ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে ‘একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম তাত্পর্যপূর্ণ সম্পর্ক’ বলে অভিহিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। যে কোনো বিবেচনায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নানা কারণে আলোচিত। বিশেষ করে দুটি দেশের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে খোদ ভারতেই যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। এমনকি এই চুক্তির বিরোধিতা করে বামরা কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। সে ইতিহাস কিছুটা পুরনো। তারপর ভারতে লোকসভা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে। হোয়াইট হাউস প্রশাসন যে ভারতকে
কত বেশি গুরুত্ব দেয়, তার বড় প্রমাণ ওবামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম যে রাষ্ট্রীয় ভোজসভার আয়োজন করা হলো তা মনমোহন সিংয়ের সম্মানেই করা হলো। ওয়াশিংটনে মনমোহন সিংয়ের চার দিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় সফর শেষ হয়েছে। এই সফরে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত সহযোগিতা বিষয়ক কাঠামো গড়ে তোলা এবং আর্থিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের সূচনা করার মতো নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। যৌথ বিবৃতির এই যে ভাষা, তা আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়। ওবামা যখন চীনে গিয়েছিলেন তখনও ‘অংশীদারিত্বের’ কথা বলেছিলেন। ‘অংশীদারিত্ব’ শব্দটি আসলে কূটনৈতিক শব্দ। কূটনৈতিক ভাষায় এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য কী। দক্ষিণ এশিয়া তথা মধ্য এশিয়ায় আফগানিস্তানের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে সঙ্কটের গভীরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায়, ভারত মহাসাগর ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে চীন এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি ক্রমশ হুমকি হয়ে উঠছে। এজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা। মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফর দেখতে হবে এ আলোকেই। তবে মনে রাখতে হবে, ওবামা প্রশাসনের সময়েই ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়নি, বরং বুশ প্রশাসনের সময়েই এই সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০০৬ সালের ১৮ জুলাই। ওই চুক্তিটি পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে অনুমোদিত হওয়ায় তা আইনে পরিণত হয়েছে। এই চুক্তির ফলে মার্কিন ব্যবসায়ীদের ১০ হাজার কোটি ডলারের এক ব্যবসায়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ‘জুনিয়র পার্টনার’ হয়েছিল। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জুনিয়র পার্টনার’ বা ‘কৌশলগত মিত্র’ বানানোর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সাবেক (বুশ আমলের) পররাষ্ট্র সচিব ড. কন্ডোলিজা রাইস। ২০০৫ সালের মার্চে রাইসের নয়াদিল্লি সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে একটি বিশ্বশক্তি হিসেবেই দেখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিল তখন। ভারত সফরে এসে ২০০৫ সালের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদে দেখতে চায়। বলা ভালো, কন্ডোলিজা রাইসের ভারত সফরের পরপরই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ভারত সফর করেছিলেন। ওই সফরের মধ্য দিয়েই ভারতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে পরিবর্তন আসে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারতের সঙ্গে পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে, তখন স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে তার ‘দ্বৈতনীতির’ প্রতিফলন ঘটেছিল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তি অর্জনে (বিদ্যুত্ উত্পাদনে) ইরানের যেমনি বিরোধিতা করছে, অন্যদিকে ঠিক তেমনি একই প্রশ্নে ভারতকে সমর্থন করছে। যে যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে বিরোধিতা করছে, ঠিক একই যুক্তিতে তার ভারতের বিরোধিতা করার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা করেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র তার দক্ষিণ এশীয় নীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারত কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল না। মিত্র ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তান এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সেন্টো’ ও ‘সিয়াটো’র অন্যতম সদস্য ছিল। এমনকি ৯/১১-এর ঘটনাবলির পর প্রেসিডেন্ট বুশ যে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিলেন, সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানে আল কায়দার তত্পরতা বেড়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করেনি। অথচ সেই পাকিস্তানকে বাদ দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে একটি পারমাণবিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল, যা কিনা উপমহাদেশে নতুন করে পারমাণবিক প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল। পাকিস্তান এরই মধ্যে খুসাবে দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই হেভি ওয়াটার চুল্লিটি বছরে ২০০ কেজির বেশি অস্ত্র তৈরির প্লুটোনিয়াম উত্পন্ন করতে পারবে।
ভারত বড় বাজার। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ থাকবেই। ২০৫০ সালের দিকে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। তাই দেশ দুটো যে পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি আসবে, এটাই স্বাভাবিক। বুশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিলেও ডেমোক্রেটদের সমর্থনও তিনি পেয়েছিলেন। সিনেটর কেরি ভারতের পরমাণু কর্মসূচিকে সমর্থন করেছিলেন। কেরি বুশের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গিয়েছিলেন। এখন ওবামা বুশ প্রণীত নীতি নিয়েই এগিয়ে গেলেন মাত্র। বুশের আমলেও মনমোহন সিং ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। এখন ওবামার আমলেও তিনি দ্বিতীয়বার ওয়াশিংটন সফর করলেন ২০০৯ সালের নভেম্বরে। দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের এটা ধারাবাহিকতা মাত্র।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মাঝে একটা প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই এখন উঠেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে এখন কীভাবে দেখতে চাইছে। এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে আমি বারাক ওবামার একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। গত ২৪ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ওবামার আলোচনার পর ওবামা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় ভারতের ভূমিকা উল্লেখ করেছিলেন এভাবে— “In Asia, Indian leadership is expanding prosperity and the security accross the region. And the United States welcomes and encourages India’s leadership role in helping to shape the rise of a stable, peaceful and prosperous Asia” (ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৫ নভেম্বর)। যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে, এশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে ভারতের নেতৃবৃন্দ একটি বড় ভূমিকা রাখছেন। আর ওবামার কথায়, ভারতের এই ভূমিকাকে যুক্তরাষ্ট্র উত্সাহিত করছে। অর্থাত্ যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে নিরাপত্তার সমস্যাটিকে যেভাবে দেখছে, ভারতও ঠিক একইভাবে দেখছে এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যাটিকে মোকাবিলা করতে চায়। এ অঞ্চলে উভয় দেশের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার স্বার্থকে এগিয়ে নিতে ভারতকে মিত্র হিসেবে দেখছে।
এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রচিত হয়েছে আফগানিস্তান তথা মধ্য এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরকে ঘিরে। প্রতিটি ক্ষেত্রে চীন একটি ফ্যাক্টর। চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে ভারতও। চীনের ভূমিকাকে এ অঞ্চলে সঙ্কুচিত করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এক। যদিও ওবামার চীন সফরের পর একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরও উন্নতি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের ভূমিকা ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। যদিও এখন অব্দি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের কোনো তুলনা হয় না (চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ৩ ভাগের ১ ভাগ, প্রতিরক্ষা বাজেট ৬ ভাগের ১ ভাগ, চীনের মাথাপিছু জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ ভাগের ১ ভাগ), কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার ঋণী। ইরানে চীনের স্বার্থ (চীনের বিনিয়োগ সব সেক্টর মিলিয়ে ৫০ বিলিয়ন ডলার) যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটা মাথাব্যথার কারণ। তাই সমগ্র ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে ভারতের মতো শক্তির। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে আলোচনার আগে আফগানিস্তান নিয়ে দু’কথা বলা প্রয়োজন। ২০০১ সালের অক্টোবরের পর থেকে ২০০৯ সালের শেষ দিন পর্যন্ত আফগানিস্তানে অনেক রক্ত ঝরেছে। হামিদ কারজাই দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন সত্য, কিন্তু আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো বাহিনীর গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ানো যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র এখন চাইবে আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়ুক। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। নিউজ উইকের সম্পাদক ফারিদ জাকারিয়া সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে (২৩ নভেম্বর) জেনারেল ম্যাকক্রিস্টালের একটি গোপন দলিলের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ফারিদ জাকারিয়া লিখেছেন— ‘increasing Indian influence in Afganistan is likely exacerbate regional tensions and encourage Pakistani Countermeasures.” ফারিদ জাকারিয়া আরও লিখেছেন— “India is the hegemors of South Asia, with enormous influence throughout the sub-continent.” ফারিদ জাকারিয়ার মূল্যায়নে কোনো মিথ্যা নেই।
আফগানিস্তানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মতত্পরতা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র ভারতের ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ যে বাড়ছে, তা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই ওবামা প্রশাসন যদি আফগানিস্তানে ভারতকে বড় ভূমিকা পালন করার সুযোগ দেয়, তাহলে তা এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত হানতে বাধ্য। অন্যদিকে ভারতীয় মহাসাগর ঘেঁষা অঞ্চলগুলোতে চীনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে, যা পেন্টাগনের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে থাকবে। চীন এ অঞ্চলজুড়ে যে ‘মুক্তার মালা’ বা ‘String of Pearls’-এর নীতি গ্রহণ করেছে তাতে বেলুচিস্তানের গাওদার বন্দর (যা চীন তৈরি করে দিচ্ছে), দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীনে রফতানিকৃত তেলের ৮০ ভাগ মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে। গাওদারের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা, মিয়ানমারের গিটওয়ে ও কাইয়াযুকে রয়েছে চীনা নেভির ঘাঁটি। কোকো দ্বীপপুঞ্জও ব্যবহার করতে পারে চীনা নৌবাহিনী। চীন শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। চীন বিনামূল্যে যুদ্ধ বিমান দিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকারকে বিদ্রোহী তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ শেষ’ করতে সাহায্য করেছিল। মজার ব্যাপার, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের রেশ ধরে এ অঞ্চলে চীন-ইরান-রাশিয়া ঐক্য গড়ে উঠেছিল, যারা রাজাপাকসের সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনা নেভির উপস্থিতিকে ভারতও খুব সহজভাবে নেয়নি। প্রতিপক্ষ ভারতীয় নৌবাহিনীও এখানে যথেষ্ট শক্তিশালী। মুম্বাই, কারওয়ার, কোচি, বিশাখাপত্তম, পোর্ট ব্লেয়ারে রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর ঘাঁটি। সেই সঙ্গে সিসিলি, মাদাগাস্কার, মৌরিতাসে ভারতীয় নৌবাহিনী বন্দর সুবিধা পায়। আর দিয়াগো গার্সিয়াতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ঘাঁটি। তুলনামূলক বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখানে কিছুটা দুর্বল। এ কারণেই তার ভারতীয় নৌবাহিনীর সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা যথেষ্ট তত্পর। ইরানের ওপর ‘চাপ’ বাড়াতে এই বেলুচিস্তান একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে আগামীতে। বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতা তাই আগামীতে আরও বাড়বে বলেই আমার ধারণা।
মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফর তাই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরে ব্যবসায়িক স্বার্থ কিছুটা রয়েছে বটে (১৯৯০ সালের ৫ মিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫০ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে ২০০৯ সালে), তবে মূল বিষয় হচ্ছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ও রাজনৈতিক ঐক্য। এই ‘ঐক্য’ আগামীতে ‘নয়া বিশ্ব’ ব্যবস্থায় একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই দু’দেশের মাঝে বিকাশমান সম্পর্কের ব্যাপারে অনেকেরই আগ্রহ থাকবে আগামী দিনগুলোতে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল : tsrahmanbd@yahoo.com (সুত্র, আমার দেশ, ০৫/১২/২০০৯)
কত বেশি গুরুত্ব দেয়, তার বড় প্রমাণ ওবামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম যে রাষ্ট্রীয় ভোজসভার আয়োজন করা হলো তা মনমোহন সিংয়ের সম্মানেই করা হলো। ওয়াশিংটনে মনমোহন সিংয়ের চার দিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় সফর শেষ হয়েছে। এই সফরে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত সহযোগিতা বিষয়ক কাঠামো গড়ে তোলা এবং আর্থিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের সূচনা করার মতো নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। যৌথ বিবৃতির এই যে ভাষা, তা আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়। ওবামা যখন চীনে গিয়েছিলেন তখনও ‘অংশীদারিত্বের’ কথা বলেছিলেন। ‘অংশীদারিত্ব’ শব্দটি আসলে কূটনৈতিক শব্দ। কূটনৈতিক ভাষায় এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য কী। দক্ষিণ এশিয়া তথা মধ্য এশিয়ায় আফগানিস্তানের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে সঙ্কটের গভীরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায়, ভারত মহাসাগর ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে চীন এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি ক্রমশ হুমকি হয়ে উঠছে। এজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা। মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফর দেখতে হবে এ আলোকেই। তবে মনে রাখতে হবে, ওবামা প্রশাসনের সময়েই ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়নি, বরং বুশ প্রশাসনের সময়েই এই সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০০৬ সালের ১৮ জুলাই। ওই চুক্তিটি পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে অনুমোদিত হওয়ায় তা আইনে পরিণত হয়েছে। এই চুক্তির ফলে মার্কিন ব্যবসায়ীদের ১০ হাজার কোটি ডলারের এক ব্যবসায়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ‘জুনিয়র পার্টনার’ হয়েছিল। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জুনিয়র পার্টনার’ বা ‘কৌশলগত মিত্র’ বানানোর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সাবেক (বুশ আমলের) পররাষ্ট্র সচিব ড. কন্ডোলিজা রাইস। ২০০৫ সালের মার্চে রাইসের নয়াদিল্লি সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে একটি বিশ্বশক্তি হিসেবেই দেখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিল তখন। ভারত সফরে এসে ২০০৫ সালের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদে দেখতে চায়। বলা ভালো, কন্ডোলিজা রাইসের ভারত সফরের পরপরই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ভারত সফর করেছিলেন। ওই সফরের মধ্য দিয়েই ভারতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে পরিবর্তন আসে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারতের সঙ্গে পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে, তখন স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে তার ‘দ্বৈতনীতির’ প্রতিফলন ঘটেছিল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তি অর্জনে (বিদ্যুত্ উত্পাদনে) ইরানের যেমনি বিরোধিতা করছে, অন্যদিকে ঠিক তেমনি একই প্রশ্নে ভারতকে সমর্থন করছে। যে যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে বিরোধিতা করছে, ঠিক একই যুক্তিতে তার ভারতের বিরোধিতা করার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা করেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র তার দক্ষিণ এশীয় নীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারত কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল না। মিত্র ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তান এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সেন্টো’ ও ‘সিয়াটো’র অন্যতম সদস্য ছিল। এমনকি ৯/১১-এর ঘটনাবলির পর প্রেসিডেন্ট বুশ যে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিলেন, সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানে আল কায়দার তত্পরতা বেড়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করেনি। অথচ সেই পাকিস্তানকে বাদ দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে একটি পারমাণবিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল, যা কিনা উপমহাদেশে নতুন করে পারমাণবিক প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল। পাকিস্তান এরই মধ্যে খুসাবে দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই হেভি ওয়াটার চুল্লিটি বছরে ২০০ কেজির বেশি অস্ত্র তৈরির প্লুটোনিয়াম উত্পন্ন করতে পারবে।
ভারত বড় বাজার। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ থাকবেই। ২০৫০ সালের দিকে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। তাই দেশ দুটো যে পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি আসবে, এটাই স্বাভাবিক। বুশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিলেও ডেমোক্রেটদের সমর্থনও তিনি পেয়েছিলেন। সিনেটর কেরি ভারতের পরমাণু কর্মসূচিকে সমর্থন করেছিলেন। কেরি বুশের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গিয়েছিলেন। এখন ওবামা বুশ প্রণীত নীতি নিয়েই এগিয়ে গেলেন মাত্র। বুশের আমলেও মনমোহন সিং ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। এখন ওবামার আমলেও তিনি দ্বিতীয়বার ওয়াশিংটন সফর করলেন ২০০৯ সালের নভেম্বরে। দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের এটা ধারাবাহিকতা মাত্র।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মাঝে একটা প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই এখন উঠেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে এখন কীভাবে দেখতে চাইছে। এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে আমি বারাক ওবামার একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। গত ২৪ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ওবামার আলোচনার পর ওবামা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় ভারতের ভূমিকা উল্লেখ করেছিলেন এভাবে— “In Asia, Indian leadership is expanding prosperity and the security accross the region. And the United States welcomes and encourages India’s leadership role in helping to shape the rise of a stable, peaceful and prosperous Asia” (ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৫ নভেম্বর)। যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে, এশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে ভারতের নেতৃবৃন্দ একটি বড় ভূমিকা রাখছেন। আর ওবামার কথায়, ভারতের এই ভূমিকাকে যুক্তরাষ্ট্র উত্সাহিত করছে। অর্থাত্ যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে নিরাপত্তার সমস্যাটিকে যেভাবে দেখছে, ভারতও ঠিক একইভাবে দেখছে এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যাটিকে মোকাবিলা করতে চায়। এ অঞ্চলে উভয় দেশের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার স্বার্থকে এগিয়ে নিতে ভারতকে মিত্র হিসেবে দেখছে।
এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রচিত হয়েছে আফগানিস্তান তথা মধ্য এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরকে ঘিরে। প্রতিটি ক্ষেত্রে চীন একটি ফ্যাক্টর। চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে ভারতও। চীনের ভূমিকাকে এ অঞ্চলে সঙ্কুচিত করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এক। যদিও ওবামার চীন সফরের পর একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরও উন্নতি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের ভূমিকা ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। যদিও এখন অব্দি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের কোনো তুলনা হয় না (চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ৩ ভাগের ১ ভাগ, প্রতিরক্ষা বাজেট ৬ ভাগের ১ ভাগ, চীনের মাথাপিছু জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ ভাগের ১ ভাগ), কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার ঋণী। ইরানে চীনের স্বার্থ (চীনের বিনিয়োগ সব সেক্টর মিলিয়ে ৫০ বিলিয়ন ডলার) যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটা মাথাব্যথার কারণ। তাই সমগ্র ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে ভারতের মতো শক্তির। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে আলোচনার আগে আফগানিস্তান নিয়ে দু’কথা বলা প্রয়োজন। ২০০১ সালের অক্টোবরের পর থেকে ২০০৯ সালের শেষ দিন পর্যন্ত আফগানিস্তানে অনেক রক্ত ঝরেছে। হামিদ কারজাই দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন সত্য, কিন্তু আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো বাহিনীর গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ানো যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র এখন চাইবে আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়ুক। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। নিউজ উইকের সম্পাদক ফারিদ জাকারিয়া সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে (২৩ নভেম্বর) জেনারেল ম্যাকক্রিস্টালের একটি গোপন দলিলের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ফারিদ জাকারিয়া লিখেছেন— ‘increasing Indian influence in Afganistan is likely exacerbate regional tensions and encourage Pakistani Countermeasures.” ফারিদ জাকারিয়া আরও লিখেছেন— “India is the hegemors of South Asia, with enormous influence throughout the sub-continent.” ফারিদ জাকারিয়ার মূল্যায়নে কোনো মিথ্যা নেই।
আফগানিস্তানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মতত্পরতা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র ভারতের ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ যে বাড়ছে, তা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই ওবামা প্রশাসন যদি আফগানিস্তানে ভারতকে বড় ভূমিকা পালন করার সুযোগ দেয়, তাহলে তা এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত হানতে বাধ্য। অন্যদিকে ভারতীয় মহাসাগর ঘেঁষা অঞ্চলগুলোতে চীনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে, যা পেন্টাগনের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে থাকবে। চীন এ অঞ্চলজুড়ে যে ‘মুক্তার মালা’ বা ‘String of Pearls’-এর নীতি গ্রহণ করেছে তাতে বেলুচিস্তানের গাওদার বন্দর (যা চীন তৈরি করে দিচ্ছে), দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীনে রফতানিকৃত তেলের ৮০ ভাগ মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে। গাওদারের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা, মিয়ানমারের গিটওয়ে ও কাইয়াযুকে রয়েছে চীনা নেভির ঘাঁটি। কোকো দ্বীপপুঞ্জও ব্যবহার করতে পারে চীনা নৌবাহিনী। চীন শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। চীন বিনামূল্যে যুদ্ধ বিমান দিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকারকে বিদ্রোহী তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ শেষ’ করতে সাহায্য করেছিল। মজার ব্যাপার, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের রেশ ধরে এ অঞ্চলে চীন-ইরান-রাশিয়া ঐক্য গড়ে উঠেছিল, যারা রাজাপাকসের সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনা নেভির উপস্থিতিকে ভারতও খুব সহজভাবে নেয়নি। প্রতিপক্ষ ভারতীয় নৌবাহিনীও এখানে যথেষ্ট শক্তিশালী। মুম্বাই, কারওয়ার, কোচি, বিশাখাপত্তম, পোর্ট ব্লেয়ারে রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর ঘাঁটি। সেই সঙ্গে সিসিলি, মাদাগাস্কার, মৌরিতাসে ভারতীয় নৌবাহিনী বন্দর সুবিধা পায়। আর দিয়াগো গার্সিয়াতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ঘাঁটি। তুলনামূলক বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখানে কিছুটা দুর্বল। এ কারণেই তার ভারতীয় নৌবাহিনীর সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা যথেষ্ট তত্পর। ইরানের ওপর ‘চাপ’ বাড়াতে এই বেলুচিস্তান একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে আগামীতে। বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতা তাই আগামীতে আরও বাড়বে বলেই আমার ধারণা।
মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফর তাই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরে ব্যবসায়িক স্বার্থ কিছুটা রয়েছে বটে (১৯৯০ সালের ৫ মিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫০ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে ২০০৯ সালে), তবে মূল বিষয় হচ্ছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ও রাজনৈতিক ঐক্য। এই ‘ঐক্য’ আগামীতে ‘নয়া বিশ্ব’ ব্যবস্থায় একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই দু’দেশের মাঝে বিকাশমান সম্পর্কের ব্যাপারে অনেকেরই আগ্রহ থাকবে আগামী দিনগুলোতে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল : tsrahmanbd@yahoo.com (সুত্র, আমার দেশ, ০৫/১২/২০০৯)
0 comments:
Post a Comment