একজন সিআইপি ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের গ্রেফতার, রিমান্ড ও জেলের রেশ শেষ হতে না হতেই পুলিশ আরও একটি ‘কান্ড’ ঘটিয়ে বসেছে গত ২ সেপ্টেম্বর। তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির একটি মিছিলে বেধড়ক লাঠিচার্জ করে আহত করেছে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে। আনু মুহাম্মদের আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকার ছবি ছাপা হয়েছে প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে। আনু আমার সহকর্মী, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি। এ দেশের সংবাদপত্র জগত কেন, এ দশের শিক্ষিত সমাজের কাছে তিনি একটি পরিচিত নাম। তার অধ্যাপনার বয়সও প্রায় ২৫ বছরের কাছাকাছি। আমার মতোই তার অনেক ছাত্রও এখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সচিবালয়ে থাকা তার ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
সেই আনু মুহাম্মদ (যার আসল নাম মোহম্মদ আনিসুর রহমান) যখন পুলিশের পিটুনি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন, তখন এর চাইতে আর দুঃখজনক কী থাকতে পারে? একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, জাতীয় পর্যায়ে যার যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে তাঁকে কেন পুলিশ পেটাবে? কেন তাঁকে অসুস্হ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে? এ প্রশ্ন আজ উঠেছে সঙ্গত কারণেই। আনু বাম রাজনীতি ঘরানার লোক। ছাত্রাবস্হা থেকেই তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার এই বাম দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যখন তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার কথা বলেন, সেখানে তার বাম রাজনীতির দর্শন থাকে না। সেখানে থাকে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি। তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে এসব প্রশ্নে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছেন। তাদের কতগুলো দাবি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তারা বিদেশিদের কাছে সমুদ্রের গ্যাস সম্পদ ছেড়ে দিতে চান না। তারা চান না সমুদ্রের গ্যাসসম্পদ বিদেশে রফতানি করার সুযোগ দেয়া হোক। দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়লা উত্তোলন নিয়েও তাদের ভুমিকা স্পষ্ট। তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিপক্ষে। কারণ তাতে করে অনেক কৃষি জমি নষ্ট হবে। অনেক লোক তাদের বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র স্হানান্তরিত হবে। মাত্র পাঁচ ভাগ রয়েলটিতে কয়লা বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ারও বিপক্ষে তারা। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যেসব কথা বলেন তা কি জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে না? অবশ্যই করে। এর মধ্যে কোনো ‘রাজনীতি’ আছে বলে আমার কাছে মনে হয়নি। তবে তাদের এই ‘আন্দোলন’ নিয়েও আমার কিছু মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে।
মুল প্রশ্নে তাদের সঙ্গে আমার কোনো দ্বিমত নেই; কিন্তু কতগুলো প্রশ্নে তাদের ব্যাখ্যা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজটি আমরা যদি বিদেশি কোম্পানিকে না দেই (তিনটি ব্লককে সম্প্রতি তিনটি বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে), তাহলে আমাদের এই সম্পদ আমরা আহরণ করব কীভাবে? আমাদের সে মেধা ও প্রযুক্তি কি আছে? যেখানে কথা হচ্ছে ২০১২ সালের মধ্যেই আমাদের যে গ্যাস সম্পদ রয়েছে, তা ফুরিয়ে যাবে, তখন আমাদের জ্বালানি চাহিদা আমরা মেটাব কীভাবে? আমরা তো বড় ধরনের ‘এনার্জি ট্রাপ’-এর মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। কয়লা আমাদের জন্য বিকল্প হতে পারে। বলা হচ্ছে, আমাদের আগামী ৫০ বছরের যে জ্বালানি চাহিদা, তা মেটাতে যে কয়লা সম্পদের প্রয়োজন, তা আমাদের দেশে রয়েছে। ‘কুপ পদ্ধতিতে’ কয়লা তোলা হলে, মাত্র ২১ ভাগ (মোট প্রাপ্ত কয়লার) তোলা সম্ভব। আর ‘উন্মুক্ত পদ্ধতিতে’ তুললে তোলা সম্ভব প্রায় একশ’ ভাগ। বিশেষজ্ঞরা তো তাই বলছেন। এতে জমি নষ্ট হবে। মানুষ স্হানান্তরিত হবে। পানি সমস্যা দেখা দেবে। এসব সত্য। তাহলে পুরো কয়লা উত্তোলনের বিকল্প কি? এখানেই আনুদের সঙ্গে আমার চিন্তার অমিল। তারপরও বিরোধী দল যখন এসব বিষয়কে ‘ইস্যু’ করতে পারেনি, আনুরা তা পেরেছেন। মানুষকে সচেতন করেছেন। মানুষকে শিক্ষিত করেছেন। ‘নব্য সাম্রাজ্যবাদীদের’ চক্রান্ত সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে তিনি রাজপথে নেমেছেন। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা তো তাকে চেনেন। তাই বলে তাঁকে পেটাতে হবে? হেনস্হা করতে হবে? পুলিশ তো চাইলেই ওই বিক্ষোভ মিছিল এমনিতেই ভেঙে দিতে পারত। কেননা এ মিছিল তো বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের মতো বড় মিছিল ছিল না। খুব সহজেই মিছিলটি ভেঙে দিতে পারত পুলিশ; কিন্তু পুলিশ লাঠিচার্জ করল। আহত করল একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে। পুলিশের এ কাজটি বাড়াবাড়ি হয়েছে। অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসাররা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, ‘বাড়াবাড়ি’ হয়ে থাকলে তার ‘বিচার’ তারা করবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম সেই ‘বিচারটি’ দেখার জন্য।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের আহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের গ্রেফতার ও রিমান্ডের ঘটনারও অনেক মিল রয়েছে। আজাদের ঘটনায়ও পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে। পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টস-এর স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম আজাদ একটি পরিচিত নাম। নিজের চেষ্টায় একজন সাধারণ পোষ্টার বিক্রেতা থেকে তিনি বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন। পেয়েছেন সম্মান। তিনি নিজে তার অতীতকে কখনও লুকাননি। বিজ্ঞাপনে মডেলও হয়েছিলেন, যেখানে তিনি তার ‘উঠে আসার’ কথা বলেছিলেন। সেই সিআইপি আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতার, রিমান্ড, অতঃপর জেল। তিনি জামিন পেয়েছেন বটে; কিন্তু এই ঘটনা কী এখানেই শেষ হয়ে যাবে? পুলিশের ইসপেক্টর পদমর্যাদার একজন লোক কী পারে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সঙ্গে এভাবে আচরণ করতে? এ প্রশ্ন আজ বিবেকমান মানুষের। ইসপেক্টর গোলাম সরোয়ার তার ভাইয়ের চাকরির জন্য গিয়েছিলেন। অনুমতি ছাড়াই তিনি আজাদের ব্যক্তিগত রুমে ঢুকে ছিলেন। এতে আজাদ সাহেবতো বিব্রত হতেই পারেন। গোলাম সরোয়ার যে মামলা করেছেন, তাতে বলা হয়েছে তার গলায় থাকা ৫০ হাজার টাকার চেইন, ৫০ হাজার টাকার আংটি, ৫০ হাজার টাকার ঘড়ি ও পকেটে থাকা ৩৫ হাজার টাকা ব্যবসায়ী আজাদ ছিনিয়ে নেন। এই বক্তব্য কি বিশ্বাসযোগ্য? যিনি কোটি কোটি টাকার মালিক, তিনি ছিনিয়ে নেবেন গলার চেইন? উপরন্তু গোলাম সরোয়ার কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা, কত টাকা তিনি বেতন পান যে তার গলায় ও হাতে এক লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার থাকবে? এগুলো কি বৈধভাবে কেনা? তার এই স্বর্ণের উৎস কি-এটা বোধ হয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। সরকার ইতোমধ্যে এ ঘটনা তদন্ত করে দেখার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। এতে করে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে বলে আমার মনে হয় না। কেননা ইসপেক্টর গোলাম সরোয়ার তার ‘অপকর্মের’ জন্য সাসপেন্ড হননি। তিনি চাকরিতে থেকে তদন্ত কমিটিকে প্রভাবান্বিত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত ছিল। এফবিসিসিআই তাই চেয়েছে।
নিছক একটি ছোট্ট ঘটনায় একজন সিআইপি ব্যবসায়ীকে রিমান্ডে নিতে হবে-এর চাইতে আর দুঃখজনক কিছু হতে পারে না। তাহলে তো কোনো ব্যক্তিই পুলিশের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না? একজন সিআইপিকে যদি রিমান্ডে নেয়া হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের জায়গাটা কোথায়? তাহলে কি যে কাউকে পুলিশ ‘ফাঁসিয়ে’ দিয়ে রিমান্ড চাইবে আর আমাদের বিচারকরা সেই রিমান্ড মঞ্জুর করবেন? আমি এই বিষয়টিকে নিছক একটি তুচ্ছ বিষয় হিসেবে দেখতে চাচ্ছি না। এটা ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। এতে করে পুলিশের ভাবমুর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। আমি বুঝতে অক্ষম, ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের ঘটনায় যে মামলা হয়েছে তাতে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা সম্মতি দিলেন কিভাবে? গোলাম সরোয়ার কীভাবে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সম্মতি আদায় করলেন? নাকি আদৌ কোনো সম্মতি নেয়া হয়নি? তদন্ত কমিটি বিষয়টা দেখবেন-আশা করি।
এভাবে পুলিশ যদি ‘রিমান্ড’-এর অপব্যবহার করে, তাহলে তা পুলিশের ভাবমুর্তিকে শুধু নষ্টই করবে না, বরং মানুষ ভাবতে শুরু করবে, এ রাষ্ট্রটি পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গেছে (?)। একজন গোলাম সরোয়ারের জন্য সমগ্র পুলিশ বিভাগকে আমি কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই না। আমার অনেক ছাত্র এখন পুলিশের কর্মকর্তা, মধ্যম সারির অফিসার। এদের কেউ একজন ভবিষ্যতে আইজি হলে আমি অবাক হব না। এদের সবার কর্মকান্ডে আমি মুগ্ধ ও গর্বিত। দু’একজন বিদেশেও ‘মিশন’ করে এসেছে। একজন পিএইচডি পর্যন্ত করছে। সুতরাং একজন গোলাম সরোয়ারের জন্য আমি আমার ছাত্রদের দোষ দিতে চাই না। ওদের ভাবমুর্তি নষ্ট হলে, আমি কষ্ট পাব বেশি।
পুলিশের ভাবমুর্তি নিয়ে যখন আলোচনা করছি, তখন আমার দেশ-এর একটি পুরনো সংখ্যার (২৮ আগষ্ট) দিকে চোখ পড়ল। সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ঢাকামুখী ট্রাকে ২০টি স্পটে চাঁদা নেয় পুলিশ। পুলিশের আইজি এক সংবাদ সম্মেলনে পরোক্ষভাবে পুলিশের চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করেছিলেন। ঈদের মৌসুমে ঢাকায় কোন কোন স্পট থেকে পুলিশ চাঁদা ওঠায়, সে কথাও ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। এসব ঘটনা পুলিশের ভাবমুর্তিকে নষ্ট করে। আমরা পুলিশকে দেখতে চাই জনগণের সেবক হিসেবে। আইনতো তাই বলছে; কিন্তু পুলিশ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে লাঠিপেটা করে রাস্তায় শুইয়ে দেয়, যখন সিআইপি ব্যবসায়ীদের বিনা দোষে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করে, তখন কি মনে হয় পুলিশ জনগণের সেবক? পুলিশ নিয়ে আমি আর লিখতে চাই না; কিন্তু চাই পুলিশ নেতৃত্বে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। ইসপেক্টর গোলাম সরোয়ার যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন, তাহলে তার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হওয়া উচিত। একই কথা প্রযোজ্য যারা আনু মুহাম্মদকে পেটাল, তাদের ক্ষেত্রেও। এ দুটো ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হলে, তাতে করে পুলিশ বিভাগেরই ক্ষতি হবে বেশি। একজনের ‘অপকর্মের’ দায়িত্ব পুলিশ বিভাগ নেবে কনে? আনু মুহাম্মদ সুস্হ হয়ে উঠুন আর ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ সবকিছু ভুলে যাবেন-এ প্রত্যাশা রইল।
লেখকঃ অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (সুত্র, আমার দেশ, ০৬/০৯/২০০৯)
সেই আনু মুহাম্মদ (যার আসল নাম মোহম্মদ আনিসুর রহমান) যখন পুলিশের পিটুনি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন, তখন এর চাইতে আর দুঃখজনক কী থাকতে পারে? একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, জাতীয় পর্যায়ে যার যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে তাঁকে কেন পুলিশ পেটাবে? কেন তাঁকে অসুস্হ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে? এ প্রশ্ন আজ উঠেছে সঙ্গত কারণেই। আনু বাম রাজনীতি ঘরানার লোক। ছাত্রাবস্হা থেকেই তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার এই বাম দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যখন তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার কথা বলেন, সেখানে তার বাম রাজনীতির দর্শন থাকে না। সেখানে থাকে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি। তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে এসব প্রশ্নে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছেন। তাদের কতগুলো দাবি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তারা বিদেশিদের কাছে সমুদ্রের গ্যাস সম্পদ ছেড়ে দিতে চান না। তারা চান না সমুদ্রের গ্যাসসম্পদ বিদেশে রফতানি করার সুযোগ দেয়া হোক। দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়লা উত্তোলন নিয়েও তাদের ভুমিকা স্পষ্ট। তারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিপক্ষে। কারণ তাতে করে অনেক কৃষি জমি নষ্ট হবে। অনেক লোক তাদের বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র স্হানান্তরিত হবে। মাত্র পাঁচ ভাগ রয়েলটিতে কয়লা বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ারও বিপক্ষে তারা। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যেসব কথা বলেন তা কি জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে না? অবশ্যই করে। এর মধ্যে কোনো ‘রাজনীতি’ আছে বলে আমার কাছে মনে হয়নি। তবে তাদের এই ‘আন্দোলন’ নিয়েও আমার কিছু মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে।
মুল প্রশ্নে তাদের সঙ্গে আমার কোনো দ্বিমত নেই; কিন্তু কতগুলো প্রশ্নে তাদের ব্যাখ্যা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজটি আমরা যদি বিদেশি কোম্পানিকে না দেই (তিনটি ব্লককে সম্প্রতি তিনটি বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে), তাহলে আমাদের এই সম্পদ আমরা আহরণ করব কীভাবে? আমাদের সে মেধা ও প্রযুক্তি কি আছে? যেখানে কথা হচ্ছে ২০১২ সালের মধ্যেই আমাদের যে গ্যাস সম্পদ রয়েছে, তা ফুরিয়ে যাবে, তখন আমাদের জ্বালানি চাহিদা আমরা মেটাব কীভাবে? আমরা তো বড় ধরনের ‘এনার্জি ট্রাপ’-এর মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। কয়লা আমাদের জন্য বিকল্প হতে পারে। বলা হচ্ছে, আমাদের আগামী ৫০ বছরের যে জ্বালানি চাহিদা, তা মেটাতে যে কয়লা সম্পদের প্রয়োজন, তা আমাদের দেশে রয়েছে। ‘কুপ পদ্ধতিতে’ কয়লা তোলা হলে, মাত্র ২১ ভাগ (মোট প্রাপ্ত কয়লার) তোলা সম্ভব। আর ‘উন্মুক্ত পদ্ধতিতে’ তুললে তোলা সম্ভব প্রায় একশ’ ভাগ। বিশেষজ্ঞরা তো তাই বলছেন। এতে জমি নষ্ট হবে। মানুষ স্হানান্তরিত হবে। পানি সমস্যা দেখা দেবে। এসব সত্য। তাহলে পুরো কয়লা উত্তোলনের বিকল্প কি? এখানেই আনুদের সঙ্গে আমার চিন্তার অমিল। তারপরও বিরোধী দল যখন এসব বিষয়কে ‘ইস্যু’ করতে পারেনি, আনুরা তা পেরেছেন। মানুষকে সচেতন করেছেন। মানুষকে শিক্ষিত করেছেন। ‘নব্য সাম্রাজ্যবাদীদের’ চক্রান্ত সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে তিনি রাজপথে নেমেছেন। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা তো তাকে চেনেন। তাই বলে তাঁকে পেটাতে হবে? হেনস্হা করতে হবে? পুলিশ তো চাইলেই ওই বিক্ষোভ মিছিল এমনিতেই ভেঙে দিতে পারত। কেননা এ মিছিল তো বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের মতো বড় মিছিল ছিল না। খুব সহজেই মিছিলটি ভেঙে দিতে পারত পুলিশ; কিন্তু পুলিশ লাঠিচার্জ করল। আহত করল একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে। পুলিশের এ কাজটি বাড়াবাড়ি হয়েছে। অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসাররা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, ‘বাড়াবাড়ি’ হয়ে থাকলে তার ‘বিচার’ তারা করবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম সেই ‘বিচারটি’ দেখার জন্য।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের আহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের গ্রেফতার ও রিমান্ডের ঘটনারও অনেক মিল রয়েছে। আজাদের ঘটনায়ও পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে। পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টস-এর স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম আজাদ একটি পরিচিত নাম। নিজের চেষ্টায় একজন সাধারণ পোষ্টার বিক্রেতা থেকে তিনি বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন। পেয়েছেন সম্মান। তিনি নিজে তার অতীতকে কখনও লুকাননি। বিজ্ঞাপনে মডেলও হয়েছিলেন, যেখানে তিনি তার ‘উঠে আসার’ কথা বলেছিলেন। সেই সিআইপি আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতার, রিমান্ড, অতঃপর জেল। তিনি জামিন পেয়েছেন বটে; কিন্তু এই ঘটনা কী এখানেই শেষ হয়ে যাবে? পুলিশের ইসপেক্টর পদমর্যাদার একজন লোক কী পারে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সঙ্গে এভাবে আচরণ করতে? এ প্রশ্ন আজ বিবেকমান মানুষের। ইসপেক্টর গোলাম সরোয়ার তার ভাইয়ের চাকরির জন্য গিয়েছিলেন। অনুমতি ছাড়াই তিনি আজাদের ব্যক্তিগত রুমে ঢুকে ছিলেন। এতে আজাদ সাহেবতো বিব্রত হতেই পারেন। গোলাম সরোয়ার যে মামলা করেছেন, তাতে বলা হয়েছে তার গলায় থাকা ৫০ হাজার টাকার চেইন, ৫০ হাজার টাকার আংটি, ৫০ হাজার টাকার ঘড়ি ও পকেটে থাকা ৩৫ হাজার টাকা ব্যবসায়ী আজাদ ছিনিয়ে নেন। এই বক্তব্য কি বিশ্বাসযোগ্য? যিনি কোটি কোটি টাকার মালিক, তিনি ছিনিয়ে নেবেন গলার চেইন? উপরন্তু গোলাম সরোয়ার কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা, কত টাকা তিনি বেতন পান যে তার গলায় ও হাতে এক লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার থাকবে? এগুলো কি বৈধভাবে কেনা? তার এই স্বর্ণের উৎস কি-এটা বোধ হয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। সরকার ইতোমধ্যে এ ঘটনা তদন্ত করে দেখার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। এতে করে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে বলে আমার মনে হয় না। কেননা ইসপেক্টর গোলাম সরোয়ার তার ‘অপকর্মের’ জন্য সাসপেন্ড হননি। তিনি চাকরিতে থেকে তদন্ত কমিটিকে প্রভাবান্বিত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত ছিল। এফবিসিসিআই তাই চেয়েছে।
নিছক একটি ছোট্ট ঘটনায় একজন সিআইপি ব্যবসায়ীকে রিমান্ডে নিতে হবে-এর চাইতে আর দুঃখজনক কিছু হতে পারে না। তাহলে তো কোনো ব্যক্তিই পুলিশের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না? একজন সিআইপিকে যদি রিমান্ডে নেয়া হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের জায়গাটা কোথায়? তাহলে কি যে কাউকে পুলিশ ‘ফাঁসিয়ে’ দিয়ে রিমান্ড চাইবে আর আমাদের বিচারকরা সেই রিমান্ড মঞ্জুর করবেন? আমি এই বিষয়টিকে নিছক একটি তুচ্ছ বিষয় হিসেবে দেখতে চাচ্ছি না। এটা ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। এতে করে পুলিশের ভাবমুর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। আমি বুঝতে অক্ষম, ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের ঘটনায় যে মামলা হয়েছে তাতে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা সম্মতি দিলেন কিভাবে? গোলাম সরোয়ার কীভাবে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সম্মতি আদায় করলেন? নাকি আদৌ কোনো সম্মতি নেয়া হয়নি? তদন্ত কমিটি বিষয়টা দেখবেন-আশা করি।
এভাবে পুলিশ যদি ‘রিমান্ড’-এর অপব্যবহার করে, তাহলে তা পুলিশের ভাবমুর্তিকে শুধু নষ্টই করবে না, বরং মানুষ ভাবতে শুরু করবে, এ রাষ্ট্রটি পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গেছে (?)। একজন গোলাম সরোয়ারের জন্য সমগ্র পুলিশ বিভাগকে আমি কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই না। আমার অনেক ছাত্র এখন পুলিশের কর্মকর্তা, মধ্যম সারির অফিসার। এদের কেউ একজন ভবিষ্যতে আইজি হলে আমি অবাক হব না। এদের সবার কর্মকান্ডে আমি মুগ্ধ ও গর্বিত। দু’একজন বিদেশেও ‘মিশন’ করে এসেছে। একজন পিএইচডি পর্যন্ত করছে। সুতরাং একজন গোলাম সরোয়ারের জন্য আমি আমার ছাত্রদের দোষ দিতে চাই না। ওদের ভাবমুর্তি নষ্ট হলে, আমি কষ্ট পাব বেশি।
পুলিশের ভাবমুর্তি নিয়ে যখন আলোচনা করছি, তখন আমার দেশ-এর একটি পুরনো সংখ্যার (২৮ আগষ্ট) দিকে চোখ পড়ল। সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ঢাকামুখী ট্রাকে ২০টি স্পটে চাঁদা নেয় পুলিশ। পুলিশের আইজি এক সংবাদ সম্মেলনে পরোক্ষভাবে পুলিশের চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করেছিলেন। ঈদের মৌসুমে ঢাকায় কোন কোন স্পট থেকে পুলিশ চাঁদা ওঠায়, সে কথাও ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। এসব ঘটনা পুলিশের ভাবমুর্তিকে নষ্ট করে। আমরা পুলিশকে দেখতে চাই জনগণের সেবক হিসেবে। আইনতো তাই বলছে; কিন্তু পুলিশ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে লাঠিপেটা করে রাস্তায় শুইয়ে দেয়, যখন সিআইপি ব্যবসায়ীদের বিনা দোষে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করে, তখন কি মনে হয় পুলিশ জনগণের সেবক? পুলিশ নিয়ে আমি আর লিখতে চাই না; কিন্তু চাই পুলিশ নেতৃত্বে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। ইসপেক্টর গোলাম সরোয়ার যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন, তাহলে তার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হওয়া উচিত। একই কথা প্রযোজ্য যারা আনু মুহাম্মদকে পেটাল, তাদের ক্ষেত্রেও। এ দুটো ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হলে, তাতে করে পুলিশ বিভাগেরই ক্ষতি হবে বেশি। একজনের ‘অপকর্মের’ দায়িত্ব পুলিশ বিভাগ নেবে কনে? আনু মুহাম্মদ সুস্হ হয়ে উঠুন আর ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ সবকিছু ভুলে যাবেন-এ প্রত্যাশা রইল।
লেখকঃ অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (সুত্র, আমার দেশ, ০৬/০৯/২০০৯)
0 comments:
Post a Comment