দীর্ঘ ১৮ দিন তাহরির স্কয়ারে অবস্থান করে মিসরের তরুণ সমাজ যে ইতিহাস রচনা করলেন, সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। আপাতদৃষ্টিতে বিপ্লবীদের প্রথম দাবিটিই পূরণ হয়নি। বিপ্লবীরা চেয়েছিলেন একটি বেসামরিক সরকার। তা হয়নি। সামরিক জান্তার কাছেই হোসনি মোবারক ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন।
মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব কি শেষ পর্যন্ত তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে? দীর্ঘ ১৮ দিন তাহরির স্কয়ারে অবস্থান করে মিসরের তরুণ সমাজ যে ইতিহাস রচনা করলেন,
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। আপাতদৃষ্টিতে বিপ্লবীদের প্রথম দাবিটিই পূরণ হয়নি। বিপ্লবীরা চেয়েছিলেন একটি বেসামরিক সরকার। তা হয়নি। সামরিক জান্তার কাছেই হোসনি মোবারক ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। যারা সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন সেনাবাহিনী একবার ক্ষমতা নিলে সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায়। মিসরের ক্ষেত্রে এমনটিই হতে যাচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, অনেক বিপ্লবই তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। ফ্রান্সের সাধারণ কৃষকরা রুটির দাবিতে ১৭৮৯ সালে ভার্সাই দুর্গের পতন ঘটিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। কিন্তু এরপরের চার বছরের ইতিহাস অনেক করুণ। সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। আর এর মধ্য দিয়ে ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়নের একনায়কতন্ত্রী শাসন শুরু হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব রাজতন্ত্রের পতন ডেকে আনলেও নেপোলিয়ন নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে (১৮০৪) সেই রাজতন্ত্রই আবার চালু করেছিলেন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে বিপ্লবীরা সফল হয়েছিলেন। কিন্তু কেরনস্ক্রির ব্যর্থতাই রুশ বিপ্লবের চূড়ান্ত রূপ দেয় নভেম্বরে। কেরনস্ক্রির নেতৃত্বে 'মেনসেভিক'রা যদি সফল হতেন, রুশ বিপ্লবের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। ১৯৫২ সালে মিসরে সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের বিদ্রোহ (ফ্রি অফিসার্স ক্লাব) রাজতন্ত্রের পতন ঘটালেও সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যে সময়সীমা, সেখানে জনগণের শাসন ছিল না; ছিল কিছু অভিজাত শ্রেণী আর গোষ্ঠীর শাসন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের 'গুরু' অ্যারিস্টটল এটাকে শাসনব্যবস্থার বিকৃত রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যাকে তিনি বলেছেন 'কতিপয়তন্ত্র'। ১৯৭৯ সালে আধুনিক এক রাষ্ট্র ইরানে বিপ্লব হয়েছিল। ওই বিপ্লব সেখানে প্রথমবারের মতো একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দিলেও ২০০৯ সালে ইরানে যে বিক্ষোভ সংঘটিত হয় তাতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়, ইরানি সমাজে অসন্তোষ আছে। এর অর্থ পরিষ্কার, বিপ্লব তার লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারেনি। ১৯৭৯ সালে নিকারাগুয়ায় বামপন্থি সান্ডানিস্টদের বিপ্লব তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল। মার্কসবাদী সান্ডানিস্টদের কাছে যে প্রত্যাশা মানুষের ছিল, তা পূরণ হয়নি। একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উস্কানি (কনট্রা বিদ্রোহীদের সাহায্য), অন্যদিকে হতাশা; ফলাফল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সান্ডানিস্ট নেতা ড্যানিয়েল ওর্তেগা পরাজিত হন ১৯৯০ সালে দক্ষিণপন্থি নেতা মিসেস ভায়োলেটা বারিওস ডি চামোরোর কাছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও ওর্তেগা পরাজিত হয়েছিলেন, যদিও গেল বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি আবারও বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু এখন সম্ভবত ওর্তেগাকে মার্কসবাদী বলা যাবে না। ১৯৮৬ সালে ফিলিপাইনে 'পিপলস পাওয়ার' কোরাজান আকিনোকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। প্রয়াত কোরাজানও তার শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেননি।
অতি সাম্প্রতিককালে জর্জিয়া, ইউক্রেন আর কিরঘিজস্তানে যে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে, ইতিহাসে তা 'কালার রেভলিউশন' হিসেবে খ্যাত। ২০০৩ সালে জর্জিয়ার বিপ্লব (গোলাপ বিপ্লব) এখন অনেকটা ফিকে হয়ে আসছে। সাকাসভিলি সেখানে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছেন। ২০০৫ সালের ইউক্রেনের 'অরেঞ্জ রেভলিউশন' ইয়ুশ্মেনকোকে ক্ষমতায় বসালেও ২০১০ সালে নির্বাচনে তিনি হেরে গেলেন। কিরঘিজস্তানে ২০০৫ সালে 'টিউলিপ রেভলিউশন' অস্কার আকায়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। 'বিপ্লবের' নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কুরমানবেক আকিয়েভ। আকিয়েভও ক্ষমতাচ্যুত হলেন আরেক 'বিপ্লবী' রোজা অতুনভায়েভার দ্বারা। রোজা অতুনভায়েভা এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এই তিনটি দেশে বারবার ক্ষমতার পটপরিবর্তন প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা, তা পূরণে তারা ব্যর্থ; বরং ক্ষমতা গ্রহণ করে তারা সেখানে কায়েম করেছিলেন একনায়কতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা। স্বজনপ্রীতি আর গোষ্ঠীপ্রীতি 'বিপ্লবের' স্পিরিটকেই নষ্ট করে দিয়েছিল। এভাবেই 'বিপ্লবের' মধ্য দিয়ে যে প্রত্যাশার জন্ম হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই পূরণ করতে ব্যর্থ হন বিপ্লবীরা। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই। দীর্ঘ ২৭ বছর জেলে কাটিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা (মুক্ত ১৯৯০) ১৯৯৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। যে 'বিপ্লব' নেলসন ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট করে ও সেখানে বর্ণবাদ ভেঙে দিয়েছিল, সেই বিপ্লবকে পুঁজি করে ম্যান্ডেলা আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। থাকেননি। তাই তিনি আজ বিশ্ব নেতা। মহাত্মা গান্ধী ভারতে ১৯৩০-এর দশকে অহিংস আন্দোলন করেছিলেন।
ভারত স্বাধীন হয়েছিল; কিন্তু গান্ধীজি ক্ষমতায় যাননি। ক্ষমতা তার কাছে বড় ছিল না কোনোদিন। আজ তাই সঙ্গত কারণেই তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব যখন হোসনি মোবারকের 'সাম্রাজ্যে'র পতন ঘটায় তখন প্রশ্ন ওঠে, এই বিপ্লব কি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে? এই বিপ্লবের কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক. কোনো একটি দল বা ব্যক্তির নেতৃত্বে এই বিপ্লব পরিচালিত হয়নি। দুই. তরুণ সমাজের নেতৃত্বেই এই বিপ্লব পরিচালিত হয়েছে। তিন. ইন্টারনেট আর ফেসবুক এই 'বিপ্লব'-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চার. সেনাবাহিনী বিপ্লবীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তা বলা যাবে না। পাঁচ. দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা সেনাবাহিনীর স্টাবলিশমেন্ট (মিসরের ২১০ মিলিয়ন অর্থনীতির ১০ থেকে ১৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী) সহজে ভেঙে যাবে না। ছয়. ইসরায়েল বরাবর চেয়ে এসেছে হোসনি মোবারক ক্ষমতায় থাকুক। কেননা মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার বিন্যাসে মিসর-ইসরায়েল ঐক্য নেতানিয়াহুর বড় প্রয়োজন। সাত. যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করলেও ঘটনাপ্রবাহ বলে শেষ দিন পর্যন্ত ওবামা চেয়েছেন হোসনি মোবারক ক্ষমতায় থাকুক (সাবেক সিআইএ এজেন্ট ও এক সময়ে মিসরে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ফ্রাঙ্ক ওয়াইজনারকে কায়রো প্রেরণ ও মোবারকের ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা)। কেননা ওবামা প্রশাসনের স্ট্র্যাটেজিতে হোসনি মোবারক অন্যতম একটি ফ্যাক্টর, বিশেষ করে এ অঞ্চলে আল কায়দার উত্থান ঠেকানো ও হিজবুল্লাহ (লেবানন) ও হামাসের (ফিলিস্তিন) প্রভাব সংকুচিত করতে মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয় কোনো মিত্র নেই যুক্তরাষ্ট্রের। যে কারণে প্রতি বছর দুই বিলিয়ন ডলার আর্থিক ও সামরিক সাহায্য মিসর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পায়। আট. ইসলামপন্থি সংগঠন ইসলামিক ব্রাদারহুডের সম্ভাব্য উত্থান ও ক্ষমতা গ্রহণের আশঙ্কায় (দলটি নিষিদ্ধ ১৯৪৮ সাল থেকে) তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবীরা সমর্থন পাননি কোনো পশ্চিমা দেশের। অথচ এই দলটির বড় কোনো অংশগ্রহণ ছিল না এই 'বিপ্লব'-এ। নয়. আসমা মাহফুজ (এপ্রিল ৬ ইয়ুথ মুভমেন্ট) কিংবা ওয়াইল গনিমের মতো সিভিল সোসাইটির ব্যক্তিরা এই 'বিপ্লব'-এ বড় ভূমিকা পালন করলেও অচিরেই তাদের আশাভঙ্গের মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে সম্রাট চতুর্দশ লুই যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তিনি বলতেন_ 'আমিই রাষ্ট্র_ ও ধস ঃযব ংঃধঃব.' আর ষোড়শ লুই (১৭৭৪-৯২) বলতেন, ্তুডযধঃ ও ফবংরৎব রং ফবপৎবব্থ_ আমি যা ইচ্ছা করি, সেটাই আইন। একজন শাসক কতটুকু স্বৈরাচারী হলে এ ধরনের কথা বলতে পারেন। জয়নেল আবিদিন বেন আলি কিংবা হোসনি মোবারকের একদলীয় শাসন যেন ছিল সেই ষোড়শ লুইয়ের কথারই প্রতিধ্বনি। ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে কৃষকরা রুটির দাবিতে যখন গ্রাম থেকে শহরে এসে দলে দলে জমায়েত হয়েছিলেন, তখন রানী অ্যান্টোয়নেট প্রাসাদে বিলাসবহুল জীবন কাটাতেন। তিউনিসিয়ায় একজন বেকার গ্র্যাজুয়েট বউকুজিজি যখন রাস্তার ফুটপাতে ফল বিক্রি করে জীবন কাটাতেন (যার আত্মহত্যা জেসমিন বিপ্লবের জন্ম দেয়), তখন সাধারণ একজন হেয়ার ড্রেসার থেকে ফার্স্ট লেডি হওয়া লায়লা বেন আলি ট্রাবেলসি কোটি কোটি ডলারের মালিক হয়েছিলেন। সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়ার সময় নিয়ে গিয়েছিলেন দেড় টন সোনা। আজকে মিসরে জনসংখ্যার অর্ধেক যেখানে দিনে দুই ডলারের নিচে আয় করে, সেখানে মোবারকের পরিবার মালিক হয়েছে ৪০ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলারের। পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত মেক্সিকোর কার্লোস স্লিমের সম্পত্তির পরিমাণ ৫৪ বিলিয়ন ডলার। এর পরের স্থান বিল গেটসের, যার সম্পত্তির পরিমাণ ৫৩ বিলিয়ন ডলার। ৮৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত মিসরের ৫২ দশমিক ৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর বয়স ২৫ বছরের নিচে। আর জিডিপিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মাত্র ৫ দশমিক ৯ ভাগ। অথচ কাতারে এই হার ৬৬ দশমিক ৯ ভাগ। অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেশি কাতারে। এভাবেই শাসকরা সাধারণ মানুষের কথা ভুলে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। ষোড়শ লুই থেকে হোসনি মোবারক_ ব্যবধানটা প্রায় ২২২ বছরের হলেও পার্থক্য নেই কোনো। হোসনি মোবারকের পতন হয়েছে; কিন্তু তার অনুসারীরা রয়ে গেছেন (জান্তাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাবি মোবারকের ছত্রছায়ায় এতদূর পর্যন্ত এসেছেন)। তাই ফরিদ যতই গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন না কেন মিসরের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব কি শেষ পর্যন্ত তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে? দীর্ঘ ১৮ দিন তাহরির স্কয়ারে অবস্থান করে মিসরের তরুণ সমাজ যে ইতিহাস রচনা করলেন,
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। আপাতদৃষ্টিতে বিপ্লবীদের প্রথম দাবিটিই পূরণ হয়নি। বিপ্লবীরা চেয়েছিলেন একটি বেসামরিক সরকার। তা হয়নি। সামরিক জান্তার কাছেই হোসনি মোবারক ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। যারা সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন সেনাবাহিনী একবার ক্ষমতা নিলে সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায়। মিসরের ক্ষেত্রে এমনটিই হতে যাচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, অনেক বিপ্লবই তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। ফ্রান্সের সাধারণ কৃষকরা রুটির দাবিতে ১৭৮৯ সালে ভার্সাই দুর্গের পতন ঘটিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। কিন্তু এরপরের চার বছরের ইতিহাস অনেক করুণ। সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। আর এর মধ্য দিয়ে ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়নের একনায়কতন্ত্রী শাসন শুরু হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব রাজতন্ত্রের পতন ডেকে আনলেও নেপোলিয়ন নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে (১৮০৪) সেই রাজতন্ত্রই আবার চালু করেছিলেন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে বিপ্লবীরা সফল হয়েছিলেন। কিন্তু কেরনস্ক্রির ব্যর্থতাই রুশ বিপ্লবের চূড়ান্ত রূপ দেয় নভেম্বরে। কেরনস্ক্রির নেতৃত্বে 'মেনসেভিক'রা যদি সফল হতেন, রুশ বিপ্লবের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। ১৯৫২ সালে মিসরে সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের বিদ্রোহ (ফ্রি অফিসার্স ক্লাব) রাজতন্ত্রের পতন ঘটালেও সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যে সময়সীমা, সেখানে জনগণের শাসন ছিল না; ছিল কিছু অভিজাত শ্রেণী আর গোষ্ঠীর শাসন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের 'গুরু' অ্যারিস্টটল এটাকে শাসনব্যবস্থার বিকৃত রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যাকে তিনি বলেছেন 'কতিপয়তন্ত্র'। ১৯৭৯ সালে আধুনিক এক রাষ্ট্র ইরানে বিপ্লব হয়েছিল। ওই বিপ্লব সেখানে প্রথমবারের মতো একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দিলেও ২০০৯ সালে ইরানে যে বিক্ষোভ সংঘটিত হয় তাতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়, ইরানি সমাজে অসন্তোষ আছে। এর অর্থ পরিষ্কার, বিপ্লব তার লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারেনি। ১৯৭৯ সালে নিকারাগুয়ায় বামপন্থি সান্ডানিস্টদের বিপ্লব তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল। মার্কসবাদী সান্ডানিস্টদের কাছে যে প্রত্যাশা মানুষের ছিল, তা পূরণ হয়নি। একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উস্কানি (কনট্রা বিদ্রোহীদের সাহায্য), অন্যদিকে হতাশা; ফলাফল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সান্ডানিস্ট নেতা ড্যানিয়েল ওর্তেগা পরাজিত হন ১৯৯০ সালে দক্ষিণপন্থি নেতা মিসেস ভায়োলেটা বারিওস ডি চামোরোর কাছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও ওর্তেগা পরাজিত হয়েছিলেন, যদিও গেল বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি আবারও বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু এখন সম্ভবত ওর্তেগাকে মার্কসবাদী বলা যাবে না। ১৯৮৬ সালে ফিলিপাইনে 'পিপলস পাওয়ার' কোরাজান আকিনোকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। প্রয়াত কোরাজানও তার শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেননি।
অতি সাম্প্রতিককালে জর্জিয়া, ইউক্রেন আর কিরঘিজস্তানে যে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে, ইতিহাসে তা 'কালার রেভলিউশন' হিসেবে খ্যাত। ২০০৩ সালে জর্জিয়ার বিপ্লব (গোলাপ বিপ্লব) এখন অনেকটা ফিকে হয়ে আসছে। সাকাসভিলি সেখানে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছেন। ২০০৫ সালের ইউক্রেনের 'অরেঞ্জ রেভলিউশন' ইয়ুশ্মেনকোকে ক্ষমতায় বসালেও ২০১০ সালে নির্বাচনে তিনি হেরে গেলেন। কিরঘিজস্তানে ২০০৫ সালে 'টিউলিপ রেভলিউশন' অস্কার আকায়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। 'বিপ্লবের' নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কুরমানবেক আকিয়েভ। আকিয়েভও ক্ষমতাচ্যুত হলেন আরেক 'বিপ্লবী' রোজা অতুনভায়েভার দ্বারা। রোজা অতুনভায়েভা এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এই তিনটি দেশে বারবার ক্ষমতার পটপরিবর্তন প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা, তা পূরণে তারা ব্যর্থ; বরং ক্ষমতা গ্রহণ করে তারা সেখানে কায়েম করেছিলেন একনায়কতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা। স্বজনপ্রীতি আর গোষ্ঠীপ্রীতি 'বিপ্লবের' স্পিরিটকেই নষ্ট করে দিয়েছিল। এভাবেই 'বিপ্লবের' মধ্য দিয়ে যে প্রত্যাশার জন্ম হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই পূরণ করতে ব্যর্থ হন বিপ্লবীরা। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই। দীর্ঘ ২৭ বছর জেলে কাটিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা (মুক্ত ১৯৯০) ১৯৯৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। যে 'বিপ্লব' নেলসন ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট করে ও সেখানে বর্ণবাদ ভেঙে দিয়েছিল, সেই বিপ্লবকে পুঁজি করে ম্যান্ডেলা আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। থাকেননি। তাই তিনি আজ বিশ্ব নেতা। মহাত্মা গান্ধী ভারতে ১৯৩০-এর দশকে অহিংস আন্দোলন করেছিলেন।
ভারত স্বাধীন হয়েছিল; কিন্তু গান্ধীজি ক্ষমতায় যাননি। ক্ষমতা তার কাছে বড় ছিল না কোনোদিন। আজ তাই সঙ্গত কারণেই তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব যখন হোসনি মোবারকের 'সাম্রাজ্যে'র পতন ঘটায় তখন প্রশ্ন ওঠে, এই বিপ্লব কি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে? এই বিপ্লবের কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক. কোনো একটি দল বা ব্যক্তির নেতৃত্বে এই বিপ্লব পরিচালিত হয়নি। দুই. তরুণ সমাজের নেতৃত্বেই এই বিপ্লব পরিচালিত হয়েছে। তিন. ইন্টারনেট আর ফেসবুক এই 'বিপ্লব'-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চার. সেনাবাহিনী বিপ্লবীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তা বলা যাবে না। পাঁচ. দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা সেনাবাহিনীর স্টাবলিশমেন্ট (মিসরের ২১০ মিলিয়ন অর্থনীতির ১০ থেকে ১৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী) সহজে ভেঙে যাবে না। ছয়. ইসরায়েল বরাবর চেয়ে এসেছে হোসনি মোবারক ক্ষমতায় থাকুক। কেননা মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার বিন্যাসে মিসর-ইসরায়েল ঐক্য নেতানিয়াহুর বড় প্রয়োজন। সাত. যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করলেও ঘটনাপ্রবাহ বলে শেষ দিন পর্যন্ত ওবামা চেয়েছেন হোসনি মোবারক ক্ষমতায় থাকুক (সাবেক সিআইএ এজেন্ট ও এক সময়ে মিসরে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ফ্রাঙ্ক ওয়াইজনারকে কায়রো প্রেরণ ও মোবারকের ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা)। কেননা ওবামা প্রশাসনের স্ট্র্যাটেজিতে হোসনি মোবারক অন্যতম একটি ফ্যাক্টর, বিশেষ করে এ অঞ্চলে আল কায়দার উত্থান ঠেকানো ও হিজবুল্লাহ (লেবানন) ও হামাসের (ফিলিস্তিন) প্রভাব সংকুচিত করতে মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয় কোনো মিত্র নেই যুক্তরাষ্ট্রের। যে কারণে প্রতি বছর দুই বিলিয়ন ডলার আর্থিক ও সামরিক সাহায্য মিসর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পায়। আট. ইসলামপন্থি সংগঠন ইসলামিক ব্রাদারহুডের সম্ভাব্য উত্থান ও ক্ষমতা গ্রহণের আশঙ্কায় (দলটি নিষিদ্ধ ১৯৪৮ সাল থেকে) তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবীরা সমর্থন পাননি কোনো পশ্চিমা দেশের। অথচ এই দলটির বড় কোনো অংশগ্রহণ ছিল না এই 'বিপ্লব'-এ। নয়. আসমা মাহফুজ (এপ্রিল ৬ ইয়ুথ মুভমেন্ট) কিংবা ওয়াইল গনিমের মতো সিভিল সোসাইটির ব্যক্তিরা এই 'বিপ্লব'-এ বড় ভূমিকা পালন করলেও অচিরেই তাদের আশাভঙ্গের মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে সম্রাট চতুর্দশ লুই যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তিনি বলতেন_ 'আমিই রাষ্ট্র_ ও ধস ঃযব ংঃধঃব.' আর ষোড়শ লুই (১৭৭৪-৯২) বলতেন, ্তুডযধঃ ও ফবংরৎব রং ফবপৎবব্থ_ আমি যা ইচ্ছা করি, সেটাই আইন। একজন শাসক কতটুকু স্বৈরাচারী হলে এ ধরনের কথা বলতে পারেন। জয়নেল আবিদিন বেন আলি কিংবা হোসনি মোবারকের একদলীয় শাসন যেন ছিল সেই ষোড়শ লুইয়ের কথারই প্রতিধ্বনি। ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে কৃষকরা রুটির দাবিতে যখন গ্রাম থেকে শহরে এসে দলে দলে জমায়েত হয়েছিলেন, তখন রানী অ্যান্টোয়নেট প্রাসাদে বিলাসবহুল জীবন কাটাতেন। তিউনিসিয়ায় একজন বেকার গ্র্যাজুয়েট বউকুজিজি যখন রাস্তার ফুটপাতে ফল বিক্রি করে জীবন কাটাতেন (যার আত্মহত্যা জেসমিন বিপ্লবের জন্ম দেয়), তখন সাধারণ একজন হেয়ার ড্রেসার থেকে ফার্স্ট লেডি হওয়া লায়লা বেন আলি ট্রাবেলসি কোটি কোটি ডলারের মালিক হয়েছিলেন। সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়ার সময় নিয়ে গিয়েছিলেন দেড় টন সোনা। আজকে মিসরে জনসংখ্যার অর্ধেক যেখানে দিনে দুই ডলারের নিচে আয় করে, সেখানে মোবারকের পরিবার মালিক হয়েছে ৪০ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলারের। পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত মেক্সিকোর কার্লোস স্লিমের সম্পত্তির পরিমাণ ৫৪ বিলিয়ন ডলার। এর পরের স্থান বিল গেটসের, যার সম্পত্তির পরিমাণ ৫৩ বিলিয়ন ডলার। ৮৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত মিসরের ৫২ দশমিক ৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর বয়স ২৫ বছরের নিচে। আর জিডিপিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মাত্র ৫ দশমিক ৯ ভাগ। অথচ কাতারে এই হার ৬৬ দশমিক ৯ ভাগ। অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেশি কাতারে। এভাবেই শাসকরা সাধারণ মানুষের কথা ভুলে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। ষোড়শ লুই থেকে হোসনি মোবারক_ ব্যবধানটা প্রায় ২২২ বছরের হলেও পার্থক্য নেই কোনো। হোসনি মোবারকের পতন হয়েছে; কিন্তু তার অনুসারীরা রয়ে গেছেন (জান্তাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাবি মোবারকের ছত্রছায়ায় এতদূর পর্যন্ত এসেছেন)। তাই ফরিদ যতই গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন না কেন মিসরের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment