প্রথমে শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। তারপর মিসর। এখন লিবিয়ায়। আরব বিশ্বের গণবিস্ফোরণ এখন ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিটি আরব বিশ্বে, পশ্চিমে আলজেরিয়া থেকে মরক্কো, আর পূর্বে বাহরাইন থেকে ইয়েমেন। পঞ্চাশের দশকে মিসরে 'বিপ্লব' আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল। আজ প্রায় তিনটি বছর পর তিউনিসিয়ায় জাইন এল আবিদিন বেন আলীর পতনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে আরেক 'বিপ্লব'-এর। ইতিহাসে এ বিপ্লব কিভাবে চিহ্নিত হবে জানি না, কিন্তু প্রচণ্ড এক 'রাজনৈতিক সুনামির' জন্ম দিয়েছে আরব বিশ্বে
। একটা পরিবর্তন সেখানে আসতে বাধ্য। তবে তিউনিসিয়া কিংবা মিসরে যা ঘটেনি, সেটাই ঘটে চলেছে লিবিয়ায়। তিউনিসিয়ায় বেন আলীর সমর্থকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। মিসরে মুবারক-সমর্থকরা কায়রোর তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু লিবিয়ায় আমরা দেখছি ভিন্ন চিত্র। গণ-অভ্যুত্থানে বেনগাজির মতো শহরের যেখানে পতন ঘটছে, সেখানে গাদ্দাফির 'প্রিয় বন্ধুদের' কেউ কেউ স্বপক্ষ ত্যাগ করে জনতার কাতারে মিশে গেছেন। সেখানে গাদ্দাফি স্পর্ধিত ভাষণে বিক্ষোভকারীদের দমনের কথা বলেছেন। লিবিয়ায় আফ্রিকা থেকে ভাড়াটে সেনা আনা হয়েছে, এমন খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গাদ্দাফি নিজে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেও সেনাবাহিনীতেও বিভক্তি এসেছে। ৪৫ হাজার সেনা নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর ওপর গাদ্দাফির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে_এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বিমানবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে এ কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য বিমান নিয়ে পালিয়ে গেছেন দুজন বৈমানিক। সেখানে চলছে এক নীরব গণহত্যা। জিম্মি করা হয়েছে বিদেশিদের, যাঁদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছেন। স্পষ্টতই লিবিয়া এখন গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি। বেনগাজি বিক্ষোভকারীদের দখলে চলে যাওয়ায় তারা বেনগাজির স্বাধীনতাও ঘোষণা করেছে। এখন কী হতে পারে লিবিয়ায়, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এটা সত্য, বিশ্বব্যাপী এখন গাদ্দাফিবিরোধী একটা জনমত রয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে লন্ডন, প্যারিস কিংবা বার্লিনে সর্বত্রই এমন একটা জনমত তৈরি হয়েছে যে তারা চাচ্ছে গাদ্দাফি ক্ষমতা ছেড়ে দিক।
এটা অস্বীকার করা যাবে না, গত ৪১ বছরের শাসনে এই প্রথমবারের মতো গাদ্দাফি ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ১৯৬৯ সাল থেকে ২০১১, সময়টা বেশ দীর্ঘ। ৪১ বছর। রাজতন্ত্র দীর্ঘদিন থাকে বটে, কিন্তু একজন 'রাজা' কিংবা বাদশাহও দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় নেই। গাদ্দাফি বাদশাহ ইদ্রিসকে উৎখাত করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাঁর দীর্ঘ শাসনে তিনি এক অদ্ভুত শাসনব্যবস্থার জন্ম দিয়েছেন, যাকে গণতন্ত্র বলা যাবে না, সমাজতন্ত্রও বলা যাবে না। রাজতন্ত্র তো নয়ই। তিনি এটাকে বলছেন, 'জনগণের শাসন'। এই 'জনগণের শাসন'-এ কোনো রাজনৈতিক দল নেই। এমনকি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ অপরাধের শামিল, মৃত্যুদণ্ড যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি। তিনি এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, যেখানে তিনিই মুখ্য শক্তি। তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে সব কর্মকাণ্ড। তিনি সরকারিভাবে কোনো পদবি গ্রহণ করেন না। অর্থাৎ লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট তিনি নন। তবে প্রেসিডেন্টের সব সুযোগ-সুবিধা তিনি ভোগ করেন। লিবিয়ায় তাঁর পদবি হচ্ছে 'লিডার অফ দ্য রেভ্যুলেশন' অর্থাৎ বিপ্লবের নেতা। ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা দখলকে তিনি 'বিপ্লব' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন জেনারেল পিপলস কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। পরে এ পদটি তিনি ছেড়ে দেন। বেছে নেন বিপ্লবের নেতার পদবিটি। তবে জেনারেল পিপলস কমিটি ব্যবস্থাটি তিনি রেখে দেন। এই ব্যবস্থাই তাঁকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে এত দিন। আমরা যাকে সংসদ হিসেবে চিনি, এই পিপলস কংগ্রেস বাহ্যত সেই সংসদের ভূমিকা পালন করছে। গাদ্দাফি গ্রামপর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন পিপলস কমিটি। প্রতিটি মিউনিসিপালিটিতে গঠিত হয়েছে 'বেসিক পিপলস কংগ্রেস'। এরা নিজেদের মধ্য থেকে একজন চেয়ারম্যান ও পাঁচ জন সদস্য নির্বাচিত করে। এঁদের নিয়েই গঠিত হয় 'জেনারেল পিপলস কংগ্রেস'। এখানে ছাত্র ও পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করা হয়েছে। মজার ব্যাপার, লিবিয়ায় কোনো সংবিধান নেই। একটি রাষ্ট্র যে সংবিধান ছাড়া চলতে পারে, লিবিয়া তার বড় প্রমাণ। তবে গাদ্দাফি লিখিত 'Green Book' (সবুজগ্রন্থ)-ই হলো লিবিয়ার সংবিধান (অনেকটা চীনের মাও জে ডংয়ের Read Book-এর মতো)। Green Book-এ অবশ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, মানুষের তৈরি আইন অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্র চলবে দেশের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা। আরো বলা হয়েছে, 'বিপ্লবের নেতা'কে (অর্থাৎ গাদ্দাফিকে) পরিবর্তন করা যাবে না। গত ৪১ বছর এভাবেই তিনি রাষ্ট্রটি পরিচালনা করে আসছেন। এবং গাদ্দাফি তাঁর বৈধতা আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। কেউ কোনোদিন লিবিয়ার শাসনব্যবস্থা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে 'ডমিনো তত্ত্ব' (Domino effect) বলে একটা কথা আছে। পঞ্চাশের দশকে ইন্দোচীনে উত্তর ভিয়েতনামে বিপ্লবী ও সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতকং বাহিনী যখন ক্ষমতা দখল করল, এর কিছুদিনের মধ্যে এক-এক করে দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্পুচিয়ায়ও সরকারের পতন ঘটল এবং সেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। এটা অনেকটা এ রকম_কিছু তাস যদি খাড়া করানো থাকে এবং একটা টোকা দিয়ে ফেলে দিলে বাকিগুলোও পড়ে যাবে। এটাই হচ্ছে 'ডমিনো তত্ত্ব'। তিউনিসিয়ায় জাইন এল আবিদিন বেন আলীর পতনের পর আমরা আরব বিশ্বে এই ডমিনো তত্ত্বের প্রয়োগ দেখছি। তিউনিসিয়ার পর মিসর, এবার লিবিয়া। এরপর সম্ভবত ইয়েমেন, আলজেরিয়া কিংবা বাহরাইন। বাহরাইনে মিসরের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও চূড়ান্ত বিচারে এখানে 'বিপ্লব' সফল হবে না। কেননা, এখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর পঞ্চম ফ্লিটের ঘাঁটি।
লিবিয়ায় গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে হাজারটা কারণ থাকলেও এটা অস্বীকার করা যাবে না, পশ্চিমা শক্তির এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন নিয়েই গাদ্দাফি এত দিন ক্ষমতায় ছিলেন। লিবিয়ায় পশ্চিমাদের স্বার্থ রয়েছে যথেষ্ট। বিশেষ করে তেল-স্বার্থ। ফ্রান্স (Total), ইতালি (ঊঘও) ও স্পেন (Repso) লিবিয়ার তেল বা গ্যাস উত্তোলনে সরাসরি জড়িত। লিবিয়া প্রতিদিন ১০ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করে (বিশ্বের ১২তম রপ্তানিকারক দেশ)। এর মধ্যে বিদেশি কম্পানিগুলোর উৎপাদনের হার নিম্নরূপ : ইতালি ৩৬৫৭৪২ ব্যারেল (রপ্তানির ২৯ ভাগ), ফ্রান্স ১৭৭৭৯৭ ব্যারেল (১৪ ভাগ), স্পেন ১২৯২২৭ ব্যারেল (১০ ভাগ), চীন ১৬০৬৭৬ ব্যারেল (১৩ ভাগ), আর যুক্তরাষ্ট্র ৬০৫৫৩ ব্যারেল (শতকরা