গত ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ির রামগড়ে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলা ও তিন বাঙালিকে হত্যা করার ঘটনার পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও সেখানে আস্থার সঙ্কট রয়ে গেছে। গত ২০ এপ্রিল সংবাদপত্রগুলো আমাদের খবর দিচ্ছে খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার বড়পিলাকসহ আশপাশের ১৫-২০টি গ্রামের বাঙালিরা আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। দিনের বেলায় নিজেদের জায়গাজমিতে বাঙালিরা থাকলেও রাতে বাঙালি অধ্যুষিত গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে (আমার দেশ, ২০ এপ্রিল' ১১)। ইতোমধ্যে ওই ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হলেও, তদন্ত কমিটি অভিযুক্তদের আদৌ চিহ্নিত করতে পারবে কিনা, কিংবা দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে পারবে কিনা, এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। কিন্তু খোদ পাহাড়িদের একটা অংশ এই শান্তি চুক্তি মানছে না। সেখানে অপহরণ, হত্যা, অগি্নসংযোগ অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি যেখানে জরুরি, সেখানে এখনো পাহাড়ি নেতারা সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সৈন্যের ৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এতেও খুশি নন পাহাড়ি নেতারা। তারা আরো চান সেনা প্রত্যাহারের। তাদের এই সেনা প্রত্যাহারের দাবি সঙ্গত কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় গত ১০ বছরে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে ১৯০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং ৪৫০ জনের মতো পাহাড়ি ও বাঙালি নিহত হয়েছেন। গত ৩ মাসে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান থেকে আশার কথা বলে না। এখানে পাহাড়ি নেতাদের যে ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, সেই ভূমিকা তারা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে সন্তু লারমার উস্কানিমূলক বক্তব্য (বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন চলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাঙালিদের সরিয়ে নিতে আর্থিক সহায়তা দেবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে খাসজমি বলে কিছু নেই ইত্যদি) সেখানে স্থিতিশীলতা বিপন্ন করছে। পাহাড়ি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা যে বিঘি্নত হয়েছে, তার দায় সন্তু লারমা এড়াতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সন্তু লারমা যা বলে আসছেন, তা কি তিনি সত্য বলেছেন? কোন অধিকারবলে তিনি এসব কথা বলেন? তাকে এই অধিকার কে দিয়েছে? তিনি নির্বাচিত কোনো নেতা নন। পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ তাকে ভোট দেয়নি। জনগণের ভোটে তিনি কখনো বিজয়ী হয়ে আসেননি। আজকে নির্বাচিত কোনো পাহাড়ি নেতা যদি এ সব কথা বলতেন তাহলে তার পেছনে যুক্তি ছিল। পাহাড়িদের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার তাকে কেউ দেয়নি। দশ বছর ধরে তিনি আঞ্চলিক পরিষদের তথাকথিত চেয়ারম্যান। তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছেন। পাহাড়িরা সবাই তার ওপর আস্থাশীল, এটা আমি মনে করি না। জনসংহতি সমিতিতে তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। একটি অংশ আলাদা অবস্থান নিয়েছে। সুতরাং তাকে পাহাড়িদের একক নেতা বলা যাবে না। তবুও দেশের একশ্রেণীর মানুষ তাকে পাহাড়িদের নেতা মনে করেন। এটি ভুল। বরং সরকারের উচিত নির্বাচিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা। পাহাড়িরা এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র নন। অর্থাৎ তারা এ অঞ্চলের মূল বাসিন্দা নন। বরং ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে চাকমারা বাংলাদেশে আশ্রিত একটি উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। একাধিক চাকমা বুদ্ধিজীবীর লেখায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। চাকমারা