ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লিয়ন চোয়েন জিগমে ওয়াই থিনলে পাঁচ দিনের বাংলাদেশ সফর শেষ করে দেশে ফিরে গেছেন গত ১৪ জানুয়ারি। ভুটান বর্তমানে সার্কের চেয়ারম্যান। সুতরাং তার বাংলাদেশ সফরের কিছুটা হলেও গুরুত্ব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলোচনা, এমনকি বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে বৈঠকও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে তাঁর আলোচনায় খালেদা জিয়া মন্তব্য করেছেন, সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করলে সার্কই হবে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিরক্ষার প্রতিষ্ঠান। সার্কের বয়স চলতি ডিসেম্বরে ২৬ বছর পার করলেও সার্ক নিয়ে যখন এক ধরনের হতাশা কাজ করছে, তখন খালেদা জিয়ার মন্তব্যটি গুরুত্ব বহন করে বৈকি! এমনকি ভুটান যখন বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিতে চায়, তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী জিগমে ওয়াই থিনলে গত ১৩ জানুয়ারি সংবাদকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। বাংলাদেশ যখন চলতি গ্রীষ্মে বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, তখন প্রধানমন্ত্রী থিনলে বলেছেন বাংলাদেশকে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে বিদ্যুৎ দেওয়ার চেষ্টা করবে ভুটান। তবে এর জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী থিনলে আরো বলেছেন, ভুটান চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী। এখানে তিনি যা বলেননি তা হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে তাঁর আমদানি-রপ্তানি ভারতের 'সাত বোন' রাজ্যের মধ্য দিয়ে তাঁকে নিয়ে যেতে হবে। ভারতের অনুমতি এখানে প্রয়োজন। ভারত না চাইলে ভুটান চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা পাবে না। সাম্প্রতিককালে 'কানেকটিভিটি' বা বহুপক্ষীয় যাতায়াত ব্যবস্থার কথা খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যখন গেল জানুয়ারিতে ভারতে গিয়েছিলেন এবং ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তখন তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা ভুটান ও নেপালকেও দিতে চায়। চীনের ইউনান প্রদেশ সফরের সময় তিনি কুনমিং-চট্টগ্রাম সড়ক যোগাযোগ তথা চীন কর্তৃক চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের কথাও বলেছিলেন।
বাংলাদেশের সদিচ্ছা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন নেই ভুটানের সদিচ্ছা নিয়েও। এটাই হচ্ছে আঞ্চলিক সহযোগিতার মোদ্দা কথা। বিশ্বায়নের যুগে কেউ একা চলতে পারে না। কিন্তু মূল সমস্যা ভারতকে নিয়ে। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে বহুপাক্ষিকতার ওপর গুরুত্ব দিলেও ভারত বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে না। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি দ্বিপক্ষীয় নীতির আলোকে পরিচালিত। এ ক্ষেত্রে যখন ত্রিপক্ষীয় আলোচনার প্রশ্ন ওঠে, ঠিক তখনই এ আলোচনা আর এগিয়ে যায় না। আজ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী যখন ত্রিপক্ষীয় আলোচনার কথা বলেন, তখন তিনি সত্য কথাটাই বলেন। ভুটানে সারপ্লাস বিদ্যুৎ রয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে ভুটান আরো ১০টি বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই জলবিদ্যুতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে নেপালে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, নেপালে যে জলসম্পদ রয়েছে তা কাজে লাগিয়ে এক লাখ মেগাওয়াটের ওপর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, এমনকি সুদূর পাকিস্তানেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতার আলোকে নেপালের জলসম্পদকে কাজে লাগানোর কথা বলে আসছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অথচ ভারত ভুটান ও নেপালের জলসম্পদকে নিজের কাজে লাগিয়েছে। ভারত সেই ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে নেপালের সঙ্গে জলসম্পদ আহরণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি চুক্তি করেছিল। এতে নেপালের চারটি নদীতে (কর্ণালী, পঞ্চেশ্বর, সপ্তকোষী ও বুড়িগঙ্গকী) স্টোরেজ ড্যাম নির্মাণ করা হয়, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৯৩ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন ভুটানের রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকের ভারত সফরের সময় ভুটানের সাংকোশ নদীতে একটি বহুমুখী ড্যাম তৈরির বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে সাড়ে ১২ লাখ একর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ভুটানের মানোস নদীর প্রধান উপনদীর ওপর ভারত নির্মাণ করেছে কুরিচু ড্যাম। পরবর্তী সময়ে ভারত ওয়াংচু নদীতে আরো তিনটি ড্যাম নির্মাণ করেছে। এগুলো করা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ সুবিধা দেওয়ার জন্য। ফলে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারের মতো নদীগুলোর শুকনো মৌসুমের প্রবাহে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি দেখা দেবে বলে তৎকালীন সেচমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন (জনকণ্ঠ, ১২ জুন, ১৯৯৩)। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত বেশ কয়েকটি সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে আঞ্চলিক ভিত্তিতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা বলা হলেও আঞ্চলিক ভিত্তিতে একটি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়নি। শুধু ভারত চায় দ্বিপাক্ষিকতা, বহুপাক্ষিকতা ভারতের নীতি নয়। নেপাল ও ভুটানের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও অতি সাম্প্রতিককালে একটি জলবিদ্যুৎ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল ভারত। চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা গেলে ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন কেব্লের মাধ্যমে পক প্রণালী দিয়ে তামিলনাড়ুর মদুরাই পাওয়ার গ্রিড থেকে মানমারে অবস্থিত থালাইমাম্মার ও অনুরাধাপুরা ন্যাশনাল পাওয়ার গ্রিডে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা সহজ হবে। বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত বাংলাদেশকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ জন্য বাংলাদেশকে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। ব্যয় হবে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ এ জন্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণও নিয়েছে। কিন্তু গেল বছর একটি সম্মেলনে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের বাংলাদেশি অধ্যাপক ড. মুসতাক খান একটি 'বোমা' ফাটিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতের পক্ষে কোনো দিনই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এখন দেখতে হবে ভারত কবে নাগাদ প্রস্তাবিত ওই বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। অথচ আঞ্চলিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা অনেক সহজ।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রশ্নটি উঠলেও দক্ষিণ এশিয়ায় এই আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রশ্নটি একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে সার্ক গঠিত হয়েছিল। এরই মাঝে ২৫ বছর পার হয়ে গেছে। যতটুকু প্রত্যাশা ছিল সার্ককে নিয়ে, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এখানে বড় অর্থনীতি হিসেবে ভারতের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল, তা ভারত পারেনি। ২০০৩ সালে নয়াদিলি্লতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ভারতের বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনেও (২০০২, কাঠমাণ্ডু) এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এ ধরনের ইউনিয়ন নতুন কিছু নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা না হয় বাদই দিলাম (১৯৫৭, ইইসি), ১৯৬৭ সালে গঠিত হওয়া আসিয়ান এখন ধীরে ধীরে একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলো গঠন করেছিল 'অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিটি' (ওএইউ)। ওএইউ এখন পরিণত হয়েছে আফ্রিকান ইউনিয়নে। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠন নিয়ে তেমন কিছু শোনা যায় না। সম্ভবত ভারত এখন তা চায় না। অনেকেই জানেন ভারতের লক্ষ্য এখন আসিয়ানের দিকে। ভারত আসিয়ানের সদস্য হতে চায়। আর সে লক্ষ্যে ভারত ইতিমধ্যে 'আসিয়ান ডায়ালগ পার্টনার'-এর সদস্য হয়েছে, যা বাংলাদেশ হয়নি। ভারত একই সঙ্গে 'গঙ্গা-মেকং সহযোগিতার' ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, যে কারণে 'কুনমিং উদ্যোগ' তার কাছে গুরুত্ব পায়নি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটি বিশ্ব সমস্যায় আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেছেন। এখানে ভুটান কিংবা বাংলাদেশের ভূমিকা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের ভূমিকা। প্রযুক্তিগত দিক অথবা পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
কিন্তু ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ভারত অন্য তিনটি দেশকে (ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন) নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যখন একটি 'সমঝোতা চুক্তি' করে, তখন বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষিত হয় বৈকি! কেননা লন্ডনভিত্তিক 'দ্য ক্লাইমেট চেঞ্জ ভালনারেবিলিটি ইনডেক্স' অনুযায়ী বিশ্বে চরম ঝুঁকিতে থাকা ১৬টি দেশের মধ্যে পাঁচটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত। এমনকি জার্মান ওয়াচ 'গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০১১'-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। তাই ভুটানের প্রধানমন্ত্রী যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেন, তখন তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে ওঠেনি। কেননা ভারতের বড় উদ্যোগ আমরা লক্ষ করিনি। বাংলাদেশ যেখানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে (যা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী) মাত্র শূন্য দশমিক ২ টন, সেখানে ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারতের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ দুই বিলিয়ন টন (মাথাপিছু দুই মেট্রিক টন)। ১৯৮০ সালে ভারতের এর পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন টন। ভারতে জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে। শুধু 'জ্বালানি স্বার্থ'র কারণে ভারত মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সমর্থন করেনি। আরো খারাপ খবর গত ৩০ বছরে গঙ্গোত্রী হিমবাহ ১.৫ কিলোমিটার দূরে সরে গেছে। জন ভাইডালের একটি প্রতিবেদন (গার্ডিয়ান, ৭ ডিসেম্বর ২০০৯) যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা আঁতকে উঠবেন এই খবর শুনে যে হিমালয়ের গ্লোসিয়ারগুলো গলছে। তুলগি (Thulagi) গ্লোসিয়ার প্রতিবছর ৫০ মিটার গলছে। এটা যদি অতিরিক্ত গরমে ভেঙে যায় তাহলে কয়েক মিলিয়ন লিটার পানি নিচের দিকে নেমে আসবে। ভাসিয়ে দেবে বাংলাদেশকে। তাই বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করার জন্য ডারবান চুক্তি (নভেম্বর, ২০১১) যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বড় শক্তি হিসেবে ভারতকেও এগিয়ে আসতে হবে।
আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রশ্নে আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি, কিন্তু আমাদের সমুদ্রসীমার ওপর ভারত তার দাবি প্রত্যাহার করে নেয়নি। সংসদে দীপু মনি জানিয়েছিলেন (নয়া দিগন্ত, ২৯ জুন ২০০৯), ভারতের সঙ্গে আমাদের আট হাজার ৭১৪ বর্গমাইল সমুদ্র এলাকা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। ভারত আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ছাড় দেয়নি। ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার সীমান্ত ৪০ বছরেও চিহ্নিত হয়নি। আর একজন কিশোরী ফেলানীর লাশ যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকে, তখন বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ভারত এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি। দায়ী ব্যক্তিদের বিচারও করেনি, যা তারা করেছিল কাশ্মীরে এক কিশোরকে হত্যা করার পর। ফারাক্কায় চুক্তি হয়েছে। কিন্তু পদ্মা শুকিয়ে মরা খাল। এখন শুনছি তিস্তার ব্যাপারে একটি 'চুক্তি' হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী বললেন, তিনি কিছুই জানেন না। পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়ে কোনো চুক্তি হতে পারে না। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি হবে ভারতের। বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১৭ শতাংশ। মাথাপিছু আয় হবে ২২ হাজার ডলার। এ মতামত হরিন্দর কোহলীর, যিনি বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা। সুতরাং আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে ভারতের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসে এই আঞ্চলিক সহযোগিতার কথাই বলে গেলেন। তাঁর ঢাকা সফর এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কন্ঠ, ১৯/০১/১১]
বাংলাদেশের সদিচ্ছা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন নেই ভুটানের সদিচ্ছা নিয়েও। এটাই হচ্ছে আঞ্চলিক সহযোগিতার মোদ্দা কথা। বিশ্বায়নের যুগে কেউ একা চলতে পারে না। কিন্তু মূল সমস্যা ভারতকে নিয়ে। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে বহুপাক্ষিকতার ওপর গুরুত্ব দিলেও ভারত বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে না। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি দ্বিপক্ষীয় নীতির আলোকে পরিচালিত। এ ক্ষেত্রে যখন ত্রিপক্ষীয় আলোচনার প্রশ্ন ওঠে, ঠিক তখনই এ আলোচনা আর এগিয়ে যায় না। আজ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী যখন ত্রিপক্ষীয় আলোচনার কথা বলেন, তখন তিনি সত্য কথাটাই বলেন। ভুটানে সারপ্লাস বিদ্যুৎ রয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে ভুটান আরো ১০টি বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই জলবিদ্যুতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে নেপালে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, নেপালে যে জলসম্পদ রয়েছে তা কাজে লাগিয়ে এক লাখ মেগাওয়াটের ওপর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, এমনকি