সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০টির বেশি জঙ্গি সংগঠন (?) রয়েছে। এ তথ্যটি দিয়েছেন মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান। তিনি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট। তিনি তাদের একটি গবেষণা থেকেই এ তথ্যটি দিয়েছেন। বিআইপিএসএস ও সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেরোরিজম রিসার্চ (আইসিপিডিটিআর) যৌথভাবে এ সম্মেলনটির আয়োজন করে। বেশ ক’জন বিদেশিও ওই সম্মেলনে অংশ নেন। সম্মেলনে যেসব কথা বলা হয়েছে তার মাঝে রয়েছে
, ১. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা এবার বাংলাদেশকে টার্গেট করছে, ২. পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে তাড়া খাওয়ার পর সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ভাবছে, ৩. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এক সঙ্গে কাজ করা উচিত। ৪. ঢাকাস্থ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে ইত্যাদি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ মার্চ, ২০১০)। সম্মেলনে যেসব কথা উচ্চারিত হয়েছে তা বেশ স্পর্শকাতর এবং তার ব্যাখ্যা দাবি করে। আমি ঠিক জানি না, বাংলাদেশ সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কেউ ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কিনা। না থাকলে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট তারা পেয়ে থাকবেন। সাধারণত এ ধরনের অনুষ্ঠানে আমরা আমন্ত্রিত হই। কিন্তু এবার আমি আমন্ত্রিত হইনি (যদিও অতীতে বিআইপিএসএস আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে)।
আমি নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করি, বিশেষ করে অপ্রচলিত নিরাপত্তায় আমার আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। এটা নিয়ে আমি গবেষণা করি ও একটি বইও আমার প্রকাশিত হয়েছে (বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভাবনা : অপ্র্রচলিত ধারণাসমূহ)। সঙ্গত কারণে তাই নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেমিনারগুলোয় আমি উপস্থিত থাকি। বুঝতে চেষ্টা করি নিরাপত্তার ধারণা কীভাবে বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বহুল আলোচিত একটি বিষয়। শায়েখ আবদুর রহমানের উত্থান ও সারাদেশে একসঙ্গে বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদ আমাদের জানান দিয়েছিল এরা বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রতি কতটুকু হুমকিস্বরূপ। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের ওই ঘটনার পর বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের নেটওয়ার্ক এখন খুব শক্তিশালী বলে আমার মনে হয় না। সরকারের একটা সাফল্য এখানেই যে, তারা শায়খ আবদুর রহমান বা বাংলাভাইকে বিচারের মুখোমুখি করিয়ে তাদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করেছে। এরপর এদের কোনো তত্পরতা নেই বললেই চলে। বিআইপিএসএসের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি পরিচিত। জেনারেল মুনীরুজ্জামানও আমার ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ। তার প্রতিষ্ঠানে গবেষণা হয় না। তিনি মূলত একটি ‘কনসালটেন্সি’ ফার্ম পরিচালনা করেন। দাতাদের চাহিদামত কাজ করেন। আর সেই ‘কাজ’-কে যদি কেউ গবেষণা বলেন আমি অন্তত মানতে নারাজ। গবেষণা এক জিনিস আর ‘কনসালটেন্সি’ অন্য জিনিস। আমরা যারা ‘কনসালটেন্সি করি না, আমাদের কাছে মৌলিক গবেষণাটাই আসল, সেখানে দাতা সংস্থাগুলোর শিখিয়ে দেয়া, তাদের মতো করে কাজ করার কিছু থাকে না। তাই মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান যখন বলেন বাংলাদেশে ৩০টির মতো জঙ্গি সংগঠন রয়েছে, আমি এটাকে গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ তার এই বক্তব্য দাতারা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবে।
আর আমরা তো এটা সবাই জানি কিছু কিছু দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে একটি উঠতি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে (?) পরিণত করতে চায়। পাঠক, এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আইসিজি বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে চাই। গত ১ মার্চ আইসিজি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামানের বক্তব্যের একটি মিল রয়েছে। মূল বিষয়টি হচ্ছে জঙ্গিবাদ ও বাংলাদেশ। কোথায় যেন মনে হচ্ছে একটি ইউরোপীয় শক্তি বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদী (?) রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়! ইউরোপীয়দের টাকায় আমরা ঢাকায় সেমিনার করি, তথাকথিত গবেষণা (?) করি, ওদের কথাই আমাদের মুখ দিয়ে বের হয়। পাঠক, অতীতে আইসিজির অনেক রিপোর্ট বাংলাদেশে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপকে প্রশস্ত করতেই আইসিজি কাজ করছে। এটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নয়া কারসাজি ও কৌশল। নয়া উপনিবেশবাদী ষড়যন্ত্র। জঙ্গিবাদ এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ‘হটকেক’। এটা ‘বিক্রি’ করা সহজ। অভিযোগ আছে বাংলাদেশে ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর ঘটনাবলীর সঙ্গে আইসিজির পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। পাঠক, ফরহাদ মজহারের একটি প্রবন্ধ পড়ে দেখতে পারেন (জরুরি অবস্থা, রাষ্ট্র ও রাজনীতি)। ফরহাদ মজহার আইসিজির ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বোঝার দিক থেকে পরাশক্তির স্বার্থরক্ষাকারী পাশ্চাত্যের থিংকট্যাংকগুলোর আগ্রহ নেই। তাদের আগ্রহ একটাই, ইসলামী সন্ত্রাস দমন। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আওতায় বাংলাদেশকে নিয়ে আসা এবং সে আলোকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার পরিস্থিতি তৈরি করার পরিকল্পনা মূলত ২০০০ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে তালিকায় ফেলে দেয়ার গুরুত্ব এ সময় থেকে। ২০০৬ সালের এক প্রতিবেদনে আইসিজির পরামর্শ ছিল আন্তর্জাতিক শক্তিকে এখনই হস্তক্ষেপ করতে হবে, ‘অবশ্য যদি তারা বাংলাদেশকে তাদের স্ট্রাটেজিক পার্টনার গণ্য করে এবং রাজনৈতিকভাবে আরও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বাংলাদেশে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে তারা অগ্রসর হয়।’ এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাংলাদেশকে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ (?) হিসেবে পরিচিত করান এবং এর সূত্র ধরে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করা। পাঠক, আপনাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা। বেগম জিয়ার সরকারের শেষের দিকে ইউরোপীয় কয়েকটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদের উদ্যোগে ঞঁবংফধু এত্ড়ঁঢ় গঠিত হয়েছিল। এরা অযাচিতভাবে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করত। সেই ধারা থেকে আজও তারা পিছপা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তাদের বক্তব্য সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। তাই আইসিজির বক্তব্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতির সুর মূলত একই—বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ। বলা ভালো আইসিজি ব্রাসেলস-ভিত্তিক একটি সংগঠন। ২০০৬ সালে আইসিজি যে বক্তব্য দিয়েছিল, আর ২০১০ সালে এসে যে বক্তব্য দিল তার মাঝে কোনো অমিল নেই। মূল সুর একটাই—বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ। এখন বিআইপিএসএস যখন ঢাকায় সেমিনার করে (অবশ্যই ওই দাতাগোষ্ঠীর আর্থিক সহায়তায়), তখনও আমরা শুনি জঙ্গিবাদের কথা। আসলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ কোন পর্যায়ে রয়েছে, এটা নিয়ে আমি নিজেও সন্দিহান। বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা হয়ত ঘটছে। কিন্তু তাকে কি বড় করে দেখার কোনো সুযোগ আছে?
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ ই মোহাম্মদ, ভারতের আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের দু’একজন পাতি নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনা দিয়ে কখনই বলা যাবে না বাংলাদেশ জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়। পাকিস্তানে যেভাবে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটেছে, বাংলাদেশে তা আদৌ কোনো দিন ঘটবে না। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু জঙ্গি নয়। তাই মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান সাহেব যখন ৩০টি জঙ্গি সংগঠনের কথা বলেন, আমি তাতে অবাক না হয়ে পারি না। আমি খুশি হব যদি তিনি তার তথাকথিত গবেষণা প্রকাশ করেন। এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আমরা যারা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সিরিয়াস গবেষণা করি (অবশ্যই ব্যক্তি উদ্যোগে এবং দাতাগোষ্ঠীর সাহায্য ছাড়াই), এ ধরনের একটি গবেষণা আমাদের কাজে আসবে। আমার তো মনে হয় সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিত। মেজর জেনারেল মুনীর কি একবারও চিন্তা করে দেখেছেন তার এই বক্তব্য (৩০টি জঙ্গি সংগঠন) এখন বিদেশি মিডিয়ায় কোট হবে। বিদেশিরা তো এটাই চায়। ইহুদি মিডিয়া তো এ বক্তব্য লুফে নেবে। একটি দেশে ৩০টি জঙ্গি সংগঠন থাকার অর্থ হচ্ছে দেশটি একটি জঙ্গি রাষ্ট্র। তালেবানি রাষ্ট্র! অথচ আমাদের দেশের সংসদ আছে। নির্বাচিত সরকার আছে। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো এখানে অনেক শক্তিশালী। এখানে কী করে ৩০টি জঙ্গি সংগঠন থাকে? কি মেথোডলজি অনুসরণ করে এগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে? সূত্র কী? সূত্রগুলো যাচাই হয়েছে কীভাবে? গোয়েন্দা রিপোর্ট কী তাই বলে? এ ধরনের নানা প্রশ্ন আসবে। আমি আহ্বান করব ওই জঙ্গি সংগঠনের নামগুলো প্রকাশ করতে। কেননা বাংলাদেশকে নিয়ে বার বার ‘ষড়যন্ত্র’ হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হবে—এটা আমি কেন, এদেশের কোনো মানুষই চায় না।
আমরা অবশ্যই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। অবশ্যই আমরা এর প্রতিবাদ করব। যারা ইসলামের নামে মানুষ হত্যা করে, তারা সন্ত্রাসী। জেএমবি কোনো ইসলামিক সংগঠন ছিল না। আর শায়খ আবদুর রহমানও কোনো ইসলামিক পণ্ডিত ছিলেন না। জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা করা কোনো খারাপ জিনিস নয়। বিআইপিএসএস যদি এটা নিয়ে গবেষণা করে, যদি সিনিয়র স্কলারদের এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করে, আমি তাকে সাধুবাদ জানাব। কিন্তু সিরিয়াস কোনো গবেষণা ছাড়াই শুধু দাতাদের শেখানো বুলিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করার নাম আর যাই হোক, গবেষণা হতে পারে না। আইসিজির প্রতিবেদন, ইইউর ভূমিকা (যেখান তারা বাংলাদেশকে ইয়েমেনের পর্যায় নিয়ে গেছে) আর ঢাকার সেমিনারের বক্তব্য একই সূত্রে গাঁথা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান অনেক অভিজ্ঞ লোক। তার নিজের সিরিয়াস কোনো গ্রন্থ নেই। তবে ভালো বলতে পারেন। বিআইআইএসএস এ কাজ করার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তিনি নানা বিষয় নিয়ে ভাবেন। এটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু দাতাদের প্রভাবমুক্ত হতে হবে। দাতাদের কাছ থেকে টাকা নিলে, দাতাদের কথাই শুনতে হবে। ফরমাইশি গবেষণা করতে হবে। সত্যিকার গবেষণা করা যাবে না। এই দেশকে আমরা জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই না। এজন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ আমার দেশ, ০৪/০৪/১০]
, ১. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা এবার বাংলাদেশকে টার্গেট করছে, ২. পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে তাড়া খাওয়ার পর সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ভাবছে, ৩. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এক সঙ্গে কাজ করা উচিত। ৪. ঢাকাস্থ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে ইত্যাদি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ মার্চ, ২০১০)। সম্মেলনে যেসব কথা উচ্চারিত হয়েছে তা বেশ স্পর্শকাতর এবং তার ব্যাখ্যা দাবি করে। আমি ঠিক জানি না, বাংলাদেশ সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কেউ ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কিনা। না থাকলে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট তারা পেয়ে থাকবেন। সাধারণত এ ধরনের অনুষ্ঠানে আমরা আমন্ত্রিত হই। কিন্তু এবার আমি আমন্ত্রিত হইনি (যদিও অতীতে বিআইপিএসএস আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে)।
আমি নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করি, বিশেষ করে অপ্রচলিত নিরাপত্তায় আমার আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। এটা নিয়ে আমি গবেষণা করি ও একটি বইও আমার প্রকাশিত হয়েছে (বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভাবনা : অপ্র্রচলিত ধারণাসমূহ)। সঙ্গত কারণে তাই নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেমিনারগুলোয় আমি উপস্থিত থাকি। বুঝতে চেষ্টা করি নিরাপত্তার ধারণা কীভাবে বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বহুল আলোচিত একটি বিষয়। শায়েখ আবদুর রহমানের উত্থান ও সারাদেশে একসঙ্গে বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদ আমাদের জানান দিয়েছিল এরা বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রতি কতটুকু হুমকিস্বরূপ। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের ওই ঘটনার পর বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের নেটওয়ার্ক এখন খুব শক্তিশালী বলে আমার মনে হয় না। সরকারের একটা সাফল্য এখানেই যে, তারা শায়খ আবদুর রহমান বা বাংলাভাইকে বিচারের মুখোমুখি করিয়ে তাদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করেছে। এরপর এদের কোনো তত্পরতা নেই বললেই চলে। বিআইপিএসএসের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি পরিচিত। জেনারেল মুনীরুজ্জামানও আমার ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ। তার প্রতিষ্ঠানে গবেষণা হয় না। তিনি মূলত একটি ‘কনসালটেন্সি’ ফার্ম পরিচালনা করেন। দাতাদের চাহিদামত কাজ করেন। আর সেই ‘কাজ’-কে যদি কেউ গবেষণা বলেন আমি অন্তত মানতে নারাজ। গবেষণা এক জিনিস আর ‘কনসালটেন্সি’ অন্য জিনিস। আমরা যারা ‘কনসালটেন্সি করি না, আমাদের কাছে মৌলিক গবেষণাটাই আসল, সেখানে দাতা সংস্থাগুলোর শিখিয়ে দেয়া, তাদের মতো করে কাজ করার কিছু থাকে না। তাই মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান যখন বলেন বাংলাদেশে ৩০টির মতো জঙ্গি সংগঠন রয়েছে, আমি এটাকে গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ তার এই বক্তব্য দাতারা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবে।
আর আমরা তো এটা সবাই জানি কিছু কিছু দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে একটি উঠতি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে (?) পরিণত করতে চায়। পাঠক, এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আইসিজি বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে চাই। গত ১ মার্চ আইসিজি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামানের বক্তব্যের একটি মিল রয়েছে। মূল বিষয়টি হচ্ছে জঙ্গিবাদ ও বাংলাদেশ। কোথায় যেন মনে হচ্ছে একটি ইউরোপীয় শক্তি বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদী (?) রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়! ইউরোপীয়দের টাকায় আমরা ঢাকায় সেমিনার করি, তথাকথিত গবেষণা (?) করি, ওদের কথাই আমাদের মুখ দিয়ে বের হয়। পাঠক, অতীতে আইসিজির অনেক রিপোর্ট বাংলাদেশে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপকে প্রশস্ত করতেই আইসিজি কাজ করছে। এটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নয়া কারসাজি ও কৌশল। নয়া উপনিবেশবাদী ষড়যন্ত্র। জঙ্গিবাদ এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ‘হটকেক’। এটা ‘বিক্রি’ করা সহজ। অভিযোগ আছে বাংলাদেশে ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর ঘটনাবলীর সঙ্গে আইসিজির পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। পাঠক, ফরহাদ মজহারের একটি প্রবন্ধ পড়ে দেখতে পারেন (জরুরি অবস্থা, রাষ্ট্র ও রাজনীতি)। ফরহাদ মজহার আইসিজির ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বোঝার দিক থেকে পরাশক্তির স্বার্থরক্ষাকারী পাশ্চাত্যের থিংকট্যাংকগুলোর আগ্রহ নেই। তাদের আগ্রহ একটাই, ইসলামী সন্ত্রাস দমন। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আওতায় বাংলাদেশকে নিয়ে আসা এবং সে আলোকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার পরিস্থিতি তৈরি করার পরিকল্পনা মূলত ২০০০ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে তালিকায় ফেলে দেয়ার গুরুত্ব এ সময় থেকে। ২০০৬ সালের এক প্রতিবেদনে আইসিজির পরামর্শ ছিল আন্তর্জাতিক শক্তিকে এখনই হস্তক্ষেপ করতে হবে, ‘অবশ্য যদি তারা বাংলাদেশকে তাদের স্ট্রাটেজিক পার্টনার গণ্য করে এবং রাজনৈতিকভাবে আরও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বাংলাদেশে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে তারা অগ্রসর হয়।’ এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাংলাদেশকে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ (?) হিসেবে পরিচিত করান এবং এর সূত্র ধরে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করা। পাঠক, আপনাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা। বেগম জিয়ার সরকারের শেষের দিকে ইউরোপীয় কয়েকটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদের উদ্যোগে ঞঁবংফধু এত্ড়ঁঢ় গঠিত হয়েছিল। এরা অযাচিতভাবে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করত। সেই ধারা থেকে আজও তারা পিছপা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তাদের বক্তব্য সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। তাই আইসিজির বক্তব্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতির সুর মূলত একই—বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ। বলা ভালো আইসিজি ব্রাসেলস-ভিত্তিক একটি সংগঠন। ২০০৬ সালে আইসিজি যে বক্তব্য দিয়েছিল, আর ২০১০ সালে এসে যে বক্তব্য দিল তার মাঝে কোনো অমিল নেই। মূল সুর একটাই—বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ। এখন বিআইপিএসএস যখন ঢাকায় সেমিনার করে (অবশ্যই ওই দাতাগোষ্ঠীর আর্থিক সহায়তায়), তখনও আমরা শুনি জঙ্গিবাদের কথা। আসলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ কোন পর্যায়ে রয়েছে, এটা নিয়ে আমি নিজেও সন্দিহান। বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা হয়ত ঘটছে। কিন্তু তাকে কি বড় করে দেখার কোনো সুযোগ আছে?
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ ই মোহাম্মদ, ভারতের আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের দু’একজন পাতি নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনা দিয়ে কখনই বলা যাবে না বাংলাদেশ জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়। পাকিস্তানে যেভাবে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটেছে, বাংলাদেশে তা আদৌ কোনো দিন ঘটবে না। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু জঙ্গি নয়। তাই মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান সাহেব যখন ৩০টি জঙ্গি সংগঠনের কথা বলেন, আমি তাতে অবাক না হয়ে পারি না। আমি খুশি হব যদি তিনি তার তথাকথিত গবেষণা প্রকাশ করেন। এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আমরা যারা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সিরিয়াস গবেষণা করি (অবশ্যই ব্যক্তি উদ্যোগে এবং দাতাগোষ্ঠীর সাহায্য ছাড়াই), এ ধরনের একটি গবেষণা আমাদের কাজে আসবে। আমার তো মনে হয় সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিত। মেজর জেনারেল মুনীর কি একবারও চিন্তা করে দেখেছেন তার এই বক্তব্য (৩০টি জঙ্গি সংগঠন) এখন বিদেশি মিডিয়ায় কোট হবে। বিদেশিরা তো এটাই চায়। ইহুদি মিডিয়া তো এ বক্তব্য লুফে নেবে। একটি দেশে ৩০টি জঙ্গি সংগঠন থাকার অর্থ হচ্ছে দেশটি একটি জঙ্গি রাষ্ট্র। তালেবানি রাষ্ট্র! অথচ আমাদের দেশের সংসদ আছে। নির্বাচিত সরকার আছে। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো এখানে অনেক শক্তিশালী। এখানে কী করে ৩০টি জঙ্গি সংগঠন থাকে? কি মেথোডলজি অনুসরণ করে এগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে? সূত্র কী? সূত্রগুলো যাচাই হয়েছে কীভাবে? গোয়েন্দা রিপোর্ট কী তাই বলে? এ ধরনের নানা প্রশ্ন আসবে। আমি আহ্বান করব ওই জঙ্গি সংগঠনের নামগুলো প্রকাশ করতে। কেননা বাংলাদেশকে নিয়ে বার বার ‘ষড়যন্ত্র’ হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হবে—এটা আমি কেন, এদেশের কোনো মানুষই চায় না।
আমরা অবশ্যই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। অবশ্যই আমরা এর প্রতিবাদ করব। যারা ইসলামের নামে মানুষ হত্যা করে, তারা সন্ত্রাসী। জেএমবি কোনো ইসলামিক সংগঠন ছিল না। আর শায়খ আবদুর রহমানও কোনো ইসলামিক পণ্ডিত ছিলেন না। জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা করা কোনো খারাপ জিনিস নয়। বিআইপিএসএস যদি এটা নিয়ে গবেষণা করে, যদি সিনিয়র স্কলারদের এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করে, আমি তাকে সাধুবাদ জানাব। কিন্তু সিরিয়াস কোনো গবেষণা ছাড়াই শুধু দাতাদের শেখানো বুলিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করার নাম আর যাই হোক, গবেষণা হতে পারে না। আইসিজির প্রতিবেদন, ইইউর ভূমিকা (যেখান তারা বাংলাদেশকে ইয়েমেনের পর্যায় নিয়ে গেছে) আর ঢাকার সেমিনারের বক্তব্য একই সূত্রে গাঁথা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামান অনেক অভিজ্ঞ লোক। তার নিজের সিরিয়াস কোনো গ্রন্থ নেই। তবে ভালো বলতে পারেন। বিআইআইএসএস এ কাজ করার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তিনি নানা বিষয় নিয়ে ভাবেন। এটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু দাতাদের প্রভাবমুক্ত হতে হবে। দাতাদের কাছ থেকে টাকা নিলে, দাতাদের কথাই শুনতে হবে। ফরমাইশি গবেষণা করতে হবে। সত্যিকার গবেষণা করা যাবে না। এই দেশকে আমরা জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই না। এজন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ আমার দেশ, ০৪/০৪/১০]
0 comments:
Post a Comment