রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নয়া সংকট


সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্কের সাময়িকভাবে জড়িত হওয়ার ঘটনা নতুন করে একটি সংকট সৃষ্টি করেছে এবং সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে আরো অনিশ্চিত করে তুলেছে। সিরিয়ার কুর্দি নিয়ন্ত্রিত আফরিন অঞ্চলে তুরস্ক সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ নতুন একটি মোড় নিল। আপাতদৃষ্টিতে আফরিন অঞ্চল থেকে কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজি উচ্ছেদ হলেও তারা পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়াকে আরো বিস্তৃত করবে। জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে যে শান্তি আলোচনা চলে আসছিল, তা কোনো ফল বয়ে আনতে পারছিল না। অন্যদিকে রাশিয়ার সোচিতে যে বিকল্প শান্তি আলোচনা চলছিল, তাতেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ২৯-৩০ জানুয়ারি সোচিতে যে শান্তি আলোচনা আহ্বান করা হয়েছিল, সিরিয়ার বিরোধীপক্ষ তাতে যোগ না দেওয়ায় কার্যত সেই উদ্যোগও এখন থেমে গেল। ফলে একটা প্রশ্ন সংগত কারণেই উঠেছে যে সিরিয়ার রাজনীতি এখন কোন পথে? সিরিয়া থেকে আইএসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী এক রকম উচ্ছেদ হয়েছে। বিশেষ করে বছর দুই-এক আগে মার্কিন ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর আইএস সিরিয়ায় দুর্বল হয়ে যায়। তারা ২০১৪ সালের পর থেকে যেসব এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল এবং যেসব এলাকায় তারা তথাকথিত একটি ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ওই বিমান হামলায় তা ধ্বংস হয়ে যায়। এবং আইএস সিরিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাশিয়ার বিমান হামলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে, রাশিয়ার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে আসাদবিরোধী বেশ কিছু বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা আইএসের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আফরিনে তুরস্ক সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। তুরস্ক তার সামরিক আগ্রাসনের জন্য যুক্তি দেখিয়েছে। তুরস্ক বলছে, তারা শহরটিকে সন্ত্রাসীদের করিডর হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবে না। এই সামরিক আগ্রাসনের ঘটনা ন্যাটোভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে।
তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের এক দিন আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দিদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতৃত্বেই এই পরিকল্পনা করে। পিকেকে তুরস্কে নিষিদ্ধ। ওয়াইপিজি হচ্ছে পিকেকের সামরিক শাখা। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে তুরস্কের অভ্যন্তরে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে পিকেকের হাত রয়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করেছিল। আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযান সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরো বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এই হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গেল অক্টোবরে (২০১৭) সিরিয়ার রাকা শহর থেকে আইএসকে উৎখাতে ওয়াইপিজির সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক ওয়াইপিজি-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকে ভালো চোখে নেয়নি। তুরস্কের ভয় ছিল কুর্দি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ নিয়ে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে! সিরিয়ার কুর্দিরা বেশির ভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পিকেকের সশস্ত্র শাখা ওয়াইপিজি বা ‘পিপলস ডিফেন্স ইউনিট’ (YPG) ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব পারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই তুরস্ক এক ধরনের অস্বস্তিতে ছিল। বলা ভালো, ১৯৮৪ সাল থেকেই পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অনেকের স্মরণ থাকার কথা, কুর্দি শহর কোবানিকে আইএসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের বক্তব্য যদি আমরা সত্য বলে ধরে নিই, তাহলে এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি রাখতে চায়। তারা সিরিয়ায় দুই হাজার সামরিক উপদেষ্টা পাঠাতে চায়! আর তাই তারা ব্যবহার করতে চায় ওয়াইপিজিকে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানে। তুরস্কের এটা পছন্দ নয়। ওয়াইপিজি যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা দেশটির (তুরস্ক) সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। একসময় ওয়াইপিজির সঙ্গে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার উপদেষ্টারা আফরিনে ওয়াইপিজির পক্ষে কাজ করত। কিন্তু ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করায় রাশিয়া কুর্দিদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এবং সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না। এখানে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা লক্ষ করার মতো। সিরিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্পষ্টতই দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ার কারণেই আসাদ সরকার টিকে গেল। এখানে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটি পক্ষ। আর যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিরুদ্ধে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই রাশিয়া-ইরান-সিরিয়ার শিবিরে অবস্থান করছে।
তাহলে সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কোন পথে? সেখানে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সেখানে আসাদকে রাখা-না রাখা নিয়ে একটি ‘ডিবেট’ আছে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধী অনেক ‘পক্ষ’ রয়েছে, যারা একদিকে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধেও ‘যুদ্ধ’ করছে, আবার ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেও লিপ্ত। দুটি বড় শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও সিরিয়া সংকটে নিজেদের জড়িত করেছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় একটি শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু ওই সম্মেলনে এখন অব্দি একটি শান্তি ফর্মুলা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে রাশিয়ার সোচিতেও আসাদবিরোধীদের নিয়ে একটি শান্তি সম্মেলন আয়োজন করে আসছে রাশিয়া। কিন্তু সেখানেও কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সোচি বৈঠক বয়কট করেছে সিরিয়ার বিরোধীপক্ষ, যাদের কেউ কেউ জেনেভা সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিল। জেনেভা সম্মেলনে যোগ দিতে বিরোধী দলগুলোর উদ্যোগে একটি ‘হাই নেগোসিয়েশনস কমিটি’ (এইচএনসি) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কমিটির মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে। এইচএনসি সৌদি আরব সমর্থিত। তবে কুর্দিদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে এখানে দ্বন্দ্ব আছে। বস্তুত ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম হওয়া এইচএনসির কোনো ভূমিকা নেই।
সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যখন একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখছে, ঠিক তখনই এসেছিল একটি উদ্বেগজনক সংবাদ। ডাচ অনুসন্ধানকারী দল জানিয়েছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আকাশে যে মালয়েশিয়ান বিমানটি ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে ২৯৫ জন আরোহী প্রাণ হারিয়েছিল, তা রাশিয়ার মিসাইল হামলার শিকার হয়েছিল। এই প্রতিবেদন নিঃসন্দেহে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটাবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা অনেক দিন ধরেই লক্ষ করছে যে এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতার সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক বর্তমান পরিস্থিতিতে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ক্রিমিয়ার গণভোট (২০১৪) ও ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি পরবর্তী পরিস্থিতির কথা। ইউক্রেনে একটি রুশপন্থী সরকারকে উৎখাতের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের ‘ষড়যন্ত্র’ ও সরকার উৎখাতের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তির পরই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও সীমান্তে রাশিয়ার সেনা মোতায়েনের ঘটনা ঘটেছিল। পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করেছিল রাশিয়া। এরপর একপর্যায়ে রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। কার্যত ইউক্রেনের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল একটি ‘প্রক্সিওয়ার’—এর একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রাশিয়া। তখন এর সঙ্গে যোগ হলো সিরিয়ার ঘটনাবলি। সুষ্ঠুভাবে দেখলে দেখা যায়, স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর পূর্ব ইউরোপে যে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটেছে, তাকে কেন্দ্র করেই এ অঞ্চলে উত্তেজনার জন্ম হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই চাচ্ছে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দুটি দেশ জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য হোক। একসময় এ দেশ দুটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদি জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে এই দেশ দুটিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা যাবে। ফলে ‘চাপের’ মুখে রাখা যাবে রাশিয়াকে। শুধু তা-ই নয়, রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদ (গ্যাস) (যার ওপর ইউরোপ অনেকটা নির্ভরশীল)-এর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এখানে ২০০৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়ার সীমিত যুদ্ধের (ওসেটিয়া প্রশ্নে) কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘ব্ল্যাক সি’র অন্য পাশের দেশগুলো (বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড ও রুমানিয়া) এরই মধ্যে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। তুরস্ক ও গ্রিস আগে থেকেই ন্যাটোর সদস্য। জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনো ন্যাটোতে যোগ দেয়নি। তাই ইউক্রেনে একটি ‘পরিবর্তন’ প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে উৎখাতের প্রয়োজন ছিল। ২০১০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলেও ‘গণ-অভ্যুত্থানে’ উৎখাত হন। অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্র ওই অভ্যুত্থানের পেছনে মদদ জুগিয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটি সরকার ইউক্রেনে ক্ষমতায় রয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ক্রিমিয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ইউরোপ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তিনটি পাইপলাইন, নর্ড স্ট্রিম, বেলারুশ, আর ইউক্রেন লাইনে এই গ্যাস রাশিয়া সরবরাহ করে পূর্ব তথা পশ্চিম ইউরোপে। যদি ‘সংকট’ আরো গভীরতর হয়, তাহলে রাশিয়া এই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ (?) করে দিতে পারে, যদিও রাশিয়ার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গ্যাস (পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাস রিজার্ভ রাশিয়ায় অবস্থিত)। মজার কথা, বেলারুশ আর ইউক্রেন আবার রাশিয়ার গ্যাস নিয়ে নিজেরা রিজার্ভ গড়ে তুলছে। তারা আবার এই গ্যাস পশ্চিম ইউরোপে বিক্রিও করে। ২০০৯ সালে এই ‘গ্যাস বিক্রি’র বিষয়টি নিয়ে বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল এবং একপর্যায়ে রাশিয়া বেলারুশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। ওই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘গ্যাসওয়ার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলে এক ধরনের ‘প্রক্সিওয়ার’ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলেও রাশিয়া তথাকথিত এই ‘নিরাপত্তাকে’ দেখছে তার নিজের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে। অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এই পরিস্থিতিকে স্নায়ুযুদ্ধ-২ নামেও অভিহিত করেছেন।
এখন সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে দুটি বড় পক্ষ—যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফ বলছে, সিরিয়া পুনর্গঠনে প্রয়োজন হবে ২০০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পুনর্গঠনকাজে সহযোগিতা দিতে রাজি, কিন্তু আসাদকে ক্ষমতায় রেখে নয়। ইরাকের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি দেখেছিলাম। ইরাক পুনর্গঠনের কাজ পেয়েছিল মার্কিন কম্পানিগুলো। একজন ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বার্থ এখানেই—দুই লাখ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ‘কাজ’ মার্কিন কম্পানিগুলোকে পাইয়ে দেওয়া। তাই যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাইবে না, আসাদকে ক্ষমতায় রেখেই সিরিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হোক। আবার মাইনাস আসাদ ফর্মুলায় রয়েছে রাশিয়া-ইরান-তুরস্কের আপত্তি! সর্বশেষ ঘটনায় আফরিনে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন দৃশ্যপটকে বদলে দিল। তাই সিরিয়ার শান্তি আলোচনা এখন কোন দিকে যায়, সেদিকেই লক্ষ থাকবে অনেকের।
Daily Kalerkontho
31.01.2018

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে



বলতে দ্বিধা নেই, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের ইতিহাস অনেক পুরোনো। এ দ্বন্দ্বের কারণে তিন-তিনবার দেশ দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এর মাঝে কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে দু-দুবারÑ ১৯৪৭-৪৮ সালে একবার, আর ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ দুটি তৃতীয়বারের মতো যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে কারগিলকে কেন্দ্র করে আরও একবার যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, যা জেনারেল মোশাররফকে ক্ষমতা দখল করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা, আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। ভারত পরপর দু-বার পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ওই ঘটনা পাকিস্তানকে পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সিপরির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ১৩৫টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, আর ভারতের রয়েছে ১২৫টি। ২০১৭ সালে উভয় দেশ ১০টি করে ওয়ারহেড তাদের পারমাণবিক শক্তিবহরে সংযুক্ত করে (Knoema, January 23, 2018))। ভারত ইতোমধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে ৩৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে পাঁচটি আকাশ প্রতিরক্ষার মিসাইল এস-৪০০ কিনতে চূড়ান্ত আলোচনা শুরু করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই এ চুক্তি চূড়ান্ত করতে চায় তারা। তাহলে পরবর্তী ২৪ থেকে ৫৪ মাসের মধ্যে এসব অস্ত্র ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী সরবরাহ শেষ হবে। ৩০ কিলোমিটার উঁচু দিয়ে এ মিসাইল সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এর আগে জানুয়ারিতে (২০১৮) ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভারত সফরের সময় ভারত ৭ কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এস-৪০০ মধ্যপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল বহনে সক্ষম। তাদের মতে, বহুমুখী ব্যবহার-উপযোগী এস-৪০০ এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাই পাল্টে দেবে। এই মিসাইলটি পাকিস্তানের স্বল্পপাল্লার পারমাণবিক মিসাইল নসরকেও নিষ্ক্রিয় করতে পারবে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই অস্ত্র চুক্তি নতুন নয়। তবে নিঃসন্দেহে এই চুক্তি রাশিয়ার সঙ্গে অন্যতম বড় চুক্তি। এর আগে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার দিয়ে যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ বিক্রমাদিত্য কিনেছিল ভারত। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের এই অস্ত্র ক্রয় পাকিস্তানকেও উদ্বুদ্ধ করবে তাকে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করতে। ফলে নতুন করে উপমহাদেশে আবারও অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হলো। এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা উপমহাদেশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। অস্ত্র খাতে ব্যয় বরাদ্দ বেড়ে যাওয়ার কারণে সামাজিক খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ভারত তার প্রতিরক্ষার জন্য বছরে খরচ করে মাথাপিছু ১০ ডলার, আর পাকিস্তান করে ২৬ ডলার। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ভারত খরচ করে মাথাপিছু ১৪ ডলার, আর পাকিস্তান খরচ করে ১০ ডলার। পাকিস্তান ও ভারত যে পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় করে, তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। যেমন বলা যেতে পারে, একটি ট্যাংকের যে দাম, ওই পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে প্রাণঘাতী অসুখবিসুখ ঠেকানোর জন্য ৪০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া সম্ভব। একটি ট্যাংকের দাম ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। আর একটি শিশুকে প্রাণঘাতী ৬ রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিতে খরচ হয় মাত্র ১ ডলার। একটি মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমানের (যা ভারতীয় বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত হয়েছে) দাম ৯ কোটি মার্কিন ডলার। অথচ একটি শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর পড়ালেখার জন্য গড়পড়তা খরচ হয় ৩০ ডলার। মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমান কেনা না হলে ওই অর্থে ৩০ লাখ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার খরচ মেটানো সম্ভব। আনুষঙ্গিক সাজসজ্জাসহ আধুনিক একটি ডুবোজাহাজের দাম ধরা হয় ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে এক বছরের জন্য একজনকে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে মোটামুটি ৫ ডলারের মতো ব্যয় হয়। অর্থাৎ একটি ডুবোজাহাজ কেনা মানে ৬ কোটি লোককে সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত করা। ভারত ও পাকিস্তানে দরিদ্রতা আছে। শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। মায়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যাচ্ছেন। ভারতে কৃষক ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন। অথচ এই দেশ দুটিতে সামাজিক খাতে অগ্রগতি হয়েছে অতিসামান্যই। দেশ দুটি সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েই চলেছে। ফলে উত্তেজনা থাকবেই। চিরবৈরী এই দেশ দুটির মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোনো ভালো খবর নয়। গত দু-তিন বছর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। ১৩ ডিসেম্বর (২০০১) ভারতীয় পার্লামেন্টে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। ওই হামলায় পাঁচ হামলাকারীসহ ১৩ জন নিহত হয়েছিল। ভারত ওই হামলার জন্য কাশ্মীরি জঙ্গিগোষ্ঠী ‘লস্কর-ই-তৈয়্যবা’ এবং ‘জয়শ-ই-মোহাম্মদ’কে দায়ী করেছিল এবং এ দুই জঙ্গি সংগঠনকে মদত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছিল। ওই ঘটনার পর থেকে দেশ দুটির মধ্যে আস্থার সম্পর্ক আর ফিরে আসেনি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির লাহোর সফর (১৯৯৯) ও সাবেক পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের আগ্রা সফরের (২০০১) পর একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যে, দেশ দুটি আরও কাছাকাছি আসবে; কিন্তু তা হয়নি। বরং দেশ দুটির মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। পাকিস্তান মনে করে, ভারত বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকে দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত মনে করে, পাকিস্তান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করছে এবং তাদের দিয়ে ভারতের ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকা- করাচ্ছে! অতিসম্প্রতি মার্কিন প্রশাসন চাচ্ছে, ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। কিন্তু পাকিস্তানের তাতে রয়েছে জোর আপত্তি। দেশ দুটির মধ্যকার বৈরিতার কারণে পাকিস্তানে ২০১৬ সালে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ভারত ওই সম্মেলন বয়কট করেছিল। ফলে সম্মেলনটি আর আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এক অনির্ধারিত সফরে লাহোর গিয়েছিলেন। সেটা ছিল গত ১২ বছরের মধ্যে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম পাকিস্তান সফর। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উরির ঘটনাবলিতে সম্পর্ক উন্নত করার সব সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেয়। ওই ঘটনায় জঙ্গিগোষ্ঠী জয়শ-ই-মোহাম্মদ ১৮ ভারতীয় সৈনিককে হত্যা করেছিল। ওই হত্যাকা- সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে একটা বড় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। গত বছর সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। এখন বছরের শুরুতেই দেশ দুটির মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার খবর প্রকাশিত হলো। এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা উপমহাদেশে শুধু উত্তেজনাই বাড়বে না, বরং উপমহাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।
Daily Alokito Bangladesh
28.01.2018

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনিশ্চয়তা কাটছে না



গত ২৩ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তাতে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। ইতিপূর্বে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা ফেরত যাবে, প্রতিদিন ৩০০ করে এবং দু’বছরে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে মিয়ানমারে দুটি ‘ক্যাম্প’ প্রতিষ্ঠা করা হবে- এমন একটি সিদ্ধান্তও হয়েছিল। প্রথম ‘ক্যাম্পে’ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ‘গ্রহণ’ করা হবে এবং দ্বিতীয় ‘ক্যাম্পে’ তাদের যাচাই-বাছাই করা হবে। এখন পুরো প্রক্রিয়াতেই এক ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না, কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।
উল্লেখ্য, ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিদোয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯ ডিসেম্বর দেশ দুটি একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করে। এর মধ্য দিয়ে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল, সদ্য আগত রোহিঙ্গারা শেষ পর্যন্ত বোধহয় নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি একটি তারিখ নির্ধারিত হলেও বহুল প্রত্যাশিত প্রত্যাবাসনের কাজটি শুরু হল না। আমরা বারবার বলে আসছি, মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখাটা সত্যিকার অর্থেই কঠিন। মিয়ানমার সনাতন কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলে না। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি, মিয়ানমার এর আগে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই প্রতিশ্রুতি তারা পালন করেনি। এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও তা কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিছু রোহিঙ্গাদের তারা ফেরত নিয়ে গেছে বটে, কিন্তু ব্যাপক সংখ্যক রোহিঙ্গা, যারা নিবন্ধিত নয়, তারা বাংলাদেশের মাটিতে রয়ে গিয়েছিল। এখন এর সঙ্গে যোগ হল আরও সাড়ে ছ’লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ এদের আশ্রয় দিয়ে নিঃসন্দেহে মানবতার পরিচয় দিয়েছিল। বাংলাদেশের এই ভূমিকা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি অথবা ‘সমঝোতা’ স্মারকে স্বাক্ষর করা জরুরি ছিল। বাংলাদেশ সেটা করেছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মাটিতে থেকে যেতে পারে! সুতরাং মিয়ানমার সরকারের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে, এটা আমরা বলতে পারি না। তাদের কোনো কার্যকলাপে তা প্রমাণিত হয় না।
