মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারের ঘটনাবলি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ২১ বছর আগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের বিখ্যাত তিয়েন আনমেন স্কয়ারে সংঘটিত ঘটনাবলির কথা। মিসর আর চীনের সমাজব্যবস্থা এক নয়; কিন্তু অদ্ভুত এক মিল লক্ষ্য করা যায়। চীনের জনগণ সেদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে, আরও সংস্কারের দাবিতে তিয়েন আনমেন স্কয়ারে সমবেত হয়েছিল। আর আজ প্রায় একই ধরনের দাবিতে মিসরের জনগণ সমবেত হয়েছে তাহরির স্কয়ারে। সেদিন চীনা সেনাবাহিনী ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে সেই গণজমায়েত ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। আজও মিসরের সেনাবাহিনী পরোক্ষভাবে
তাহরির স্কয়ারে জমায়েত হওয়া গণতন্ত্রকামীদের সমাবেশ ভণ্ডুল করতে মোবারক সমর্থকদের উস্কে দিয়েছে। চীনে গণতন্ত্রকামীদের সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। সেখানে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকলেও সেখানে পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক। মিসরেও পরিবর্তন আসছে। হোসনি মোবারক সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছেন। আগামী ৭ মাস অনেক লম্বা সময়। অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে মিসরে। এখন শুধু অপেক্ষা করার পালা। গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে মিসরসহ সারা আরব বিশ্বে যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, জর্ডান কিংবা ইয়েমেনে যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে জনগণের অসন্তোষ আর ক্ষোভ। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার প্রবণতা, বেকার সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতা, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি এত চরম পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে, সেখানে গণবিস্ফোরণ ঘটেছে। এই গণবিস্ফোরণে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবিদিন বেন আলি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। ইয়েমেনে দীর্ঘদিনের শাসক (৩২ বছর) আলী আবদুল্লাহ সালেহ বলেছেন, তিনি ২০১৩ সালের পর আর প্রেসিডেন্ট পদে থাকবেন না। তার ছেলের হাতেও তিনি ক্ষমতা তুলে দেবেন না। আর জর্ডানে গণবিস্ফোরণ এড়াতে বাদশাহ আবদুল্লাহ মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছেন। সারা আরব বিশ্বেই বইছে পরিবর্তনের ঢেউ। তিউনিসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ যে ঘটনার জন্ম দিল, তার রেশ এখন লেগেছে মিসরে। তিউসিনিয়ার ঘটনাবলি, বিশেষ করে তরুণ সমাজের ভূমিকা দেখে মিসরবাসীও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ইন্টারনেট মিসরের গণআন্দোলনেও একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। তিউনিসিয়ায় বেন আলি ও তার পরিবার বিপুল বিত্ত ও বৈভবের মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ ছিল দরিদ্র। মিসরের ঘটনাবলিও ঠিক একই সূত্রে গাঁথা। মিসরে সাম্প্রতিককালে ধনী ও গরিবের মাঝে একটি বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছিল। মিসরে যত বেশি ভিক্ষুক দেখা যায়, অন্য কোনো আরব বিশ্বে এত ভিক্ষুক নেই। ঠিক তেমনি মিসরে শত শত কোটিপতির জন্ম হয়েছে, যা উত্তর আফ্রিকার অন্য কোনো দেশে নেই। ধনী ও দরিদ্রের এই ব্যবধান মিসরে গণবিপ্লবকে অনিবার্য করেছে।
আজ মিসরে তরুণ সমাজের একটি বড় অংশই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে এরা চাকরি পায় না। সরকার এদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফলে এদের মাঝে যে হতাশার জন্ম হয়েছে, তা থেকে সৃষ্টি হয়েছে গণবিস্ফোরণের। সনাতন পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ মিসরে নেই। একটি গোষ্ঠী বার বার জনগণের নাম করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছে। সাধারণ মানুষের সমর্থন এদের প্রতি না থাকলেও এরাই সব সুবিধা নিচ্ছেন। এদের দিয়েই গঠিত হচ্ছে সংসদ, মন্ত্রিসভা। সাধারণ মানুষ যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতিতে সারা বিশ্বের উন্নয়ন এখন তাদের সামনে। সেই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তারা উত্সাহিত। গণবিস্ফোরণের এটাও একটা কারণ। বলতে দ্বিধা নেই, প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক তার দীর্ঘ শাসনামলে নিজেকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবেই প্রমাণ করেছেন, যেমনি প্রমাণ করেছিলেন তিউনিসিয়ায় বেন আলি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের ‘পাল্স’ তিনি বুঝতে পারেননি। তরুণ সমাজ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ ছিল। এই ক্ষুব্ধতাই তাদের রাজপথে টেনে নিয়ে আসে। বলা ভালো, মিসরে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছিল ১৯৫২ সালে। সেদিন তরুণ অফিসাররা কর্নেল জামাল আবদুল নাসেরের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল হোসনি মোবারক মিসরে এক ধরনের ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করেছেন।
তিনি ভেতরে ভেতরে তার সন্তান জামালকে তৈরি করেছিলেন ভবিষ্যত্ প্রেসিডেন্টের জন্য। মিসরে তথা সারা বিশ্বে এটা জানানো হয়েছিল যে, জামাল মোবারক বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। ৮২ বছর বয়সে এসে হোসনি মোবারক তার ছেলের কাছেই দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন—এরকম আভাসই পাওয়া গিয়েছিল। এটা তো এক ধরনের ‘রাজতন্ত্রই’! আর মিসরে ক্ষমতাসীনরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন, যেখানে হোসনি মোবারক যা চান তা-ই হয়। বড় ধরনের এই গণবিস্ফোরণ না ঘটলে হয়তো মিসরবাসী জামাল মোবারককেই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে পেতেন। অথচ এক সময় মিসর জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতাও ছিল মিসর। নাসের ছিলেন ‘ন্যাম’-এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ‘প্যান এরাবিজম’-এর জন্ম দিয়ে আরব জাহানের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন নাসের। জামাল আবদুল নাসেরের সেই মিসর শৌর্যে-উন্নতিতে এখন অনেক পেছনে। মিসর এখন আর আরব জাহানকে নেতৃত্ব দিতে পারে না। তরুণ সমাজের মাঝে এ থেকে হতাশা আসতেই পারে। এই হতাশাই তাদের টেনে নিয়ে গেছে রাজপথে। একই সঙ্গে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির পর এতটা বছর পার হয়ে গেছে। ২০১০ সাল পার হওয়া সত্ত্বেও শুধু ইসরাইলের একগুঁয়েমির কারণে ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান হয়নি। আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন আজও বিশ্ব রাজনীতিতে আবিভূত হয়নি। ফলে হোসনি মোবারকের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা বিতৃষ্ণা ও বিদ্বেষ জন্ম হতেই পারে। কেননা ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সাধারণ মিসরবাসীর একটা সমর্থন সব সময়ই ছিল। এখনও আছে।
হোসনি মোবারক যদি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি নজর দিতেন, যদি দারিদ্র্য কমানো তথা কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতেন, সর্বোপরি তরুণ সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি দৃষ্টি দিতেন; তাহলে আজকের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে তিনি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি চালু করেছিলেন এক ধরনের পরিবারতন্ত্র। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সারা বিশ্বজুড়েই যখন একটি সমস্যা, তখন তিনি এদিকে নজর দেননি। ক্ষমতার মোহ তাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং আজকের যে পরিস্থিতি, এর দায়-দায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হবে। কিন্তু যে প্রশ্ন এখন বেশি করে আলোচিত হবে তা হচ্ছে, এরপর কী? কোনিদকে যাচ্ছে এখন মিসর? মনে রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মিসরের গুরুত্ব অনেক বেশি। মিসর যদি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকেই বিঘ্ন ঘটাবে না, বরং পুরো আরব বিশ্বেই এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে মিসরে যা ঘটে চলছে, তাকে কোনোমতেই স্বাভাবিক বলা যাবে না। হোসনি মোবারকের পদত্যাগ ছাড়া কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। সমস্যা হচ্ছে, হোসনি মোবারকের বিকল্প কে? একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে তিনি প্রথমবারের মতো নিয়োগ করেছেন। ওমর সুলেইমান সাবেক গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি পরিচিত; কিন্তু বিক্ষোভকারীদের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য নন। সাংবিধানিকভাবে মোবারক তার কাছেই ক্ষমতা ছাড়তে পারেন। অন্য কারও কাছে নয়। বিক্ষোভকারীদের কোনো নেতা নেই। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেও এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে না। সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা (আইএইএ প্রধান) ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এল বারাদি এরই মধ্যে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পশ্চিমা বিশ্ব তাকে মিসরের পরবর্তী নেতা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু এল বারাদির সমস্যা হচ্ছে, তিনি দীর্ঘদিন মিসরে বসবাস করেননি। মিসরের অতীতের কোনো গণআন্দোলনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি থাকেনও ভিয়েনাতে। সবচেয়ে বড় কথা, মিসরের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত মুসলিম ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির সমর্থন তিনি পাবেন বলেও মনে হয় না। একজন মডারেট এল বারাদি ইসলামিক কট্টরপন্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন না। মুসলিম ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি অনেক পুরনো। ১৯২৮ সালে সংগঠনটির জন্ম। বর্তমানে নিষিদ্ধ; কিন্তু সংগঠনটির একটি বড় ভিত্তি রয়েছে। দলটি মিসরে শরিয়া আইন প্রবর্তন করতে চায়। দলের নেতা মোহাম্মদ বেদিই’র তেমন একটা পরিচিতি না থাকলেও, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি হয়ে উঠেছেন গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি।
একই সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল সামি আল আনানও হয়ে উঠেছেন আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। মিসরে গণঅভ্যুত্থান শুরুর প্রাক্কালেও জেনারেল আনান ছিলেন ওয়াশিংটনে। এই মুহূর্তে সেনাবাহিনী এক ধরনের ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে থাকলেও, তাদের অবস্থান পরোক্ষভাবে হোসনি মোবারককে ক্ষমতায় থাকতেই সাহায্য করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ভিন্নভাবে। বলেছেন, হোসনি মোবারকের পরিবর্তে একটি কট্টরপন্থী ইসলামিক গ্রুপ মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। এটি একটি পরিষ্কার ‘মেসেজ’। অর্থাত্ হোসনি মোবারক চলে গেলেও তার সমর্থক কেউ একজন ক্ষমতায় থাকুক। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যে ওমর সুলাইমানের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তা বুঝতে কারও বাকি থাকে না। কেননা ইসরাইল-মিসর শান্তিচুক্তি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গোয়েন্দা শাখার প্রধান হিসেবে ওমর সুলাইমান একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র হোসনি মোবারকের পরিবর্তন চাইছে বটে। ওবামা প্রশাসনের কাছেও এই মুহূর্তে বিকল্প ওই সুলাইমান; কিন্তু মিসরের জনগণ কি সুলাইমানকে মেনে নেবে? শেষ পর্যন্ত নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি ‘সমঝোতা’ হতে পারে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। এল বারাদিসহ আন্দোলনকারীরা এই ফর্মুলা মেনে নিতে পারেন। এতে করে কি বিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে? তিউনিসিয়াতে হয়নি। পুরনো ক্ষমতাসীনরাই রয়ে গেছেন। মিসরেও এমনটি হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় ‘কালার রেভ্যুলুশন’-এর সঙ্গে পূর্ব ইউরোপ তথা মধ্য এশিয়ার ‘কালার রেভ্যুলুশন’-এর পার্থক্য এখানেই।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
তাহরির স্কয়ারে জমায়েত হওয়া গণতন্ত্রকামীদের সমাবেশ ভণ্ডুল করতে মোবারক সমর্থকদের উস্কে দিয়েছে। চীনে গণতন্ত্রকামীদের সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। সেখানে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকলেও সেখানে পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক। মিসরেও পরিবর্তন আসছে। হোসনি মোবারক সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছেন। আগামী ৭ মাস অনেক লম্বা সময়। অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে মিসরে। এখন শুধু অপেক্ষা করার পালা। গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে মিসরসহ সারা আরব বিশ্বে যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, জর্ডান কিংবা ইয়েমেনে যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে জনগণের অসন্তোষ আর ক্ষোভ। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার প্রবণতা, বেকার সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতা, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি এত চরম পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে, সেখানে গণবিস্ফোরণ ঘটেছে। এই গণবিস্ফোরণে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবিদিন বেন আলি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। ইয়েমেনে দীর্ঘদিনের শাসক (৩২ বছর) আলী আবদুল্লাহ সালেহ বলেছেন, তিনি ২০১৩ সালের পর আর প্রেসিডেন্ট পদে থাকবেন না। তার ছেলের হাতেও তিনি ক্ষমতা তুলে দেবেন না। আর জর্ডানে গণবিস্ফোরণ এড়াতে বাদশাহ আবদুল্লাহ মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছেন। সারা আরব বিশ্বেই বইছে পরিবর্তনের ঢেউ। তিউনিসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ যে ঘটনার জন্ম দিল, তার রেশ এখন লেগেছে মিসরে। তিউসিনিয়ার ঘটনাবলি, বিশেষ করে তরুণ সমাজের ভূমিকা দেখে মিসরবাসীও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ইন্টারনেট মিসরের গণআন্দোলনেও একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। তিউনিসিয়ায় বেন আলি ও তার পরিবার বিপুল বিত্ত ও বৈভবের মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ ছিল দরিদ্র। মিসরের ঘটনাবলিও ঠিক একই সূত্রে গাঁথা। মিসরে সাম্প্রতিককালে ধনী ও গরিবের মাঝে একটি বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছিল। মিসরে যত বেশি ভিক্ষুক দেখা যায়, অন্য কোনো আরব বিশ্বে এত ভিক্ষুক নেই। ঠিক তেমনি মিসরে শত শত কোটিপতির জন্ম হয়েছে, যা উত্তর আফ্রিকার অন্য কোনো দেশে নেই। ধনী ও দরিদ্রের এই ব্যবধান মিসরে গণবিপ্লবকে অনিবার্য করেছে।
আজ মিসরে তরুণ সমাজের একটি বড় অংশই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে এরা চাকরি পায় না। সরকার এদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফলে এদের মাঝে যে হতাশার জন্ম হয়েছে, তা থেকে সৃষ্টি হয়েছে গণবিস্ফোরণের। সনাতন পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ মিসরে নেই। একটি গোষ্ঠী বার বার জনগণের নাম করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছে। সাধারণ মানুষের সমর্থন এদের প্রতি না থাকলেও এরাই সব সুবিধা নিচ্ছেন। এদের দিয়েই গঠিত হচ্ছে সংসদ, মন্ত্রিসভা। সাধারণ মানুষ যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতিতে সারা বিশ্বের উন্নয়ন এখন তাদের সামনে। সেই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তারা উত্সাহিত। গণবিস্ফোরণের এটাও একটা কারণ। বলতে দ্বিধা নেই, প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক তার দীর্ঘ শাসনামলে নিজেকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবেই প্রমাণ করেছেন, যেমনি প্রমাণ করেছিলেন তিউনিসিয়ায় বেন আলি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের ‘পাল্স’ তিনি বুঝতে পারেননি। তরুণ সমাজ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ ছিল। এই ক্ষুব্ধতাই তাদের রাজপথে টেনে নিয়ে আসে। বলা ভালো, মিসরে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছিল ১৯৫২ সালে। সেদিন তরুণ অফিসাররা কর্নেল জামাল আবদুল নাসেরের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল হোসনি মোবারক মিসরে এক ধরনের ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করেছেন।
তিনি ভেতরে ভেতরে তার সন্তান জামালকে তৈরি করেছিলেন ভবিষ্যত্ প্রেসিডেন্টের জন্য। মিসরে তথা সারা বিশ্বে এটা জানানো হয়েছিল যে, জামাল মোবারক বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। ৮২ বছর বয়সে এসে হোসনি মোবারক তার ছেলের কাছেই দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন—এরকম আভাসই পাওয়া গিয়েছিল। এটা তো এক ধরনের ‘রাজতন্ত্রই’! আর মিসরে ক্ষমতাসীনরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন, যেখানে হোসনি মোবারক যা চান তা-ই হয়। বড় ধরনের এই গণবিস্ফোরণ না ঘটলে হয়তো মিসরবাসী জামাল মোবারককেই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে পেতেন। অথচ এক সময় মিসর জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতাও ছিল মিসর। নাসের ছিলেন ‘ন্যাম’-এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ‘প্যান এরাবিজম’-এর জন্ম দিয়ে আরব জাহানের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন নাসের। জামাল আবদুল নাসেরের সেই মিসর শৌর্যে-উন্নতিতে এখন অনেক পেছনে। মিসর এখন আর আরব জাহানকে নেতৃত্ব দিতে পারে না। তরুণ সমাজের মাঝে এ থেকে হতাশা আসতেই পারে। এই হতাশাই তাদের টেনে নিয়ে গেছে রাজপথে। একই সঙ্গে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির পর এতটা বছর পার হয়ে গেছে। ২০১০ সাল পার হওয়া সত্ত্বেও শুধু ইসরাইলের একগুঁয়েমির কারণে ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান হয়নি। আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন আজও বিশ্ব রাজনীতিতে আবিভূত হয়নি। ফলে হোসনি মোবারকের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা বিতৃষ্ণা ও বিদ্বেষ জন্ম হতেই পারে। কেননা ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সাধারণ মিসরবাসীর একটা সমর্থন সব সময়ই ছিল। এখনও আছে।
হোসনি মোবারক যদি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি নজর দিতেন, যদি দারিদ্র্য কমানো তথা কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতেন, সর্বোপরি তরুণ সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি দৃষ্টি দিতেন; তাহলে আজকের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে তিনি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি চালু করেছিলেন এক ধরনের পরিবারতন্ত্র। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সারা বিশ্বজুড়েই যখন একটি সমস্যা, তখন তিনি এদিকে নজর দেননি। ক্ষমতার মোহ তাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং আজকের যে পরিস্থিতি, এর দায়-দায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হবে। কিন্তু যে প্রশ্ন এখন বেশি করে আলোচিত হবে তা হচ্ছে, এরপর কী? কোনিদকে যাচ্ছে এখন মিসর? মনে রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মিসরের গুরুত্ব অনেক বেশি। মিসর যদি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকেই বিঘ্ন ঘটাবে না, বরং পুরো আরব বিশ্বেই এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে মিসরে যা ঘটে চলছে, তাকে কোনোমতেই স্বাভাবিক বলা যাবে না। হোসনি মোবারকের পদত্যাগ ছাড়া কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। সমস্যা হচ্ছে, হোসনি মোবারকের বিকল্প কে? একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে তিনি প্রথমবারের মতো নিয়োগ করেছেন। ওমর সুলেইমান সাবেক গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি পরিচিত; কিন্তু বিক্ষোভকারীদের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য নন। সাংবিধানিকভাবে মোবারক তার কাছেই ক্ষমতা ছাড়তে পারেন। অন্য কারও কাছে নয়। বিক্ষোভকারীদের কোনো নেতা নেই। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেও এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে না। সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা (আইএইএ প্রধান) ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এল বারাদি এরই মধ্যে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পশ্চিমা বিশ্ব তাকে মিসরের পরবর্তী নেতা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু এল বারাদির সমস্যা হচ্ছে, তিনি দীর্ঘদিন মিসরে বসবাস করেননি। মিসরের অতীতের কোনো গণআন্দোলনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি থাকেনও ভিয়েনাতে। সবচেয়ে বড় কথা, মিসরের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত মুসলিম ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির সমর্থন তিনি পাবেন বলেও মনে হয় না। একজন মডারেট এল বারাদি ইসলামিক কট্টরপন্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন না। মুসলিম ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি অনেক পুরনো। ১৯২৮ সালে সংগঠনটির জন্ম। বর্তমানে নিষিদ্ধ; কিন্তু সংগঠনটির একটি বড় ভিত্তি রয়েছে। দলটি মিসরে শরিয়া আইন প্রবর্তন করতে চায়। দলের নেতা মোহাম্মদ বেদিই’র তেমন একটা পরিচিতি না থাকলেও, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি হয়ে উঠেছেন গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি।
একই সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল সামি আল আনানও হয়ে উঠেছেন আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। মিসরে গণঅভ্যুত্থান শুরুর প্রাক্কালেও জেনারেল আনান ছিলেন ওয়াশিংটনে। এই মুহূর্তে সেনাবাহিনী এক ধরনের ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে থাকলেও, তাদের অবস্থান পরোক্ষভাবে হোসনি মোবারককে ক্ষমতায় থাকতেই সাহায্য করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ভিন্নভাবে। বলেছেন, হোসনি মোবারকের পরিবর্তে একটি কট্টরপন্থী ইসলামিক গ্রুপ মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। এটি একটি পরিষ্কার ‘মেসেজ’। অর্থাত্ হোসনি মোবারক চলে গেলেও তার সমর্থক কেউ একজন ক্ষমতায় থাকুক। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যে ওমর সুলাইমানের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তা বুঝতে কারও বাকি থাকে না। কেননা ইসরাইল-মিসর শান্তিচুক্তি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গোয়েন্দা শাখার প্রধান হিসেবে ওমর সুলাইমান একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র হোসনি মোবারকের পরিবর্তন চাইছে বটে। ওবামা প্রশাসনের কাছেও এই মুহূর্তে বিকল্প ওই সুলাইমান; কিন্তু মিসরের জনগণ কি সুলাইমানকে মেনে নেবে? শেষ পর্যন্ত নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি ‘সমঝোতা’ হতে পারে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। এল বারাদিসহ আন্দোলনকারীরা এই ফর্মুলা মেনে নিতে পারেন। এতে করে কি বিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে? তিউনিসিয়াতে হয়নি। পুরনো ক্ষমতাসীনরাই রয়ে গেছেন। মিসরেও এমনটি হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় ‘কালার রেভ্যুলুশন’-এর সঙ্গে পূর্ব ইউরোপ তথা মধ্য এশিয়ার ‘কালার রেভ্যুলুশন’-এর পার্থক্য এখানেই।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment