শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদের ফরম পূরণ করা হয়েছে। রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এখন তিনি। জয় যে রাজনীতিতে আসবেন, এটি এক রকম নিশ্চিতই ছিল। আমি গেল নভেম্বরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে পারিবারিক ধারা কীভাবে কাজ করে, এ ব্যাপারে একটি দৈনিকে বিস্তারিত লিখেছিলাম এবং তখনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম জয়কে রাজনীতিতে আসতেই হবে। তা-ই হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় টার্ম শেষ হওয়ার আগেই জয় রাজনীতিতে এ
লেন। এখন দেখতে হবে জয় কতদূর পর্যন্ত যাবেন। তিনি কি শুধুই রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রাথমিক সদস্য থাকবেন? নাকি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ তাকে দিয়ে পূর্ণ করা হবে? ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের যে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের একটি পদ পূরণ করা হয়নি। তখন থেকেই গুজব ছিল জয় এ পদে আসবেন। এ ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমি আজকের এ ঘটনার সঙ্গে ১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে এক সঙ্গে মেলাতে চাই না। ওইদিন শেখ হাসিনার অবর্তমানে আওয়ামী লীগের (মালেক) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি তখন ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন ১৭ মে। শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেতৃত্ব ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন মিজানুর রহমান আর মূলধারা ছিল মালেক উকিলের নেতৃত্বে। ওই সময় শেখ হাসিনা ফিরে না এলে ও দলের হাল না ধরলে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা কঠিন হতো। তবে এটি তো স্বীকার করতেই হবে যে, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি এ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা তিনি, এ সুবিধাটুকু পেয়েছিলেন তিনি_ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ছাত্র সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা তার ছিল। সেই অভিজ্ঞতা ধারণ করেই তিনি ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের মতো বড় একটি সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সজীব ওয়াজেদের এ সুযোগ ছিল না। তিনি কোনোদিন ছাত্র সংগঠন করেননি। মায়ের সঙ্গে ছেলের পার্থক্যটা এখানেই।
জয় উপমহাদেশের পারিবারিক রাজনীতির ধারার সর্বশেষ প্রতিনিধি। এই পারিবারিক ধারা উপমহাদেশের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এই উপমহাদেশে পারিবারিক রাজনীতি গণতন্ত্র বিকাশে অবদান রেখে আসছে, এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ভারতে শুধু নেহরু পরিবারকে বলা হলে, ভুল বলা হবে। প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা লক্ষ্য করা যায়। প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই এ ধরনের একেকটি পরিবার রয়েছে, যাদের কেন্দ্র করে 'রাজনীতি' আবর্তিত হয়। যেমন বলা যেতে পারে দেবী লাল, ভজনলাল, বংশীলাল (হরিয়ানা), শারদ পাওয়ার (মহারাষ্ট্র), মুকুট মিথি (অরুণাচল), লালুপ্রসাদ, জগজীবনরাম (বিহার), পূর্ণ সাংমা (মেঘালয়), সিন্ধিয়া (মধ্যপ্রদেশ), রাজেশ পাইলট (রাজস্থান), মুলায়াম সিং (উত্তর প্রদেশ), শেখ আবদুল্লাহ (কাশ্মীর), করুণানিধি (তামিলনাড়ূ), বহুরাপ্পা (কর্ণাটক), বিজ পট্টনায়েক (উড়িষ্যা) পরিবারের কথা। বাবার অবর্তমানে ছেলে কিংবা মেয়ে এখন সেখানে পারিবারিক রাজনীতির ধারাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার কিংবা নওয়াজ শরিফ পরিবার অন্যতম 'শক্তি'। তাদের বাদ দিয়ে যে পাকিস্তানের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না, তা আবারও প্রমাণিত হলো এবং পারিবারিক রাজনীতির ধারায় 'বালক' বিলওয়াল ভুট্টো যে আগামী দিনের পাকিস্তানের নেতা তা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। শ্রীলংকায় বন্দরনায়েকে পরিবারও সে দেশের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত একটি শক্তি। এমনকি নেপালের রাজনীতিতে কৈরালা পরিবারকে বাদ দিয়ে কিছু চিন্তা করা যায় না। এ ধারায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে মাওবাদী নেতা প্রচন্ডের পরিবারও। উপমহাদেশের রাজনীতির এটি একটি বৈশিষ্ট্য। যদিও এ পারিবারিক রাজনীতি নিয়ে নানা কথা আছে। আমি একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি ইউরোপকে গণতন্ত্রের তীর্থস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও সেখানেও কোনো কোনো দেশে পারিবারিক রাজনীতির এই ধারা লক্ষ্য করা যায়। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জর্জ পাপান্ড্রু। তার বাবা আন্দ্রেয়াস পাপান্ড্রু এবং দাদা জর্জ পাপান্ড্রুও (সিনিয়র) সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিরোধী দল নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কসটাস কারমানলিসের পিতাও ছিলেন গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী। মেসিডোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোলা গ্রুয়েভস্কি, কসোভোর হাসিম থাচি, হাঙ্গেরির গর্ডন বাজনাই, লিচেনস্টাইনের ক্লাউস সুসটার পারিবারিক রাজনীতির ধারায় ক্ষমতাসীন হয়েছেন। এমনকি আফ্রিকার মাদাগাস্কারে আন্দ্রে রাজালিনা, গ্যাবনের আলি কঙ্গো, কঙ্গোর জোসেফ কাবিলা একই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আমরা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নামও উল্লেখ করতে পারি। জর্জ বুশের বাবা সিনিয়র বুশও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সুতরাং পারিবারিক রাজনীতি যে আজ উপমহাদেশেই রয়েছে তা নয়। বরং পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও এই রাজনীতি বহমান।
পারিবারিক এই রাজনীতির ধারায় জয় রাজনীতিতে এলেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা বিশ্বাস করি একুশ শতকের উপযোগী যে নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের দরকার, সেই নেতৃত্ব জয় সৃষ্টি করতে পারবেন। ইতিমধ্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে তাও খুব আশাব্যঞ্জক। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই প্রয়োজন। আমাদের যেখানে সামনে তাকানোর কথা, সেখানে আমরা তাকাচ্ছি পেছনের দিকে। ইতিহাসে যার যা অবদান, সে অবদানকে আমরা স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ফলে দেশে নির্বাচন হচ্ছে, সংসদ হচ্ছে, সরকার পরিবর্তন হচ্ছে; কিন্তু 'আগামীর বাংলাদেশ' গড়ার যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। জয় আধুনিকমনস্ক একজন মানুষ। কম্পিউটার বিদ্যায় তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। প্রধানমন্ত্রী 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার যে প্রত্যয়ের কথা ঘোষণা করেছেন তা বাস্তবায়নে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করতে পারেন। মহাজোট সরকার এক বছর পার করেছে। সরকারের হাতে এজেন্ডা অনেক। গেল এক বছর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার সফল হয়েছে, এটি বলা যাবে না। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে 'আস্থার সংকট'-এর সৃষ্টি হয়েছে জয় পারেন তা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে। তার বিদেশে পড়াশোনা ও বিদেশের সংস্কৃতি থেকে শেখা তাকে এ কাজে সাহায্য করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের এই দেশে চাকুটারদের কোনো অভাব নেই। এখন যখন তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লেখালেন, আমি ধারণা করছি অচিরেই তিনি বেশকিছু 'বন্ধু' খুঁজে পাবেন, যারা তাকে ব্যবহার করবে তাদের স্বার্থে। তার দল এখন ক্ষমতায়। মা প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং সুযোগসন্ধানীরা তাকে সঠিক তথ্যটি দিয়ে 'সাহায্য' করবে না; বরং ভুল পরামর্শ দিয়ে তাকে ভুল পথে চালিত করতে পারে। জয় যদি তাদের থেকে দূরে থাকতে পারেন, তিনি ভালো করবেন এবং এ মুহূর্তে তার দলের কোনো শীর্ষপদ নেওয়াও ঠিক হবে না। কাজের মধ্যে থেকে তিনি শীর্ষপদে উঠে আসবেন, আমরা সেটিই চাইব। 'একজন শেখ মুজিব' হঠাৎ করে জন্ম নেননি। তৃণমূল পর্যায় থেকে কাজ শিখে, মানুষের সঙ্গে মিশে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার ভাগীদার হয়ে তিনি অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। 'একজন শেখ মুজিব'-এর রক্ত তার শরীরে বহমান। 'আরেকজন শেখ মুজিব' তৈরি হোক জয়ের মধ্যে, আমাদের প্রত্যাশা এটিই।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক, জাবি
[সূত্রঃ সমকাল, ১৫/০৩/১০]
লেন। এখন দেখতে হবে জয় কতদূর পর্যন্ত যাবেন। তিনি কি শুধুই রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রাথমিক সদস্য থাকবেন? নাকি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ তাকে দিয়ে পূর্ণ করা হবে? ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের যে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের একটি পদ পূরণ করা হয়নি। তখন থেকেই গুজব ছিল জয় এ পদে আসবেন। এ ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমি আজকের এ ঘটনার সঙ্গে ১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে এক সঙ্গে মেলাতে চাই না। ওইদিন শেখ হাসিনার অবর্তমানে আওয়ামী লীগের (মালেক) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি তখন ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন ১৭ মে। শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেতৃত্ব ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন মিজানুর রহমান আর মূলধারা ছিল মালেক উকিলের নেতৃত্বে। ওই সময় শেখ হাসিনা ফিরে না এলে ও দলের হাল না ধরলে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা কঠিন হতো। তবে এটি তো স্বীকার করতেই হবে যে, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি এ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা তিনি, এ সুবিধাটুকু পেয়েছিলেন তিনি_ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ছাত্র সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা তার ছিল। সেই অভিজ্ঞতা ধারণ করেই তিনি ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের মতো বড় একটি সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সজীব ওয়াজেদের এ সুযোগ ছিল না। তিনি কোনোদিন ছাত্র সংগঠন করেননি। মায়ের সঙ্গে ছেলের পার্থক্যটা এখানেই।
জয় উপমহাদেশের পারিবারিক রাজনীতির ধারার সর্বশেষ প্রতিনিধি। এই পারিবারিক ধারা উপমহাদেশের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এই উপমহাদেশে পারিবারিক রাজনীতি গণতন্ত্র বিকাশে অবদান রেখে আসছে, এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ভারতে শুধু নেহরু পরিবারকে বলা হলে, ভুল বলা হবে। প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা লক্ষ্য করা যায়। প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই এ ধরনের একেকটি পরিবার রয়েছে, যাদের কেন্দ্র করে 'রাজনীতি' আবর্তিত হয়। যেমন বলা যেতে পারে দেবী লাল, ভজনলাল, বংশীলাল (হরিয়ানা), শারদ পাওয়ার (মহারাষ্ট্র), মুকুট মিথি (অরুণাচল), লালুপ্রসাদ, জগজীবনরাম (বিহার), পূর্ণ সাংমা (মেঘালয়), সিন্ধিয়া (মধ্যপ্রদেশ), রাজেশ পাইলট (রাজস্থান), মুলায়াম সিং (উত্তর প্রদেশ), শেখ আবদুল্লাহ (কাশ্মীর), করুণানিধি (তামিলনাড়ূ), বহুরাপ্পা (কর্ণাটক), বিজ পট্টনায়েক (উড়িষ্যা) পরিবারের কথা। বাবার অবর্তমানে ছেলে কিংবা মেয়ে এখন সেখানে পারিবারিক রাজনীতির ধারাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার কিংবা নওয়াজ শরিফ পরিবার অন্যতম 'শক্তি'। তাদের বাদ দিয়ে যে পাকিস্তানের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না, তা আবারও প্রমাণিত হলো এবং পারিবারিক রাজনীতির ধারায় 'বালক' বিলওয়াল ভুট্টো যে আগামী দিনের পাকিস্তানের নেতা তা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। শ্রীলংকায় বন্দরনায়েকে পরিবারও সে দেশের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত একটি শক্তি। এমনকি নেপালের রাজনীতিতে কৈরালা পরিবারকে বাদ দিয়ে কিছু চিন্তা করা যায় না। এ ধারায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে মাওবাদী নেতা প্রচন্ডের পরিবারও। উপমহাদেশের রাজনীতির এটি একটি বৈশিষ্ট্য। যদিও এ পারিবারিক রাজনীতি নিয়ে নানা কথা আছে। আমি একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি ইউরোপকে গণতন্ত্রের তীর্থস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও সেখানেও কোনো কোনো দেশে পারিবারিক রাজনীতির এই ধারা লক্ষ্য করা যায়। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জর্জ পাপান্ড্রু। তার বাবা আন্দ্রেয়াস পাপান্ড্রু এবং দাদা জর্জ পাপান্ড্রুও (সিনিয়র) সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিরোধী দল নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কসটাস কারমানলিসের পিতাও ছিলেন গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী। মেসিডোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোলা গ্রুয়েভস্কি, কসোভোর হাসিম থাচি, হাঙ্গেরির গর্ডন বাজনাই, লিচেনস্টাইনের ক্লাউস সুসটার পারিবারিক রাজনীতির ধারায় ক্ষমতাসীন হয়েছেন। এমনকি আফ্রিকার মাদাগাস্কারে আন্দ্রে রাজালিনা, গ্যাবনের আলি কঙ্গো, কঙ্গোর জোসেফ কাবিলা একই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আমরা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নামও উল্লেখ করতে পারি। জর্জ বুশের বাবা সিনিয়র বুশও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সুতরাং পারিবারিক রাজনীতি যে আজ উপমহাদেশেই রয়েছে তা নয়। বরং পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও এই রাজনীতি বহমান।
পারিবারিক এই রাজনীতির ধারায় জয় রাজনীতিতে এলেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা বিশ্বাস করি একুশ শতকের উপযোগী যে নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের দরকার, সেই নেতৃত্ব জয় সৃষ্টি করতে পারবেন। ইতিমধ্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে তাও খুব আশাব্যঞ্জক। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই প্রয়োজন। আমাদের যেখানে সামনে তাকানোর কথা, সেখানে আমরা তাকাচ্ছি পেছনের দিকে। ইতিহাসে যার যা অবদান, সে অবদানকে আমরা স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ফলে দেশে নির্বাচন হচ্ছে, সংসদ হচ্ছে, সরকার পরিবর্তন হচ্ছে; কিন্তু 'আগামীর বাংলাদেশ' গড়ার যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। জয় আধুনিকমনস্ক একজন মানুষ। কম্পিউটার বিদ্যায় তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। প্রধানমন্ত্রী 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার যে প্রত্যয়ের কথা ঘোষণা করেছেন তা বাস্তবায়নে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করতে পারেন। মহাজোট সরকার এক বছর পার করেছে। সরকারের হাতে এজেন্ডা অনেক। গেল এক বছর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার সফল হয়েছে, এটি বলা যাবে না। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে 'আস্থার সংকট'-এর সৃষ্টি হয়েছে জয় পারেন তা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে। তার বিদেশে পড়াশোনা ও বিদেশের সংস্কৃতি থেকে শেখা তাকে এ কাজে সাহায্য করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের এই দেশে চাকুটারদের কোনো অভাব নেই। এখন যখন তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লেখালেন, আমি ধারণা করছি অচিরেই তিনি বেশকিছু 'বন্ধু' খুঁজে পাবেন, যারা তাকে ব্যবহার করবে তাদের স্বার্থে। তার দল এখন ক্ষমতায়। মা প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং সুযোগসন্ধানীরা তাকে সঠিক তথ্যটি দিয়ে 'সাহায্য' করবে না; বরং ভুল পরামর্শ দিয়ে তাকে ভুল পথে চালিত করতে পারে। জয় যদি তাদের থেকে দূরে থাকতে পারেন, তিনি ভালো করবেন এবং এ মুহূর্তে তার দলের কোনো শীর্ষপদ নেওয়াও ঠিক হবে না। কাজের মধ্যে থেকে তিনি শীর্ষপদে উঠে আসবেন, আমরা সেটিই চাইব। 'একজন শেখ মুজিব' হঠাৎ করে জন্ম নেননি। তৃণমূল পর্যায় থেকে কাজ শিখে, মানুষের সঙ্গে মিশে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার ভাগীদার হয়ে তিনি অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। 'একজন শেখ মুজিব'-এর রক্ত তার শরীরে বহমান। 'আরেকজন শেখ মুজিব' তৈরি হোক জয়ের মধ্যে, আমাদের প্রত্যাশা এটিই।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক, জাবি
[সূত্রঃ সমকাল, ১৫/০৩/১০]
0 comments:
Post a Comment