পাঁচ ভাগ)। আর ইতালি লিবিয়া থেকে বছরে গ্যাস পাচ্ছে ৬০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই জ্বালানি নির্ভরশীলতার কারণে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গাদ্দাফি সব সময়ই 'বন্ধু' ছিলেন। পশ্চিমা বিশ্ব ২০০১ সালের 'নাইন-ইলেভেনে'র ঘটনাবলির পর 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শুরু করলে গাদ্দাফি ছিলেন তাদের মিত্র। সেদিন গাদ্দাফি সাদ্দাম হোসেনের তথাকথিত Weapons of mass destruction-এর সমালোচনা করেছিলেন। ফলে ইরাকের বিরুদ্ধে গাদ্দাফিকে ব্যবহার করেছিল পশ্চিমা বিশ্ব। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, আশির দশকে লিবিয়ার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল লিবিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদকে 'প্রমোট' করে। এই অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ১৯৮৬ সালে ত্রিপোলিতে বোমা হামলা চালিয়েছিল, যাতে গাদ্দাফির মেয়ে মারা গিয়েছিলেন। ওই সময় ইরানে ইসলামিক বিপ্লবীদের বিরুদ্ধেও গাদ্দাফিকে ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার ত্রিপোলি সফর করেছিলেন। কেননা, লিবিয়ায় ব্যবসার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল এবং ব্রিটেন চেয়েছিল সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে। এমনকি সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসও ত্রিপোলি সফর করেছিলেন ২০০৮ সালে। শুধু ওই ব্যবসায়িক স্বার্থ বিবেচনাতেই ব্রিটেন লকারবি বিমান দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত আবদুল বাসেত আল মেগরাহিকে মানবিক কারণে(?) ২০০৯ সালে মুক্তি দিয়েছিল। অথচ মেগরাহি আজও বেঁচে আছেন। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের নিজেদের স্বার্থেই এত দিন লিবিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছিল। এ জন্যই ফ্রিডম হাউস যখন লিবিয়াকে 'Most despotic country' হিসেবে আখ্যায়িত করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি (উত্তর কোরিয়া ও ইরানের ক্ষেত্রে তারা উদ্যোগ নিয়েছে)। স্বার্থ এখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে।
আজ হঠাৎ করেই যখন লিবিয়া এক পরিবর্তনের মুখোমুখি, জনতা যখন একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে, তখন পশ্চিমা বিশ্ব অনেকটাই 'জনতার' পাশে এসে দাঁড়িয়েছে(?)। জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। চাইছে গাদ্দাফির পতন। কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে না। সেখানে দুটো সম্ভাবনা উজ্জ্বর। এক. গাদ্দাফি তাঁর সমর্থক তথা গোষ্ঠীর (Qadhadhfa) সমর্থন নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ ত্রিপোলি কিংবা সারা শহরে তার অবস্থান ধরে রাখা। দুই. লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়া ও 'দ্বিতীয় আরেকটি সোমালিয়া' সৃষ্টি হওয়া। এখানে সোমালিয়ার 'আল সাবাব' জঙ্গিগোষ্ঠীর মতো ইসলামিক কট্টরপন্থীদের উত্থানও ঘটতে পারে। মিসরের সঙ্গে লিবিয়ার পার্থক্যটা এখানেই যে হোসনি মুবারক স্বেচ্ছায় সরে গেছেন, সেনাবাহিনী সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। কিন্তু গাদ্দাফি একটু পাগলাটে স্বভাবের (রিগ্যান তাঁকে আখ্যায়িত করেছিলেন Mad Dog হিসেবে)। তিনি চাইবেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে। কিন্তু পরিস্থিতি বলে ভিন্ন কথা। পূর্বাঞ্চলে স্পষ্টতই গাদ্দাফির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অধ্যাপক James D. Le Sueeur যে Post-colonial Time Disorder (PTD)-এর কথা বলেছেন (ফরেন অ্যাফেয়ার্স ১৪ ফেব্রুয়ারি), তার বাস্তব রূপ হচ্ছে আজকের লিবিয়া। সেই পুরনো মানসিকতায় দেশ চালানো এবং ক্ষমতা ধরে রাখা, এরই নাম PTD। জাইন এল আবিদিন বেন আলী, হোসনি মুবারক, আলী আবদুল্লাহ সালেহ, আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা, হামাদ বিন ইসা আল খলিফা এই PTD-এরই প্রতিনিধি। কিন্তু পরিস্থিতি আজ ভিন্ন। একে একে নিভেছে দেউটি। বেন আলী ও মুবারক এখন ইতিহাস। আর গাদ্দাফি এখন সেই পথেরই যাত্রী।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
। একটা পরিবর্তন সেখানে আসতে বাধ্য। তবে তিউনিসিয়া কিংবা মিসরে যা ঘটেনি, সেটাই ঘটে চলেছে লিবিয়ায়। তিউনিসিয়ায় বেন আলীর সমর্থকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। মিসরে মুবারক-সমর্থকরা কায়রোর তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু লিবিয়ায় আমরা দেখছি ভিন্ন চিত্র। গণ-অভ্যুত্থানে বেনগাজির মতো শহরের যেখানে পতন ঘটছে, সেখানে গাদ্দাফির 'প্রিয় বন্ধুদের' কেউ কেউ স্বপক্ষ ত্যাগ করে জনতার কাতারে মিশে গেছেন। সেখানে গাদ্দাফি স্পর্ধিত ভাষণে বিক্ষোভকারীদের দমনের কথা বলেছেন। লিবিয়ায় আফ্রিকা থেকে ভাড়াটে সেনা আনা হয়েছে, এমন খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গাদ্দাফি নিজে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেও সেনাবাহিনীতেও বিভক্তি এসেছে। ৪৫ হাজার সেনা নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর ওপর গাদ্দাফির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে_এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বিমানবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে এ কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য বিমান নিয়ে পালিয়ে গেছেন দুজন বৈমানিক। সেখানে চলছে এক নীরব গণহত্যা। জিম্মি করা হয়েছে বিদেশিদের, যাঁদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছেন। স্পষ্টতই লিবিয়া এখন গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি। বেনগাজি বিক্ষোভকারীদের দখলে চলে যাওয়ায় তারা বেনগাজির স্বাধীনতাও ঘোষণা করেছে। এখন কী হতে পারে লিবিয়ায়, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এটা সত্য, বিশ্বব্যাপী এখন গাদ্দাফিবিরোধী একটা জনমত রয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে লন্ডন, প্যারিস কিংবা বার্লিনে সর্বত্রই এমন একটা জনমত তৈরি হয়েছে যে তারা চাচ্ছে গাদ্দাফি ক্ষমতা ছেড়ে দিক।
এটা অস্বীকার করা যাবে না, গত ৪১ বছরের শাসনে এই প্রথমবারের মতো গাদ্দাফি ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ১৯৬৯ সাল থেকে ২০১১, সময়টা বেশ দীর্ঘ। ৪১ বছর। রাজতন্ত্র দীর্ঘদিন থাকে বটে, কিন্তু একজন 'রাজা' কিংবা বাদশাহও দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় নেই। গাদ্দাফি বাদশাহ ইদ্রিসকে উৎখাত করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাঁর দীর্ঘ শাসনে তিনি এক অদ্ভুত শাসনব্যবস্থার জন্ম দিয়েছেন, যাকে গণতন্ত্র বলা যাবে না, সমাজতন্ত্রও বলা যাবে না। রাজতন্ত্র তো নয়ই। তিনি এটাকে বলছেন, 'জনগণের শাসন'। এই 'জনগণের শাসন'-এ কোনো রাজনৈতিক দল নেই। এমনকি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ অপরাধের শামিল, মৃত্যুদণ্ড যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি। তিনি এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, যেখানে তিনিই মুখ্য শক্তি। তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে সব কর্মকাণ্ড। তিনি সরকারিভাবে কোনো পদবি গ্রহণ করেন না। অর্থাৎ লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট তিনি নন। তবে প্রেসিডেন্টের সব সুযোগ-সুবিধা তিনি ভোগ করেন। লিবিয়ায় তাঁর পদবি হচ্ছে 'লিডার অফ দ্য রেভ্যুলেশন' অর্থাৎ বিপ্লবের নেতা। ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা দখলকে তিনি 'বিপ্লব' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন জেনারেল পিপলস কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। পরে এ পদটি তিনি ছেড়ে দেন। বেছে নেন বিপ্লবের নেতার পদবিটি। তবে জেনারেল পিপলস কমিটি ব্যবস্থাটি তিনি রেখে দেন। এই ব্যবস্থাই তাঁকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে এত দিন। আমরা যাকে সংসদ হিসেবে চিনি, এই পিপলস কংগ্রেস বাহ্যত সেই সংসদের ভূমিকা পালন করছে। গাদ্দাফি গ্রামপর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন পিপলস কমিটি। প্রতিটি মিউনিসিপালিটিতে গঠিত হয়েছে 'বেসিক পিপলস কংগ্রেস'। এরা নিজেদের মধ্য থেকে একজন চেয়ারম্যান ও পাঁচ জন সদস্য নির্বাচিত করে। এঁদের নিয়েই গঠিত হয় 'জেনারেল পিপলস কংগ্রেস'। এখানে ছাত্র ও পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করা হয়েছে। মজার ব্যাপার, লিবিয়ায় কোনো সংবিধান নেই। একটি রাষ্ট্র যে সংবিধান ছাড়া চলতে পারে, লিবিয়া তার বড় প্রমাণ। তবে গাদ্দাফি লিখিত 'Green Book' (সবুজগ্রন্থ)-ই হলো লিবিয়ার সংবিধান (অনেকটা চীনের মাও জে ডংয়ের Read Book-এর মতো)। Green Book-এ অবশ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, মানুষের তৈরি আইন অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্র চলবে দেশের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা। আরো বলা হয়েছে, 'বিপ্লবের নেতা'কে (অর্থাৎ গাদ্দাফিকে) পরিবর্তন করা যাবে না। গত ৪১ বছর এভাবেই তিনি রাষ্ট্রটি পরিচালনা করে আসছেন। এবং গাদ্দাফি তাঁর বৈধতা আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। কেউ কোনোদিন লিবিয়ার শাসনব্যবস্থা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে 'ডমিনো তত্ত্ব' (Domino effect) বলে একটা কথা আছে। পঞ্চাশের দশকে ইন্দোচীনে উত্তর ভিয়েতনামে বিপ্লবী ও সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতকং বাহিনী যখন ক্ষমতা দখল করল, এর কিছুদিনের মধ্যে এক-এক করে দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্পুচিয়ায়ও সরকারের পতন ঘটল এবং সেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। এটা অনেকটা এ রকম_কিছু তাস যদি খাড়া করানো থাকে এবং একটা টোকা দিয়ে ফেলে দিলে বাকিগুলোও পড়ে যাবে। এটাই হচ্ছে 'ডমিনো তত্ত্ব'। তিউনিসিয়ায় জাইন এল আবিদিন বেন আলীর পতনের পর আমরা আরব বিশ্বে এই ডমিনো তত্ত্বের প্রয়োগ দেখছি। তিউনিসিয়ার পর মিসর, এবার লিবিয়া। এরপর সম্ভবত ইয়েমেন, আলজেরিয়া কিংবা বাহরাইন। বাহরাইনে মিসরের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও চূড়ান্ত বিচারে এখানে 'বিপ্লব' সফল হবে না। কেননা, এখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর পঞ্চম ফ্লিটের ঘাঁটি।
লিবিয়ায় গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে হাজারটা কারণ থাকলেও এটা অস্বীকার করা যাবে না, পশ্চিমা শক্তির এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন নিয়েই গাদ্দাফি এত দিন ক্ষমতায় ছিলেন। লিবিয়ায় পশ্চিমাদের স্বার্থ রয়েছে যথেষ্ট। বিশেষ করে তেল-স্বার্থ। ফ্রান্স (Total), ইতালি (ঊঘও) ও স্পেন (Repso) লিবিয়ার তেল বা গ্যাস উত্তোলনে সরাসরি জড়িত। লিবিয়া প্রতিদিন ১০ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করে (বিশ্বের ১২তম রপ্তানিকারক দেশ)। এর মধ্যে বিদেশি কম্পানিগুলোর উৎপাদনের হার নিম্নরূপ : ইতালি ৩৬৫৭৪২ ব্যারেল (রপ্তানির ২৯ ভাগ), ফ্রান্স ১৭৭৭৯৭ ব্যারেল (১৪ ভাগ), স্পেন ১২৯২২৭ ব্যারেল (১০ ভাগ), চীন ১৬০৬৭৬ ব্যারেল (১৩ ভাগ), আর যুক্তরাষ্ট্র ৬০৫৫৩ ব্যারেল (শতকরা পাঁচ ভাগ)। আর ইতালি লিবিয়া থেকে বছরে গ্যাস পাচ্ছে ৬০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই জ্বালানি নির্ভরশীলতার কারণে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গাদ্দাফি সব সময়ই 'বন্ধু' ছিলেন। পশ্চিমা বিশ্ব ২০০১ সালের 'নাইন-ইলেভেনে'র ঘটনাবলির পর 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শুরু করলে গাদ্দাফি ছিলেন তাদের মিত্র। সেদিন গাদ্দাফি সাদ্দাম হোসেনের তথাকথিত Weapons of mass destruction-এর সমালোচনা করেছিলেন। ফলে ইরাকের বিরুদ্ধে গাদ্দাফিকে ব্যবহার করেছিল পশ্চিমা বিশ্ব। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, আশির দশকে লিবিয়ার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল লিবিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদকে 'প্রমোট' করে। এই অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ১৯৮৬ সালে ত্রিপোলিতে বোমা হামলা চালিয়েছিল, যাতে গাদ্দাফির মেয়ে মারা গিয়েছিলেন। ওই সময় ইরানে ইসলামিক বিপ্লবীদের বিরুদ্ধেও গাদ্দাফিকে ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার ত্রিপোলি সফর করেছিলেন। কেননা, লিবিয়ায় ব্যবসার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল এবং ব্রিটেন চেয়েছিল সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে। এমনকি সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসও ত্রিপোলি সফর করেছিলেন ২০০৮ সালে। শুধু ওই ব্যবসায়িক স্বার্থ বিবেচনাতেই ব্রিটেন লকারবি বিমান দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত আবদুল বাসেত আল মেগরাহিকে মানবিক কারণে(?) ২০০৯ সালে মুক্তি দিয়েছিল। অথচ মেগরাহি আজও বেঁচে আছেন। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের নিজেদের স্বার্থেই এত দিন লিবিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছিল। এ জন্যই ফ্রিডম হাউস যখন লিবিয়াকে 'Most despotic country' হিসেবে আখ্যায়িত করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি (উত্তর কোরিয়া ও ইরানের ক্ষেত্রে তারা উদ্যোগ নিয়েছে)। স্বার্থ এখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে।
আজ হঠাৎ করেই যখন লিবিয়া এক পরিবর্তনের মুখোমুখি, জনতা যখন একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে, তখন পশ্চিমা বিশ্ব অনেকটাই 'জনতার' পাশে এসে দাঁড়িয়েছে(?)। জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। চাইছে গাদ্দাফির পতন। কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে না। সেখানে দুটো সম্ভাবনা উজ্জ্বর। এক. গাদ্দাফি তাঁর সমর্থক তথা গোষ্ঠীর (Qadhadhfa) সমর্থন নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ ত্রিপোলি কিংবা সারা শহরে তার অবস্থান ধরে রাখা। দুই. লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়া ও 'দ্বিতীয় আরেকটি সোমালিয়া' সৃষ্টি হওয়া। এখানে সোমালিয়ার 'আল সাবাব' জঙ্গিগোষ্ঠীর মতো ইসলামিক কট্টরপন্থীদের উত্থানও ঘটতে পারে। মিসরের সঙ্গে লিবিয়ার পার্থক্যটা এখানেই যে হোসনি মুবারক স্বেচ্ছায় সরে গেছেন, সেনাবাহিনী সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। কিন্তু গাদ্দাফি একটু পাগলাটে স্বভাবের (রিগ্যান তাঁকে আখ্যায়িত করেছিলেন Mad Dog হিসেবে)। তিনি চাইবেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে। কিন্তু পরিস্থিতি বলে ভিন্ন কথা। পূর্বাঞ্চলে স্পষ্টতই গাদ্দাফির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অধ্যাপক James D. Le Sueeur যে Post-colonial Time Disorder (PTD)-এর কথা বলেছেন (ফরেন অ্যাফেয়ার্স ১৪ ফেব্রুয়ারি), তার বাস্তব রূপ হচ্ছে আজকের লিবিয়া। সেই পুরনো মানসিকতায় দেশ চালানো এবং ক্ষমতা ধরে রাখা, এরই নাম PTD। জাইন এল আবিদিন বেন আলী, হোসনি মুবারক, আলী আবদুল্লাহ সালেহ, আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা, হামাদ বিন ইসা আল খলিফা এই PTD-এরই প্রতিনিধি। কিন্তু পরিস্থিতি আজ ভিন্ন। একে একে নিভেছে দেউটি। বেন আলী ও মুবারক এখন ইতিহাস। আর গাদ্দাফি এখন সেই পথেরই যাত্রী।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment