সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্য ও মন্ত্রণালয় পরিচালনায় তাঁদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেশ কয়েকটি সেক্টরে সরকারের পারফরম্যান্স আশাব্যঞ্জক নয়। বিশেষ করে খাদ্য, বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিয়ে অভিযোগ অনেক বেশি এবং সরকারের ব্যর্থতাও প্রকট। অতিসম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সরকারের আস্থাভাজন হলেও বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি সরকারপ্রধানের জন্য কোনো সাফল্য বয়ে আনতে পারেননি। বিদেশ সফর যদি সরকারের সাফল্যের মানদণ্ড হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি তাতে 'ফার্স্ট'। ফেলানীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশে ও বিদেশে তাঁর নীরব ভূমিকা নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠেছে,
যা কোনো সরকারপ্রধানের জন্য আশার কথা নয়। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের অর্থমন্ত্রী একজন সজ্জন ব্যক্তি। সনাতন রাজনীতিবিদ তিনি নন। তাই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে তিনি অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাননি। নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। যেখানে ৩৩ লাখ লোক পুঁজিবাজারের সঙ্গে জড়িত, সেখানে বাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাওয়া, হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে দেওয়া, একজন মন্ত্রীর মন্ত্রণালয় পরিচালনায় ব্যর্থতা প্রমাণ করে বৈকি। তিনি সরাসরি জড়িত নন, এটা সত্য। কিন্তু তাঁর আওতাধীন তো সিকিউরিটি অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন। তিনি তো দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী (দ্য সান, ২৫ জানুয়ারি) শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত যে দুটি সংস্থা, তার কর্তাব্যক্তিরা সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ভার অর্থমন্ত্রী এড়িয়ে যান কিভাবে? অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন একজন উপদেষ্টাও। তাঁর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। চালের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ওএমএসের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। টিসিবির মতে, মোটা চালের দামই বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯ শতাংশ। আর ক্যাবের হিসাবে এক বছরে চালের গড় দাম বৃদ্ধি ২৪ শতাংশ। এই চাল এখন 'রাজনীতি' নিয়ন্ত্রণ করবে। বাণিজ্যমন্ত্রী 'মগের মুল্লুকবাজ'দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর অতিকথনে সাধারণ মানুষ বিরক্তই হয়েছে। খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা সরকারপ্রধানকে বিব্রত করবে নিঃসন্দেহে। যেকোনো সরকারের জন্য এই দুটো সেক্টর অগ্রাধিকারের বিষয়, যেখানে মন্ত্রীরা সাফল্য দেখাতে পারেননি।
জ্বালানি সংকট সরকারের জন্য আরেকটি অগ্রাধিকারের বিষয়। বছরের শুরুতে শীতের মধ্যেও লোডশেডিং হচ্ছে মাঝেমধ্যে। আগামী গ্রীষ্মে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনা করাও কঠিন। দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা আছে ২৪০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের কারণেই বিদ্যুতের এই ঘাটতি। সাধারণ মানুষের বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু গেল বছর এ সেক্টরে সরকারের সাফল্য আশাপ্রদ নয়। গত বছর বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট ছিল ব্যাপক। গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার বিদ্যমান শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাসের রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেছিল। নতুন শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়াও বন্ধ রাখা হয়েছিল। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র পিকিং প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এখানে ব্যবহৃত হবে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল। এসব প্লান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ তিন গুণেরও বেশি। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের দাম আরো বাড়বে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে (২০০৮) বলা হয়েছিল, ২০১১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট, ২০১৩ সালের মধ্যে সাত হাজার মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এটা একটা উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে যেসব পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, তা ইতিমধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আরো দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, যা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নির্মিত হবে আইপিপি হিসেবে ১৫ বছর মেয়াদে। সরকারের এ ধরনের পরিকল্পনা অদূর-ভবিষ্যতে কোনো ফল দিলেও চলতি ২০১১ সালে কোনো ফল দেবে না। ফলে এই সেক্টরে অসন্তোষ লক্ষ করা যাবে। আসলে বিকল্প জ্বালানি দরকার। সৌরবিদ্যুতের একটি সম্ভাবনা থাকলেও এ সেক্টরে ব্যাপক কর্মকাণ্ড লক্ষ করা যায় না। তরল গ্যাস আমদানির ঘোষণা থাকলেও এ ব্যাপারে অগ্রাধিকার তেমন নেই।
অর্থনীতির চেহারা চলতি বছর খুব যে ভালো তা বলা যাবে না। রিজার্ভ বাড়লেও রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে। সৌদি আরবের মতো বড় বাজারে জনসম্পদ রপ্তানি বন্ধ। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে জটিলতা কাটেনি। সেখান থেকে কয়েক লাখ বাংলাদেশিকে এখন ফিরে আসতে হবে। নতুন ভিসায় যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে বটে; কিন্তু বায়রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দ্বন্দ্ব জনশক্তি রপ্তানিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এ সেক্টরে একটি বড় সম্ভাবনা থাকলেও এ মন্ত্রণালয়ে কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। চলতি বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্যও কমেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগও আশাপ্রদ নয়। অথচ আমদানি চাহিদা বাড়ছে। ফলে আর্থিক খাতের লেনদেনের চেয়ে বৈদেশিক লেনদেনের চাপ বাড়ছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বারবার শ্রমিক অসন্তোষের কারণে। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দরের স্থবিরতাও বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে। খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আরো বাড়বে। প্রতিবছর দেশে সর্বোচ্চ ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব (এফবিসিসিআইয়ের মতে)। অথচ দেশে বর্তমানে দুই কোটি ৭০ লাখ লোক বেকার। আর প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে কর্মবাজারে। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এর ওপর দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্মবাজারে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এককভাবে এত বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে না। তাই দরকার বেসরকারি উদ্যোগ। কিন্তু যেভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অসন্তোষ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে বেসরকারি সেক্টরে সেভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যর্থতা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারপ্রধান যে দিন ৩৬ জন পুলিশ অফিসারকে 'পুলিশ পদক' দিয়েছিলেন, সেদিনই উচ্চ আদালত কামরাঙ্গীরচর থানার একজন পুলিশ অফিসারকে 'কাজে অবহেলার' জন্য কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছিলেন। পরে তাঁকে বরখাস্ত করার জন্য মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশও দিয়েছিলেন। একটি শিশুর অঙ্গহানি ঘটিয়ে তাকে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করনো হতো। এ ব্যাপারে কামরাঙ্গীরচর থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন নির্লিপ্ত। বছরের শুরুতেই যেভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, তাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। খোদ দুইজন মহিলা সাংসদের বাসায় ডাকাতি, একজন সাংবাদিককে হত্যা পুলিশ রোধ করতে পারেনি। দুইজন সংসদ সদস্যের অসহায়ত্ব যখন প্রকাশ পায়, যখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দুর্ধর্ষ চুরি ও কালীমন্দিরে চুরি রোধ করা সম্ভব হয় না, তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে ধরা পড়ে বৈকি! চলতি বছরের শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতির চিত্র আমরা পাই, তাতে করে আগামী দিনগুলো সম্পর্কে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পারি না। গেল বছরও এ মন্ত্রণালয়ের জন্য কোনো আশার খবর ছিল না। আর ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, মাস্তানি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
আর একসময়ের ছাত্রলীগের সভাপতি, আর বর্তমানে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের তো প্রকাশ্যেই ছাত্রলীগের নামে যারা সন্ত্রাস করে, তাদের দ্রুত বিচার আইনে বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন। দলের একজন সিনিয়র নেতার হতাশা কোন পর্যায়ে গেলে এ ধরনের কথা তিনি বলতে পারেন। ছাত্রলীগের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা, একটি শিক্ষানীতি জাতিকে উপহার দেওয়া, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পাস করা সরকারের জন্য বড় অর্জন। কিন্তু ছোট ছোট 'ঘটনা' যেমনি বড় অর্জনকে ম্লান করে দেয়, ঠিক তেমনি সরকারের অনেক বড় অর্জন ম্লান হয়ে গেছে কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যর্থতার কারণে। সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে, গেল বছর চার হাজার ১৬৩টি হত্যা, ৮৭১টি অপহরণ ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ১৩৩টি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। কিন্তু তার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে শুনি পুলিশ বাহিনীর প্রশংসার কথা। 'আইনি বাহিনীর আত্মরক্ষার গুলিতে সন্ত্রাসী মরাই স্বাভাবিক' (কালের কণ্ঠ, ২৭ জানুয়ারি), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিগত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। এ ধরনের বক্তব্য পুলিশ কর্মকর্তাদের খুশি করলেও সাধারণ মানুষ এ বক্তব্যে খুশি হয়নি। আড়িয়াল বিল নিয়ে যা ঘটল তা কাম্য নয়। একজন পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ড কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবার ঠিক তেমনি বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করায় রাজনীতিতে অস্থিরতা আরো বাড়বে। সরকার এখন আর আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ করবে না, এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত।
পৌরসভা ও দুটি উপনির্বাচনের ফলাফলে সরকারের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই। প্রথম দফা পৌরসভা নির্বাচনে (২৩৬টি পৌরসভা) বিএনপি বিজয়ী হয়েছিল ৯৭টিতে, আর আওয়ামী লীগ ৯৩টিতে। দ্বিতীয় দফায় (১২টি) আওয়ামী লীগ পেয়েছে ছয়টি, বিএনপি তিনটি। উপনির্বাচনে একটি আসন চলে গেছে বিএনপির দখলে। মন্ত্রীরা উপনির্বাচনে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি, এটা ভালো লক্ষণ। তবে সরকার যদি সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে বিতর্কের মাত্রা আরো কমত।
সরকার দুই বছর পার করেছে। এখন হিসাব-নিকাশের পালা। পৌরসভা ও উপনির্বাচন একটা মাপকাঠি হতে পারে। এর আলোকে ব্যর্থ মন্ত্রীদের 'বিদায়' করে দেওয়াই উত্তম। এতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এটা একটা গতানুগতিক প্রক্রিয়া। মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আসতেই পারে। সব দেশেই এ রকমটি হয়। এটাই গণতান্ত্রিক সৌকর্য। প্রধানমন্ত্রীর হাতে আছে আরো প্রায় তিন বছর। মানুষ মন্ত্রীদের ভালো 'পারফরম্যান্স' দেখতে চায়। চায় যোগ্য লোকরাই দেশ চালাক। সাতজন উপদেষ্টাকে পেছনে রেখে মন্ত্রীদের পরিকল্পনা করা অর্থহীন। প্রয়োজনে উপদেষ্টাদের 'টেকনোক্র্যাট' কোটায় মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে মন্ত্রিসভার যোগ্যতা বাড়ানো যেতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
যা কোনো সরকারপ্রধানের জন্য আশার কথা নয়। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের অর্থমন্ত্রী একজন সজ্জন ব্যক্তি। সনাতন রাজনীতিবিদ তিনি নন। তাই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে তিনি অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাননি। নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। যেখানে ৩৩ লাখ লোক পুঁজিবাজারের সঙ্গে জড়িত, সেখানে বাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাওয়া, হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে দেওয়া, একজন মন্ত্রীর মন্ত্রণালয় পরিচালনায় ব্যর্থতা প্রমাণ করে বৈকি। তিনি সরাসরি জড়িত নন, এটা সত্য। কিন্তু তাঁর আওতাধীন তো সিকিউরিটি অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন। তিনি তো দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী (দ্য সান, ২৫ জানুয়ারি) শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত যে দুটি সংস্থা, তার কর্তাব্যক্তিরা সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ভার অর্থমন্ত্রী এড়িয়ে যান কিভাবে? অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন একজন উপদেষ্টাও। তাঁর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। চালের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ওএমএসের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। টিসিবির মতে, মোটা চালের দামই বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯ শতাংশ। আর ক্যাবের হিসাবে এক বছরে চালের গড় দাম বৃদ্ধি ২৪ শতাংশ। এই চাল এখন 'রাজনীতি' নিয়ন্ত্রণ করবে। বাণিজ্যমন্ত্রী 'মগের মুল্লুকবাজ'দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর অতিকথনে সাধারণ মানুষ বিরক্তই হয়েছে। খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা সরকারপ্রধানকে বিব্রত করবে নিঃসন্দেহে। যেকোনো সরকারের জন্য এই দুটো সেক্টর অগ্রাধিকারের বিষয়, যেখানে মন্ত্রীরা সাফল্য দেখাতে পারেননি।
জ্বালানি সংকট সরকারের জন্য আরেকটি অগ্রাধিকারের বিষয়। বছরের শুরুতে শীতের মধ্যেও লোডশেডিং হচ্ছে মাঝেমধ্যে। আগামী গ্রীষ্মে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনা করাও কঠিন। দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা আছে ২৪০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের কারণেই বিদ্যুতের এই ঘাটতি। সাধারণ মানুষের বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু গেল বছর এ সেক্টরে সরকারের সাফল্য আশাপ্রদ নয়। গত বছর বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট ছিল ব্যাপক। গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার বিদ্যমান শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাসের রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেছিল। নতুন শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়াও বন্ধ রাখা হয়েছিল। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র পিকিং প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এখানে ব্যবহৃত হবে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল। এসব প্লান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ তিন গুণেরও বেশি। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের দাম আরো বাড়বে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে (২০০৮) বলা হয়েছিল, ২০১১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট, ২০১৩ সালের মধ্যে সাত হাজার মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এটা একটা উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে যেসব পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, তা ইতিমধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আরো দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, যা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নির্মিত হবে আইপিপি হিসেবে ১৫ বছর মেয়াদে। সরকারের এ ধরনের পরিকল্পনা অদূর-ভবিষ্যতে কোনো ফল দিলেও চলতি ২০১১ সালে কোনো ফল দেবে না। ফলে এই সেক্টরে অসন্তোষ লক্ষ করা যাবে। আসলে বিকল্প জ্বালানি দরকার। সৌরবিদ্যুতের একটি সম্ভাবনা থাকলেও এ সেক্টরে ব্যাপক কর্মকাণ্ড লক্ষ করা যায় না। তরল গ্যাস আমদানির ঘোষণা থাকলেও এ ব্যাপারে অগ্রাধিকার তেমন নেই।
অর্থনীতির চেহারা চলতি বছর খুব যে ভালো তা বলা যাবে না। রিজার্ভ বাড়লেও রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে। সৌদি আরবের মতো বড় বাজারে জনসম্পদ রপ্তানি বন্ধ। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে জটিলতা কাটেনি। সেখান থেকে কয়েক লাখ বাংলাদেশিকে এখন ফিরে আসতে হবে। নতুন ভিসায় যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে বটে; কিন্তু বায়রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দ্বন্দ্ব জনশক্তি রপ্তানিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এ সেক্টরে একটি বড় সম্ভাবনা থাকলেও এ মন্ত্রণালয়ে কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। চলতি বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্যও কমেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগও আশাপ্রদ নয়। অথচ আমদানি চাহিদা বাড়ছে। ফলে আর্থিক খাতের লেনদেনের চেয়ে বৈদেশিক লেনদেনের চাপ বাড়ছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বারবার শ্রমিক অসন্তোষের কারণে। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দরের স্থবিরতাও বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে। খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আরো বাড়বে। প্রতিবছর দেশে সর্বোচ্চ ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব (এফবিসিসিআইয়ের মতে)। অথচ দেশে বর্তমানে দুই কোটি ৭০ লাখ লোক বেকার। আর প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে কর্মবাজারে। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এর ওপর দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্মবাজারে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এককভাবে এত বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে না। তাই দরকার বেসরকারি উদ্যোগ। কিন্তু যেভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অসন্তোষ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে বেসরকারি সেক্টরে সেভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যর্থতা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারপ্রধান যে দিন ৩৬ জন পুলিশ অফিসারকে 'পুলিশ পদক' দিয়েছিলেন, সেদিনই উচ্চ আদালত কামরাঙ্গীরচর থানার একজন