সুদূর পাকিস্তানেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতার আলোকে নেপালের জলসম্পদকে কাজে লাগানোর কথা বলে আসছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অথচ ভারত ভুটান ও নেপালের জলসম্পদকে নিজের কাজে লাগিয়েছে। ভারত সেই ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে নেপালের সঙ্গে জলসম্পদ আহরণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি চুক্তি করেছিল। এতে নেপালের চারটি নদীতে (কর্ণালী, পঞ্চেশ্বর, সপ্তকোষী ও বুড়িগঙ্গকী) স্টোরেজ ড্যাম নির্মাণ করা হয়, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৯৩ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন ভুটানের রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকের ভারত সফরের সময় ভুটানের সাংকোশ নদীতে একটি বহুমুখী ড্যাম তৈরির বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে সাড়ে ১২ লাখ একর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ভুটানের মানোস নদীর প্রধান উপনদীর ওপর ভারত নির্মাণ করেছে কুরিচু ড্যাম। পরবর্তী সময়ে ভারত ওয়াংচু নদীতে আরো তিনটি ড্যাম নির্মাণ করেছে। এগুলো করা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ সুবিধা দেওয়ার জন্য। ফলে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারের মতো নদীগুলোর শুকনো মৌসুমের প্রবাহে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি দেখা দেবে বলে তৎকালীন সেচমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন (জনকণ্ঠ, ১২ জুন, ১৯৯৩)। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত বেশ কয়েকটি সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে আঞ্চলিক ভিত্তিতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা বলা হলেও আঞ্চলিক ভিত্তিতে একটি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়নি। শুধু ভারত চায় দ্বিপাক্ষিকতা, বহুপাক্ষিকতা ভারতের নীতি নয়। নেপাল ও ভুটানের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও অতি সাম্প্রতিককালে একটি জলবিদ্যুৎ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল ভারত। চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা গেলে ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন কেব্লের মাধ্যমে পক প্রণালী দিয়ে তামিলনাড়ুর মদুরাই পাওয়ার গ্রিড থেকে মানমারে অবস্থিত থালাইমাম্মার ও অনুরাধাপুরা ন্যাশনাল পাওয়ার গ্রিডে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা সহজ হবে। বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত বাংলাদেশকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ জন্য বাংলাদেশকে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। ব্যয় হবে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ এ জন্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণও নিয়েছে। কিন্তু গেল বছর একটি সম্মেলনে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের বাংলাদেশি অধ্যাপক ড. মুসতাক খান একটি 'বোমা' ফাটিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতের পক্ষে কোনো দিনই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এখন দেখতে হবে ভারত কবে নাগাদ প্রস্তাবিত ওই বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। অথচ আঞ্চলিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা অনেক সহজ।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রশ্নটি উঠলেও দক্ষিণ এশিয়ায় এই আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রশ্নটি একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে সার্ক গঠিত হয়েছিল। এরই মাঝে ২৫ বছর পার হয়ে গেছে। যতটুকু প্রত্যাশা ছিল সার্ককে নিয়ে, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এখানে বড় অর্থনীতি হিসেবে ভারতের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল, তা ভারত পারেনি। ২০০৩ সালে নয়াদিলি্লতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ভারতের বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনেও (২০০২, কাঠমাণ্ডু) এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এ ধরনের ইউনিয়ন নতুন কিছু নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা না হয় বাদই দিলাম (১৯৫৭, ইইসি), ১৯৬৭ সালে গঠিত হওয়া আসিয়ান এখন ধীরে ধীরে একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলো গঠন করেছিল 'অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিটি' (ওএইউ)। ওএইউ এখন পরিণত হয়েছে আফ্রিকান ইউনিয়নে। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠন নিয়ে তেমন কিছু শোনা যায় না। সম্ভবত ভারত এখন তা চায় না। অনেকেই জানেন ভারতের লক্ষ্য এখন আসিয়ানের দিকে। ভারত আসিয়ানের সদস্য হতে চায়। আর সে লক্ষ্যে ভারত ইতিমধ্যে 'আসিয়ান ডায়ালগ পার্টনার'-এর সদস্য হয়েছে, যা বাংলাদেশ হয়নি। ভারত একই সঙ্গে 'গঙ্গা-মেকং সহযোগিতার' ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, যে কারণে 'কুনমিং উদ্যোগ' তার কাছে গুরুত্ব পায়নি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটি বিশ্ব সমস্যায় আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেছেন। এখানে ভুটান কিংবা বাংলাদেশের ভূমিকা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের ভূমিকা। প্রযুক্তিগত দিক অথবা পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
কিন্তু ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ভারত অন্য তিনটি দেশকে (ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন) নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যখন একটি 'সমঝোতা চুক্তি' করে, তখন বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষিত হয় বৈকি! কেননা লন্ডনভিত্তিক 'দ্য ক্লাইমেট চেঞ্জ ভালনারেবিলিটি ইনডেক্স' অনুযায়ী বিশ্বে চরম ঝুঁকিতে থাকা ১৬টি দেশের মধ্যে পাঁচটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত। এমনকি জার্মান ওয়াচ 'গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০১১'-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। তাই ভুটানের প্রধানমন্ত্রী যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেন, তখন তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে ওঠেনি। কেননা ভারতের বড় উদ্যোগ আমরা লক্ষ করিনি। বাংলাদেশ যেখানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে (যা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী) মাত্র শূন্য দশমিক ২ টন, সেখানে ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারতের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ দুই বিলিয়ন টন (মাথাপিছু দুই মেট্রিক টন)। ১৯৮০ সালে ভারতের এর পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন টন। ভারতে জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে। শুধু 'জ্বালানি স্বার্থ'র কারণে ভারত মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সমর্থন করেনি। আরো খারাপ খবর গত ৩০ বছরে গঙ্গোত্রী হিমবাহ ১.৫ কিলোমিটার দূরে সরে গেছে। জন ভাইডালের একটি প্রতিবেদন (গার্ডিয়ান, ৭ ডিসেম্বর ২০০৯) যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা আঁতকে উঠবেন এই খবর শুনে যে হিমালয়ের গ্লোসিয়ারগুলো গলছে। তুলগি (Thulagi) গ্লোসিয়ার প্রতিবছর ৫০ মিটার গলছে। এটা যদি অতিরিক্ত গরমে ভেঙে যায় তাহলে কয়েক মিলিয়ন লিটার পানি নিচের দিকে নেমে আসবে। ভাসিয়ে দেবে বাংলাদেশকে। তাই বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করার জন্য ডারবান চুক্তি (নভেম্বর, ২০১১) যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বড় শক্তি হিসেবে ভারতকেও এগিয়ে আসতে হবে।
আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রশ্নে আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি, কিন্তু আমাদের সমুদ্রসীমার ওপর ভারত তার দাবি প্রত্যাহার করে নেয়নি। সংসদে দীপু মনি জানিয়েছিলেন (নয়া দিগন্ত, ২৯ জুন ২০০৯), ভারতের সঙ্গে আমাদের আট হাজার ৭১৪ বর্গমাইল সমুদ্র এলাকা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। ভারত আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ছাড় দেয়নি। ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার সীমান্ত ৪০ বছরেও চিহ্নিত হয়নি। আর একজন কিশোরী ফেলানীর লাশ যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকে, তখন বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ভারত এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি। দায়ী ব্যক্তিদের বিচারও করেনি, যা তারা করেছিল কাশ্মীরে এক কিশোরকে হত্যা করার পর। ফারাক্কায় চুক্তি হয়েছে। কিন্তু পদ্মা শুকিয়ে মরা খাল। এখন শুনছি তিস্তার ব্যাপারে একটি 'চুক্তি' হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী বললেন, তিনি কিছুই জানেন না। পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়ে কোনো চুক্তি হতে পারে না। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি হবে ভারতের। বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১৭ শতাংশ। মাথাপিছু আয় হবে ২২ হাজার ডলার। এ মতামত হরিন্দর কোহলীর, যিনি বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা। সুতরাং আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে ভারতের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসে এই আঞ্চলিক সহযোগিতার কথাই বলে গেলেন। তাঁর ঢাকা সফর এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কন্ঠ, ১৯/০১/১১]
0 comments:
Post a Comment