লিবিয়ায় মার্কিন বিমান হামলাকে এখন চিহ্নিত করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও ওয়াশিংটনের পেন্টাগন ভবনে আত্মঘাতী বিমান হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শুরু করেছিল। ওই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আফগানিস্তানে ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলার মধ্য দিয়ে। ২৬ ডিসেম্বর হামিদ কারজাইকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে কার্যত দেশটি দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই দখলীস্বত্ব আজও বজায় রয়েছে। আফগানিস্তান 'দখল' ও ক্ষমতাসীন তালেবানদের কাবুলের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উৎখাতের পেছনে যুক্তি ছিল, তালেবান নেতা মোল্লা
ওমর আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের জন্য ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা হয়েছিল। দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে। ওই বিমান হামলার মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় ৯ এপ্রিল বাগদাদ দখল করে নিয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী। সাদ্দাম হোসেন উৎখাত হয়েছিলেন (ডিসেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল)। অভিযোগ ছিল, ইরাকের কাছে তথাকথিত WMD (Weapons of Mass Destruction) আছে, যা এ অঞ্চলের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। বাস্তবতা হচ্ছে, আফগানিস্তানে যেমনি ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, ঠিক তেমনি ইরাকেও ডগউ-এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইরাক আক্রমণের আট বছর পর, ২০১১ সালের ১৯ মার্চ ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী (সেই সঙ্গে ফ্রান্স) লিবিয়া আক্রমণ করল। এবারের যুক্তি, গাদ্দাফি বাহিনীর অত্যাচার থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি অনুমোদন রয়েছে বটে, কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধের কোনো অনুমতি দেয়নি। জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারাবলে নিরাপত্তা পরিষদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে (রাশিয়া, চীন ও জার্মানি অনুপস্থিত ছিল)। ওই ধারায় বলা আছে, 'প্রয়োজনীয় বিধিব্যবস্থা' নেওয়ার কথা। কিন্তু বিমান হামলা কোনো অবস্থায়ই 'বিধিব্যবস্থা নেওয়ার' পর্যায়ে পড়ে না। যুদ্ধ শুরু করা কিংবা আক্রমণ করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে অপর আরেকটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা যুক্তরাষ্ট্র নেয়নি। এমনকি 'যে নিরীহ সাধারণ জনগণকে' রক্ষার জন্য এ বিমান হামলা, এই হামলায় তো সাধারণ মানুষও মারা গেছে। এ মৃত্যুর বিচার এখন কে করবে?
স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব আসরে যুক্তরাষ্ট্র তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তির অনুপস্থিতিতে কিংবা দুর্বলতার সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র দিন দিন একটি আগ্রাসী ও যুদ্ধবাজ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অথচ খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই কellog-Briand Pact নামে একটি আইন রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী যেকোনো যুদ্ধ (যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক) অবৈধ ও নিন্দনীয়। কেলগ (Kellog) ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট_অর্থাৎ বিদেশসচিব। যুদ্ধকে ঘৃণা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের জন্য ১৯২৯ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। আজ যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে ব্যবহার করে তৃতীয় যুদ্ধের সূচনা করল বটে, কিন্তু জাতিসংঘ সনদেই যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী এ বিমান হামলা অবৈধ। সনদের ৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, 'বর্তমান সনদে জাতিসংঘ কোনো রাষ্ট্রের নিছক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে না বা সেরূপ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য কোনো সদস্যকে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে না (তবে এখানে ৫১ নম্বর ধারায় নিরাপত্তা পরিষদকে কিছুটা অধিকার দেওয়া হয়েছে, যা কোনো অবস্থায়ই যুদ্ধ শুরু করার অনুমতি নয়)।' এমনকি সনদের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, 'সব সদস্য তাদের আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে এমনভাবে নিষ্পত্তি করবে, যাতে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার বিঘি্নত না হয়।'
এটা অস্বীকার করা যাবে না যে লিবিয়ায় কোনো সংকট তৈরি হয়নি। লিবিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। সেখানে সরকার পতনের আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল। এটা নিঃসন্দেহে লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। জাতিসংঘ সনদের ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী লিবিয়ার এই অভ্যন্তরীণ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেন হস্তক্ষেপ করতে পারে না (একই ধরনের ঘটনায় তারা মিসর, তিউনিসিয়া, কিংবা বাহরাইনে হস্তক্ষেপ করেনি)। ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী লিবিয়ার এই অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি আন্তর্জাতিক শান্তি কিংবা নিরাপত্তা বিঘি্নত করেনি। যেখানে জাতিসংঘ সনদের ৪ নম্বর ধারায় যেকোনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন করা থেকে অন্য রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত থাকতে বলা হয়েছে, সেখানে ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলায় লিবিয়ার রাজনৈতিক স্বাধীনতা আজ বিপন্ন। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র আজ নিজে নিজের আইন ভঙ্গ করছে। ২০১০ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা National Security Strategy-র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, 'Military force, at times, may be necessary to defend our country and allies or to preserve broader peace and security, including by protecting civilians facing a grave humanitarian crisis....The United States must reserve the right to act unilaterally if necessary, to defend our nation and our interests, get we well also seek to adhere to standards that govern the use of force|' এখন লিবিয়ায় বিমান আক্রমণের সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট ওবামার নিজের বক্তব্যেরই বিরোধী। লিবিয়া এমন কোনো হটকারী সিদ্ধান্ত নেয়নি, যা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে বিঘি্নত করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারে। আর ওবামা নির্বাচনের আগে যুদ্ধের অবসান ও একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রবাসীর কাছে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন, কিন্তু মাত্র তিন বছরের মাথায় ওবামা যুদ্ধের সূচনা করে নিজেকে আরেকজন যুদ্ধবাজ নেতা হিসেবে পরিচিত করলেন। অথচ শান্তির জন্য তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে পেন্টাগন, গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, বহুজাতিক সংস্থা, করপোরেট হাউস, এমনকি ইসরায়েলি লবি একটি বড় ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। আফগানিস্তান আর ইরাক এর বড় প্রমাণ। ইরাকের মতো লিবিয়ারও রয়েছে প্রচুর তেলসম্পদ। আন্তর্জাতিক তেল কম্পানিগুলোর আগ্রহ রয়েছে এই তেলসম্পদের দিকে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে মুনাফা অর্জনই তাদের লক্ষ্য, যেমনটি তারা করেছিল ইরাকে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মিখায়েল হাস ২০০৯ সালে একটি বই লিখেছিলেন। George W. Bush : War Criminals? The Bush Administration Liability for 269 War Crimes। ২০১০ সালে বইটির পরিবর্ধিত সংস্করণে প্রেসিডেন্ট ওবামাকেও তিনি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অধ্যাপক হাস পাঁচটি ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধ (আফগানিস্তান ও ইরাক) সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে_১. গৃহযুদ্ধে বিরোধীপক্ষকে সমর্থন দেওয়া (আফগানিস্তানে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন), ২. যুদ্ধের হুমকি দেওয়া, ৩. আগ্রাসী যুদ্ধের পরিকল্পনা করা, ৪. যুদ্ধের জন্য ষড়যন্ত্র করা, ৫. যুদ্ধের পক্ষে প্রপাগান্ডা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে দুটি আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। প্রথমটি International Military Tribunal at Nuremberg, যেখানে জার্মান নারীদের যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছিল। দ্বিতীয়টি, International Military Tribunal for Far East, যেখানে জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছিল। নুরেমবার্গের আদালতে যুদ্ধাপরাধের তিনটি দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে_শান্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যুদ্ধে অপরাধ করা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। অধ্যাপক হাস যে পাঁচটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেছেন কিংবা International Military Tribunals যুদ্ধাপরাধের যে দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তাতে আজ ওবামাও অভিযুক্ত হতে পারেন। কেননা ওবামা প্রশাসন গাদ্দাফিবিরোধী শক্তিকে সহযোগিতা ও সমর্থন করছে। হোয়াইট হাউসে ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর সেই নীতিটি হচ্ছে আগ্রাসী, সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, হুমকি ও বলপ্রয়োগ করে স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা। লিবিয়ার সমস্যার খুব দ্রুত সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। 'অপারেশন অডিসি ডন' শুরু হয়েছে। একজন 'হামিদ কারজাই'কেও (মুস্তাফা আবদুল জলিল) লিবিয়ায় পাওয়া গেছে। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের জন্য তা আদৌ কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
ওমর আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের জন্য ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা হয়েছিল। দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে। ওই বিমান হামলার মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় ৯ এপ্রিল বাগদাদ দখল করে নিয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী। সাদ্দাম হোসেন উৎখাত হয়েছিলেন (ডিসেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল)। অভিযোগ ছিল, ইরাকের কাছে তথাকথিত WMD (Weapons of Mass Destruction) আছে, যা এ অঞ্চলের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। বাস্তবতা হচ্ছে, আফগানিস্তানে যেমনি ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, ঠিক তেমনি ইরাকেও ডগউ-এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইরাক আক্রমণের আট বছর পর, ২০১১ সালের ১৯ মার্চ ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী (সেই সঙ্গে ফ্রান্স) লিবিয়া আক্রমণ করল। এবারের যুক্তি, গাদ্দাফি বাহিনীর অত্যাচার থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি অনুমোদন রয়েছে বটে, কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধের কোনো অনুমতি দেয়নি। জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারাবলে নিরাপত্তা পরিষদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে (রাশিয়া, চীন ও জার্মানি অনুপস্থিত ছিল)। ওই ধারায় বলা আছে, 'প্রয়োজনীয় বিধিব্যবস্থা' নেওয়ার কথা। কিন্তু বিমান হামলা কোনো অবস্থায়ই 'বিধিব্যবস্থা নেওয়ার' পর্যায়ে পড়ে না। যুদ্ধ শুরু করা কিংবা আক্রমণ করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে অপর আরেকটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা যুক্তরাষ্ট্র নেয়নি। এমনকি 'যে নিরীহ সাধারণ জনগণকে' রক্ষার জন্য এ বিমান হামলা, এই হামলায় তো সাধারণ মানুষও মারা গেছে। এ মৃত্যুর বিচার এখন কে করবে?
স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব আসরে যুক্তরাষ্ট্র তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তির অনুপস্থিতিতে কিংবা দুর্বলতার সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র দিন দিন একটি আগ্রাসী ও যুদ্ধবাজ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অথচ খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই কellog-Briand Pact নামে একটি আইন রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী যেকোনো যুদ্ধ (যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক) অবৈধ ও নিন্দনীয়। কেলগ (Kellog) ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট_অর্থাৎ বিদেশসচিব। যুদ্ধকে ঘৃণা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের জন্য ১৯২৯ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। আজ যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে ব্যবহার করে তৃতীয় যুদ্ধের সূচনা করল বটে, কিন্তু জাতিসংঘ সনদেই যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী এ বিমান হামলা অবৈধ। সনদের ৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, 'বর্তমান সনদে জাতিসংঘ কোনো রাষ্ট্রের নিছক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে না বা সেরূপ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য কোনো সদস্যকে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে না (তবে এখানে ৫১ নম্বর ধারায় নিরাপত্তা পরিষদকে কিছুটা অধিকার দেওয়া হয়েছে, যা কোনো অবস্থায়ই যুদ্ধ শুরু করার অনুমতি নয়)।' এমনকি সনদের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, 'সব সদস্য তাদের আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে এমনভাবে নিষ্পত্তি করবে, যাতে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার বিঘি্নত না হয়।'
এটা অস্বীকার করা যাবে না যে লিবিয়ায় কোনো সংকট তৈরি হয়নি। লিবিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। সেখানে সরকার পতনের আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল। এটা নিঃসন্দেহে লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। জাতিসংঘ সনদের ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী লিবিয়ার এই অভ্যন্তরীণ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেন হস্তক্ষেপ করতে পারে না (একই ধরনের ঘটনায় তারা মিসর, তিউনিসিয়া, কিংবা বাহরাইনে হস্তক্ষেপ করেনি)। ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী লিবিয়ার এই অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি আন্তর্জাতিক শান্তি কিংবা নিরাপত্তা বিঘি্নত করেনি। যেখানে জাতিসংঘ সনদের ৪ নম্বর ধারায় যেকোনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন করা থেকে অন্য রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত থাকতে বলা হয়েছে, সেখানে ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলায় লিবিয়ার রাজনৈতিক স্বাধীনতা আজ বিপন্ন। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র আজ নিজে নিজের আইন ভঙ্গ করছে। ২০১০ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা National Security Strategy-র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, 'Military force, at times, may be necessary to defend our country and allies or to preserve broader peace and security, including by protecting civilians facing a grave humanitarian crisis....The United States must reserve the right to act unilaterally if necessary, to defend our nation and our interests, get we well also seek to adhere to standards that govern the use of force|' এখন লিবিয়ায় বিমান আক্রমণের সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট ওবামার নিজের বক্তব্যেরই বিরোধী। লিবিয়া এমন কোনো হটকারী সিদ্ধান্ত নেয়নি, যা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে বিঘি্নত করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারে। আর ওবামা নির্বাচনের আগে যুদ্ধের অবসান ও একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রবাসীর কাছে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন, কিন্তু মাত্র তিন বছরের মাথায় ওবামা যুদ্ধের সূচনা করে নিজেকে আরেকজন যুদ্ধবাজ নেতা হিসেবে পরিচিত করলেন। অথচ শান্তির জন্য তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে পেন্টাগন, গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, বহুজাতিক সংস্থা, করপোরেট হাউস, এমনকি ইসরায়েলি লবি একটি বড় ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। আফগানিস্তান আর ইরাক এর বড় প্রমাণ। ইরাকের মতো লিবিয়ারও রয়েছে প্রচুর তেলসম্পদ। আন্তর্জাতিক তেল কম্পানিগুলোর আগ্রহ রয়েছে এই তেলসম্পদের দিকে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে মুনাফা অর্জনই তাদের লক্ষ্য, যেমনটি তারা করেছিল ইরাকে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মিখায়েল হাস ২০০৯ সালে একটি বই লিখেছিলেন। George W. Bush : War Criminals? The Bush Administration Liability for 269 War Crimes। ২০১০ সালে বইটির পরিবর্ধিত সংস্করণে প্রেসিডেন্ট ওবামাকেও তিনি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অধ্যাপক হাস পাঁচটি ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধ (আফগানিস্তান ও ইরাক) সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে_১. গৃহযুদ্ধে বিরোধীপক্ষকে সমর্থন দেওয়া (আফগানিস্তানে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন), ২. যুদ্ধের হুমকি দেওয়া, ৩. আগ্রাসী যুদ্ধের পরিকল্পনা করা, ৪. যুদ্ধের জন্য ষড়যন্ত্র করা, ৫. যুদ্ধের পক্ষে প্রপাগান্ডা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে দুটি আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। প্রথমটি International Military Tribunal at Nuremberg, যেখানে জার্মান নারীদের যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছিল। দ্বিতীয়টি, International Military Tribunal for Far East, যেখানে জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছিল। নুরেমবার্গের আদালতে যুদ্ধাপরাধের তিনটি দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে_শান্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যুদ্ধে অপরাধ করা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। অধ্যাপক হাস যে পাঁচটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেছেন কিংবা International Military Tribunals যুদ্ধাপরাধের যে দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তাতে আজ ওবামাও অভিযুক্ত হতে পারেন। কেননা ওবামা প্রশাসন গাদ্দাফিবিরোধী শক্তিকে সহযোগিতা ও সমর্থন করছে। হোয়াইট হাউসে ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর সেই নীতিটি হচ্ছে আগ্রাসী, সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, হুমকি ও বলপ্রয়োগ করে স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা। লিবিয়ার সমস্যার খুব দ্রুত সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। 'অপারেশন অডিসি ডন' শুরু হয়েছে। একজন 'হামিদ কারজাই'কেও (মুস্তাফা আবদুল জলিল) লিবিয়ায় পাওয়া গেছে। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের জন্য তা আদৌ কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment