মহাজোট সরকার তিন বছরে পা দেবে আজ। পররাষ্ট্রনীতির গত দুই বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের ভারতমুখিতা রয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী তাঁর চীন সফরের মধ্য দিয়ে এই দুই প্রতিবেশী তথা নিকট প্রতিবেশীর মধ্যে এক ধরনের 'ব্যালেন্স' কিংবা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। গত দুই বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যথেষ্ট অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে যেসব সমস্যা বিরাজমান, সে ব্যাপারে সমাধানের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে দুটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফর। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও চীনে প্রধানমন্ত্রীর সফর ছিল অনেকটা রুটিন ওয়ার্ক। মার্চে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকালে চীনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক যে তিনটি চুক্তি ও একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, তা নিঃসন্দেহে সহযোগিতার সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করবে। তবে মনে রাখতে হবে, চীন এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোনো বিশেষ মর্যাদা দেয়নি। অতীতেও চীন বাংলাদেশের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণে চীনের 'গুড অফিসকে' বাংলাদেশ ব্যবহার করতে চেয়েছে। যদিও এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর চীন সফরে ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়েও গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক নির্মাণে আগ্রহের কথাও জানিয়েছিলেন।
চীন বাংলাদেশকে যে কত গুরুত্ব দেয়, তার বড় প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর জুনে বাংলাদেশে আসেন চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। শি জিন পিং চীনা নেতৃত্ব সারিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। শোনা যায়, হু চিনথাও ২০১২ সালে অবসরে গেলে শি জিন পিং হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। শি জিন পিংয়ের সফরের সময় কুনমিং-কক্সবাজার সড়কের পাশাপাশি বাংলাদেশ একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সহযোগিতা চায় এবং চীন এ ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এই সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে তা এ অঞ্চলের বৈদেশিক বাণিজ্য পুরোপুরি বদলে দেবে। চীনের ইউনান প্রদেশও এই বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। সম্প্রতি চীনের গণতন্ত্রকামী লিউ সিয়াওবোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার জন্য চীন বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ করেছিল। ১৪টি দেশ চীনের অনুরোধে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। বিষয়টি এখন চীন কিভাবে দেখবে, সেটাই দেখার বিষয়। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের দিকে হেলে আছে। গত অর্থবছরে (২০১০) বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের (আপটা) ব্যাংকক চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি ২০০৬ থেকে বাংলাদেশের ৮৪টি পণ্যের জন্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শুল্কমুক্ত এসব পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য নেই। আপটার মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র স্বল্পোন্নত দেশ। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এখনো চীনের অভ্যন্তরে বাজার পেতে পারে, এমন পণ্য খুঁজে পায়নি।
গত বছর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যতটা আলোচিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সব সময়ই 'অম্লমধুর'। গত ৪০ বছরে দেশ দুটির মাঝে বেশ কিছু সমস্যার জন্ম হয়েছে, যার সমাধান হয়নি। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী যখন ভারতে গেলেন, তখন একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল। দেখা গেল, ট্রানজিটের প্রশ্নে বাংলাদেশ একটি চুক্তি করেছে। আঞ্চলিক কানেকটিভিটির আওতায়ই এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত এখন ভুটান ও নেপালকেও ট্রানজিট দেবে। ভারত বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দিয়েছে। এই ঋণ নিয়েও বাংলাদেশে আমরা 'বিতর্ক' লক্ষ করেছি। কেউ কেউ বলেছেন, ওই ঋণ দিয়ে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি হবে না, বরং তাতে ভারতেরই লাভ বেশি। কেননা ট্রানজিট সুবিধার জন্য যে অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার, তা এখন ভারতীয় ঋণে তৈরি করা হবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সব বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে যা হয়, ভারতীয় ঋণেও তাই হচ্ছে। ওই ঋণের টাকায় ৮৫ ভাগ পণ্য ও সেবা কিনতে হবে ভারত থেকে। বাকি ১৫ ভাগ কিনতে হবে ভারতীয় পরামর্শে। এমনকি বিশেষজ্ঞরাও আসবেন ভারত থেকে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণ নিলেও এমনটি হতো_সে দেশ থেকেই পণ্য ও সেবা কিনতে হতো। নিজস্ব বিশেষজ্ঞ থাকলেও দাতা দেশেরই বিশেষজ্ঞ নিতে হয়। ঋণের টাকায় ঢাকায় একটি ফ্লাইওভার হবে। তাতে নিশ্চয়ই আমরা উপকৃত হব। ডবল ডেকার বাস ও আর্টিকুলেটেড বাস কিনব ভারতীয় অর্থে। এ ক্ষেত্রে বাসের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এটা যত দ্রুত ছাড়করণ হবে, অন্য দাতাদের কাছে এ খাতে সাহায্য পেতে সময় লাগত।
দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রধানমন্ত্রীর দিলি্ল সফরের পরও বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক সমস্যা যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে। যেমন_গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের যে পানি প্রাপ্তির কথা, তা বাংলাদেশ পাচ্ছে না। জানুয়ারির এ কিস্তিতে বাংলাদেশ ৫৬ হাজার কিউসেক কম পানি পেয়েছে। এর আগের বছর (২০০৯) কম পেয়েছিল ৬০ হাজার কিউসেক। অর্থাৎ পানির পরিমাণ কমছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি আসার আগে উজানে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ এ প্রশ্নটি উত্থাপন করেনি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বৈঠক হলেও চুক্তির ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে তিস্তা একটি ইস্যু। পশ্চিমবাংলার বিধানসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকার তেমন উদ্যোগ নেয়নি। অথচ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য তিস্তা একটি জীবন-মরণ সমস্যা। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও দ্বিমত আছে। ভারত সরকার জানিয়েছে, টিপাইমুখ নিয়ে ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু তার পরও বিতর্ক রয়ে গেছে। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক অব্যাহত বাংলাদেশিদের হত্যা, ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত না হওয়া ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিগত বছরে এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান আমরা পাইনি। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। কিন্তু ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টিও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়টি তাই গত বছর যেভাবে আলোচিত হয়েছে, ধারণা করছি চলতি বছরও তা একইভাবে আলোচিত হবে। চলতি বছরের মাঝামাঝি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা। কিন্তু এই সফর নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
গেল বছর বাংলাদেশের একটা বড় পাওয়া হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস) পুরস্কার অর্জন। প্রধানমন্ত্রী নিজে এই পুরস্কার গ্রহণ করেছেন নিউইয়র্কে। ২০০০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে ১৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের দেশগুলোকে ৮ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আহ্বান জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। এ জন্যই বাংলাদেশকে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। তবে দক্ষিণাঞ্চলে ২০০৯ সালের ২৫ মে 'আইলা' আঘাত হানার পর আজ পর্যন্ত পরিস্থিতি সেখানে তেমন উন্নতি হয়নি। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নিজে নিউইয়র্কে বিশ্ব সভায় বলেছেন, ২০০৯-২০১৫ সাল মেয়াদে এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়নের সব লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের ২ হাজার ২১০ কোটি ডলার, অর্থাৎ প্রতিবছর ৪৪০ কোটি ডলার প্রয়োজন। সংগত কারণেই একটা বড় প্রশ্ন এখন আমরা সেই সাহায্য পাব কি না? আর না পেলে, এমডিজি অর্জনে আমাদের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে। এ জন্য যা জরুরি, তা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে অর্থ সংগ্রহ করা।
বাংলাদেশ গত বছর জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ে পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন সোচ্চার। তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক শীর্ষ সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল (কপ-১৫, কোপেনহেগেন, ২০০৯) সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে উষ্ণতা থেকে যে ক্ষতি হবে, তা মোকাবিলায় আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। কপ-১৬ সম্মেলনে (কানকুন, ২০১০) বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সোচ্চার ছিল বেশি। চলতি বছর কপ-১৭ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ডারবানে, আর সেখানে উষ্ণতা কমাতে আইনগত বাধ্যবাধকতা সংবলিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এ ব্যাপারে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বেশি উদ্যোগী হতে হবে। কেননা গত অক্টোবরে (২০১০) লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ম্যাপলক্রফট' ১৭০টি দেশের ওপর পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে যে জরিপ চালায়, তাতে ১৫টি দেশকে 'চরম ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মাঝে বাংলাদেশকে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং চলতি বছর 'জলবায়ু কূটনীতি' নিয়ে বাংলাদেশকে বেশি তৎপর হতে হবে। একই সঙ্গে ইটের ভাটায় কালো ধোঁয়া উদ্গিরণ বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে গাছ কাটা। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ খুবই কম। বাংলাদেশের জন্য গত বছর একটি খারাপ খবর ছিল, মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে এবং এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে। অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, ২০০৭-০৮ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু ২০১০-১১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের সেই ইতিবাচক ধারা আর নেই। উল্টো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে (কালের কণ্ঠ, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১০)।
অন্যদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এত বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষকে পাশে নিয়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে কোনো দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে না (কালের কণ্ঠ, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১০)। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। ভোজ্য তেল ও চালের দামের ঊর্ধ্বগতি সরকার রোধ করতে পারেনি। এসব পরিসংখ্যান ও তথ্য যদি নীতিনির্ধারকরা গুরুত্বের সঙ্গে নেন, তাহলে আমরা একটা ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারি। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রেই এই জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tsrahmanbd_yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ০৬/০১/১১]
চীন বাংলাদেশকে যে কত গুরুত্ব দেয়, তার বড় প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর জুনে বাংলাদেশে আসেন চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। শি জিন পিং চীনা নেতৃত্ব সারিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। শোনা যায়, হু চিনথাও ২০১২ সালে অবসরে গেলে শি জিন পিং হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। শি জিন পিংয়ের সফরের সময় কুনমিং-কক্সবাজার সড়কের পাশাপাশি বাংলাদেশ একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সহযোগিতা চায় এবং চীন এ ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এই সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে তা এ অঞ্চলের বৈদেশিক বাণিজ্য পুরোপুরি বদলে দেবে। চীনের ইউনান প্রদেশও এই বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। সম্প্রতি চীনের গণতন্ত্রকামী লিউ সিয়াওবোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার জন্য চীন বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ করেছিল। ১৪টি দেশ চীনের অনুরোধে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। বিষয়টি এখন চীন কিভাবে দেখবে, সেটাই দেখার বিষয়। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের দিকে হেলে আছে। গত অর্থবছরে (২০১০) বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের (আপটা) ব্যাংকক চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি ২০০৬ থেকে বাংলাদেশের ৮৪টি পণ্যের জন্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শুল্কমুক্ত এসব পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য নেই। আপটার মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র স্বল্পোন্নত দেশ। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এখনো চীনের অভ্যন্তরে বাজার পেতে পারে, এমন পণ্য খুঁজে পায়নি।
গত বছর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যতটা আলোচিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সব সময়ই 'অম্লমধুর'। গত ৪০ বছরে দেশ দুটির মাঝে বেশ কিছু সমস্যার জন্ম হয়েছে, যার সমাধান হয়নি। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী যখন ভারতে গেলেন, তখন একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল। দেখা গেল, ট্রানজিটের প্রশ্নে বাংলাদেশ একটি চুক্তি করেছে। আঞ্চলিক কানেকটিভিটির আওতায়ই এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত এখন ভুটান ও নেপালকেও ট্রানজিট দেবে। ভারত বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দিয়েছে। এই ঋণ নিয়েও বাংলাদেশে আমরা 'বিতর্ক' লক্ষ করেছি। কেউ কেউ বলেছেন, ওই ঋণ দিয়ে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি হবে না, বরং তাতে ভারতেরই লাভ বেশি। কেননা ট্রানজিট সুবিধার জন্য যে অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার, তা এখন ভারতীয় ঋণে তৈরি করা হবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সব বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে যা হয়, ভারতীয় ঋণেও তাই হচ্ছে। ওই ঋণের টাকায় ৮৫ ভাগ পণ্য ও সেবা কিনতে হবে ভারত থেকে। বাকি ১৫ ভাগ কিনতে হবে ভারতীয় পরামর্শে। এমনকি বিশেষজ্ঞরাও আসবেন ভারত থেকে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণ নিলেও এমনটি হতো_সে দেশ থেকেই পণ্য ও সেবা কিনতে হতো। নিজস্ব বিশেষজ্ঞ থাকলেও দাতা দেশেরই বিশেষজ্ঞ নিতে হয়। ঋণের টাকায় ঢাকায় একটি ফ্লাইওভার হবে। তাতে নিশ্চয়ই আমরা উপকৃত হব। ডবল ডেকার বাস ও আর্টিকুলেটেড বাস কিনব ভারতীয় অর্থে। এ ক্ষেত্রে বাসের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এটা যত দ্রুত ছাড়করণ হবে, অন্য দাতাদের কাছে এ খাতে সাহায্য পেতে সময় লাগত।
দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রধানমন্ত্রীর দিলি্ল সফরের পরও বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক সমস্যা যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে। যেমন_গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের যে পানি প্রাপ্তির কথা, তা বাংলাদেশ পাচ্ছে না। জানুয়ারির এ কিস্তিতে বাংলাদেশ ৫৬ হাজার কিউসেক কম পানি পেয়েছে। এর আগের বছর (২০০৯) কম পেয়েছিল ৬০ হাজার কিউসেক। অর্থাৎ পানির পরিমাণ কমছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি আসার আগে উজানে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ এ প্রশ্নটি উত্থাপন করেনি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বৈঠক হলেও চুক্তির ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে তিস্তা একটি ইস্যু। পশ্চিমবাংলার বিধানসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকার তেমন উদ্যোগ নেয়নি। অথচ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য তিস্তা একটি জীবন-মরণ সমস্যা। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও দ্বিমত আছে। ভারত সরকার জানিয়েছে, টিপাইমুখ নিয়ে ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু তার পরও বিতর্ক রয়ে গেছে। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক অব্যাহত বাংলাদেশিদের হত্যা, ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত না হওয়া ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিগত বছরে এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান আমরা পাইনি। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। কিন্তু ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টিও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়টি তাই গত বছর যেভাবে আলোচিত হয়েছে, ধারণা করছি চলতি বছরও তা একইভাবে আলোচিত হবে। চলতি বছরের মাঝামাঝি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা। কিন্তু এই সফর নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
গেল বছর বাংলাদেশের একটা বড় পাওয়া হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস) পুরস্কার অর্জন। প্রধানমন্ত্রী নিজে এই পুরস্কার গ্রহণ করেছেন নিউইয়র্কে। ২০০০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে ১৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের দেশগুলোকে ৮ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আহ্বান জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। এ জন্যই বাংলাদেশকে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। তবে দক্ষিণাঞ্চলে ২০০৯ সালের ২৫ মে 'আইলা' আঘাত হানার পর আজ পর্যন্ত পরিস্থিতি সেখানে তেমন উন্নতি হয়নি। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নিজে নিউইয়র্কে বিশ্ব সভায় বলেছেন, ২০০৯-২০১৫ সাল মেয়াদে এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়নের সব লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের ২ হাজার ২১০ কোটি ডলার, অর্থাৎ প্রতিবছর ৪৪০ কোটি ডলার প্রয়োজন। সংগত কারণেই একটা বড় প্রশ্ন এখন আমরা সেই সাহায্য পাব কি না? আর না পেলে, এমডিজি অর্জনে আমাদের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে। এ জন্য যা জরুরি, তা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে অর্থ সংগ্রহ করা।
বাংলাদেশ গত বছর জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ে পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন সোচ্চার। তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক শীর্ষ সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল (কপ-১৫, কোপেনহেগেন, ২০০৯) সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে উষ্ণতা থেকে যে ক্ষতি হবে, তা মোকাবিলায় আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। কপ-১৬ সম্মেলনে (কানকুন, ২০১০) বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সোচ্চার ছিল বেশি। চলতি বছর কপ-১৭ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ডারবানে, আর সেখানে উষ্ণতা কমাতে আইনগত বাধ্যবাধকতা সংবলিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এ ব্যাপারে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বেশি উদ্যোগী হতে হবে। কেননা গত অক্টোবরে (২০১০) লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ম্যাপলক্রফট' ১৭০টি দেশের ওপর পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে যে জরিপ চালায়, তাতে ১৫টি দেশকে 'চরম ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মাঝে বাংলাদেশকে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং চলতি বছর 'জলবায়ু কূটনীতি' নিয়ে বাংলাদেশকে বেশি তৎপর হতে হবে। একই সঙ্গে ইটের ভাটায় কালো ধোঁয়া উদ্গিরণ বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে গাছ কাটা। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ খুবই কম। বাংলাদেশের জন্য গত বছর একটি খারাপ খবর ছিল, মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে এবং এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে। অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, ২০০৭-০৮ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু ২০১০-১১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের সেই ইতিবাচক ধারা আর নেই। উল্টো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে (কালের কণ্ঠ, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১০)।
অন্যদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এত বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষকে পাশে নিয়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে কোনো দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে না (কালের কণ্ঠ, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১০)। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। ভোজ্য তেল ও চালের দামের ঊর্ধ্বগতি সরকার রোধ করতে পারেনি। এসব পরিসংখ্যান ও তথ্য যদি নীতিনির্ধারকরা গুরুত্বের সঙ্গে নেন, তাহলে আমরা একটা ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারি। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রেই এই জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tsrahmanbd_yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ০৬/০১/১১]
0 comments:
Post a Comment