রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কিরগিজস্তান থেকে থাইল্যান্ড

মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তানের 'টিউলিপ রেভলিউশন' শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে চলেছে। স্পষ্টতই একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেখানে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছে। বিরোধী দলের নেতৃত্বে সেখানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। তারা আগামী ছ'মাসের মধ্যে একটি শাসনতন্ত্র তৈরি করবেন বলে ঘোষণা করেছেন বিরোধী দলের নেত্রী রোজা অটুনভায়েভা। তিনিই এখন মূলত কিরগিজস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাকিয়েভ পালিয়ে গেছেন। ২০০৫ সালের মার্চ মাসে যে বিপ্লব তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আসকার আকায়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল, সেই একই ঘটনার
পুনরাবৃত্তি ঘটল পাঁচ বছর পর ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে। কিরগিজস্তান বিখ্যাত টিউলিপ ফুলের জন্য। ওই সময় আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল টিউলিপ ফুল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসকার আকায়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। কিন্তু এবারের আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। সহিংস ঘটনাবলিতে মারা গেছেন একশ' মানুষ। পালিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট কুরমানবেক বাকিয়েভ আর ২০০৫ সালের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আসকার আকায়েভের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, অন্তত ক্ষমতা পরিচালনার দিক থেকে। তারা দু'জনই মূলত একটি 'অথোরেটারিয়ান নেতৃত্ব'-এর জন্ম দিয়েছেন। এটা কখনই গণতন্ত্রসম্মত ছিল না। আসকার আকায়েভ ছিলেন মূলত সাবেক কমিউনিস্ট নেতা।

১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতন ও সেই সঙ্গে রাষ্ট্রটি ভেঙে গেলে কিরগিজস্তান স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং আসকার আকায়েভও তার ভোল পাল্টে ফেলেন। তিনি 'গণতন্ত্রী' রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৯০ সালের ২৮ অক্টোবর। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগেই ১৯৯১ সালের ৩১ আগস্ট কিরগিজস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এরপর থেকে ক্ষমতাচ্যুতির আগ পর্যন্ত তিনি একাধিকবার তথাকথিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এজন্য তিনি সংবিধান সংশোধন করেছেন। জনমতের আয়োজন করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শান্তিপূর্ণ বিপ্লব তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আকায়েভ একটি মোসাহেবি তথা সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি করেছিলেন। যারা তাকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেছিল। ২০০৫ সালে সাধারণ মানুষ হাতে টিউলিপ ফুল নিয়ে বিক্ষোভ করল, জনগণ সংগঠিত হলো এবং শান্তিপূর্ণ বিপ্লব আকায়েভকে ক্ষমতাচ্যুত করল। মানুষের প্রত্যাশা ছিল, সত্যিকার অর্থেই সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হবে, মানুষের অধিকার স্বীকৃত হবে। কিন্তু কুরমানবেক বাকিয়েভ একই পথ অনুসরণ করলেন। তিনিও সৃষ্টি করলেন একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী। সৃষ্টি করলেন 'অথোরেটারিয়ান নেতৃত্ব'। কেউ কেউ বলেন, বাকিয়েভ অনেকটা 'রাশিয়ান মডেলে' আকৃষ্ট হয়েছিলেন। গণতন্ত্রের নামে কিছু ব্যক্তি যেভাবে রাশিয়াতে ক্ষমতা ধরে রাখছে, সেই একই পথে হাঁটছিলেন বাকিয়েভ। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। এবারের বিপ্লব সহিংসতায় রূপ নিল। কিন্তু টিউলিপ ফুল আর খনিজসম্পদের এই দেশটিতে কি সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? নয়া নেত্রী রোজা অটুনভায়েভা কি সত্যিকার অর্থেই একজন 'গণতন্ত্রী রূপে' আবির্ভূত হবেন? নাকি আকায়েভ ও বাকিয়েভের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন? সেটাই দেখার বিষয় এখন।

কিরগিজস্তানের রাজনীতির সঙ্গে থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক রাজনীতির বেশ মিল রয়েছে। কিরগিজস্তানের ২০০৫ সালের আদলে এখানে তৈরি হয়েছে 'রেড শার্ট' আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা লাল শার্ট পরে প্রধানমন্ত্রী অভিজিৎ ভেজ্জাভিজার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবন দখল করে নিলে এমপি ও মন্ত্রীদের হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করা হয়। ব্যাংককে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলেও বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা তা মানবেন না। স্পষ্টতই সরকারের ভবিষ্যৎ একটি প্রশ্নের মধ্যে আটকে আছে। আজকে থাইল্যান্ডের যে পরিস্থিতি তার একটি প্রেক্ষাপট আছে। ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী যখন থাকসিন সিনাওয়াত্রার সরকারকে উৎখাত করে, তারপর থেকে পরিস্থিতি কখনও স্বাভাবিক হয়নি। যদিও থাকসিনের দল 'থাই বক থাই' পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে সেখানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল থাকসিনের সমর্থকরাই অন্য নামে (পিপলস পার্টি) সংগঠিত হয়ে নির্বাচনে ভালো ফল করেছে। নির্বাচনের পর থাকসিন সমর্থক সামাক সুন্দরাভেজ অন্য পাঁচটি দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলেও বিরোধীদের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য হননি। টিভিতে একটি রান্নার অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ও সাংবিধানিক আদালত তাকে অযোগ্য ঘোষণা করলে দল সোমচাই ওয়াংসাওয়াতকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করে। এবার সাংবিধানিক আদালত নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ আনেন। শেষ পর্যন্ত বিরোধীদলীয় নেতা (ডেমোক্রেটিক পার্টি) অভিজিৎ ভেজ্জাভিজা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে একটি সরকার গঠন করেন। তারপর থেকেই থাকসিনের সমর্থকরা বারবার অভিজিৎ ভেজ্জাভিজা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন। 'লাল শার্ট' আন্দোলনের পেছনে থাকসিন সিনাওয়াত্রার সমর্থন ও মদদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আন্দোলনকারীরা নয়া নির্বাচন চাচ্ছেন। এটা ছাড়া কোনো বিকল্প আছে বলেও মনে হয় না।

কিরগিজস্তান ও থাইল্যান্ড_ দুটি দেশেই গণতান্ত্রিক বিনির্মাণের প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন। দুটি দেশের অভিজ্ঞতাও এক নয়। মিলও রয়েছে কিছু কিছু। যেমন_ এ মুহূর্তে স্ট্র্যাটেজিক্যালি কিরগিজস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, থাইল্যান্ড অত গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এই থাইল্যান্ড একসময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইন্দোচীনে যুদ্ধের সময় থাইল্যান্ড যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, আজ আফগান যুদ্ধের কারণে কিরগিজস্তান তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিরগিজস্তানের মানাস বিমানবন্দর যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করছে। আফগানিস্তানে সেনা ট্রান্সফারে যুক্তরাষ্ট্র মানাস বিমানঘাঁটি ব্যবহার করছে। এছাড়া কিরগিজস্তানের তেল, স্বর্ণ ও কয়লা পশ্চিমাদের কাছে আকর্ষণীয়। কিরগিজস্তানের তেলের রিজার্ভের পরিমাণ ৪০ মিলিয়ন ব্যারেল। সুতরাং কিরগিজস্তানের সাম্প্রতিক আন্দোলনের পেছনে কোনো বহির্শক্তির যে হাত নেই, তা বলা যাবে না। তবে স্পষ্টতই উন্নয়নশীল বিশ্ব গণতন্ত্র বিনির্মাণ যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা বোঝাই যায়। নির্বাচন যে গণতন্ত্রকে কোনো ভিত্তি দিতে পারে না, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে।

এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। মধ্য এশিয়া তথা ইউরো-এশিয়ার গণতন্ত্রের সমস্যা এখানেই। পারিবারিক বন্ধন ও 'গোষ্ঠীতন্ত্র' যদি ভেঙে দেওয়া না যায়, তাহলে গণতন্ত্রের যে সর্বজনীন রূপ তা বিকশিত হবে না। থাইল্যান্ডের গণতন্ত্রের সমস্যা একটু ভিন্ন ধরনের। এখানে নির্বাচন হলেও সরকারকে মেনে না নেওয়ার যে মানসিকতা তা গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। সবচেয়ে বড় কথা, থাইল্যান্ডে বিক্ষোভকারীরা নিজেদের শরীরের রক্ত সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢেলে দিয়ে যে ঘটনার জন্ম দিলেন, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে তা চিন্তাও করা যায় না। কেউ কেউ এ ঘটনাকে ইষড়ড়ফ চড়বিৎ হিসেবে চিহ্নিত করলেও তা নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। কিরগিজস্তান ও থাইল্যান্ডের ঘটনাবলি প্রমাণ করল, উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্রের সংকট এখনও রয়ে গেছে। শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্রে উত্তরণে একমাত্র পথ নয়। নির্বাচনকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থে।
হ ড. তারেক শামসুর রেহমান : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ সমকাল, ২০/০৪/১০]

0 comments:

Post a Comment