যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কর্তৃক পূর্ব ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত এ মুহূর্তে বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় পোল্যান্ডে ভূমি থেকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা এবং চেক রিপাবলিকে একটি রাডার স্টেশন স্থাপন করার কথা। প্রেসিডেন্ট বুশ ইরান থেকে সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মোকাবেলায় পূর্ব ইউরোপে এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে রাশিয়ার প্রবল আপত্তি ছিল। এখন এ মিসাইল সমঝোতা নতুন করে যে স্নায়ুযুদ্ধ জন্মের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল, তা প্রশাসনে কতটুকু সাহায্য করবে, সেটাই দেখার বিষয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ ওবামার এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন এবং পোল্যান্ডের নিকটবর্তী কালিনিনগ্রাদে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা রাশিয়া ঘোষণা করেছিল, তা বাতিল করার কথাও ঘোষণা করেছেন। ওবামার এ সিদ্ধান্ত রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করবে এবং বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাসে সাহায্য করবে। এদিকে গেল ১ অক্টোবর জেনেভায় বিশ্বের পারমাণবিক পরিকল্পনা নিয়ে ইরানের সঙ্গে ‘ফাইভ প্লাস ওয়ান’ শক্তির (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি) প্রাথমিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র এখন চায় রাশিয়ার সহযোগিতা। জেনেভা আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে ইরানের প্রক্রিয়াজাত ইউরেনিয়াম এখন রাশিয়ায় পাঠানো হবে।
বেশ কিছুদিন ধরে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের এ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমনি দু’দেশের মধ্যে একটি শীতল সম্পর্ক তৈরি করেছিল, ঠিক তেমনি জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতিতে জর্জিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ইত্যাদি নানা কারণে এ দুটো দেশের মাঝে আস্থার অভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কৃষ্ণসাগরে জর্জিয়ার সঙ্গে একটি নৌমহড়ায় অংশ নিয়েছে, যা ক্রেমলিনকে খুশি করেনি। অন্যদিকে রাশিয়া সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (যেখানে চীন সদস্য) ও বিআরআইসিভুক্ত (যেখানে চীন ও ভারত সদস্য) দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করায় হোয়াইট হাউস প্রশাসনও তা ভালো চোখে দেখেনি। এমনি এক পরিস্থিতিতে রিপাবলিকানদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ওবামা প্রশাসন যখন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করার কথা ঘোষণা করে, তখন তার এ সিদ্ধান্ত যে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করতে সাহায্য করবে- তা বলাই বাহুল্য। এখানে বলা ভালো প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ওবামা মস্কো সফর করেন গত জুলাই মাসে। কিন্তু তারপরও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিমত থেকে গিয়েছিল। এখন দেখার বিষয়, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে এবং কতটুকু সম্পর্কের উন্নতি ঘটায়। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এ সম্পর্ক খুবই জরুরি। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র বুশ প্রশাসনের আমলে দুটি পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড ও চেক রিপাবলিকে যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছিল, সে ব্যাপারে রাশিয়ার প্রবল আপত্তি ছিল। রাশিয়া এটাকে দেখেছে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ হিসেবে। উল্লেখ্য, স্নায়ুযুদ্ধকালীন ১৯৪৯ সালে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে নিয়ে ন্যাটো ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সমন্বয়ে ১৯৫৫ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল ওয়ারশ জোট। কিন্তু গরবাচেভ ১৯৮৯ সালে ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দিলেও ন্যাটো কখনও ভেঙে দেয়া হয়নি। বরং ওয়ারশ জোটের তিনটি দেশ ইতিমধ্যে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। একই সঙ্গে ইউক্রেন ও জর্জিয়ার ন্যাটোতে যোগ দেয়ার কথা। জর্জিয়া রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ। এক্ষেত্রে জর্জিয়া যদি ন্যাটোতে যোগ দেয় ও সেখানে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়, তাহলে তা যে রাশিয়াকে এক ধরনের স্নায়ুযন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাশিয়া এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে, সেটাই স্বাভাবিক।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ব্যাপারে রাশিয়ার নেতিবাচক মনোভাব ছিল না। তবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সহযোগিতা চাইলেও অতীতে রাশিয়া এ সহযোগিতা নিশ্চিত করেনি। রাশিয়া স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিল, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে যা কিনা বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হবে, কোন ধরনের হুমকি হিসেবে মনে করে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার যে নীতি, তাতে ইরান একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। এমনকি চেচনিয়ায় ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ইরান, যা কিনা রাশিয়ার অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। আঞ্চলিক রাজনীতির কারণেই রাশিয়ার পক্ষে ইরানের বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব ছিল না। রাশিয়া একই অবস্থান নিয়েছে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়েও। যুক্তরাষ্ট্রসহ জাপান এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো যখন উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় উৎকণ্ঠিত, তখন রাশিয়া পরোক্ষভাবে উত্তর কোরিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলা ভালো, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল উত্তর কোরিয়ার অন্যতম মিত্র। মস্কো সফরে ওবামা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, পূর্ব এশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় নেমে যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া কেউই লাভবান হবে না। কাজেই উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু ক্ষমতাধর ও ইরানকে পরমাণু অস্ত্র অর্জন থেকে ফেরাতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু মেদভেদেভ বা পুতিন তার এ আহ্বানে তখন সাড়া দেননি। এখন ইরানের ব্যাপারে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেছে ন্যাটোর নেতৃবৃন্দ। তবে কোন কোন মহল থেকে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে বিমান হামলা চালানো, তা ধ্বংস করে দেয়ার কথাও বলা হচ্ছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলি লবি এটা চায়। ভেতরে ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করছে বলেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইরানকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরার একটি পরিকল্পনা করছে পেন্টাগন। এক্ষেত্রে একদিকে ইসরাইল, অন্যদিকে কৃষ্ণসাগর এলাকা পালন করবে একটি বড় ভূমিকা। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কৃষ্ণসাগরে তার নৌ উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে। গত বছর জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ৫ দিনের সীমিত যুদ্ধের পর জর্জিয়ার সমর্থনে এ নৌ বৃদ্ধি ঘটেছিল। এখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ....। রুমানিয়ার শহর কনসটানজার কাছাকাছি মিখাইল কোগালনাইসেনু বিমান ঘাঁটিতে রয়েছে এর সদর দফতর। প্রয়োজনে বুলগেরিয়া ও রুমানিয়ার বিমান ঘাঁটি থেকে ইরানে বিমান হামলা চালানো হতে পারে। এ দুটো দেশে মোট ৭টি ‘এয়ারবেজ’ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। যুক্তরাষ্ট্রের এক থেকে তিনশ’ বিমান সেনা নিয়মিত এ বিমান ঘাঁটিগুলোতে থাকছে। বুলগেরিয়া ও রুমানিয়া এখন ন্যাটোর সদস্য। সম্ভাব্য যে কোন ‘আক্রমণে’ রুমানিয়ার ৪টি ও বুলগেরিয়ার ৩টি সেনানিবাসও ব্যবহার করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ দুটো দেশের সম্পর্ক ভালো। কিরঘিজস্তানের মানাস বিমান ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে। আফগানিস্তান ও ইরাকেও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটি। ইরানের সীমান্তবর্তী তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। মুসলিমপ্রধান ও ইসলাম ঘেঁষা একটি দল তুরস্কে ক্ষমতায় থাকলেও তুরস্কের সঙ্গে ইসরাইলের রয়েছে কূটনৈতিক সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি তুরস্ককে ‘সম্ভাব্য শত্রুর হামলা মোকাবেলায়’ ৩০০টি প্যাট্রিয়টিক মিসাইল সরবরাহ করেছে। ৮ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্যও পেয়েছে তুরস্ক। প্রয়োজনে তুরস্কের বিমান ঘাঁটিও ব্যবহার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এর উপরে বাহরাইনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৫ম ফ্লিটের সদর দফতর। কুয়েতেও রয়েছে তাদের বিমান ঘাঁটি। ভারতীয় মহাসাগরে নিয়মিত টহল দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিমানবাহী জাহাজ।
ইসরাইল অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে ী-ধরনের রাডার পেয়েছে তা ইসরাইলকে সম্ভাব্য ইরানি বিমান হামলা থেকে সতর্ক করে দিতে পারে। আর পেন্টাগন যে ভেতরে ভেতরে এ ধরনের একটি হামলার কথা চিন্তা করছে, এ তথ্যটি আমাদের জানিয়েছিল ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক ......১৫ সেপ্টেম্বর। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাবেক নেতা হাওয়ার্ড বেকার এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তার সঙ্গে রয়েছেন আরও কয়েকজন সিনেটর। পেন্টাগনের টার্গেট এখন বুশেহার পারমাণবিক কেন্দ্রের দিকে, যেখানে ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত পেন্টাগন এ মুহূর্তে বিমান হামলা চালাবে, এটা মনে হয় না। পেন্টাগন আরও সময় নেবে। কেননা নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম সদস্য চীনের সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। চীন কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। চীন ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে যে কোন বিমান হামলার বিরোধী। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ইরানের ব্যাপারে চীনের রয়েছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থ। গেল জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে চীন ইরানের সঙ্গে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি (গ্যাসফিল্ড উন্নয়নে) স্বাক্ষর হয়েছে জুনে। ৭টি তেল শোধনাগার তৈরির চুক্তি (৪২·৯ বিলিয়ন ডলার) ও ১০১৯ মাইল দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় জুলাই মাসে। আর আগস্ট মাসে ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ২টি তেল শোধনাগার সম্প্রসারণ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। চীনের জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। আর সে লক্ষ্যেই ইরানের ব্যাপারে আগ্রহ চীনের। উল্লেখ্য, বিশ্বের গ্যাস রিজার্ভের ১৫ ভাগ ও তেল রিজার্ভের দশ ভাগের এক ভাগ রয়েছে ইরানে। গেল ৫ বছরে ইরানের গ্যাস ও তেল সেক্টরের উন্নয়নে চীন প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। সুতরাং চীন-ইরান সম্পর্কের পেছনে কাজ করছে চীনের ‘প্রচণ্ড জ্বালানি ক্ষুধা।’ যে কারণে রাজনীতি এখানে গৌণ। চীন ব্যবসা বোঝে। তার পণ্যের বাজারও সম্প্রসারিত হয়েছে ইরানে। আজকে তাই সম্ভাব্য অবরোধের হুমকির মুখে চীন ‘পাঁচ শক্তি’র বাইরে আলাদা একটি অবস্থান নেবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে আশার কথা, জেনেভা আলোচনায় কোন বড় ধরনের অন্তরায়ের সৃষ্টি হয়নি। সাইড লাইনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইরানের প্রতিনিধিরা কথা বলেছেন। খোমে যে দ্বিতীয় পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের কথা ইরান ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে তা পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দিতেও ইরান রাজি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি মাসে দ্বিতীয় দফা আলোচনার আগেই খোমে যাবেন এআইইএ’র পরিদর্শকরা। ওবামার সুরও কিছুটা নরম বলে মনে হল। যদিও তিনি বলেছেন, ইরানকে আরও সুস্পষ্ট ও আন্তরিক হতে হবে। জেনেভা আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় পাওয়া হচ্ছে রাশিয়ার সহযোগিতা। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাসে সাহায্য করবে।
ড· তারেক শামসুর রেহমানঃ অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক (সুত্র, যুগান্তর, ১৭/১০/২০০৯)
বেশ কিছুদিন ধরে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের এ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমনি দু’দেশের মধ্যে একটি শীতল সম্পর্ক তৈরি করেছিল, ঠিক তেমনি জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতিতে জর্জিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ইত্যাদি নানা কারণে এ দুটো দেশের মাঝে আস্থার অভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কৃষ্ণসাগরে জর্জিয়ার সঙ্গে একটি নৌমহড়ায় অংশ নিয়েছে, যা ক্রেমলিনকে খুশি করেনি। অন্যদিকে রাশিয়া সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (যেখানে চীন সদস্য) ও বিআরআইসিভুক্ত (যেখানে চীন ও ভারত সদস্য) দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করায় হোয়াইট হাউস প্রশাসনও তা ভালো চোখে দেখেনি। এমনি এক পরিস্থিতিতে রিপাবলিকানদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ওবামা প্রশাসন যখন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করার কথা ঘোষণা করে, তখন তার এ সিদ্ধান্ত যে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করতে সাহায্য করবে- তা বলাই বাহুল্য। এখানে বলা ভালো প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ওবামা মস্কো সফর করেন গত জুলাই মাসে। কিন্তু তারপরও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিমত থেকে গিয়েছিল। এখন দেখার বিষয়, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে এবং কতটুকু সম্পর্কের উন্নতি ঘটায়। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এ সম্পর্ক খুবই জরুরি। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র বুশ প্রশাসনের আমলে দুটি পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড ও চেক রিপাবলিকে যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছিল, সে ব্যাপারে রাশিয়ার প্রবল আপত্তি ছিল। রাশিয়া এটাকে দেখেছে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ হিসেবে। উল্লেখ্য, স্নায়ুযুদ্ধকালীন ১৯৪৯ সালে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে নিয়ে ন্যাটো ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সমন্বয়ে ১৯৫৫ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল ওয়ারশ জোট। কিন্তু গরবাচেভ ১৯৮৯ সালে ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দিলেও ন্যাটো কখনও ভেঙে দেয়া হয়নি। বরং ওয়ারশ জোটের তিনটি দেশ ইতিমধ্যে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। একই সঙ্গে ইউক্রেন ও জর্জিয়ার ন্যাটোতে যোগ দেয়ার কথা। জর্জিয়া রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ। এক্ষেত্রে জর্জিয়া যদি ন্যাটোতে যোগ দেয় ও সেখানে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়, তাহলে তা যে রাশিয়াকে এক ধরনের স্নায়ুযন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাশিয়া এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে, সেটাই স্বাভাবিক।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ব্যাপারে রাশিয়ার নেতিবাচক মনোভাব ছিল না। তবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সহযোগিতা চাইলেও অতীতে রাশিয়া এ সহযোগিতা নিশ্চিত করেনি। রাশিয়া স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিল, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে যা কিনা বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হবে, কোন ধরনের হুমকি হিসেবে মনে করে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার যে নীতি, তাতে ইরান একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। এমনকি চেচনিয়ায় ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ইরান, যা কিনা রাশিয়ার অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। আঞ্চলিক রাজনীতির কারণেই রাশিয়ার পক্ষে ইরানের বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব ছিল না। রাশিয়া একই অবস্থান নিয়েছে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়েও। যুক্তরাষ্ট্রসহ জাপান এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো যখন উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় উৎকণ্ঠিত, তখন রাশিয়া পরোক্ষভাবে উত্তর কোরিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলা ভালো, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল উত্তর কোরিয়ার অন্যতম মিত্র। মস্কো সফরে ওবামা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, পূর্ব এশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় নেমে যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া কেউই লাভবান হবে না। কাজেই উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু ক্ষমতাধর ও ইরানকে পরমাণু অস্ত্র অর্জন থেকে ফেরাতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু মেদভেদেভ বা পুতিন তার এ আহ্বানে তখন সাড়া দেননি। এখন ইরানের ব্যাপারে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেছে ন্যাটোর নেতৃবৃন্দ। তবে কোন কোন মহল থেকে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে বিমান হামলা চালানো, তা ধ্বংস করে দেয়ার কথাও বলা হচ্ছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলি লবি এটা চায়। ভেতরে ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করছে বলেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইরানকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরার একটি পরিকল্পনা করছে পেন্টাগন। এক্ষেত্রে একদিকে ইসরাইল, অন্যদিকে কৃষ্ণসাগর এলাকা পালন করবে একটি বড় ভূমিকা। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কৃষ্ণসাগরে তার নৌ উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে। গত বছর জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ৫ দিনের সীমিত যুদ্ধের পর জর্জিয়ার সমর্থনে এ নৌ বৃদ্ধি ঘটেছিল। এখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ....। রুমানিয়ার শহর কনসটানজার কাছাকাছি মিখাইল কোগালনাইসেনু বিমান ঘাঁটিতে রয়েছে এর সদর দফতর। প্রয়োজনে বুলগেরিয়া ও রুমানিয়ার বিমান ঘাঁটি থেকে ইরানে বিমান হামলা চালানো হতে পারে। এ দুটো দেশে মোট ৭টি ‘এয়ারবেজ’ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। যুক্তরাষ্ট্রের এক থেকে তিনশ’ বিমান সেনা নিয়মিত এ বিমান ঘাঁটিগুলোতে থাকছে। বুলগেরিয়া ও রুমানিয়া এখন ন্যাটোর সদস্য। সম্ভাব্য যে কোন ‘আক্রমণে’ রুমানিয়ার ৪টি ও বুলগেরিয়ার ৩টি সেনানিবাসও ব্যবহার করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ দুটো দেশের সম্পর্ক ভালো। কিরঘিজস্তানের মানাস বিমান ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে। আফগানিস্তান ও ইরাকেও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটি। ইরানের সীমান্তবর্তী তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। মুসলিমপ্রধান ও ইসলাম ঘেঁষা একটি দল তুরস্কে ক্ষমতায় থাকলেও তুরস্কের সঙ্গে ইসরাইলের রয়েছে কূটনৈতিক সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি তুরস্ককে ‘সম্ভাব্য শত্রুর হামলা মোকাবেলায়’ ৩০০টি প্যাট্রিয়টিক মিসাইল সরবরাহ করেছে। ৮ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্যও পেয়েছে তুরস্ক। প্রয়োজনে তুরস্কের বিমান ঘাঁটিও ব্যবহার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এর উপরে বাহরাইনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৫ম ফ্লিটের সদর দফতর। কুয়েতেও রয়েছে তাদের বিমান ঘাঁটি। ভারতীয় মহাসাগরে নিয়মিত টহল দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিমানবাহী জাহাজ।
ইসরাইল অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে ী-ধরনের রাডার পেয়েছে তা ইসরাইলকে সম্ভাব্য ইরানি বিমান হামলা থেকে সতর্ক করে দিতে পারে। আর পেন্টাগন যে ভেতরে ভেতরে এ ধরনের একটি হামলার কথা চিন্তা করছে, এ তথ্যটি আমাদের জানিয়েছিল ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক ......১৫ সেপ্টেম্বর। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাবেক নেতা হাওয়ার্ড বেকার এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তার সঙ্গে রয়েছেন আরও কয়েকজন সিনেটর। পেন্টাগনের টার্গেট এখন বুশেহার পারমাণবিক কেন্দ্রের দিকে, যেখানে ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত পেন্টাগন এ মুহূর্তে বিমান হামলা চালাবে, এটা মনে হয় না। পেন্টাগন আরও সময় নেবে। কেননা নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম সদস্য চীনের সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। চীন কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। চীন ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে যে কোন বিমান হামলার বিরোধী। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ইরানের ব্যাপারে চীনের রয়েছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থ। গেল জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে চীন ইরানের সঙ্গে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি (গ্যাসফিল্ড উন্নয়নে) স্বাক্ষর হয়েছে জুনে। ৭টি তেল শোধনাগার তৈরির চুক্তি (৪২·৯ বিলিয়ন ডলার) ও ১০১৯ মাইল দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় জুলাই মাসে। আর আগস্ট মাসে ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ২টি তেল শোধনাগার সম্প্রসারণ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। চীনের জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। আর সে লক্ষ্যেই ইরানের ব্যাপারে আগ্রহ চীনের। উল্লেখ্য, বিশ্বের গ্যাস রিজার্ভের ১৫ ভাগ ও তেল রিজার্ভের দশ ভাগের এক ভাগ রয়েছে ইরানে। গেল ৫ বছরে ইরানের গ্যাস ও তেল সেক্টরের উন্নয়নে চীন প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। সুতরাং চীন-ইরান সম্পর্কের পেছনে কাজ করছে চীনের ‘প্রচণ্ড জ্বালানি ক্ষুধা।’ যে কারণে রাজনীতি এখানে গৌণ। চীন ব্যবসা বোঝে। তার পণ্যের বাজারও সম্প্রসারিত হয়েছে ইরানে। আজকে তাই সম্ভাব্য অবরোধের হুমকির মুখে চীন ‘পাঁচ শক্তি’র বাইরে আলাদা একটি অবস্থান নেবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে আশার কথা, জেনেভা আলোচনায় কোন বড় ধরনের অন্তরায়ের সৃষ্টি হয়নি। সাইড লাইনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইরানের প্রতিনিধিরা কথা বলেছেন। খোমে যে দ্বিতীয় পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের কথা ইরান ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে তা পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দিতেও ইরান রাজি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি মাসে দ্বিতীয় দফা আলোচনার আগেই খোমে যাবেন এআইইএ’র পরিদর্শকরা। ওবামার সুরও কিছুটা নরম বলে মনে হল। যদিও তিনি বলেছেন, ইরানকে আরও সুস্পষ্ট ও আন্তরিক হতে হবে। জেনেভা আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় পাওয়া হচ্ছে রাশিয়ার সহযোগিতা। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাসে সাহায্য করবে।
ড· তারেক শামসুর রেহমানঃ অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক (সুত্র, যুগান্তর, ১৭/১০/২০০৯)
0 comments:
Post a Comment