রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পরমাণু শক্তি : বাংলাদেশকে ভাবতে হবে

জাপানের ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামির পর ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাংলাদেশকে এখন দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে পরমাণু শক্তির প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা। জাপান প্রযুক্তি বিদ্যায় শীর্ষে অবস্থান করলেও পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ এখনও আসছে। বলা হচ্ছে ফুকুসিমায় যে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তা মধ্য আশির দশকে (১৯৮৬) রাশিয়ার চেরনোবিলের দুর্ঘটনার থেকেও ভয়াবহ। চেরনোবিলের ওই দুর্ঘটনার পর সারা পশ্চিম ইউরোপে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ক্ষতি এখনও পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখন ফুকুসিমার দুর্ঘটনার পর কেন্দ্রটি
নিশ্চিতভাবেই বন্ধ করে দেয়া হবে। আর ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করতে হবে আরও কয়েক বছর পর। কিন্তু আমরা? বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার। গত ২১ মে মস্কোতে এ ব্যাপারে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে পাবনার রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১৯৬১ সালে জমি অধিগ্রহণ করে রাখা হয়েছিল। সেখানেই এখন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। প্রস্তাবিত রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যা প্রায় ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমান। বিদ্যুতের বিকল্প বাংলাদেশে নেই। এ কারণেই পরমাণু শক্তির কথা ভাবা হয়েছিল।

বলার অপেক্ষা রাখে না, পরমাণু প্রকল্প খুব ব্যয়বহুল এবং দক্ষিণ এশিয়ায় পরমাণু শক্তির ব্যবহার খুবই কম। ভারতে মোট জ্বালানির মাত্র দুই ভাগ ও পাকিস্তানের এক ভাগ আসে পরমাণু জ্বালানি থেকে। দুটো দেশই এখন পরমাণু জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা নিয়ে খোদ ভারতেই বিতর্ক রয়েছে। অন্যদিকে অতি সম্প্রতি পাকিস্তান তার দীর্ঘদিনের বন্ধু চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে চীন পাকিস্তানে বেশ ক’টি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে দেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তির দিকে ঝুঁকেছে বটে, কিন্তু ফুকুসিমা পরমাণু কেন্দ্রে বিস্ফোরণ আমাদের জন্য চিন্তার খোরাক জোগাবে এখন।

সাধারণত ৬০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ৫০০ মেগাওয়াটের ওপরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে উৎপাদন খরচ কম হয়। কিন্তু এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয়। প্রচলিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য গড়ে খরচ হয় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে পরমাণু কেন্দ্র স্থাপন করতে খরচ হয়েছে দেড় থেকে ২ মিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে খরচ হবে দেড় বিলিয়ন ডলার বা ১৫০ কোটি ডলার। বর্তমানে ২৫০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াটেরও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যায়। তবে এ খরচ দেশ ও স্থানভেদে ভিন্ন হয়। জাপানে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় প্রতি ইউনিটে ৪ ডলার ৮০ সেন্ট। জাপানে কয়লায় খরচ হয় ৪ ডলার ৯৫ সেন্ট ও গ্যাসে ৫ ডলার ২১ সেন্ট। কোরিয়ায় পরমাণুতে ২ ডলার ৩৪ সেন্ট, কয়লায় ২ ডলার ১৬ সেন্ট ও গ্যাসে ৪ ডলার ৬৫ সেন্ট। ফ্রান্সে পরমাণুতে ২ ডলার ৫৪ সেন্ট, কয়লায় ৩ ডলার ৩৩ সেন্ট ও গ্যাসে ৩ ডলার ৯২ সেন্ট। বর্তমানে বিশ্বে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার ২৪ ভাগই পরমাণু শক্তি থেকে। এগুলো সবই প্রায় উন্নত দেশে। বিশ্বে ২৮টি পরমাণু ভিত্তিক ৪২০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। এর মাঝে ফ্রান্সে ৫৯টি। ফ্রান্সে মোট বিদ্যুতের ৭৯ শতাংশ উৎপাদন হয় পরমাণু শক্তি থেকে। বেলজিয়ামে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৫৮টি। এর মোট বিদ্যুতের ৫৮ ভাগই পারমাণবিক। সুইডেনে ৪৪ ভাগ, কোরিয়ায় ৪০ ভাগ, জাপানে ৫৫ ভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০ ভাগ। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে চীনে ৯ হাজার, ভারতে ৪ হাজার ১২০, পাকিস্তানে ৪২৫ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এসব দেশে আরও প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে চীন ৪০ হাজার, ভারত ২০ হাজার ও পাকিস্তান ৭ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। বাংলাদেশসহ ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, পোল্যান্ড, তুরস্ক, রুমানিয়া ও চিলিতে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে বেশি। জাতিসংঘ ২০০৭ সালের জুন মাসে বাংলাদেশকে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল। পাশাপাশি ২০৫০ সাল পর্যন্ত ৮টি উন্নয়নশীল দেশকেও এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে জাতিসংঘ।
পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে একটা বড় ভয় হচ্ছে এর রক্ষণাবেক্ষণে যদি ত্রু টি থাকে, তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আশির দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিলে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তার রেশ এখনও রয়ে গেছে। চেরনোবিলের ওই এলাকা এখনও বসবাসের অযোগ্য। দুর্ঘটনাকবলিত কেন্দ্রটি আর চালু করা সম্ভব হয়নি। বরং বিশাল এক এলাকা মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে এখনও তেজস্ক্রিয় পদার্থ বেরুচ্ছে এমন খবরও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউক্লিয়ার প্লান্টে অতীতে দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের জন্য ভয়টা এখানেই। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ জনশক্তি আমাদের রয়েছে কিনা সন্দেহ। এর অর্থ দীর্ঘদিন আমাদের রাশিয়ার বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে। দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হচ্ছে জনবসতির ঘনত্ব। রূপপুরে যেখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেখানকার আশপাশে জনবসতি রয়েছে। এই জনবসতি অপসারণ করা হবে একটি বড় সমস্যা। এছাড়া বাংলাদেশে এমন কোন বিরান এলাকা নেই যেখানে কেন্দ্রটি স্থাপন করা যায়। কয়লা উত্তোলন নিয়ে বাংলাদেশে যে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে এবং যেভাবে জনমতকে সংগঠিত করা হয়েছে, তাতে করে একটা আশংকা থেকেই গেল যে, অদূর ভবিষ্যতে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েও এমনটি ঘটতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এছাড়া আমাদের কোন বিকল্পও নেই। বর্তমানে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ ৫ হাজার মেগাওয়াট। ২০১২ সালে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১০ হাজার মেগাওয়াট। আর ২০২০ সালে চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াটে। তখন এই চাহিদা পূরণ হবে কিভাবে? কয়লা কিংবা পরমাণু শক্তি ছাড়া বিকল্প কিছু কি আছে?

জ্বালানি আজ বিশ্বের অন্যতম একটি সমস্যা। সস্তায় তেল পাওয়ার দিন ফুরিয়ে গেছে। আমরা বর্তমানে এক ধরনের ‘অয়েল শক’-এ আক্রান্ত। তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের সর্বোচ্চ পয়েন্টটিতে আমরা পৌঁছে গেছি এবং আগামী কয়েক দশকের মধ্যে আমাদের সভ্যতা ওই পয়েন্টটিকে অতিক্রম করবে। আর এর পরের কাহিনী হবে সাপ্লাই কমে যাওয়া এবং দাম বেড়ে যাওয়ার। গত ৪০ বছর ধরে নতুন নতুন তেলখনি আবিষ্কারের হার পড়তির দিকে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ভূতাত্ত্বিকরা প্রতি বছর ৫৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেলের সন্ধান পেয়েছেন। বর্তমানে প্রাপ্তির পরিমাণ মাত্র ৯ মিলিয়ন ব্যারেল। বর্তমানে প্রতিদিন তেল উত্তোলনের পরিমাণ ৮৬ মিলিয়ন ব্যারেল। প্রত্যেক আমেরিকান গড়ে যে পরিমাণ তেল ব্যবহার করে, বিশ্বের প্রত্যেক লোক যদি সেই পরিমাণ তেল ব্যবহার করতে শুরু করে, তখন দিনপ্রতি তেল উত্তোলন করতে হবে ৪৫০ মিলিয়ন ব্যারেল। তাহলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। আর এভাবে চলতে থাকলে মাত্র ৭ বছরে বিশ্বের তেলের স্টক ফুরিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তখন এটা হবে একটি বড় সমস্যা। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, উন্নয়নের চাপ, কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করবে। তেলের দুষ্প্রাপ্যতা ও দামের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাসকূপগুলো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ও বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবনে ব্যর্থতা বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে একটি বড় ধরনের সংকটে ফেলবে। বাংলাদেশ এই ‘অয়েল শক’ কাটিয়ে উঠতে পারবে না।

তাই এখন থেকেই বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরমাণু জ্বালানি কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে এর নেতিবাচক দিকগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু কেন্দ্র নির্মাণ করলেই চলবে না। রসদ কোত্থেকে আসবে, কোন দেশ সরবরাহ করবে, ওই দেশের সঙ্গে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের মনোভাবও বিবেচনায় নিতে হবে। ইরানের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে রয়েছে। সুতরাং প্রতিটি বিষয়ই বিবেচনায় নিতে হবে। তারপরও পরমাণু জ্বালানি কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তকে আমি পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বিবেচনায় নিতে অনুরোধ করব। যুক্তরাষ্ট্রেও পরমাণু কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখন ঘটল জাপানে। ফুকুসিমা থেকে সীমিত পরিমাণে হলেও তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছে। প্রায় ৩০ মাইল এলাকা ‘সিল’ করে দেয়া হয়েছে। জাপানি প্রযুক্তি তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে পারেনি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা ভয়াবহ হতে পারে। ফুকুসিমা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment