রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম : কিছু মৌলিক প্রশ্ন

পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এখন অনেকটা শান্ত। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে বাঙালি-পাহাড়িদের সংঘর্ষের রেশ ধরে তা ছড়িয়ে পড়েছিল খাগড়াছড়িতেও। ওই সংঘর্ষে মানুষ মারা গেছে, জানমালের ক্ষতিও হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হঠাৎ করেই যেন অশান্তির হাওয়া বইছিল পার্বত্য এলাকায়। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না! সরকার ক্ষমতায় এসেছে প্রায় তেরো মাস। এ সময়সীমার মধ্যে আমার বিবেচনায় দুটো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথমটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে একটি সম্পূর্ণ ব্রিগেড, ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন প্রত্যাহার করে নেয়। সেই সঙ্গে আরও ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প বন্ধ করে দিয়েছে। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি অনুযায়ীই সরকার কিছু সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিল। এরপর থেকেই সরকার বারবার বলে আসছে শান্তি চুক্তির প্রতিটি শর্ত পূরণ করা হবে। এমনি এক পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়ে উঠল। সংবাদপত্রে একটি খবর এসেছে, ভূমি বিরোধের জের ধরেই বাঘাইছড়িতে ঘটনাটি ঘটেছিল। সরকার নতুন করে ভূমি কমিশন গঠন করেছে। এ কমিশনের কাজ শুরু করার আগেই ভূমি বিরোধকে সামনে নিয়ে এলো কারা?
গত কয়েকদিনের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে আমার কাছে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জš§ হয়েছে, যার জবাব জানা প্রয়োজন। এক. পাহাড়ের ওপর থেকে সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে কয়েকশ’ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। এটি একাধিক সংবাদপত্রের ভাষ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করতে সাহস পায় কারা? সন্ত্রাসীরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোত্থেকে সংগ্রহ করে? এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় একটি ‘পক্ষ’ এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎপর, যারা সেখানকার স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায়। আজ সরকারের উচিত এই পক্ষকে চিহ্নিত করা। আমাদের আশংকা ছিল সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হলে (আংশিক হলেও), সেখানে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, তাতে করে অস্ত্রবাজরা সুবিধা নেবে। তারা সেখানে ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েম করবে। সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে এই সত্যটিই প্রতিষ্ঠিত হল। আরও একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একটি কাঠের ব্রিজকে (গঙ্গারাম এলাকায়) গুঁড়িয়ে দিয়ে সন্ত্রাসীরা একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার), বাঘাইছড়ির উপজেলা কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করেছিল। কোন একটি সংবাদপত্র লিখেছে, তাদের জিম্মি করারও পরিকল্পনা ছিল সন্ত্রাসীদের। ঘটনাটি সত্য এবং তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা কিংবা অন্য সরকারি কর্মকর্তারা তো সরকারি কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তখন তাদের নিরাপত্তা যদি বিঘিœত হয় তা তো আমাদের সবার জন্য চিন্তার কারণ। এখানে বাঙালি না পাহাড়ি কে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, আমাদের কাছে তা বিবেচ্য নয়। আমাদের কাছে বিবেচ্য হচ্ছে সন্ত্রাস আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ঘটনার সঙ্গে যেই জড়িত, তাকে চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। দুই. বাঘাইছড়ির ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এখানেও বাঙালি ও পাহাড়িদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে। এখানেও একজন বাঙালি মারা গেছেন। এ মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য নয়। সেখানে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ‘কারফিউ’ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। যারা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়, যারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তারা সমাজের শত্র“। এদের ব্যাপারে শৈথিল্য দেখানো যায় না। সরকার এ ক্ষেত্রে যদি কঠোর না হয়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে। তিন. বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ির ঘটনার পর আমরা লক্ষ্য করেছি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও বাঙালি জনগোষ্ঠী পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। পাহাড়ি নেতৃত্ব দায়ী করেছে বাঙালিদের আর বাঙালিরা দায়ী করেছে পাহাড়িদের। মজার ব্যাপার, পাহাড়ি নেতৃত্বের মাঝে দুটো গ্র“প থাকলেও (জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ) তারা উভয়ই বাঙালিদের দায়ী করেছেন। অতীতে জনসংহতি সমিতি ও তার নেতা সন্তু লারমা একাধিকবার বিবৃতি দিয়ে, সাক্ষাৎকার দিয়ে পাহাড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য ইউপিডিএফ বা ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে দায়ী করেছিল। একাধিক সংবাদপত্রের রিপোর্টে পরোক্ষভাবে সংঘটিত ঘটনাবলীর জন্য ইউপিডিএফের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছে। অবরোধের ডাক প্রথমে ইউপিডিএফই দিয়েছিল। প্রয়োজনে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক, যে কমিটি সামগ্রিক বিষয় নিয়ে তদন্ত করবে। কেননা, যেখানে সরকার পাহাড়িদের দাবি-দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল এবং কমিটেড এবং বেশ কিছু কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে, সেখানে এ ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি করে সরকারের উদ্যোগকে নস্যাৎ করা প্রকারান্তরে একটি ষড়যন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। শক্ত হাতে সরকারকে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ির ঘটনা প্রমাণ করে, পাহাড়ি ও বাঙালিদের মাঝে আস্থার সংকট রয়েছে। এ আস্থা গড়ে না উঠলে বারবার সহিংস ঘটনা ঘটবে। পাহাড়িরা যেমনি এ দেশের নাগরিক, ঠিক তেমনি বাঙালিরাও এ দেশের নাগরিক। আমাদের সবার জন্য একটি সংবিধান রয়েছে। আমরা কেউই সংবিধানের ঊর্ধ্বে নই। সংবিধান এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করেছে। সংবিধানের ২৪, ৩৬, ৩৭, ৪২নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন বাঙালি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ অঞ্চলে বসবাস করা, সম্পত্তি অর্জন করা, চলাফেরা করা ও সমাবেশ করার অধিকার রাখে। সুতরাং বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে ও থাকছে তাদের অধিকারবলেই। কিন্তু পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ এটা মানতে নারাজ। ইউপিডিএফ আবারও বলেছে, বাঙালিদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে। এটা কি বাস্তবসম্মত দাবি? কিংবা কোন সরকারের পক্ষেই কি তা সম্ভব? বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ। কিন্তু লোকসংখ্যা প্রচুর। আমাদের পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী গেল বছর ডিসেম্বরে কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনে বলে এলেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের দুই কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তখন এই দুই কোটি মানুষকেই বা আমরা কোথায় পুনর্বাসন করব? আমাদের তো জায়গা নেই? এত খাস জমিও নেই? পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের মাঝে শুভবুদ্ধির মানুষ আছে আমরা এটা বিশ্বাস করি। শুধু শুধু পুনর্বাসনের নাম করে বাঙালি বিদ্বেষী বক্তব্য দিলে, তা শুধু উত্তেজনাই ছড়াবে। শান্তি নিশ্চিত করতে পারবে না। এ দেশের জনগণ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তারা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। ‘জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহ-এর অংশ হিসেবে পাহাড়িরা আজ যে সুযোগ-সুবিধা পায়, তা সাধারণ বাঙালিরা পায় না। পাহাড়ি বাঙালিরাও পায় না। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ‘বিশেষ কোটার’ সুযোগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হচ্ছে, সরকারি চাকরিও পাচ্ছে। যেখানে হাজার হাজার বাঙালি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোন সুযোগ পায় না, সেখানে পাহাড়ি সন্তানরা ভর্তি হচ্ছে ‘জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহের’ অংশ হিসেবে। রাষ্ট্র তাই পাহাড়িদের উন্নয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। ইতিমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাঙ্গামাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। আমরা সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, প্রস্তাবিত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবহেলিত বোম, পাংখো, খুমি, চাক, খিয়াং, তনচৈঙ্গা কিংবা হারং গোষ্ঠীর সন্তানরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এমনকি আমরা দাবিও জানিয়েছিলাম, এসব জনগোষ্ঠীর সন্তানদের বিনা পয়সায় এবং বৃত্তি দিয়ে তাদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উš§ুক্ত করে দেয়ার। কিন্তু জনসংহতি সমিতি সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। আমাদের পরিসংখ্যান বলে, চাকমা জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯০ ভাগ শিক্ষিত এবং কোটা সুবিধা নেয় এই চাকমারা। অথচ পাংখো, খুমি, চাক, খিয়াং, বোম জনগোষ্ঠীর সন্তানরা এই সুযোগ পায় না। শুধু চাকমারাই অনগ্রসর জনগোষ্ঠী নয়। পাংখো, খুমি, চাকরাও ‘অনগ্রসর’। এদেরও উন্নয়ন দরকার। না হলে পাহাড়ি এলাকায় ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হবে। এক সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীও চামকা ‘আধিপত্যবাদের’ বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তুলবে। সতর্ক হওয়ার সময় এখনই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে পাহাড়ি ও বাঙালিদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান জাতীয় পর্যায়ে এসেও একই ‘অবস্থান’ লক্ষ্য করা গেছে। নাগরিক সমাজের ব্যাপারে ২৫ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় যে জমায়েত হয়েছে, তাতে লিখিত প্রস্তাবে অভিযোগ করা হয়েছে, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে বাঙালিরা পাহাড়িদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তখন তাদের বক্তব্যে বাঙালিরা যে হামলার শিকার হল তার কোন কথা নেই। অন্যদিকে সমঅধিকার আন্দোলনের ব্যানারে আয়োজিত এক সভায় বলা হয়েছে, বিদেশী গোষ্ঠীর তৎপরতা, অবৈধ অস্ত্র, উগ্র উপজাতীয় সন্ত্রাস পার্বত্য চট্টগ্রামকে গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সংকটের জন্য বাঙালি ও উপজাতীয়রা দায়ী নয়Ñ এ কথাও বলেছে সমঅধিকার আন্দোলন। আমরা এ কথাটাও বলতে চাই, বাঘাইছড়ি কিংবা খাগড়াছড়িতে যা ঘটল, তার জন্য ঢালাওভাবে বাঙালিদের দায়ী করা যেমনি ঠিক নয়, তেমনি ঠিক নয় পাহাড়িদেরও দায়ী করা। কিছু সন্ত্রাসী রয়েছে, যারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তা থেকে ফায়দা উঠাতে চায়। আজ এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে পাহাড়ে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখা। অর্থাৎ যার যার অবস্থানে যে যেভাবে আছে, সে সেভাবেই থাকবে। যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি করেছে, তারা সঠিক কাজটি করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী না থাকলে, পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা আরও বিঘিœত হবে। পাহাড়ি ও বাঙালিÑ সবাইকে নিয়ে পাহাড়ি অঞ্চল। যুগ যুগ ধরে তারা মিলেমিশেই বসবাস করছে এবং স্থানীয় উন্নয়নে অবদান রাখছে। আজ যারা আপত্তি সৃষ্টি করতে চায়, তারা পাহাড়ি বা বাঙালি কারোরই মিত্র নয়। পাহাড়ি ও বাঙালি নেতৃবৃন্দ যদি এটি উপলব্ধি করেন, তাহলেই মঙ্গল। আশার কথা, পাহাড়ের পরিস্থিতি এখন শান্ত এবং স্বাভাবিক। কোন পক্ষই কোন উত্তেজক বক্তব্য দেবে না, আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[সূত্রঃ যুগান্তর, ০২/০৩/১০]

0 comments:

Post a Comment