পুলিশ অফিসারকে 'কাজে অবহেলার' জন্য কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছিলেন। পরে তাঁকে বরখাস্ত করার জন্য মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশও দিয়েছিলেন। একটি শিশুর অঙ্গহানি ঘটিয়ে তাকে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করনো হতো। এ ব্যাপারে কামরাঙ্গীরচর থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন নির্লিপ্ত। বছরের শুরুতেই যেভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, তাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। খোদ দুইজন মহিলা সাংসদের বাসায় ডাকাতি, একজন সাংবাদিককে হত্যা পুলিশ রোধ করতে পারেনি। দুইজন সংসদ সদস্যের অসহায়ত্ব যখন প্রকাশ পায়, যখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দুর্ধর্ষ চুরি ও কালীমন্দিরে চুরি রোধ করা সম্ভব হয় না, তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে ধরা পড়ে বৈকি! চলতি বছরের শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতির চিত্র আমরা পাই, তাতে করে আগামী দিনগুলো সম্পর্কে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পারি না। গেল বছরও এ মন্ত্রণালয়ের জন্য কোনো আশার খবর ছিল না। আর ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, মাস্তানি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
আর একসময়ের ছাত্রলীগের সভাপতি, আর বর্তমানে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের তো প্রকাশ্যেই ছাত্রলীগের নামে যারা সন্ত্রাস করে, তাদের দ্রুত বিচার আইনে বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন। দলের একজন সিনিয়র নেতার হতাশা কোন পর্যায়ে গেলে এ ধরনের কথা তিনি বলতে পারেন। ছাত্রলীগের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা, একটি শিক্ষানীতি জাতিকে উপহার দেওয়া, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পাস করা সরকারের জন্য বড় অর্জন। কিন্তু ছোট ছোট 'ঘটনা' যেমনি বড় অর্জনকে ম্লান করে দেয়, ঠিক তেমনি সরকারের অনেক বড় অর্জন ম্লান হয়ে গেছে কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যর্থতার কারণে। সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে, গেল বছর চার হাজার ১৬৩টি হত্যা, ৮৭১টি অপহরণ ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ১৩৩টি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। কিন্তু তার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে শুনি পুলিশ বাহিনীর প্রশংসার কথা। 'আইনি বাহিনীর আত্মরক্ষার গুলিতে সন্ত্রাসী মরাই স্বাভাবিক' (কালের কণ্ঠ, ২৭ জানুয়ারি), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিগত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। এ ধরনের বক্তব্য পুলিশ কর্মকর্তাদের খুশি করলেও সাধারণ মানুষ এ বক্তব্যে খুশি হয়নি। আড়িয়াল বিল নিয়ে যা ঘটল তা কাম্য নয়। একজন পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ড কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবার ঠিক তেমনি বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করায় রাজনীতিতে অস্থিরতা আরো বাড়বে। সরকার এখন আর আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ করবে না, এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত।
পৌরসভা ও দুটি উপনির্বাচনের ফলাফলে সরকারের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই। প্রথম দফা পৌরসভা নির্বাচনে (২৩৬টি পৌরসভা) বিএনপি বিজয়ী হয়েছিল ৯৭টিতে, আর আওয়ামী লীগ ৯৩টিতে। দ্বিতীয় দফায় (১২টি) আওয়ামী লীগ পেয়েছে ছয়টি, বিএনপি তিনটি। উপনির্বাচনে একটি আসন চলে গেছে বিএনপির দখলে। মন্ত্রীরা উপনির্বাচনে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি, এটা ভালো লক্ষণ। তবে সরকার যদি সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে বিতর্কের মাত্রা আরো কমত।
সরকার দুই বছর পার করেছে। এখন হিসাব-নিকাশের পালা। পৌরসভা ও উপনির্বাচন একটা মাপকাঠি হতে পারে। এর আলোকে ব্যর্থ মন্ত্রীদের 'বিদায়' করে দেওয়াই উত্তম। এতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এটা একটা গতানুগতিক প্রক্রিয়া। মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আসতেই পারে। সব দেশেই এ রকমটি হয়। এটাই গণতান্ত্রিক সৌকর্য। প্রধানমন্ত্রীর হাতে আছে আরো প্রায় তিন বছর। মানুষ মন্ত্রীদের ভালো 'পারফরম্যান্স' দেখতে চায়। চায় যোগ্য লোকরাই দেশ চালাক। সাতজন উপদেষ্টাকে পেছনে রেখে মন্ত্রীদের পরিকল্পনা করা অর্থহীন। প্রয়োজনে উপদেষ্টাদের 'টেকনোক্র্যাট' কোটায় মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে মন্ত্রিসভার যোগ্যতা বাড়ানো যেতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment