রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

করোনা মহামারি থেকে আমরা কি আদৌ কোনো শিক্ষা নিয়েছি?

গত সোমবার দেশে আবার ‘লকডাউন’ দেওয়া হলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে তা তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ছে। এ ‘লকডাউনে’র সময় অন্তত দুটি ছবি ও সংবাদ আমাদের জানিয়ে দিল ২০২০ সালের করোনাভাইরাস থেকে আমরা আদৌ কোনো শিক্ষা নেইনি। একটি ছবি সম্ভবত ঢাকার মুগদা হাসপাতালের সামনে থেকে তোলা। এতে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি শুয়ে আছেন ফ্লোরে, মুখে অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগানো, পাশে আত্মীয়স্বজন। হাসপাতালে কোনো ‘সিট’ খালি নেই। সম্ভবত অপেক্ষা করছেন ‘সিট’ পাওয়ার আশায়। আমি জানি না নাম না জানা ওই ভদ্রলোকের পরিণতি পরে কী হয়েছিল। তিনি তথাকথিত ভিআইপি নন, তাই সংবাদকর্মীরা তার ‘ফলোআপ’ স্টোরি করেননি। গেল বছর ব্রাজিলে আমরা এ ধরনের দৃশ্য দেখেছিলাম। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষ পড়ে আছে রাস্তায়, মৃতদেহগুলো কবর দেওয়ার লোকও পাওয়া যায়নি তখন। আরেকটি ছবি ও সংবাদ সমকালে ছাপা হয়েছে ৬ এপ্রিল। চৌধুরী মহিদুল হকের একটি ছবি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক। সংবাদের শিরোনাম- ‘আইসিইউ খালি নেই : রাস্তাতেই মৃত্যু হলো সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার’। মহিদুল মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। আমাদের বন্ধু। রাতে তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে অক্সিজেন সাপোর্টের জন্য তাকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটেন তার আত্মীয়স্বজনরা। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল আমাদের মহিদুল। মহিদুল ছিল দেশের শীর্ষ ব্যাংকারদের একজন। প্রচলিত অর্থে ভিআইপি। একজন ভিআইপি হাসপাতালে কোনো ‘সিট’ পেলেন না, প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পেলেন না! এর চেয়ে আর দুঃখজনক কী থাকতে পারে? এ সংবাদ দুটি অনেক সংবাদের দুটি মাত্র। করোনাভাইরাসের নতুন একটি ‘ধরন’ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আঘাত করেছে। দেশে মৃত্যুর সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। ৯ এপ্রিল মৃত্যুর সংখ্যা ৬৩, আর শনাক্ত ৭৪৬২ জন। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৯৫৮৪ জনের। সরকার ‘লকডাউন’ দিয়ে রাজধানীসহ সিটি করপোরেশনগুলোতে গণপরিবহণ বন্ধ ঘোষণা করলেও গেল বুধবার তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সরকারের ‘লকডাউন’ ঘোষণা ছিল যৌক্তিক। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন ‘লকডাউন’ ও ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এটা কেউ মানতে চাইছে না। এত মৃত্যুর পরও মানুষের সচেতনতা বাড়েনি। মানুষ কোনো নির্দেশই মানতে চাইছে না। গাদাগাদি করে ফেরিতে যাওয়া যেন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কোভিড-১৯-এর পেছনে রয়েছে SARS-COV-2 ভাইরাস। শরীরে যদি দীর্ঘস্থায়ী ‘ইমিউন’ সিস্টেম শক্তিশালী হয়, তাহলে তা ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধকারী শক্তি হিসাবে গড়ে উঠবে। তাই শরীরের ‘ইমিউন’ সিস্টেম শক্তিশালী হলে মৃত্যুহার কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, সংক্রমণ কমাতে ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক জোসেফ উ’র (Joseph Wu) মতে, The future will very much depend on how much social mixing resumes, and what kind of prevention we do (Nature, 5 August 2020)। মহামারির ধরন ও ‘মডেল’ নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মাঝে জোসেফ উ অন্যতম। তিনি মডেলের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করেছেন কোভিড-১৯ কতদিন পর্যন্ত বজায় থাকবে। তবে করোনাভাইরাসের নতুন নতুন ধরন পৃথিবীতে আসবে এবং ২০২৫ সাল পর্যন্ত তা বিশ্বকে ঝুঁকির মুখে রাখবে। চীন, নিউজিল্যান্ড ও রুয়ান্ডা এ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পেরেছে। এর কারণ হচ্ছে, ভাইরাসটি যাতে সংক্রমিত হতে না পারে সে জন্য লকডাউনের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ। সেই সঙ্গে ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি তারা কঠোরভাবে মেনে চলেছেন। ফলে মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পেরেছেন তারা (Nature)। এটাই হচ্ছে আসল কথা। ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই চিত্র ছিল ভিন্ন। সেখানে ‘লকডাউন’ আর সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। ৭ এপ্রিল (২০২১) ব্রাজিলে একদিনেই মারা গেছে চার হাজার মানুষ। ‘সামাজিক দূরত্ব’ আর ‘ঘরে থাকার’ কথা বারবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। ফ্লোরিডা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক Hakan Yilmazkuday তার এক গবেষণায় (Stay-at-Home Works to Fight against Covid-19: International Evidence from Google Mobility Data) দেখিয়েছেন (১৩০টি দেশের তথ্য নিয়ে), সাধারণ মানুষের কম Mobility বা সক্রিয়তা (গ্রোসারি শপ, পার্ক, কাজে কিংবা বাইরে না যাওয়া) দ্বারা করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেশও অনেকটা তেমনই-ঘরে থাকা, বাড়িতে বসে কাজ করা, বেশি মানুষের সংস্পর্শে না যাওয়া। নিউইয়র্কে বেশি মানুষের মৃত্যুর (বাঙালিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) কারণ ছিল একটাই-সেখানে প্রচুর মানুষ বাস করে এবং মানুষের মাঝে ‘মোবিলিটি’ বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এর ব্যাখ্যা কী দেব? পোশাক শিল্প মালিকদের ‘অর্ডার বাতিল’ হওয়ার অজুহাতে গত বছর হাজার হাজার মানুষকে প্রথমবার ঢাকায় আনা এবং দ্বিতীয়বার পোশাক শিল্প চালু রাখা, গাদাগাদি করে ফেরিতে পার হওয়া এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে বিদেশফেরতদের নজরদারিতে না রাখা ইত্যাদি পরিস্থিতিকে খারাপের দিকে নিয়ে যায়। সম্ভবত বাংলাদেশ ‘হার্ড ইমিউনিটির’ দিকে গিয়েছিল! অর্থাৎ বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউনিটি) গড়ে তোলা যায় কিনা, তা নিয়ে কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে বাংলাদেশ। এতে প্রথমবার সফলও হয়েছে। তবে সব দেশ এ ‘হার্ড ইমিউনিটিতে’ গেছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। যেমন সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর ‘হার্ড ইমিউনিটি’র প্রস্তাব বাতিল করেছিল। এ জন্য ‘সামাজিক দূরত্ব’ মেনে চলার বিষয়টি যথেষ্ট কার্যকর। তাই Medical News Today-তে ড. মারিয়া কোহুট (Maria Cohut) তার প্রবন্ধে (Why social distancing is key in containing the new coronavirus, March 24, 2020) সামাজিক দূরত্বের ব্যাপারে তার যুক্তি তুলে ধরেছেন। একই বিষয়ে Nature Communications-এ একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছেন Michael te Vrugt, Jens Bickmann এবং Raphael Wittkowski (Effects or social distancing and isolation on epidemic spreading model via dynamical density functional theory, 4 November 2020)। তাদের মন্তব্য- 'Controlling the spread of infections, such as the Plague or the Spanish flu, has been an important topic throughout history'। তারা মিথ্যা বলেননি, ইতিহাস তাই বলে-মহামারি বারবার ফিরে আসে। স্প্যানিশ ফ্লুর কথা আমরা জানি। স্প্যানিশ ফ্লু স্থায়ী হয়েছিল ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, ৩৬ মাস। ওই সময় ৫০ কোটি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছিল, যা ছিল ওই সময়ে বিশ্বের জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। মৃত্যুর সংখ্যা ধরা হয় ১৭ মিলিয়ন থেকে ৫০ মিলিয়ন। বলা হয়, সমসাময়িককালের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারি ছিল সেটি। এর ১০০ বছর আগে অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ১৮১২-১৮১৯ সময়সীমায় প্লেগে মারা গিয়েছিল ৩ লাখ মানুষ। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে এশিয়ার ফ্লু’র কথাও আমরা জানি, যখন বিশ্বব্যাপী এ মহামারি ইনফ্লুয়েঞ্জায় (এইচ২এন২) মারা গিয়েছিল ১ থেকে ৪ মিলিয়ন মানুষ। ২০০৯-২০১০ সালে আরেক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জার (এইচ১এন১) খবরও আমরা জানি, যা মহামারি আকারে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাতে মারা গিয়েছিল ৫ লাখের উপর মানুষ। এর অর্থ হচ্ছে, প্রকৃতিতে এ ধরনের ভাইরাস বারবার ফিরে আসে। কিন্তু এবারের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ব্যতিক্রমধর্মী, ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে। এ কারণে কয়েকটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। এক. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাস পুরোপুরি নির্মূল হবে না (আল জাজিরা); অর্থাৎ সাময়িকভাবে এ ভাইরাসটি ‘নিয়ন্ত্রণে’ এলেও তা থেকে যাবে এবং ফিরে আসবে। যেমন উহানে (চীন) আবার ফিরে এসেছিল। দুই. ব্লুমবার্গ গবেষকদের মতে, ‘করোনাভাইরাসের পরবর্তী সংকট তৈরি হবে ব্যাপক আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে (The Next Covid Crisis could be a wave of suicides, May 8, 2020)। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মানুষ আত্মহত্যা করবে, যাকে ব্লুমবার্গ বলছে ‘death of despair’। তিন. করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী ২৬ কোটি মানুষ ক্ষুধার কারণে মারা যেতে পারে (PBS News, April 22, 2020)। এ বক্তব্য বিশ্ব খাদ্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলের। সুতরাং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্য দিয়ে যে সংকট শুরু হয়েছে, তা দ্রুত শেষ হয়ে যাবে মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই প্রস্তুতি বাংলাদেশ কতটুকু নিতে পেরেছে, আমি নিশ্চিত নই। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ যখন ইউরোপে আঘাত করেছে, তখন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা কতটুকু সচেতন ছিলেন, আমি হলফ করে তা বলতে পারব না। উচিত ছিল গত এক বছরে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। আমরা তা করতে পারিনি। এ কারণে ঢাকার হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। উচিত ছিল প্রতিটি হাসপাতালে আইসিইউ বেড বাড়ানো এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। তা হয়েছে বলে মনে হয় না। আমাদের বিশেষায়িত রোগের জন্য চিকিৎসক, দক্ষ নার্স ও টেকনিশিয়ান দরকার। হাসপাতালগুলোতে ‘ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ’ বাড়ানো দরকার। চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনা জরুরি ছিল, আমরা তা করিনি। চীন প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করবে বলে জানিয়েছিল। এ ব্যাপারে খুব একটা অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। বিষয়টিকে আমরা সিরিয়াসলি নেইনি। ঢাকায় আরও হাসপাতাল দরকার। উত্তরায় বিশাল এলাকা পড়ে রয়েছে। এখানে বিএসএমএমইউ’র মতো একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়। পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত জেল এলাকায়ও একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা যায়। আসলে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা দরকার। আরও একটা কথা-কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য কিছু বিশেষ হাসপাতাল নির্দিষ্ট না করে প্রতিটি হাসপাতালেই করোনা রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। একজন সাধারণ রোগী আইসিইউ বেডের অভাবে জরুরি বিভাগের বারান্দায় অথবা রাস্তায় পড়ে থাকবেন, একজন শীর্ষ ব্যাংক কর্মকর্তা চিকিৎসার জন্য, অক্সিজেনের জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে যাওয়ার পথে রাস্তায়ই মারা যাবেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা নিশ্চয়ই এটা প্রত্যাশা করি না। করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে গেল। জানি না এ থেকে আমরা কতটুকু শিখব। Jugantor 11.4.2021

0 comments:

Post a Comment