রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আফগানিস্তান যুদ্ধের শেষ কবে???

অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ দ্বিতীয় দফা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর দৃশ্যত একটি সমাধান পাওয়া গেলেও এটা কি আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারবে_ এ প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ওবামা প্রশাসনের কাছেও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। অব্যাহত তালেবান হামলার মুখে এবং আফগানিস্তানে শীর্ষ মার্কিন সেনা কমান্ডার জেনারেল ম্যাকক্রিস্টালের দাবির মুখে সেখানে আরও সেনা পাঠানো হলেও তা আফগান সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কতটুকু ভূমিকা পালন করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।


আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলে আসছে গত প্রায় ৩০ বছর ধরে। দীর্ঘ ৮ বছর দেশটি ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কব্জায়। আর ২০০১ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে দেশটি কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। ন্যাটোর জন্মের ৬০ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানে ন্যাটোর বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে তালেবানরা আরও বেশি সংহত হয়েছে, যে কারণে জেনারেল ম্যাকক্রিস্টাল আরও সেনা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন। গত ৩০ বছরে কাবুলের মসনদে বারবার ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। বারবাক কারমাল, ডা. নাজিবুল্লাহ, মোল্লাহ ওমর, রব্বানি, হেকমাতিয়ার কিংবা কারজাই_ সবাই ক্ষমতায় ছিলেন, আবার ক্ষমতা থেকে অপসারিতও হয়েছেন; কিন্তু আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের জন্য যে এতটুকু নিরাপত্তা তা নিশ্চিত করতে পারেননি কেউই। এক সময় সোভিয়েত শাসকরা বারবাক কারমালকেও সরিয়ে দিয়েছিল। আর এখন হামিদ কারজাই কখন ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন, সেটাই দেখার বিষয়। অতীতে বারবাক কারমালকে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি তৈরি করেছিল। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় সিআইএ হামিদ কারজাইকে তৈরি করেছিল আফগানিস্তানের পরবর্তী নেতা হিসেবে। নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে (৪ আগস্ট, ২০০৯) এলিজাবেথ রুবিন লিখিত এক প্রবন্ধে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ১৯৯২ সালে মুজাহিদিনদের নেতৃত্বে কাবুলে যে সরকার গঠিত হয়েছিল সে সরকারে হামিদ কারজাই ছিলেন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তালেবানদের কাবুল দখলের (১৯৯৫) আগেই অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কারজাইকে জেলে পাঠানো হয়েছিল (১৯৯৪)। পরে জেল থেকে পালিয়ে তিনি পাকিস্তান চলে যান। সিআইএ সেখানেই তাকে রিত্রুক্রট করে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর ঘটনাবলির পর তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাহাড়ি উপজাতিদের উদ্বুদ্ধ করতে সিআইএ কারজাইকে ব্যবহার করেছিল। এক পর্যায়ে তালেবানদের একটি গোষ্ঠীর হাতে বন্দিও হয়েছিলেন কারজাই। তখন সিআইএর একটি 'স্পেশাল মিশন' তাকে উদ্ধার করে পাকিস্তান নিয়ে এসেছিল। সে থেকে তিনি সিআইএর 'প্রিয় মানুষ'। তবে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে বলে মনে করেন। কারজাই ভারতে পড়াশোনা করেছেন। ভারতে থাকাকালেই ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের নজরে পড়েন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সাহায্যে কারজাই কাবুলে ক্ষমতাসীন হয়েছেন এবং এই শক্তির সমর্থন যতদিন তিনি নিশ্চিত করবেন, ততদিনই থাকবেন ক্ষমতায়।

কারজাই তার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ইতিমধ্যে ড্রাগ মাফিয়াদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন, যাদের পরামর্শই মূলত তিনি ক্ষমতা চালাচ্ছেন। কান্দাহার প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ মূলত তার সৎভাই আহমেদ ওয়ালি কারজাইর হাতে। ওয়ালির পাশাপাশি রয়েছেন হেলমন্দ প্রদেশের সাবেক গভর্নর মোর মোহাম্মদ আখুনজাদা, জেনারেল দোস্তাম, মোহাম্মদ ফাহিম, মোহাক্কিকের মতো যুদ্ধবাজ নেতারা। আখুনজাদা নিজেও আফিম ব্যবসায়ী। দোস্তাম অন্যতম যুদ্ধবাজ ও উজবেক উপজাতির লোক। তিনি নিজে নর্দান অ্যালায়েন্সের নেতা। ফাহিম তাজিক, সাবেক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ও বর্তমানে কারজাইর রানিং মেট। মোহাক্কিক হাজারা উপজাতির লোক ও অন্যতম যুদ্ধবাজ। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। এদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। এসব যুদ্ধবাজকে নিয়েই একটি চক্র গড়ে তুলেছেন কারজাই। আর এসব যুদ্ধবাজের অস্ত্রের অন্যতম উৎস হচ্ছে মাদক বিক্রির টাকা। এ টাকা দিয়ে তারা অস্ত্র ক্রয় করেন। হিলারি ক্লিনটনের ভাষায়, আফগানিস্তান তাই পরিণত হয়েছে অন্যতম 'ঘধৎপড় ংঃধঃব'-এ। অর্থাৎ মাদক রাষ্ট্র, যেখানে সর্বোচ্চ প্রশাসনের ইঙ্গিতে মাদক বিকিকিনি হয়।

কারজাই নিজের অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য সিআইএ প্রণীত ফর্মুলা অনুসরণ করে চলেছেন। এ ফর্মুলায় যুদ্ধবাজরা আজ তার মিত্র। উত্তরে জেনারেল দোস্তাম ও কান্দাহারে যুদ্ধবাজ নেতা সিরাজি যেমনি তার 'বন্ধু', ঠিক তেমনি হেরাতের আরেক যুদ্ধবাজ নেতা ইসমাইল খানও তার 'বন্ধু'। তিনি যুদ্ধবাজ নেতাদের স্বার্থরক্ষা করেই কাবুলে নিজের ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। ডোনাল্ড রামসফেল্ড একটি ফর্মুলা দিয়েছেন। যুদ্ধবাজ নেতারা সবাই তালেবানবিরোধী। সুতরাং এরা মিত্র। এই 'মিত্র' বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা না করে তাদের মিত্র ভাবতে হবে। তাই কারজাই এসব যুদ্ধবাজ নেতার নিজস্ব সেনাবাহিনী রাখতেই শুধু দেননি, বরং অবৈধ মাদক ব্যবসা ও নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণেরও সুবিধা দিয়েছেন। এ কারণে ভবিষ্যৎ আফগান রাষ্ট্রের কল্পনা করাও কঠিন। ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আলাদা প্রশাসন, যেখানে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। স্থানীয়ভাবেই যুদ্ধবাজ নেতারা অনেকটা 'স্বাধীন'। অস্ত্র ও মাদক এখন আফগানিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। ২৫১৮২৫ বর্গমাইলের যে বিশাল পাহাড়ি এলাকা, সেই পাহাড়ি এলাকা আবার ৩২ প্রদেশে বিভক্ত। প্রতিটি প্রদেশেই রয়েছে একাধিক যুদ্ধবাজ নেতা, যারা স্থানীয়ভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। কোথাও কোথাও এসব যুদ্ধবাজ নেতা আবার তালেবানদের মিত্র। জনসংখ্যার মধ্যে পশতুনের (৩৮ ভাগ) প্রাধান্য বেশি। এরপর রয়েছে তাজিক (২৫ ভাগ), হাজারা (১৯ ভাগ) ও উজবেকদের (৬ ভাগ) প্রাধান্য। কারজাই নিজে পশতুন হলেও ভুলে গেলে চলবে না তালেবানদের মধ্যেও পশতুন গোষ্ঠীর বড় প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।

বস্তুত আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সেখানকার সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারে না। যুদ্ধ, হত্যা, আত্মঘাতী বোমা, বিদেশি সৈন্যদের হত্যা, কোনোটাই বন্ধ হয়নি আফগানিস্তানে। তালেবানরা আজ আফগানিস্তানের অন্যতম শক্তি। এদের সঙ্গে 'সংলাপ'-এ যাওয়ার কথা কেউ কেউ বলেন। আফগানিস্তানের ধর্মীয় নেতারাও একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। তারা সহাবস্থানের একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। 'নয়া জিরগা'য় তালেবান নেতাদের স্থান দিয়ে তাদের আস্থায় নেওয়া যায়। জিমি কার্টার কিংবা বিল ক্লিনটনের মতো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টরা সাম্প্রতিক সময়ে যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছেন, এদের আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না। শুধু ধর্মীয় নেতারাই গ্রহণযোগ্য হবেন। ব্রিটিশ জেনারেল রিচার্ডসন (যিনি সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব নেবেন) ২০৫০ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে থাকার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন তা একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এতে করে বরং জটিলতা আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে পর্যায়ক্রমে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওবামা প্রশাসন আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে যদি এমনটি করে তাহলে তিনি ভালো করবেন। মনে রাখতে হবে, গত ৩০ বছরের যুদ্ধে কোনো পক্ষই 'জয়ী' হয়নি। কিন্তু দেশটি ধ্বংস হয়ে গেছে। কারজাই কিংবা আবদুল্লাহ পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট হবেন সত্য, কিন্তু যুদ্ধ তো বন্ধ হবে না। তাই নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে ওবামা প্রশাসন কি সত্যি সত্যিই আফগান যুদ্ধের অবসান চায়?

- ড. তারেক শামসুর রেহমান : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক (সুত্র,সমকাল, ১১/১১/২০০৯)

0 comments:

Post a Comment