বহিরাগত। তাদের আদি বাসস্থান চম্পক নগর কিংবা পূর্ব পুরুষ বিজয়গিরি সম্পর্কে কোনো নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য প্রমাণ ইতিহাসে নেই। ইতিহাসে দেখা গেছে চাকমা রাজারা মুসলমান নবাব শাসক সুবেদার সুলতানদের এত বেশি প্রভাবাধীন ছিলেন যে তারা তাদের চাকমা নাম পরিহার করে মুসলিম নাম ধারণ করেন (রাজাসুলভ খাঁ ১৭১২, রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫, রাজা গেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭, রাজা দৌলত খাঁ ১৭৭৬ ইত্যাদি)। চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার (১৫২৬) আনুমানিক দেড়শ বছর পরে। ইতিহাস যদি আমাদের এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়, তাহলে সন্তু লারমার কী অধিকার আছে 'সেটলারদের' (যারা বাঙালি) এ অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করে অন্যত্র পুনর্বাসন করার? সন্তু লারমার পূর্ব পুরুষদের মতো বাঙালিরাও এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছেন এবং যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। আমরা এর আগে একাধিকবার বলেছি বাঙালিরা সাংবিধানিক অধিকারবলেই (সংবিধানের ২৭, ৩৬, ৩৭ ও ৪২ অনুচ্ছেদ) এ অঞ্চলে সন্তু লারমার মতোই বসবাস করছেন। সন্তু লারমা বাঙালিদের পুনর্বাসনের কথা বলে সংবিধানবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন এবং এখন সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। উচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা যায়। তার এই দাবি সাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন। তবে অত্যন্ত চালাক সন্তু লারমা এবার প্রথমবারের মতো একটি শব্দ যোগ করেছেন। আর তা হচ্ছে 'সম্মানজনকভাবে;। অর্থাৎ বাঙালিদের পুনর্বাসন করতে হবে সম্মানজনকভাবে। হায়রে মায়াকান্না। সন্তু লারমা বলেছেন দেশে প্রচুর খাসজমি রয়েছে। সেখানে বাঙালিদের পুনর্বাসন সম্ভব। এটিও মিথ্যা তথ্য। দেশে খাসজমি রয়েছে বটে, তা প্রচুর নয়। উপরন্তু শিল্প-কালকারখানা স্থাপন করার কারণে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। দৈনিক ইত্তেফাক আমাদের জানাচ্ছে যে গত ২০ বছরে দেশে প্রায় ৫০ লাখ একর কৃষি জমি কমেছে (১৬ আগস্ট)। দেশে এভাবে যদি কৃষি জমি কমতে থাকে, তাহলে তা খাদ্য উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করবে। সন্তু বাবু কী চান কৃষি জমিতে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এনে বসিয়ে দেয়া হোক। কৃষি জমির পরিমাণ কমিয়ে সন্তু বাবু কী চান বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে খাদ্যে পরনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে? বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে নদীভাঙনে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। পরিবেশগত কারণে মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। এরা যাবে কোথায়? রাষ্ট্র, সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি এ ধরনের দাবি তোলার।
সন্তু লারমা বলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাঙালিদের পুনর্বাসনের পুরো খরচ দিতে রাজি ছিল। কথাটা কি সত্য? যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে অন্যায় করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ জন্য রয়েছে সংসদ। সংসদে সিদ্ধান্ত হবে, বিতর্ক হবে, সরকার সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ক্ষেত্রে কে? তারা কী জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে না? তাদের এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে এটা তাদের কাজ নয়। বাংলাদেশের উন্নয়নে তারা আমাদের পার্টনার। কিন্তু তাদের কোনো অধিকার নেই দেশবাসীকে বিভক্ত করার। প্রসঙ্গক্রমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউএনডিপির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন এসে গেল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে তারা কাজ করছে। এটা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু তারা কী সেখানে বসবাসরত হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষের উন্নয়নের জন্য কোনো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে? তারা কি বাঙালি শিশু সন্তানদের জন্য স্কুল গড়ে তুলেছে? নাকি তাদের কর্মসূচি শুধু পাহাড়ি, বিশেষ করে চাকমাদের কেন্দ্র করে? বাঙালি মুসলমানরা কি ইউএনডিপির কোনো প্রজেক্টে চাকরি পাচ্ছে? এটা কি সত্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের চাকরি দেয়া হচ্ছে? ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে একটি মূল্যায়ন হওয়া উচিত। সন্তু বাবু বলেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন (?) চলছে। কথাটা কি সত্য? দেশে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। একটি নির্বাচিত সরকার যেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করছে, সেখানে দেশের একটি অংশে সেনাশাসন থাকে কীভাবে? তার এই মন্তব্য কি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে না? আর পাঁচটি জায়গার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সেনাবাহিনী রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেখানে অতিরিক্ত কয়েকটি সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা যদি সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত না থাকতো, যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অতীতে যুদ্ধ না করত, তাহলে তো অতিরিক্ত সেনা ক্যাম্প স্থাপন করার প্রয়োজন হতো না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই সেখানে অতিরিক্ত সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। এসব ক্যাম্প রাখতে হবে। কয়েকটি সেনা ক্যাম্প ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যার ফলে সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ইতোমধ্যেই সেখানে আস্থানা গেড়েছে। সংবাদপত্রগুলো আমাদের এ তথ্যই দিচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে সন্তু লারমা চান পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো শাসন করুক। এখন সন্তু লারমাকেই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সন্তু লারমা যখন সব সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার দাবি করছেন, তখন সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে তথাকথিত 'গঞ্জুশ বাহিনী' ও 'সন্তুষ বাহিনী'র কথা (নয়া দিগন্ত, ১৯ আগস্ট'১০)। যারা কাপ্তাই এলাকায় বসবাস করেন, নদীপথে পণ্য আনানেয়া করেন, তাদের কাছে 'গঞ্জুশ বাহিনী' কিংবা 'সন্তুষ বাহিনীর' নাম অপরিচিত নয়। এরা চাঁদাবাজ। চাঁদা দেয়া প্রত্যেকের বাধ্যতামূলক। শান্তি বাহিনীর সাবেক সদস্যরাই (যার নেতা ছিলেন সন্তু লারমা) এমন 'গঞ্জুশ বাহিনী' গড়ে তুলে এক ব্যাপক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। সন্তু লারমা এদের কর্মকা- বন্ধ করার উদ্যোগ নেননি কেন? তিনি কী চান এই চাঁদা সংস্কৃতি এখানে চালু থাকুক? তিনি কী চান এ ধরনের হাজারটা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা একটি প্রশাসন গড়ে তুলুক? শান্তি চুক্তির আগে তো পরিস্থিতি তেমনই ছিল। রাষ্ট্র কোনো পর্যায়েই এই চাঁদাবাজি সংস্কৃতিকে চলতে দিতে পারে না। আইন-শৃঙ্ঘলা রক্ষার স্বার্থেই সেখানে সেনাবাহিনী থাকা প্রয়োজন। আমাদের অনেক সন্তান, যারা সেনাবাহিনীতে থেকে মশার কামড় খেয়ে, ম্যালেরিয়ায় ভুগে, নিজ ভূখ- রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেছেন, সন্তু লারমা আজ তাদের কৃতিত্ব না দিয়ে তাদের অবদানকে অস্বীকার করেছেন। এটা সত্যিই দুঃখজনক। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঢাকার চেয়েও শান্তিপূর্ণ বলে যে মন্তব্য সন্তু লারমা করেছিলেন, তা প্রকারান্তরে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। তিনি তো বলেই দিলেন ঢাকার পরিস্থিতি ভালো নয়। সরকার এ ক্ষেত্রে কী বলবে? মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও তা কি?
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে আগ্রহী। যে কারণে রাঙামাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে চেয়েছিল সরকার। এর ফলে অনগ্রসর লুসাই, চাক, খুমি, লিয়াং, পাংখো, রিয়াং, বোম, তংচঙ্গা, মুরং এবং স্থানীয় বাঙালিরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু সন্তু লারমা, যিনি চাকমা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি চাচ্ছেন না ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হোক। কেন? এটা কী এজন্য যে তিনি চান না চান, লুষাই, খুমি গিয়াং কিংবা পাংখো জাতির কেউ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। পাহাড়িদের মধ্যে শুধু চাকমারাই (খাদের মাঝে উচ্চ শিক্ষার হার ৯০ ভাগের উপরে) উচ্চ শিক্ষা নেবে অন্যরা নেবে না-এটাই কী সন্তু লারমার মনের বাসনা? অন্য জাতিগোষ্ঠী যদি শিক্ষায়-দীক্ষায় অনগ্রসর থাকে, তাহলে চাকমা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সহজ। পাংখো কিংবা বোম জাতির কেউ বিসিএস দিয়েছে, ডাক্তার হয়েছে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে এটা মনে হয় না। অথচ কোটা সিস্টেমে এর সুবিধা নিয়েছে শুধু চাকমারাই। অনগ্রসর বোম, রিয়াং, পাংখো কিংবা লিয়াংরা এই সুবিধা পায়নি। সংবিধানের ২৮(১) ধারা মতে রাষ্ট্র কারো প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করতে পারে না। কিন্তু বৈষম্য তো তৈরি হয়ে গেছেই। এখন সময় এসেছে তা সংশাধন করার। কোটা ব্যবস্থা থাকুক। কিন্তু এই কোটা ব্যবস্থায় পাহাড়ি ১৩টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে দিতে হবে।
সন্তু লারমার নানা বক্তব্যে আমি কষ্ট পেয়েছি। এ দেশ আমাদের সবার। পাহাড়িরা আলাদা নয়। তারাও এ দেশের সন্তান। বাঙালিরাও এ দেশের সন্তান। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ নয়, বাংলাদেশেরই একটি এলাকা। বাঙালি আর পাহাড়ি মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে হবে। বাঙালিদের আলাদা ভাবলে চলবে না। সরকারের সিদ্ধান্তে (সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার) বাঙালিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা দেখতে হবে।
সন্তু লারমা অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে আছেন। একটি সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর যখন তাকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। আজ সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি ১০ বছর নির্বাচন ছাড়া আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদটি দখল করে রাখার। সন্তু লারমা পদত্যাগ করে নতুনদের পথ করে দিতে পারেন। আঞ্চলিক পরিষদ নয়া নেতৃত্ব দরকার, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও ওই অঞ্চলের উন্নয়নের সরকারের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করবেন।
ড. তারেক শামসুর রেহমান: রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।যায় যায় দিন২৯ এপ্রিল ২০১১
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। কিন্তু খোদ পাহাড়িদের একটা অংশ এই শান্তি চুক্তি মানছে না। সেখানে অপহরণ, হত্যা, অগি্নসংযোগ অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি যেখানে জরুরি, সেখানে এখনো পাহাড়ি নেতারা সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সৈন্যের ৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এতেও খুশি নন পাহাড়ি নেতারা। তারা আরো চান সেনা প্রত্যাহারের। তাদের এই সেনা প্রত্যাহারের দাবি সঙ্গত কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় গত ১০ বছরে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে ১৯০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং ৪৫০ জনের মতো পাহাড়ি ও বাঙালি নিহত হয়েছেন। গত ৩ মাসে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান থেকে আশার কথা বলে না। এখানে পাহাড়ি নেতাদের যে ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, সেই ভূমিকা তারা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে সন্তু লারমার উস্কানিমূলক বক্তব্য (বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন চলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাঙালিদের সরিয়ে নিতে আর্থিক সহায়তা দেবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে খাসজমি বলে কিছু নেই ইত্যদি) সেখানে স্থিতিশীলতা বিপন্ন করছে। পাহাড়ি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা যে বিঘি্নত হয়েছে, তার দায় সন্তু লারমা এড়াতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সন্তু লারমা যা বলে আসছেন, তা কি তিনি সত্য বলেছেন? কোন অধিকারবলে তিনি এসব কথা বলেন? তাকে এই অধিকার কে দিয়েছে? তিনি নির্বাচিত কোনো নেতা নন। পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ তাকে ভোট দেয়নি। জনগণের ভোটে তিনি কখনো বিজয়ী হয়ে আসেননি। আজকে নির্বাচিত কোনো পাহাড়ি নেতা যদি এ সব কথা বলতেন তাহলে তার পেছনে যুক্তি ছিল। পাহাড়িদের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার তাকে কেউ দেয়নি। দশ বছর ধরে তিনি আঞ্চলিক পরিষদের তথাকথিত চেয়ারম্যান। তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছেন। পাহাড়িরা সবাই তার ওপর আস্থাশীল, এটা আমি মনে করি না। জনসংহতি সমিতিতে তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। একটি অংশ আলাদা অবস্থান নিয়েছে। সুতরাং তাকে পাহাড়িদের একক নেতা বলা যাবে না। তবুও দেশের একশ্রেণীর মানুষ তাকে পাহাড়িদের নেতা মনে করেন। এটি ভুল। বরং সরকারের উচিত নির্বাচিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা। পাহাড়িরা এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র নন। অর্থাৎ তারা এ অঞ্চলের মূল বাসিন্দা নন। বরং ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে চাকমারা বাংলাদেশে আশ্রিত একটি উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। একাধিক চাকমা বুদ্ধিজীবীর লেখায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। চাকমারা বহিরাগত। তাদের আদি বাসস্থান চম্পক নগর কিংবা পূর্ব পুরুষ বিজয়গিরি সম্পর্কে কোনো নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য প্রমাণ ইতিহাসে নেই। ইতিহাসে দেখা গেছে চাকমা রাজারা মুসলমান নবাব শাসক সুবেদার সুলতানদের এত বেশি প্রভাবাধীন ছিলেন যে তারা তাদের চাকমা নাম পরিহার করে মুসলিম নাম ধারণ করেন (রাজাসুলভ খাঁ ১৭১২, রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫, রাজা গেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭, রাজা দৌলত খাঁ ১৭৭৬ ইত্যাদি)। চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার (১৫২৬) আনুমানিক দেড়শ বছর পরে। ইতিহাস যদি আমাদের এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়, তাহলে সন্তু লারমার কী অধিকার আছে 'সেটলারদের' (যারা বাঙালি) এ অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করে অন্যত্র পুনর্বাসন করার? সন্তু লারমার পূর্ব পুরুষদের মতো বাঙালিরাও এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছেন এবং যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। আমরা এর আগে একাধিকবার বলেছি বাঙালিরা সাংবিধানিক অধিকারবলেই (সংবিধানের ২৭, ৩৬, ৩৭ ও ৪২ অনুচ্ছেদ) এ অঞ্চলে সন্তু লারমার মতোই বসবাস করছেন। সন্তু লারমা বাঙালিদের পুনর্বাসনের কথা বলে সংবিধানবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন এবং এখন সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন। উচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা যায়। তার এই দাবি সাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন। তবে অত্যন্ত চালাক সন্তু লারমা এবার প্রথমবারের মতো একটি শব্দ যোগ করেছেন। আর তা হচ্ছে 'সম্মানজনকভাবে;। অর্থাৎ বাঙালিদের পুনর্বাসন করতে হবে সম্মানজনকভাবে। হায়রে মায়াকান্না। সন্তু লারমা বলেছেন দেশে প্রচুর খাসজমি রয়েছে। সেখানে বাঙালিদের পুনর্বাসন সম্ভব। এটিও মিথ্যা তথ্য। দেশে খাসজমি রয়েছে বটে, তা প্রচুর নয়। উপরন্তু শিল্প-কালকারখানা স্থাপন করার কারণে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। দৈনিক ইত্তেফাক আমাদের জানাচ্ছে যে গত ২০ বছরে দেশে প্রায় ৫০ লাখ একর কৃষি জমি কমেছে (১৬ আগস্ট)। দেশে এভাবে যদি কৃষি জমি কমতে থাকে, তাহলে তা খাদ্য উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করবে। সন্তু বাবু কী চান কৃষি জমিতে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এনে বসিয়ে দেয়া হোক। কৃষি জমির পরিমাণ কমিয়ে সন্তু বাবু কী চান বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে খাদ্যে পরনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে? বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে নদীভাঙনে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। পরিবেশগত কারণে মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। এরা যাবে কোথায়? রাষ্ট্র, সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি এ ধরনের দাবি তোলার।
সন্তু লারমা বলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাঙালিদের পুনর্বাসনের পুরো খরচ দিতে রাজি ছিল। কথাটা কি সত্য? যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে অন্যায় করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ জন্য রয়েছে সংসদ। সংসদে সিদ্ধান্ত হবে, বিতর্ক হবে, সরকার সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ক্ষেত্রে কে? তারা কী জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে না? তাদের এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে এটা তাদের কাজ নয়। বাংলাদেশের উন্নয়নে তারা আমাদের পার্টনার। কিন্তু তাদের কোনো অধিকার নেই দেশবাসীকে বিভক্ত করার। প্রসঙ্গক্রমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউএনডিপির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন এসে গেল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে তারা কাজ করছে। এটা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু তারা কী সেখানে বসবাসরত হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষের উন্নয়নের জন্য কোনো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে? তারা কি বাঙালি শিশু সন্তানদের জন্য স্কুল গড়ে তুলেছে? নাকি তাদের কর্মসূচি শুধু পাহাড়ি, বিশেষ করে চাকমাদের কেন্দ্র করে? বাঙালি মুসলমানরা কি ইউএনডিপির কোনো প্রজেক্টে চাকরি পাচ্ছে? এটা কি সত্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের চাকরি দেয়া হচ্ছে? ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে একটি মূল্যায়ন হওয়া উচিত। সন্তু বাবু বলেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন (?) চলছে। কথাটা কি সত্য? দেশে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। একটি নির্বাচিত সরকার যেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করছে, সেখানে দেশের একটি অংশে সেনাশাসন থাকে কীভাবে? তার এই মন্তব্য কি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে না? আর পাঁচটি জায়গার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সেনাবাহিনী রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেখানে অতিরিক্ত কয়েকটি সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা যদি সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত না থাকতো, যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অতীতে যুদ্ধ না করত, তাহলে তো অতিরিক্ত সেনা ক্যাম্প স্থাপন করার প্রয়োজন হতো না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই সেখানে অতিরিক্ত সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। এসব ক্যাম্প রাখতে হবে। কয়েকটি সেনা ক্যাম্প ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যার ফলে সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ইতোমধ্যেই সেখানে আস্থানা গেড়েছে। সংবাদপত্রগুলো আমাদের এ তথ্যই দিচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে সন্তু লারমা চান পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো শাসন করুক। এখন সন্তু লারমাকেই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সন্তু লারমা যখন সব সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার দাবি করছেন, তখন সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে তথাকথিত 'গঞ্জুশ বাহিনী' ও 'সন্তুষ বাহিনী'র কথা (নয়া দিগন্ত, ১৯ আগস্ট'১০)। যারা কাপ্তাই এলাকায় বসবাস করেন, নদীপথে পণ্য আনানেয়া করেন, তাদের কাছে 'গঞ্জুশ বাহিনী' কিংবা 'সন্তুষ বাহিনীর' নাম অপরিচিত নয়। এরা চাঁদাবাজ। চাঁদা দেয়া প্রত্যেকের বাধ্যতামূলক। শান্তি বাহিনীর সাবেক সদস্যরাই (যার নেতা ছিলেন সন্তু লারমা) এমন 'গঞ্জুশ বাহিনী' গড়ে তুলে এক ব্যাপক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। সন্তু লারমা এদের কর্মকা- বন্ধ করার উদ্যোগ নেননি কেন? তিনি কী চান এই চাঁদা সংস্কৃতি এখানে চালু থাকুক? তিনি কী চান এ ধরনের হাজারটা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা একটি প্রশাসন গড়ে তুলুক? শান্তি চুক্তির আগে তো পরিস্থিতি তেমনই ছিল। রাষ্ট্র কোনো পর্যায়েই এই চাঁদাবাজি সংস্কৃতিকে চলতে দিতে পারে না। আইন-শৃঙ্ঘলা রক্ষার স্বার্থেই সেখানে সেনাবাহিনী থাকা প্রয়োজন। আমাদের অনেক সন্তান, যারা সেনাবাহিনীতে থেকে মশার কামড় খেয়ে, ম্যালেরিয়ায় ভুগে, নিজ ভূখ- রক্ষা করতে গিয়ে মারা গেছেন, সন্তু লারমা আজ তাদের কৃতিত্ব না দিয়ে তাদের অবদানকে অস্বীকার করেছেন। এটা সত্যিই দুঃখজনক। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঢাকার চেয়েও শান্তিপূর্ণ বলে যে মন্তব্য সন্তু লারমা করেছিলেন, তা প্রকারান্তরে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। তিনি তো বলেই দিলেন ঢাকার পরিস্থিতি ভালো নয়। সরকার এ ক্ষেত্রে কী বলবে? মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও তা কি?
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে আগ্রহী। যে কারণে রাঙামাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে চেয়েছিল সরকার। এর ফলে অনগ্রসর লুসাই, চাক, খুমি, লিয়াং, পাংখো, রিয়াং, বোম, তংচঙ্গা, মুরং এবং স্থানীয় বাঙালিরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু সন্তু লারমা, যিনি চাকমা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি চাচ্ছেন না ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হোক। কেন? এটা কী এজন্য যে তিনি চান না চান, লুষাই, খুমি গিয়াং কিংবা পাংখো জাতির কেউ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। পাহাড়িদের মধ্যে শুধু চাকমারাই (খাদের মাঝে উচ্চ শিক্ষার হার ৯০ ভাগের উপরে) উচ্চ শিক্ষা নেবে অন্যরা নেবে না-এটাই কী সন্তু লারমার মনের বাসনা? অন্য জাতিগোষ্ঠী যদি শিক্ষায়-দীক্ষায় অনগ্রসর থাকে, তাহলে চাকমা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সহজ। পাংখো কিংবা বোম জাতির কেউ বিসিএস দিয়েছে, ডাক্তার হয়েছে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে এটা মনে হয় না। অথচ কোটা সিস্টেমে এর সুবিধা নিয়েছে শুধু চাকমারাই। অনগ্রসর বোম, রিয়াং, পাংখো কিংবা লিয়াংরা এই সুবিধা পায়নি। সংবিধানের ২৮(১) ধারা মতে রাষ্ট্র কারো প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করতে পারে না। কিন্তু বৈষম্য তো তৈরি হয়ে গেছেই। এখন সময় এসেছে তা সংশাধন করার। কোটা ব্যবস্থা থাকুক। কিন্তু এই কোটা ব্যবস্থায় পাহাড়ি ১৩টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে দিতে হবে।
সন্তু লারমার নানা বক্তব্যে আমি কষ্ট পেয়েছি। এ দেশ আমাদের সবার। পাহাড়িরা আলাদা নয়। তারাও এ দেশের সন্তান। বাঙালিরাও এ দেশের সন্তান। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ নয়, বাংলাদেশেরই একটি এলাকা। বাঙালি আর পাহাড়ি মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে হবে। বাঙালিদের আলাদা ভাবলে চলবে না। সরকারের সিদ্ধান্তে (সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার) বাঙালিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা দেখতে হবে।
সন্তু লারমা অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে আছেন। একটি সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর যখন তাকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। আজ সংবিধান সন্তু লারমাকে কোনো অধিকার দেয়নি ১০ বছর নির্বাচন ছাড়া আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদটি দখল করে রাখার। সন্তু লারমা পদত্যাগ করে নতুনদের পথ করে দিতে পারেন। আঞ্চলিক পরিষদ নয়া নেতৃত্ব দরকার, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও ওই অঞ্চলের উন্নয়নের সরকারের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করবেন।
ড. তারেক শামসুর রেহমান: রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।যায় যায় দিন২৯ এপ্রিল ২০১১
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteI know Hasanat Very much. He is an activist. The opinion expresses by him is absolutely his own opinion.
ReplyDeleteSir, A superb, true information based column. I salute you for standing with us. Thank you very much. I am a student of your students. Thank you again.
ReplyDelete