থাইল্যান্ডে 'লাল শার্ট' আন্দোলন নির্বাচিত একটি সরকারকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এই আন্দোলন প্রমাণ করল, উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো গণতন্ত্র বিনির্মাণে যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সেগুলো তারা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেখানে নির্বাচন হচ্ছে। সরকার গঠিত হচ্ছে। কিন্তু সেই সরকার মেয়াদ শেষ করতে পারছে না। এখানে সরকার আর বিরোধী দলের মধ্যে যে সহাবস্থান প্রয়োজন, তা হচ্ছে না। ফলে নির্বাচন ও জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার গঠিত হলেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে। উন্নয়নশীল বিশ্ব গণতন্ত্রের জন্য আদৌ উপযুক্ত কি না
সে প্রশ্নটিও উঠেছে। সম্ভবত এটা বিবেচনায় নিয়ে ২০০৮ সালে ল্যারি ডায়মন্ড মন্তব্য করেছিলেন এভাবে-We have entered a period of global democratic recesion. অর্থাৎ বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্রের বিকাশে স্থবিরতা এসেছে। যাঁরা গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা ল্যারি ডায়মন্ডের গবেষণার সঙ্গে পরিচিত। উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের ধরন ও বিকাশ নিয়ে তিনি যত গবেষণা করেছেন, অন্য কেউ তা করেননি! অন্য দুই সহকারীর সঙ্গে তাঁর তিন খণ্ডে প্রকাশিত Democracy in Developing Countries গ্রন্থগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে একেকটা রেফারেন্স। থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দিকে তাকালে আমাদের বারবার ল্যারি ডায়মন্ডের মন্তব্যে ফিরে যেতে হয়। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র বিকাশে যে স্থবিরতা এসেছে, এর ঢেউ লেগেছে থাইল্যান্ডেও।
থাইল্যান্ডে নির্বাচন হয়েছে। সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু সেই বৈধ সরকার ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারছে না বিরোধী দলের অসাংবিধানিক কাজের জন্য। শুধু তা-ই নয়, সব বিক্ষোভকারী নিজেদের শরীরের রক্ত সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢেলে দিয়ে যে ঘটনার জন্ম দিল, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের ঘটনা চিন্তা করাও যায় না। থাইল্যান্ডের বিক্ষোভকারীরা একটা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। কেউ কেউ এ ঘটনাকে'Blood Power' হিসেবে চিহ্নিত করলেও তা নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। থাইল্যান্ডের সরকারবিরোধী আন্দোলনের আরো একটি বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিক্ষোভকারীদের লাল শার্ট পরিধান। সবাই লাল শার্ট পরেই বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে এ কালার রেভলিউশনও আমরা অন্যত্র প্রত্যক্ষ করি। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর জর্জিয়ায় গোলাপ বিপ্লব (Rose Revolution) সে দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অ্যাডওয়ার্ড শেভার্দনাদজেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।
আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল জর্জিয়ার বিখ্যাত লাল গোলাপ, যে কারণে শান্তিপূর্ণ ওই বিপ্লব চিহ্নিত হয়েছিল 'গোলাপ বিপ্লব' হিসেবে। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ইউক্রেনের শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে চিহ্নিত করা হয়েছিল কমলা বিপ্লব (Orange Revolution) হিসেবে। ওই বিপ্লব ভিক্টর ইয়ুশ্চেঙ্কোকে সেখানে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ইয়ুশ্চেঙ্কো ও তাঁর সমর্থকরা গলায় কমলা রঙের মাফলার ব্যবহার করতেন। ওই সময় কমলা রং একটি সিম্বলে পরিণত হয়েছিল, যে কারণে ওই গণবিক্ষোভকে চিহ্নিত করা হয়েছিল কমলা বিপ্লব হিসেবে। একই ধারায় ২০০৫ সালের মার্চে মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্তানে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়, তা চিহ্নিত হয়েছে 'টিউলিপ রেভলিউশন' হিসেবে। ওই গণ-অভ্যুত্থান কিরগিজস্তানের প্রেসিডেন্ট আসকার আকায়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। কিরগিজস্তান বিখ্যাত টিউলিপ ফুলের জন্য। আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল বিখ্যাত টিউলিপ ফুল, জর্জিয়ার গোলাপের মতো। থাইল্যান্ডে বিক্ষোভকারীদের হাতে গোলাপ বা টিউলিপ নেই সত্য; কিন্তু লাল শার্ট পরে তারা আন্দোলন করেছে। সবচেয়ে খারাপ যা, তা হচ্ছে নিজের শরীরের রক্ত ঢেলে দিল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। এই ব্লাড পাওয়ার থাইল্যান্ডে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটাবে কি না তা ভবিষ্যতের ব্যাপার।
থাইল্যান্ডে এই যে সরকারবিরোধী আন্দোলন, তার মূলে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা। অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ধনী থাকসিন সনাতন রাজনীতিবিদ নন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর বিরুদ্ধে যত দুর্নীতির অভিযোগ আসুক না কেন, তিনি থাইল্যান্ডকে একটি মাঝারি আকারের শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করেছিলেন। ২০০২ সালের নির্বাচনে তাঁর দল 'থাই র্যাক থাই' পার্টি বিজয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর একটি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি থাইল্যান্ডকে ২০২০ সালের মধ্যে একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির জালে তিনি আটকা পড়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সেখানে সেনা-অভ্যুত্থান হয়। থাইল্যান্ডে সেনা-অভ্যুত্থানের ইতিহাস নতুন নয়। ১৯৩২ সালের প্রথমবারের মতো যে সেনা-অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার মধ্য দিয়ে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো হয় এবং থাইল্যান্ড একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের দেশে পরিণত হয়। জেনারেল ফি বুনের নেতৃত্বে পরিচালিত ওই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জেনারেল ফি বুনের নেতৃত্বে গঠিত হয় Khana Ratsadon বা Peoples Party. ফি বুন ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৫৭ সালে জেনারেল সারিত তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গঠন করেন National Socialist Party. 1963 সালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত হয় United Thai Peoples Party. এভাবে দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডের ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছে। পরিণতিতে দীর্ঘ সময় থাইল্যান্ডে কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি বিকশিত হয়নি।
সিভিলিয়ান হিসেবে যাঁরাই আশির দশকের পর থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন, সবারই যোগাযোগ ছিল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের সঙ্গে। পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন থাকসিন সিনাওয়াত্রা। তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত সেনা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল সোনধি বুজিয়ারাতসিনন। এখানে পার্থক্যটা হলো, তিনি অন্য জেনারেলদের মতো কোনো দল গঠন করেননি। তিনি অবসরপ্রাপ্ত এক জেনারেল সুরাইদ চুলানন্তকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি মনোনীত কিছু সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি 'সংসদ'ও গঠন করেছিলেন। থাই র্যাক থাই পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। একটি নতুন সংবিধানও (১৯৩২ সালের পর ১৭ বার সংবিধান পরিবর্তন করা হয়) প্রণয়ন করা হয়েছিল, যা গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছিল। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে সেখানে নির্বাচন হয়। মজার ব্যাপার, থাকসিন সিনাওয়াত্রার দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া এবং তিনি দেশ ত্যাগ করার পর তাঁর সমর্থকরা Peoples Party-র ব্যানারে সংগঠিত হয়। নির্বাচনে তাঁরা ভালো করে। নির্বাচনের পর তাঁর সমর্থক সামাক সুন্দরাভেজ অন্য পাঁচটি দলের এমপির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। সমস্যার শুরু মূলত সেখান থেকেই। বিরোধী পক্ষের কাছে সুন্দরাভেজ গ্রহণযোগ্য হননি।
তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেও টিভিতে একটি রান্নার অনুষ্ঠান করতেন। সাংবিধানিক আদালত তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করেন। তাঁর দল সোমচাই ওয়াংসাওয়াতকে দলনেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করলেও এবারও সাংবিধানিক আদালত নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে সরকারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বাহ্যত নির্বাচনের পরপরইPeople Alliance for Democracy র নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা অভিজিৎ ভেজ্জাভিজা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে একটি সরকার গঠন করেন। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ছিল, সুন্দরাভেজ বা সোমচাই ওয়াংসাওয়াতের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তা থাকসিন সিনাওয়াত্রার ছায়ামাত্র। মূল ক্ষমতা থাকসিনের হাতে এবং অসৎ উপায় অর্জন করে তাঁরা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁদের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত তাঁদের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও অভিজিৎ যেভাবে সরকার গঠন করেছেন, তাও সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি থাকসিনের সমর্থক বেশ কিছু নেতাকে নিজের দলে টেনে এনেছিলেন। থাকসিনের সমর্থকরা সংসদে দল ত্যাগ করে সরকার গঠনে অভিজিৎকে সমর্থন করেছিলেন। থাইল্যান্ডের বিকাশমান গণতন্ত্রের এটা একটা বড় সমস্যা। এখানে দল ত্যাগের মতো ঘটনা ঘটেছে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে সুবিধাবাদিতা কাজ করছে। নিয়ম অনুযায়ী আগামী বছরের ডিসেম্বরে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে আগাম নির্বাচনও হতে পারে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে থাইল্যান্ডের রাজনীতি এখন কোন দিকে মোড় নেয় বলা মুশকিল। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী একটি সেনা ছাউনিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ইতিমধ্যে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা শুরু হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সরকারের পদত্যাগ ও আগাম নির্বাচনের দাবি করলেও সরকার তাতে রাজি নয়। এতে একটা সমস্যা থেকেই গেল। নির্বাচন দিলেও বিজিত হলে ফলাফল মেনে নেবে কি না সে প্রশ্ন থেকেই গেল। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে পশ্চিমা গোষ্ঠীর কোনো সমর্থন নেই। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রায়নের ওপর জোর দেওয়া হলেও এই গণতন্ত্র উন্নয়নশীল বিশ্বে সত্যিকার অর্থেই বিকশিত হচ্ছে না। রাশিয়া থেকে শুরু করে থাইল্যান্ড পর্যন্ত গণতন্ত্রের যে সংকট, তা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ২৮/০৩/১০]
সে প্রশ্নটিও উঠেছে। সম্ভবত এটা বিবেচনায় নিয়ে ২০০৮ সালে ল্যারি ডায়মন্ড মন্তব্য করেছিলেন এভাবে-We have entered a period of global democratic recesion. অর্থাৎ বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্রের বিকাশে স্থবিরতা এসেছে। যাঁরা গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা ল্যারি ডায়মন্ডের গবেষণার সঙ্গে পরিচিত। উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের ধরন ও বিকাশ নিয়ে তিনি যত গবেষণা করেছেন, অন্য কেউ তা করেননি! অন্য দুই সহকারীর সঙ্গে তাঁর তিন খণ্ডে প্রকাশিত Democracy in Developing Countries গ্রন্থগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে একেকটা রেফারেন্স। থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দিকে তাকালে আমাদের বারবার ল্যারি ডায়মন্ডের মন্তব্যে ফিরে যেতে হয়। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র বিকাশে যে স্থবিরতা এসেছে, এর ঢেউ লেগেছে থাইল্যান্ডেও।
থাইল্যান্ডে নির্বাচন হয়েছে। সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু সেই বৈধ সরকার ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারছে না বিরোধী দলের অসাংবিধানিক কাজের জন্য। শুধু তা-ই নয়, সব বিক্ষোভকারী নিজেদের শরীরের রক্ত সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢেলে দিয়ে যে ঘটনার জন্ম দিল, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের ঘটনা চিন্তা করাও যায় না। থাইল্যান্ডের বিক্ষোভকারীরা একটা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। কেউ কেউ এ ঘটনাকে'Blood Power' হিসেবে চিহ্নিত করলেও তা নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। থাইল্যান্ডের সরকারবিরোধী আন্দোলনের আরো একটি বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিক্ষোভকারীদের লাল শার্ট পরিধান। সবাই লাল শার্ট পরেই বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে এ কালার রেভলিউশনও আমরা অন্যত্র প্রত্যক্ষ করি। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর জর্জিয়ায় গোলাপ বিপ্লব (Rose Revolution) সে দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অ্যাডওয়ার্ড শেভার্দনাদজেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।
আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল জর্জিয়ার বিখ্যাত লাল গোলাপ, যে কারণে শান্তিপূর্ণ ওই বিপ্লব চিহ্নিত হয়েছিল 'গোলাপ বিপ্লব' হিসেবে। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ইউক্রেনের শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে চিহ্নিত করা হয়েছিল কমলা বিপ্লব (Orange Revolution) হিসেবে। ওই বিপ্লব ভিক্টর ইয়ুশ্চেঙ্কোকে সেখানে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ইয়ুশ্চেঙ্কো ও তাঁর সমর্থকরা গলায় কমলা রঙের মাফলার ব্যবহার করতেন। ওই সময় কমলা রং একটি সিম্বলে পরিণত হয়েছিল, যে কারণে ওই গণবিক্ষোভকে চিহ্নিত করা হয়েছিল কমলা বিপ্লব হিসেবে। একই ধারায় ২০০৫ সালের মার্চে মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্তানে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়, তা চিহ্নিত হয়েছে 'টিউলিপ রেভলিউশন' হিসেবে। ওই গণ-অভ্যুত্থান কিরগিজস্তানের প্রেসিডেন্ট আসকার আকায়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। কিরগিজস্তান বিখ্যাত টিউলিপ ফুলের জন্য। আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল বিখ্যাত টিউলিপ ফুল, জর্জিয়ার গোলাপের মতো। থাইল্যান্ডে বিক্ষোভকারীদের হাতে গোলাপ বা টিউলিপ নেই সত্য; কিন্তু লাল শার্ট পরে তারা আন্দোলন করেছে। সবচেয়ে খারাপ যা, তা হচ্ছে নিজের শরীরের রক্ত ঢেলে দিল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। এই ব্লাড পাওয়ার থাইল্যান্ডে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটাবে কি না তা ভবিষ্যতের ব্যাপার।
থাইল্যান্ডে এই যে সরকারবিরোধী আন্দোলন, তার মূলে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা। অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ধনী থাকসিন সনাতন রাজনীতিবিদ নন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর বিরুদ্ধে যত দুর্নীতির অভিযোগ আসুক না কেন, তিনি থাইল্যান্ডকে একটি মাঝারি আকারের শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করেছিলেন। ২০০২ সালের নির্বাচনে তাঁর দল 'থাই র্যাক থাই' পার্টি বিজয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর একটি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি থাইল্যান্ডকে ২০২০ সালের মধ্যে একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির জালে তিনি আটকা পড়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সেখানে সেনা-অভ্যুত্থান হয়। থাইল্যান্ডে সেনা-অভ্যুত্থানের ইতিহাস নতুন নয়। ১৯৩২ সালের প্রথমবারের মতো যে সেনা-অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার মধ্য দিয়ে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো হয় এবং থাইল্যান্ড একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের দেশে পরিণত হয়। জেনারেল ফি বুনের নেতৃত্বে পরিচালিত ওই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জেনারেল ফি বুনের নেতৃত্বে গঠিত হয় Khana Ratsadon বা Peoples Party. ফি বুন ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৫৭ সালে জেনারেল সারিত তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গঠন করেন National Socialist Party. 1963 সালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত হয় United Thai Peoples Party. এভাবে দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডের ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছে। পরিণতিতে দীর্ঘ সময় থাইল্যান্ডে কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি বিকশিত হয়নি।
সিভিলিয়ান হিসেবে যাঁরাই আশির দশকের পর থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন, সবারই যোগাযোগ ছিল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের সঙ্গে। পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন থাকসিন সিনাওয়াত্রা। তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত সেনা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল সোনধি বুজিয়ারাতসিনন। এখানে পার্থক্যটা হলো, তিনি অন্য জেনারেলদের মতো কোনো দল গঠন করেননি। তিনি অবসরপ্রাপ্ত এক জেনারেল সুরাইদ চুলানন্তকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি মনোনীত কিছু সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি 'সংসদ'ও গঠন করেছিলেন। থাই র্যাক থাই পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। একটি নতুন সংবিধানও (১৯৩২ সালের পর ১৭ বার সংবিধান পরিবর্তন করা হয়) প্রণয়ন করা হয়েছিল, যা গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছিল। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে সেখানে নির্বাচন হয়। মজার ব্যাপার, থাকসিন সিনাওয়াত্রার দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া এবং তিনি দেশ ত্যাগ করার পর তাঁর সমর্থকরা Peoples Party-র ব্যানারে সংগঠিত হয়। নির্বাচনে তাঁরা ভালো করে। নির্বাচনের পর তাঁর সমর্থক সামাক সুন্দরাভেজ অন্য পাঁচটি দলের এমপির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। সমস্যার শুরু মূলত সেখান থেকেই। বিরোধী পক্ষের কাছে সুন্দরাভেজ গ্রহণযোগ্য হননি।
তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেও টিভিতে একটি রান্নার অনুষ্ঠান করতেন। সাংবিধানিক আদালত তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করেন। তাঁর দল সোমচাই ওয়াংসাওয়াতকে দলনেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করলেও এবারও সাংবিধানিক আদালত নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে সরকারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বাহ্যত নির্বাচনের পরপরইPeople Alliance for Democracy র নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা অভিজিৎ ভেজ্জাভিজা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে একটি সরকার গঠন করেন। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ছিল, সুন্দরাভেজ বা সোমচাই ওয়াংসাওয়াতের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তা থাকসিন সিনাওয়াত্রার ছায়ামাত্র। মূল ক্ষমতা থাকসিনের হাতে এবং অসৎ উপায় অর্জন করে তাঁরা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁদের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত তাঁদের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও অভিজিৎ যেভাবে সরকার গঠন করেছেন, তাও সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি থাকসিনের সমর্থক বেশ কিছু নেতাকে নিজের দলে টেনে এনেছিলেন। থাকসিনের সমর্থকরা সংসদে দল ত্যাগ করে সরকার গঠনে অভিজিৎকে সমর্থন করেছিলেন। থাইল্যান্ডের বিকাশমান গণতন্ত্রের এটা একটা বড় সমস্যা। এখানে দল ত্যাগের মতো ঘটনা ঘটেছে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে সুবিধাবাদিতা কাজ করছে। নিয়ম অনুযায়ী আগামী বছরের ডিসেম্বরে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে আগাম নির্বাচনও হতে পারে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে থাইল্যান্ডের রাজনীতি এখন কোন দিকে মোড় নেয় বলা মুশকিল। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী একটি সেনা ছাউনিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ইতিমধ্যে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা শুরু হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সরকারের পদত্যাগ ও আগাম নির্বাচনের দাবি করলেও সরকার তাতে রাজি নয়। এতে একটা সমস্যা থেকেই গেল। নির্বাচন দিলেও বিজিত হলে ফলাফল মেনে নেবে কি না সে প্রশ্ন থেকেই গেল। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে পশ্চিমা গোষ্ঠীর কোনো সমর্থন নেই। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রায়নের ওপর জোর দেওয়া হলেও এই গণতন্ত্র উন্নয়নশীল বিশ্বে সত্যিকার অর্থেই বিকশিত হচ্ছে না। রাশিয়া থেকে শুরু করে থাইল্যান্ড পর্যন্ত গণতন্ত্রের যে সংকট, তা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ২৮/০৩/১০]
অসাধারণ,দার্শনিক চিন্তানীয় লেখক,,
ReplyDeleteতুলনামূলক আলোচনা।