতু জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দল রাখাইনে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে মতামত দিয়েছে,সেহেতু রোহিঙ্গা প্রশ্নে আইআইএমকে এখন সক্রিয় করা যায়। জাতিসংঘের সদর দফতরে আইআইআইএম কর্মকর্তাদের সাথে বাংলাদেশ মতবিনিময় করতে হবে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বিশ্ব সম্প্রদায় এখন বাংলাদেশে আইসিসির সিদ্ধান্ত দেখিয়ে দিল সেখানে যুদ্ধপরাধীদের আনা কত জরুরি। বাংলাদেশের উচিত হবে এ লক্ষ্যে কাজ করা, পররাষ্ট্রনীতির সফলতা সেখানেই নিহিত।
Daily Amader Somoy.com
10.9.2018