সম্প্রতি সাত বিভাগের ২৩৬টি পৌরসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, বিএনপি বিজয়ী হয়েছে ৯৭টি পৌরসভায় আর আওয়ামী লীগ ৯৩টিতে। একই সঙ্গে দুটি বড় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও বিজয়ী হয়েছেন। এখানে আওয়ামী লীগের সংখ্যা বেশি- ১৬ জন, বিএনপির ৮ জন। জামায়াত ৫টি আসনে, জাতীয় পার্টি ১টি, এলডিপি ১টি ও স্বতন্ত্ররা ১৫টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। এই যে নির্বাচন, একে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? বিএনপি বলেছে, জনগণ সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। আর মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, পৌর নির্বাচনের ফল মহাজোটের জন্য অশনি সংকেত। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদেরও অনেকটা এ সুরে কথা বলেছেন। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য যেমনি একটি শিক্ষা, ঠিক তেমনি বিএনপির জন্যও একটি শিক্ষা। এ থেকে দল দুটো কী শিক্ষা নেবে, আদৌ নেবে কিনা, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আমি ‘হলুদ কার্ড’ কিংবা ‘অশনি সংকেত’ বিষয়ক জটিলতায় যাব না। তবে এ নির্বাচন আমাকে কতগুলো প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। এক. সরকারি দল যতই বলুক, পৌরসভা নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতি প্রতিফলিত হয় না, বাস্তব সত্য হচ্ছে দুটি বড় দল তথা জোট এবার দলীয়ভাবেই প্রার্থী নির্বাচন করেছে। প্রার্থীরা দলের মার্কা পাননি বটে, কিন্তু তাদের একটা দলীয় পরিচয় ছিল। পৌরসভার ভোটাররা ওই দলীয় পরিচয় দেখেই ভোট দিয়েছেন। তারা জেনেশুনেই আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। দুই. বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তা প্রতিফলিত হয়েছে এ নির্বাচনে। আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা হচ্ছে এ দেশে দ্বিদলীয় একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা। অর্থাৎ দুটো বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দেশের রাজনীতি নির্ধারণ করে।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ দেশে সংসদীয় রাজনীতি পুনরায় শুরু হয়েছে। ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল থেকে শুরু করে যদি ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল দেখি, তাহলে দেখব ভোটাররা এ দুটি বড় দলকেই বেছে নিয়েছে। ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩০.৮১ (আসন ১৪১), আর আওয়ামী লীগের ৩০.০৮ (আসন ৮৮)। ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) এ ফলাফল কিছুটা পাল্টে যায়। আওয়ামী লীগ পায় ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট (আসন ১৪৬) আর বিএনপি পায় ৩৩.৬১ ভাগ ভোট (আসন ১১৬)। আবার পটপরিবর্তন ঘটে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এবার বিএনপির প্রাপ্ত ভোট ৪০ দশমিক ৯৭ (আসন ১৯৩), আর আওয়ামী লীগের ৪০ দশমিক ১৩ (আসন ৬২)। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৮.০৬ ভাগ ভোট (আসন ২৩১), আর বিএনপি পেয়েছে ৩২.৪৫ ভাগ ভোট (আসন ২৯+১)। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, ভোটাররা মূলত দুটি দলের মাঝেই তাদের সমর্থন সীমাবদ্ধ রাখেন। এখানে জাতীয় পর্যায়ে কোন তৃতীয় শক্তির উত্থান এখনও ঘটেনি। সুতরাং আওয়ামী লীগের বিকল্প যে বিএনপি, এটা আবারও প্রমাণিত হল। পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির বেশি আসনে বিজয়ী হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিন. পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুরো ভরাডুবি হয়নি। এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। আগামী তিন বছর দলটিকে এখন হিসাব করে চলতে হবে। চার. বিএনপি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এটা বিএনপির জন্যও একটা প্লাস পয়েন্ট। বিএনপিকে এ বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। অতি ‘উৎসাহী’ হয়ে বিএনপির এমন কোন কিছু করা ঠিক হবে না, যা দলটিকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। বিএনপির নেতৃবৃন্দেরও সংযত হওয়া দরকার। শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, তৃণমূল পর্যায়ে তাদের গণযোগাযোগ বাড়ানো দরকার। পাঁচ. দুটি দলের মাঝেই ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর জন্ম হয়েছে। এরা বিজয়ীও হয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, স্থানীয় এমপি এবং সাবেক এমপি নির্বাচনে প্রভাব খাটিয়েছেন।
ফলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন হয়নি। নির্বাচনে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের আস্থায় নিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতেও ভরাডুবি ঘটতে পারে। ২৩৭টি পৌরসভার মধ্যে ২৪টি পৌরসভা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের কাছে চলে যাওয়া বড় দল দুটির জন্য একটি সিগনাল। স্থানীয় পর্যায়ে বিভক্তি বাড়ানো ঠিক হবে না। ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের দলে টেনে আনাই হবে মঙ্গল। ছয়. এতগুলো পৌরসভায় কোন নারী নেতৃত্ব না থাকায় বিষয়টি দৃষ্টিকটু। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে স্থানীয় পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব না থাকা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রয়োজনে আইন করে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা উচিত। জাতীয় সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসনেরও আমি বিরোধী। আমি চাইব, আইনগতভাবে এক-তৃতীয়াংশ আসনের প্রার্থীপদ নারীদের জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হোক, যারা সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই সংসদে যাবেন। পৌরসভা নির্বাচনেও এমনটি করা যেতে পারে।
জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন ‘অশনি সংকেত’-এর কথা। ‘অশনি সংকেত’ না বলে বলা উচিত, এ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের অনেক কিছু শেখার আছে। যে দল সরকারে যায়, তার ওপর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকে অনেক বেশি। গত দু’বছরে অনেক প্রত্যাশা সরকার পূরণ করতে পারেনি। সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। চালের দাম সাধারণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। সিন্ডিকেটের কথা বারবার বলা হচ্ছে। সরকার যদি এ সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারে তাহলে এটা সরকারের ব্যর্থতা। বাণিজ্যমন্ত্রী অতিরিক্ত কথা বলেন। শীতের মৌসুমেও শাকসবজির মূল্য আকাশচুম্বী। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বারবার বলা সত্ত্বেও ভোজ্যতেলের দাম কমেনি। শেষ অব্দি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে এ কাজটি কেন করতে হবে? প্রয়োজনে অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করা হোক। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। ব্যবসায়ীরা সরকারকে ক্ষমতায় বসায় না, বসায় এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। দল তাকাবে সাধারণ মানুষের দিকে, ব্যবসায়ীদের দিকে নয়। চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাজপথ উত্তপ্ত হবে। তৈরি হবে অস্থিতিশীলতা, সরকারের জন্য যা কখনও ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। এটা সরকারের প্রথম প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকার। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার বিদ্যুৎ। এ শীতেও ‘লোডশেডিং’ হচ্ছে। গ্রীষ্মে পরিস্থিতি কোথায় যাবে ভাবতে পারছি না। সরকার বেশ ক’টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেও পরিস্থিতির সামাল দিতে পারছে না। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বেই। গ্রীষ্মকে সামনে রেখে এখন থেকেই একটি পরিকল্পনা করতে হবে। বিকল্প জ্বালানি ছাড়া কোন পথ খোলা নেই। কয়লানীতি গ্রহণ করে দ্রুত কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং কয়লানির্ভর একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রচুর বাড়ি তৈরি হচ্ছে।
হাজার হাজার কোটি টাকা এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস দিতে না পারলে অসন্তোষ দানা বাঁধবে। বাংলাদেশকে ঞঅচও প্রজেক্টে যুক্ত করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। ঞঅচও প্রজেক্টের আওতায় মধ্য এশিয়ার গ্যাস আসছে নয়াদিল্লিতে। সৌরশক্তি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ জন্য সরকারকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে (যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) ভর্তুকি দিতে হবে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রযুক্তি আমদানি ট্যাক্স ফ্রি করে দিতে হবে। সরকারের তৃতীয় অগ্রাধিকার কর্মসংস্থান। বেকরাত্ব বাড়ছে। বাড়ছে ছদ্ম বেকারত্ব। প্রতি বছর ২০ লাখ লোক যুক্ত হচ্ছে কর্মবাজারে। সরকার সবাইকে কাজ দিতে পারে না। কোন দেশই দেয় না। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়েরও ব্যর্থতা রয়েছে। বিদেশে কর্মসংস্থান আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি। এর প্রতিক্রিয়া স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের ওপর পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। সরকারের উচিত হবে কর্মসংস্থান ও বিদেশে কর্মী পাঠানোর দিকে নজর দেয়া। আমরা তিউনেসিয়ার অভিজ্ঞতা ভুলে যেন না যাই। শেয়ারবাজারের কেলেংকারি সরকার এড়াতে পারে না। ৩৩ লাখ লোক এ ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। ব্রোকারেজ হাউসগুলো এখন চলে গেছে জেলা শহর পর্যায়ে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজারে এ ধরনের ঘটনা ঘটে (১৯৯৬, ২০১১)। দোষ যাদেরই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ভুল স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। গুটিকয়েক লোকের জন্য সরকার কেন বদনামের ভাগিদার হবে? প্রয়োজনে অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব অভিযুক্ত ব্যক্তি পদত্যাগ করে সরকারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে পারেন। সরকারের আরেকটি অগ্রাধিকারের জায়গা হচ্ছে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে আনা ও আইনশৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পৌরনির্বাচনে প্রভাব খাটিয়েছে। সরকারকে আরও সহনশীল হতে হবে। বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে হবে। উত্তেজক কথাবার্তা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। পৌরসভা নির্বাচন বিএনপির জন্যও একটি শিক্ষা বটে। ‘হলুদ কার্ড’ দেখানোর কথা বলে বিএনপি যদি আত্মতৃপ্তিতে ভোগে, তাহলে ভুল করবে। সাধারণ মানুষের কথা বলার জন্য বিএনপিকে সংসদে যেতে হবে। সংসদে তাদের যদি ‘কথা বলতে না দেয়া হয়’, তাহলে সে কথাটাও তাদের জাতিকে জানাতে হবে। যে বিএনপিকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তৃণমূল পর্যায়ের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছিল, দু’বছরের মাথায় তারাই তাদের ওপর আবার আস্থা রাখতে শুরু করেছে। এই ‘আস্থা’ দলটির জন্য একটি বড় পাওয়া। সরকারের ভুলত্র“টি উল্লেখ করে সঠিক নীতি নিয়ে বিএনপিকে এখন এগিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় বড় কথা নয়। বড় কথা, নির্বাচন দলকে কোন কোন শিক্ষা দেয়। এটা অনেকটা দেয়ালের লিখনের মতো। এ দেয়ালের লিখন কেউ পড়ে, কেউ পড়ে না। নির্বাচনে দুটি বড় দলের লড়াই হয়েছে সমানে সমান। এ নির্বাচন আবারও প্রমাণ করল, বড় দল দুটির মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। দল দুটি যদি এ নির্বাচন থেকে শিক্ষা নেয়, তাহলে এ দেশের গণতন্ত্র বিকাশের জন্য তা মঙ্গল।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ যুগান্তর, ২৬/০১/১১]
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ দেশে সংসদীয় রাজনীতি পুনরায় শুরু হয়েছে। ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল থেকে শুরু করে যদি ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল দেখি, তাহলে দেখব ভোটাররা এ দুটি বড় দলকেই বেছে নিয়েছে। ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩০.৮১ (আসন ১৪১), আর আওয়ামী লীগের ৩০.০৮ (আসন ৮৮)। ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) এ ফলাফল কিছুটা পাল্টে যায়। আওয়ামী লীগ পায় ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট (আসন ১৪৬) আর বিএনপি পায় ৩৩.৬১ ভাগ ভোট (আসন ১১৬)। আবার পটপরিবর্তন ঘটে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এবার বিএনপির প্রাপ্ত ভোট ৪০ দশমিক ৯৭ (আসন ১৯৩), আর আওয়ামী লীগের ৪০ দশমিক ১৩ (আসন ৬২)। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৮.০৬ ভাগ ভোট (আসন ২৩১), আর বিএনপি পেয়েছে ৩২.৪৫ ভাগ ভোট (আসন ২৯+১)। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, ভোটাররা মূলত দুটি দলের মাঝেই তাদের সমর্থন সীমাবদ্ধ রাখেন। এখানে জাতীয় পর্যায়ে কোন তৃতীয় শক্তির উত্থান এখনও ঘটেনি। সুতরাং আওয়ামী লীগের বিকল্প যে বিএনপি, এটা আবারও প্রমাণিত হল। পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির বেশি আসনে বিজয়ী হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিন. পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুরো ভরাডুবি হয়নি। এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। আগামী তিন বছর দলটিকে এখন হিসাব করে চলতে হবে। চার. বিএনপি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এটা বিএনপির জন্যও একটা প্লাস পয়েন্ট। বিএনপিকে এ বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। অতি ‘উৎসাহী’ হয়ে বিএনপির এমন কোন কিছু করা ঠিক হবে না, যা দলটিকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। বিএনপির নেতৃবৃন্দেরও সংযত হওয়া দরকার। শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, তৃণমূল পর্যায়ে তাদের গণযোগাযোগ বাড়ানো দরকার। পাঁচ. দুটি দলের মাঝেই ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর জন্ম হয়েছে। এরা বিজয়ীও হয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, স্থানীয় এমপি এবং সাবেক এমপি নির্বাচনে প্রভাব খাটিয়েছেন।
ফলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন হয়নি। নির্বাচনে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের আস্থায় নিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতেও ভরাডুবি ঘটতে পারে। ২৩৭টি পৌরসভার মধ্যে ২৪টি পৌরসভা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের কাছে চলে যাওয়া বড় দল দুটির জন্য একটি সিগনাল। স্থানীয় পর্যায়ে বিভক্তি বাড়ানো ঠিক হবে না। ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের দলে টেনে আনাই হবে মঙ্গল। ছয়. এতগুলো পৌরসভায় কোন নারী নেতৃত্ব না থাকায় বিষয়টি দৃষ্টিকটু। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে স্থানীয় পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব না থাকা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রয়োজনে আইন করে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা উচিত। জাতীয় সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসনেরও আমি বিরোধী। আমি চাইব, আইনগতভাবে এক-তৃতীয়াংশ আসনের প্রার্থীপদ নারীদের জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হোক, যারা সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই সংসদে যাবেন। পৌরসভা নির্বাচনেও এমনটি করা যেতে পারে।
জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন ‘অশনি সংকেত’-এর কথা। ‘অশনি সংকেত’ না বলে বলা উচিত, এ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের অনেক কিছু শেখার আছে। যে দল সরকারে যায়, তার ওপর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকে অনেক বেশি। গত দু’বছরে অনেক প্রত্যাশা সরকার পূরণ করতে পারেনি। সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। চালের দাম সাধারণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। সিন্ডিকেটের কথা বারবার বলা হচ্ছে। সরকার যদি এ সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারে তাহলে এটা সরকারের ব্যর্থতা। বাণিজ্যমন্ত্রী অতিরিক্ত কথা বলেন। শীতের মৌসুমেও শাকসবজির মূল্য আকাশচুম্বী। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বারবার বলা সত্ত্বেও ভোজ্যতেলের দাম কমেনি। শেষ অব্দি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে এ কাজটি কেন করতে হবে? প্রয়োজনে অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করা হোক। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। ব্যবসায়ীরা সরকারকে ক্ষমতায় বসায় না, বসায় এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। দল তাকাবে সাধারণ মানুষের দিকে, ব্যবসায়ীদের দিকে নয়। চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাজপথ উত্তপ্ত হবে। তৈরি হবে অস্থিতিশীলতা, সরকারের জন্য যা কখনও ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। এটা সরকারের প্রথম প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকার। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার বিদ্যুৎ। এ শীতেও ‘লোডশেডিং’ হচ্ছে। গ্রীষ্মে পরিস্থিতি কোথায় যাবে ভাবতে পারছি না। সরকার বেশ ক’টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেও পরিস্থিতির সামাল দিতে পারছে না। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বেই। গ্রীষ্মকে সামনে রেখে এখন থেকেই একটি পরিকল্পনা করতে হবে। বিকল্প জ্বালানি ছাড়া কোন পথ খোলা নেই। কয়লানীতি গ্রহণ করে দ্রুত কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং কয়লানির্ভর একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রচুর বাড়ি তৈরি হচ্ছে।
হাজার হাজার কোটি টাকা এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস দিতে না পারলে অসন্তোষ দানা বাঁধবে। বাংলাদেশকে ঞঅচও প্রজেক্টে যুক্ত করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। ঞঅচও প্রজেক্টের আওতায় মধ্য এশিয়ার গ্যাস আসছে নয়াদিল্লিতে। সৌরশক্তি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ জন্য সরকারকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে (যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) ভর্তুকি দিতে হবে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রযুক্তি আমদানি ট্যাক্স ফ্রি করে দিতে হবে। সরকারের তৃতীয় অগ্রাধিকার কর্মসংস্থান। বেকরাত্ব বাড়ছে। বাড়ছে ছদ্ম বেকারত্ব। প্রতি বছর ২০ লাখ লোক যুক্ত হচ্ছে কর্মবাজারে। সরকার সবাইকে কাজ দিতে পারে না। কোন দেশই দেয় না। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়েরও ব্যর্থতা রয়েছে। বিদেশে কর্মসংস্থান আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি। এর প্রতিক্রিয়া স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের ওপর পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। সরকারের উচিত হবে কর্মসংস্থান ও বিদেশে কর্মী পাঠানোর দিকে নজর দেয়া। আমরা তিউনেসিয়ার অভিজ্ঞতা ভুলে যেন না যাই। শেয়ারবাজারের কেলেংকারি সরকার এড়াতে পারে না। ৩৩ লাখ লোক এ ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। ব্রোকারেজ হাউসগুলো এখন চলে গেছে জেলা শহর পর্যায়ে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজারে এ ধরনের ঘটনা ঘটে (১৯৯৬, ২০১১)। দোষ যাদেরই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ভুল স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। গুটিকয়েক লোকের জন্য সরকার কেন বদনামের ভাগিদার হবে? প্রয়োজনে অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব অভিযুক্ত ব্যক্তি পদত্যাগ করে সরকারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে পারেন। সরকারের আরেকটি অগ্রাধিকারের জায়গা হচ্ছে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে আনা ও আইনশৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পৌরনির্বাচনে প্রভাব খাটিয়েছে। সরকারকে আরও সহনশীল হতে হবে। বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে হবে। উত্তেজক কথাবার্তা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। পৌরসভা নির্বাচন বিএনপির জন্যও একটি শিক্ষা বটে। ‘হলুদ কার্ড’ দেখানোর কথা বলে বিএনপি যদি আত্মতৃপ্তিতে ভোগে, তাহলে ভুল করবে। সাধারণ মানুষের কথা বলার জন্য বিএনপিকে সংসদে যেতে হবে। সংসদে তাদের যদি ‘কথা বলতে না দেয়া হয়’, তাহলে সে কথাটাও তাদের জাতিকে জানাতে হবে। যে বিএনপিকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তৃণমূল পর্যায়ের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছিল, দু’বছরের মাথায় তারাই তাদের ওপর আবার আস্থা রাখতে শুরু করেছে। এই ‘আস্থা’ দলটির জন্য একটি বড় পাওয়া। সরকারের ভুলত্র“টি উল্লেখ করে সঠিক নীতি নিয়ে বিএনপিকে এখন এগিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় বড় কথা নয়। বড় কথা, নির্বাচন দলকে কোন কোন শিক্ষা দেয়। এটা অনেকটা দেয়ালের লিখনের মতো। এ দেয়ালের লিখন কেউ পড়ে, কেউ পড়ে না। নির্বাচনে দুটি বড় দলের লড়াই হয়েছে সমানে সমান। এ নির্বাচন আবারও প্রমাণ করল, বড় দল দুটির মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। দল দুটি যদি এ নির্বাচন থেকে শিক্ষা নেয়, তাহলে এ দেশের গণতন্ত্র বিকাশের জন্য তা মঙ্গল।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ যুগান্তর, ২৬/০১/১১]
0 comments:
Post a Comment