রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সরকার যা বলছে এবং যা দেখছি

জ্বালানি সংকট সরকারের জন্য আরেকটি অগ্রাধিকারের বিষয়। বছরের শুরুতে শীতের মধ্যেও লোডশেডিং হচ্ছে মাঝে মধ্যে। আগামী গ্রীষ্মে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কল্পনা করতে পারছি না। দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা আছে ২৪০ কোটি ঘনফুট, কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ২০০ ।

মহাজোট সরকার তিন বছরে পা দিয়েছে। চলতি বছর সরকারের জন্য হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। একদিকে বিরোধী দলের আন্দোলনের হুমকি, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা_ সরকারের সিদ্ধান্ত তাই যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। চলতি বছর যে বিষয়গুলোর ওপর সরকারকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা, জনশক্তি রফতানিতে স্থিতিশীলতা আনা, শেয়ারবাজারে ফটকাবাজি বন্ধ করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা, পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য আনা এবং সর্বোপরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। সরকারের জন্য দুটি প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে দ্রব্যমূল্য ও বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা। গেল বছর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চালের দাম কেন বাড়ল, তা দেখার জন্য গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেন বাড়ল, কী জন্য বাড়ল এর পেছনে যুক্তি খোঁজা যায়; কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব 'যুক্তি' বুঝবেন না। সাধারণ মানুষের জন্য ওএমএসের মাধ্যমে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত যাবে কোথায়? মধ্যবিত্তের চাল (মিনিকেট) ৮ জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, প্যাকেট আটা ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। পেঁয়াজের দাম ৮০ থেকে কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকায়। আর সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১০০ টাকা। মোটা চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৩৮ টাকায়, যা ২০০৯ সালে ছিল ২৬ থেকে ২৮ টাকা। টিসিবির মতে, মোটা চালের দামই বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। আর ক্যাবের হিসাবে এক বছরে চালের গড় দাম বৃদ্ধি ২৪ শতাংশ। এই চাল এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। আমাদের ভরা মৌসুমেও যদি চালের দাম এ পর্যায়ে থাকে তাহলে আগামী দিনগুলো নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। চাতাল মালিকদের মূল্যবৃদ্ধিতে কারসাজি রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের কাজটি হচ্ছে এদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেই কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে না। অসাধু 'সিন্ডিকেটের' কথা উঠেছে। সরকারের ভেতরের লোকজনই এই সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন। জাতিসংঘ অনেক আগেই সতর্ক করেছিল খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে। গেল সপ্তাহে তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়ায় খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্ষোভ হয়েছে। আমরা আরও একবার ২০০৭ সালের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি কি-না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। তাই সঙ্গত কারণেই চালের সংগ্রহ, মজুদ ও সরবরাহের ব্যাপারে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সংকট সরকারের জন্য আরেকটি অগ্রাধিকারের বিষয়। বছরের শুরুতে শীতের মধ্যেও লোডশেডিং হচ্ছে মাঝে মধ্যে। আগামী গ্রীষ্মে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কল্পনা করতে পারছি না। দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা আছে ২৪০ কোটি ঘনফুট, কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ২০০ কোটি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। সাধারণ মানুষের বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু গেল বছর এ সেক্টরে সরকারের সাফল্য আশাপ্রদ নয়। গেল বছর বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট প্রকট ছিল। গ্যাস সংকট মোকাবেলায় সরকার বিদ্যমান শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাসের রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেছিল। নতুন শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখাও হয়েছিল। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র পিকিং প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এখানে ব্যবহৃত হবে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল। এসব প্লান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ তিনগুণেরও বেশি। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের দাম বাড়বে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে (২০০৮) বলা হয়েছিল, ২০১১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াট, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এটা একটা উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে যেসব পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, তা ইতিমধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আরও দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সরকার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, যা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নির্মিত হবে আইপিপি হিসেবে ১৫ বছর মেয়াদে। সরকারের এ ধরনের পরিকল্পনা অদূর ভবিষ্যতে কোনো ফল দিলেও চলতি ২০১১ সালে কোনো ফল দেবে না। ফলে এই সেক্টরে অসন্তোষ লক্ষ্য করা যাবে। আসলে বিকল্প জ্বালানি দরকার। সৌরবিদ্যুতের একটি সম্ভাবনা থাকলেও এ সেক্টরে ব্যাপক কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা
যায় না। তরল গ্যাস আমদানির একটি ঘোষণা থাকলেও এ ব্যাপারে অগ্রগতি তেমন নেই।

অর্থনীতির চেহারা গেল বছর খুব যে ভালো ছিল, তা বলা যাবে না। রিজার্ভ বাড়লেও রেমিটেন্স কমতে শুরু করে। সৌদি আরবের মতো বড় বাজারে জনসম্পদ রফতানি বন্ধ। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি নিয়ে জটিলতা কাটেনি। সেখান থেকে কয়েক লাখ বাংলাদেশিকে এখন ফিরে আসতে হবে। নতুন ভিসায় যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু বায়রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দ্বন্দ্ব জনশক্তি রফতানিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এ সেক্টরে একটি বড় সম্ভাবনা থাকলেও এই মন্ত্রণালয়ে কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। চলতি বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। রেমিটেন্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্য কমেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আশাপ্রদ নয়। অথচ আমদানি চাহিদা বাড়ছে। ফলে আর্থিক খাতের লেনদেনের চেয়ে বৈদেশিক লেনদেনে চাপ বাড়ছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বারবার শ্রমিক অসন্তোষের কারণে। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দরের স্থবিরতাও বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে। খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আরও বাড়বে। প্রতি বছর দেশে সর্বোচ্চ ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব (এফবিসিসিআইয়ের মতে)। অথচ দেশে বর্তমানে ২ কোটি ৭০ লাখ লোক বেকার। আর প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে কর্মবাজারে। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এর ওপর দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্মবাজারে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এককভাবে এত বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে না। তাই দরকার বেসরকারি উদ্যোগ। কিন্তু যেভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানে অসন্তোষ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে বেসরকারি সেক্টরে সেভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে না।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যর্থতা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারপ্রধান যেদিন ৩৬ পুলিশ অফিসারকে 'পুলিশ পদক' দিলেন, সেদিনই উচ্চ আদালত কামরাঙ্গীরচর থানার এক পুলিশ অফিসারকে 'কাজে অবহেলার' জন্য কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছিলেন। পরে তাকে বরখাস্ত করার জন্য মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশও দিয়েছিলেন। একটি শিশুর অঙ্গহানি ঘটিয়ে তাকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হতো। এ ব্যাপারে কামরাঙ্গীরচর থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন নির্লিপ্ত। বছরের শুরুতেই যেভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, তাতে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। খোদ একজন মহিলা সাংসদের বাসায় ডাকাতি পুলিশ রোধ করতে পারেনি। একজন সংসদ সদস্যের অসহায়ত্ব যখন প্রকাশ পায়, যখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দুর্ধর্ষ চুরি রোধ করা সম্ভব হয় না, তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে ধরে পড়ে বৈকি! চলতি বছরের শুরুতেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতির চিত্র আমরা পাই, তাতে আগামী দিনগুলো সম্পর্কে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পারি না। গেল বছরও এই মন্ত্রণালয়ের জন্য কোনো আশার খবর ছিল না।

আর ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, মাস্তানি এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। একসময়ের ছাত্রলীগ সভাপতি আর বর্তমানে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের তো প্রকাশ্যেই ছাত্রলীগের নামে যারা সন্ত্রাস করে, তাদের দ্রুত বিচার আইনে বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন। দলের একজন সিনিয়র নেতার হতাশা কোন পর্যায়ে গেলে এ ধরনের কথা তিনি বলতে পারেন! ছাত্রলীগের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা, একটি শিক্ষানীতি জাতিকে উপহার দেওয়া, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পাস করা_ এগুলো সবই সরকারের অর্জন। কিন্তু সরকার আর বিরোধী দলের মধ্যে আস্থার যে অভাব, তার কোনো উন্নতি হয়নি। সংসদও ভালোভাবে কাজ করেছে, এটা বলা যাবে না। চলতি বছর সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে সংসদকে আরও কার্যকর করতে। বছরের শুরুতেই আশঙ্কাজনকভাবে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। ১০ জানুয়ারি ডিএসইতে সাধারণ মূল্যসূচক ৬৩৫ পয়েন্ট কমে যায়। এতে ডিএসইর বাজার মূলধন কমে যায় প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। এ ধরনের ধস সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। সরকারের ভাবমূর্তি আরও নষ্ট হয়েছে যখন সংবাদপত্র আমাদের জানাচ্ছে, গেল বছর ৪ হাজার ১৬৩টি হত্যা, ৮৭১টি অপহরণ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ১৩৩টি। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও সোচ্চার ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে। এ ধরনের অভিযোগ সরকারের জন্য ভালো নয়। সরকার এসব বিষয়ে নজর দিলে ভালো করবে। বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে সরকারের উদ্যোগ ও আন্তরিকতাই আজ বড়।

ড. তারেক শামসুর রেহমান :অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ সমকাল, ১৮/০১/১১]

0 comments:

Post a Comment