রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি সিদ্ধান্ত ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি। কমিশন রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহূত যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতি ঘনফুট সিএনজির দাম ধরা হয়েছে ২৫ টাকা ২ পয়সা। এর মধ্যে দিয়ে বিইআরসি কী অর্জন করলো কিংবা পরিবেশ বিপর্যয় রোধে তা কতটুকু সহায়ক হবে তা আমি বুঝতে অক্ষম। বলা হয়েছে গণপরিবহন-এর ক্ষেত্রে তা কার্যকরী হবে না। কিন্তু এই ‘গণপরিবহন’-এর ব্যাখ্যা কোনটি যে ‘গণপরিবহন’ আর কোনটি যে গণপরিবহন নয়, তা নিয়ে
প্রশ্ন উঠবে। গ্যাস স্টেশনগুলো এটা নির্ধারণ করবে কীভাবে? এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য দুর্নীতি করার একটা সুযোগ করে দেবে। একটি মাইক্রোবাস (যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহূত হয়) কিংবা একটি প্রাইভেট কারও ঐ ব্যাখ্যায় ‘গণপরিবহন’-এর আওতায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বিইআরসি-এর মাঝে বিভক্তি করবে কীভাবে? এক্ষেত্রে দুর্নীতি হবে এবং নতুন নতুন জটিলতার সৃষ্টি হবে। সমস্যা হবে গ্যাস স্টেশনগুলোর কর্মচারীদের। তাদের পক্ষে বিভক্তি কঠিন হয়ে পড়বে। ‘গণপরিবহন’ বলতে যদি শুধুমাত্র রাস্তায় চলাচল মিনিবাস, বাসকে বুঝান হয়, তাহলে সেটা নিয়েও সমস্যা হবে। এতে করে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হবে, যা চলমান রাজনীতিতে সরকার বিরোধী অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা সিএনজির মূল্য যদি বৃদ্ধি করতেই হয়, তাহলে সব ধরনের পরিবহনের জন্য একই আইন প্রযোজ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে যে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, তা হচ্ছে এতে কারো লাভ হবে কী? কিংবা আমরা পরিবেশ দূষণ কতটুকু কমাতে পারবো। এই মুহূর্তে পরিবেশ রক্ষায় যা করা দরকার, তা হচ্ছে: ১. ন্যূনতম এক বছরের জন্য সকল ধরনের প্রাইভেট কারের রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করা, ২. সব ধরনের প্রাইভেট কারের সিএনজিতে রূপান্তর বন্ধ করা, ৩. জাপান থেকে প্রাইভেট কার আমদানি নিষিদ্ধ করা। কেননা, অতিসম্প্রতি রাশিয়ার ভ্লাদিভোস্টক বন্দরে আমদানিকৃত জাপানি গাড়ি পরীক্ষার সময় ন্যূনতম ৫০টি গাড়িতে তেজস্ক্রিয়তা ধরা পড়েছে (আমার দেশ, ১৬ এপ্রিল), ৪. অনতিবিলম্বে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে জাপানি গাড়িতে তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে কীনা তা পরীক্ষার জন্য বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা প্রয়োজন। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া এই মুহূর্তে জরুরি। বলা ভাল, পরিবেশ বিপর্যয় এড়াতে গাড়িতে সিএনজির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। গাড়িতে ডিজেল ও অকটেন ব্যবহার কমে যায়, যার ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনও কিছুটা হ্রাস পায়। এখন বিইআরসি’র এই তুঘলকি সিদ্ধান্তের ফলে গাড়িতে ডিজেল ব্যবহার বাড়বে এবং তা উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। বিইআরসি সিএনজির মূল্য বৃদ্ধি করতে চাইছে বটে, কিন্তু তারা কিছু বিষয় বিবেচনায় নেয়নি। প্রথমত, সিএনজি দাম বাড়িয়ে সরকারের রাজস্ব খুব একটা বাড়বে না। কেননা দেশে উত্পাদিত গ্যাসের মাত্র ৫ শতাংশ ব্যবহূত হয় এ খাতে। দ্বিতীয়ত, সিএনজির দাম বাড়ালে গাড়িতে ডিজেল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে। ফলে এই সেক্টরে কর্মরত প্রায় ২০ হাজার লোকের একটা বড় অংশ চাকরি হারাবে। কেননা দাম বাড়লে সিএনজির ব্যবহার কমে যাবে।
দেশে ৫৬৫টি রি-ফুয়েলিং স্টেশন ও ১৬২টি রূপান্তর কারখানার অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে যাবে। তৃতীয়ত, অতিরিক্ত ডিজেল ব্যবহারের ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে মারাত্মকভাবে এবং বিশ্ব আসরে বাংলাদেশের পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। চতুর্থত, ডিজেল ব্যবহারের ফলে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে।
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা বছরে প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ টন। এ পরিসংখ্যান ২০০৮ সালের। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী চাহিদা কিছুটা বাড়তে পারে। ২০০৮ সালের হিসাবে আমদানি মূল্য ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ১২ লাখ টন অপরিশোধিত তেলের মূল্য ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা। পরিশোধিত তেলের মূল্য ৯ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা (প্রতি এক লাখ টনের দাম ৩৭৫ কোটি টাকা হিসাবে)। প্রতি মাসে জ্বালানি তেল আমদানিতে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার দরকার হয়। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি তেলের মূল্য একশ’ দশ ডলার। বাড়তি দামের কারণে এখন অতিরিক্ত আরো টাকার দরকার হবে। এতে করে বিপিসির লোকসানের পরিমাণও বাড়বে। বিপিসি বেশি দামে তেল কিনে কম দামে তেল বিক্রি করে। ফলে বিপিসির খরচ ও দেনা বাড়ছে। অনেকের মনে থাকার কথা ২০০৮ সালের শেষের দিকে পেট্রোবাংলা অর্থ সংকট কাটাতে সরকারের কাছে ১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা চেয়েছিল। সেই টাকা পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে উচ্চ সূদে তাদের ঋণ নিতে হয়েছিল। এখন সিএনজির দাম বাড়লে, খুব স্বাভাবিক কারণেই যারা গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার করেন তারা আবার স্বাভাবিক কারণেই পেট্রোল বা অকটেনে ফিরে যাবেন। এর ফলে চাহিদা বাড়বে। আর চাহিদা বাড়লে সরকারের আমদানি বাড়বে। তাতে করে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণও বাড়বে। এক পর্যায়ে ভর্তুকি কমাতে সরকারকে তেলের দাম বাড়াতে হবে, যা কিনা সামগ্রিক অর্থনীতিকে একটি নেতিবাচক প্রশ্নে ফেলতে পারে। প্রসঙ্গক্রমেই বলে রাখি ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জ্বালানি তেল, বিদ্যুত্, গ্যাস ও খাদ্য খাতে ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে। শুধু তেল আমদানিতেই সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এটা আমাদের নিরাপত্তাকে যে কতটুকু ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
আমি আশংকা করছি সিএনজির মূল্য বাড়ালে, সরকারকে পেট্রোল ও অকটেনের দামও বাড়াতে হবে, যা কী-না দেশের মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কেননা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর (?) ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে নতুন অস্থিরতা তৈরি হবে। মূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে কৃষকরা। কেননা জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হলে, অকটেন আর পেট্রোলের পাশাপাশি ডিজেলের দামও বাড়াতে হবে। আর এটা করা হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে চরম সংকট তৈরি করবে। দেশে বর্তমানে ২৬ লাখ টন ডিজেল ব্যবহূত হয়। বোরো মৌসুমে প্রায় ৪৫ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ৩৩ লাখ হেক্টর ডিজেল চালিত সেচযন্ত্রের মাধ্যমে ধান উত্পন্ন করা হয়। কৃষিতে ২৫ শতাংশ ডিজেল ব্যবহূত হয়। বাকি ডিজেলের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পোড়ানো হয় পরিবহন খাতে।
জ্বালানি তেল আমদানিতে অর্থের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছেই। ১৯৮৮ সালে জ্বালানি তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি মাত্র ১০ ডলার। ২০ বছরের ব্যবধানে এ দাম ব্যারেল প্রতি ১৪৬ ডলারে উঠলেও বর্তমানে ১১৭ ডলার। লিবিয়ার সংকটের কারণে তেলের দাম কমার আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই। কেননা চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, যাতে করে মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে। ১৯৯৮ সালে বিশ্বে প্রতিদিন তেলের চাহিদা ছিল সোয়া দুই কোটি ব্যারেল। বর্তমানে এ চাহিদা ৮ কোটি ব্যারেল ছাড়িয়ে গেছে। চীন ও ভারতের অর্থনীতির সমৃদ্ধির কারণে জ্বালানি তেলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। ভারতও বড় অর্থনীতি। এই দুটো দেশের পক্ষে অধিক মূল্য দিয়ে জ্বালানি ক্রয় করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিরও একটা সম্পর্ক রয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ শতাংশ। বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়ালে শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য খাত থেকে বিনিয়োগ সরে যাবে। এর ফলে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। অথচ এমডিজি পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। আর ভর্তুকি প্রত্যাহার? কোন রাজনৈতিক সরকার পক্ষই ভর্তুকি প্রত্যাহারের ঝুঁকি নিতে পারে না। এতে করে জনপ্রিয়তা হারানোর একটি সম্ভাবনা থাকে।
আরো একটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। আর তা হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। সিএনজির পরিবর্তে সাধারণ মানুষ আবারও আমদানিকৃত অকটেন ও ডিজেল ব্যবহার করে। তাতে করে পরিবেশ দূষণের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এমনিতেই বাংলাদেশ বিশ্ব পরিবেশ দূষণের শিকার। বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন ও ব্যবহারের কারণে। জীবাশ্ম জ্বালানি,অর্থাত্ তেল, গ্যাস ও কয়লা ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের বিশাল এলাকা আজ সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার করে পরিবেশকে আরো দূষিত করতে পারে না। তাই কোনো অবস্থাতেই গাড়িতে সিএনজির দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। কেননা এক পর্যায়ে সরকারকে চাপের মুখে গণপরিবহন ব্যবহূত সিএনজির দামও বাড়াতে হবে। এতে করে পরিবহন খাতে মারাত্মক বিশৃংখলতা সৃষ্টি হবে। পরিবহন খাতে খরচ বাড়বে। ফলশ্রুতিতে খাদ্যদ্রব্যের দামও বেড়ে যাবে। আজ যারা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে আছেন, তারা আমলা। জনগণের কাছে তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু রাজনীতিবিদদের আছে। ভোটের জন্য তাদেরকে জনগণের কাছে যেতে হয়। বাংলাদেশ উষ্ণতা বৃদ্ধি মোকাবিলায় ফান্ড পাচ্ছে। সেই ফান্ড থেকে এ খাতে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। দাতারা এটাকে বিবেচনায় নেবে। সিএনজির দাম বাড়িয়ে আমলারা লাভবান হলেও, সাধারণ মানুষ লাভবান হবে না। এতে করে সরকার তার জনপ্রিয়তা হারাতে পারে। সঙ্গত কারণেই তাই সিএনজির মূল্য বৃদ্ধি করা ঠিক হবে না। তথাকথিত গণশুনানির কথা বলে সিএনজির দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। গণশুনানিতে ক’জন অংশগ্রহণ করেছিল, এটা নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। প্রাইভেট কারের কথা বলে চূড়ান্ত বিচারে গণপরিবহনের ও সিএনজির মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বিইআরসি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে মুখোমুখি অবস্থানে ঠেলে দেবে। এটা ভাল নয় ও সমর্থনযোগ্য নয়। তাই বিইআরসি সিএনজির মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার দাবি রাখে।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
নিরাপত্তা বিশ্লেষক,
ইত্তেফাকের লিংক
tsrahmanbd @ yahoo.com

0 comments:

Post a Comment