মূলত এজন্যই একটা আশঙ্কা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে, মিয়ানমার তথাকথিত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে কালক্ষেপণ করতে পারে। এই কালক্ষেপণের স্ট্র্যাটেজি তাদের অনেক পুরনো। এবারও এমনটি হতে পারে। গত ২১ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফিং করেছেন। তিনি নিজে মিডিয়ার সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াং ঘি লিও গত ২১ জানুয়ারি উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। এদের সবার বক্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ব্রিফিং করেছেন, সেখানে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতও। তার বক্তব্যও গুরুত্বের দাবি রাখে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠিক কোনদিন থেকে শুরু হবে, সেরকম তারিখ-টারিক বলা মুশকিল।’
তিনি আরও বলেছেন, যেতে না চাইলে তো জোর করে পাঠিয়ে দেয়া যাবে না। আমাদের চুক্তির সব জায়গায়ই স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কফি আনান কমিশনের রিপোর্টেও তা আছে। যখন রোহিঙ্গারা জানতে পারবে মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে, তাদের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে- ইত্যাদি দেখার পর তারা নিজেরাই যেতে উৎসাহী হবে (যুগান্তর, ২২ জানুয়ারি)। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের বক্তব্যের অনেকটা ‘মিল’ খুঁজে পাওয়া যায়। বার্নিকাট বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অবশ্যই নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় হতে হবে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্পষ্টতই কয়েকটি বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এক. রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে? দুই. রোহিঙ্গারা সেখানে কতটুকু নিরাপদ? তিন. রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারবে কিনা? চার. রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের জীবন-জীবিকার কী হবে? মিয়ানমারের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক ও পরবর্তীকালে ‘বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের প্রত্যাবাসন’ সংক্রান্ত যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে নাগরিকত্বের বিষয়টি আদৌ নেই। মিয়ানমার এদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। রোহিঙ্গা নামেও আপত্তি রয়েছে তাদের। এমনকি কফি আনান কমিশনের রিপোর্টেও রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। মিয়ানমার এদের ‘বাঙালি’ হিসেবে স্বীকার করে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় এবং ডকুমেন্টে কোথাও রোহিঙ্গা শব্দটি নেই। গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে রোহিঙ্গা খেদাও অভিযান শুরু হওয়ার পর মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত থাকলেও নাগরিকত্বের প্রশ্নে তাদের অবস্থানে পরিবর্তন হয়েছে, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি উঠবে তা হল, নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা ছাড়া রোহিঙ্গারা আদৌ ফেরত যেতে চাইবে কিনা?
মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের এটা একটা বড় দুর্বলতা। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এই নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারিনি। দ্বিতীয় প্রশ্নটি সমান গুরুত্বপূর্ণ- নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কীভাবে? নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। অনেকে তার স্ত্রী, স্বামী ও সন্তানকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক খুন হতে দেখেছে। অনেক দেরিতে হলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান ‘সীমিত হত্যাকাণ্ডের’ কথা স্বীকার করেছেন। তাদের নিরাপত্তা যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে তারা নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। এখন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে? যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের নিজ বাসভূম থেকে উৎখাত করেছে, রোহিঙ্গারা তাদের বিশ্বাস করবে না।
ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তারা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া তাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। রোহিঙ্গারা এ ধরনের বক্তব্যে উৎসাহিত হবেন নিঃসন্দেহে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন, জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো যাবে না। এ ধরনের বক্তব্য রোহিঙ্গাদের এ দেশে থেকে যেতে উৎসাহ জোগাতে পারে। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে আরও ম্যাচুরড বক্তব্য আশা করেছিলাম। তৃতীয় প্রশ্নটিকেও আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। রোহিঙ্গারা কি আদৌ নিজ বাসভূমে ফেরত যেতে পারবে? এর সরাসরি জবাব হচ্ছে ‘না’। যে চুক্তি হয়েছে, তাতে মিয়ানমার দুটি ক্যাম্প করছে। প্রথমটা অভ্যর্থনা ক্যাম্প, দ্বিতীয়টা অন্তর্বর্তীকালীন ক্যাম্প। অর্থাৎ যারা বাংলাদেশ থেকে ফেরত যাবে, তাদেরও প্রথমে অভ্যর্থনা ক্যাম্পে রাখা হবে। তারপর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য অপর একটি অন্তর্বর্তীকালীন ক্যাম্পে পাঠানো হবে।
বস্তুত এখানেই সমস্যা তৈরি হবে। এই ক্যাম্পে তারা বছরের পর বছর থেকে যেতে বাধ্য হবে। এটা এক ধরনের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’। এখানে রেখেই তথাকথিত যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি হবে। আমার শঙ্কা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ভাগ্য ফিলিস্তিনিদের মতো হতে পারে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন- ফিলিস্তিনিরা নিজ বাসভূম থেকে উৎখাত হয়ে বছরের পর বছর, জেনারেশনের পর জেনারেশন থেকে যাচ্ছেন ক্যাম্পে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পাঠক, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ যুগে ‘হোমল্যান্ড’গুলোর কথা স্মরণ করতে পারেন। বর্ণবাদ যুগের অবসানের আগে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে ৭টি হোমল্যান্ডে রাখা হয়েছিল। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের অবস্থা অনেকটা হোমল্যান্ডগুলোয় থাকা কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী অথবা ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর মতো হতে পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় নীতি এটাই- রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করা। আন্তর্জাতিক ‘চাপ’-এর কারণে তারা রোহিঙ্গাদের নিতে চাচ্ছে বটে, কিন্তু বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে- তারা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করে নিতে চাইছে না। উপরন্তু তারা কোনোদিনই রোহিঙ্গাদের স্ব স্ব বসতবাড়িতে ফেরত নেবে না। কেননা ওইসব বসতবাড়ির আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। রাখাইনে কয়েকশ’ গ্রামে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ওইসব গ্রাম এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ‘লিজ’ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ফলে রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে থাকতে পারছেন না। রোহিঙ্গারা কোনোমতেই অন্যত্র থাকতে চাইবেন না। বংশপরম্পরায় তারা নিজ বাসভূমে বসবাস করে আসছেন। জমিজমা চাষ করে আসছেন। কেউ কেউ ব্যবসায়ে নিয়োজিত ছিলেন। এখন তাদের যদি অন্যত্র রাখা হয়, তারা তা মানতে চাইবেন না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এটা একটা অন্যতম সমস্যা। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে এসব প্রশ্নের জবাব থাকা বাঞ্ছনীয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ খুব শক্ত অবস্থানে গিয়েছে, এটা আমার মনে হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং তার ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বলে দেয়- বাংলাদেশ একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল! কিন্তু মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করার কোনো কৌশল অবলম্বন করেনি। জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হয়েছে। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান একটি ঘৃণিত অপরাধ। আন্তর্জাতিক আইনে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। ইতিমধ্যে বসনিয়া-হারজেগোভিনা, কঙ্গো, লাইবেরিয়া কিংবা রুয়ান্ডাতে যারা জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানে জড়িত ছিলেন, সেসব সেনা কর্মকর্তাদের বিচার হয়েছে। রায়ও দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিক সেনা কর্মকর্তাকে মিয়ানমারে গণহত্যার জন্য চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ এদের বিচারের দাবি করতে পারত। তাহলে অন্তত মিয়ানমার সরকার একটা ‘চাপ’-এর মুখে থাকত। কিন্তু বাংলাদেশ তা করেনি। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে একটি ‘সফট ডিপ্লোম্যাসি’র আশ্রয় নিয়েছে।
২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা গণহত্যা ও রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশী, বিশেষ করে চীন ও ভারতের ‘সাহায্য’ নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শেষ অব্দি চীন স্ব-উদ্যোগে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল এবং সেই প্রস্তাব অনুসরণ করেই মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিকভাবে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। আগস্টের পর থেকে সংকটের গভীরতা বাড়লেও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেননি। এমনকি এসব দেশের সাহায্যও চাওয়া হয়নি। অথচ প্রতিটি দেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ভালো। এসব দেশের মাধ্যমে আমরা মিয়ানমারের ওপর প্রভাব খাটাতে পারতাম।
এখন সে সুযোগ শেষ হয়ে গেছে- তা বলা যাবে না। বাংলাদেশ দু’ভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত করতে পারে। দ্বিপাক্ষিকভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ। একই সঙ্গে বহুপাক্ষিকভাবে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। আমাদের ভুললে চলবে না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ইচ্ছার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিরুদ্ধে। অতীতে যারা এসেছিল, তাদের ক্ষেত্রেও ইউএনএইচসিআর একই নীতি অবলম্বন করেছিল। প্রকারান্তরে এই নীতি মিয়ানমারের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ। এত বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিকের উপস্থিতি আমাদের নিরাপত্তাকে নানাবিধ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ডিপথেরিয়ার মতো রোগ আবার ফিরে এসেছে উখিয়ায়। রোহিঙ্গা উগ্রপন্থীরা (এআরএস) বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে- এমন একটি তালিকা (১৫০ জন) মিয়ানমার বাংলাদেশকে দিয়েছে। এরা বাংলাদেশেও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ডিপথেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বিদেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশি ছাত্রদের উচ্চশিক্ষায় ভর্তি বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক ধরনের ‘চাপ’-এর মুখে রেখেছে। ফলে এই নির্বাচনী বছরে সরকারের জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিঃসন্দেহে একটি বাড়তি ‘চাপ’। বিরোধী পক্ষ এটাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। এখন নির্ধারিত তারিখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় গুজবের ডালপালা গজাতে পারে। সুতরাং যত দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়, ততই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। আর এ লক্ষেই কাজ করে যেতে হবে।
Daily Jugantor
25.1.2018

ইরান পারমাণবিক সমঝোতার ভবিষ্যৎ কোন পথে

 Ken Catalino for 1/15/2018

গত ১২ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোসংক্রান্ত একটি প্রশাসনিক আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। তবে এটা জানাতেও তিনি ভোলেননি যে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির ব্যাপারে তাঁর রিজার্ভেশন আছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে ও পরে বারবার বলে আসছিলেন, তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি মানবেন না। গত শুক্রবার প্রশাসনিক আদেশটি স্বাক্ষরের সময় ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ইরানের মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বলেছেন। তিনি এটা জানাতে ভেলেননি যে ইরানের মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় যদি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা না যায়, তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে বের করে নিয়ে আসবেন।
ট্রাম্প প্রশাসনিক আদেশটি জারি করে চুক্তির মেয়াদ যে বাড়িয়ে দিলেন, এটা প্রয়োজন ছিল। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ইরান পারমাণবিক চুক্তি পর্যালোচনা আইনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন প্রতি তিন মাস পর কংগ্রেসের কাছে ইরান চুক্তির শর্তাবলি মেনে চলছে কি না তা মূল্যায়ন করে জানাবে। প্রেসিডেন্ট এতে সত্যায়ন না করলে গোটা বিষয়টি কংগ্রেসের হাতে চলে যাবে এবং ৬০ দিন পর কংগ্রেস ভোটাভুটির মাধ্যমে নতুন করে অবরোধ আরোপ করতে পারবে। ১২ জানুয়ারি ছিল সত্যায়ন আদেশের শেষ দিন। ট্রাম্প এক প্রশাসনিক আদেশে তা সত্যায়িত করলেন। এর মধ্য দিয়ে আগামী তিন মাস পর্যন্ত ইরান পারমাণবিক চুক্তিটি বহাল থাকল। এরপর কী হবে বলা মুশকিল। ট্রাম্প এটা স্পষ্ট করেছেন যে তিনি চান এসংক্রান্ত একটি স্থায়ী চুক্তি। ইরানের মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় তিনি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনতে চান, এটা উল্লেখ করতে তিনি ভোলেননি। ট্রাম্প ওই চুক্তিটি মেনে চলবেন বলে সত্যায়িত করলেও নতুন করে ১৪ জন ইরানি নাগরিকের ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে অন্য একটি প্রশাসনিক আদেশ জারি করেছেন। এসব ব্যক্তির কেউ কেউ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত। এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি এলো এমন এক সময়, যখন ইরানে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গত ২৯ ডিসেম্বর ইরানের বিভিন্ন শহরে যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে মারা গিয়েছিল ২২ জন ব্যক্তি। বিক্ষোভকারীরা সরকার পতনের লক্ষ্যে কাজ করেছিল বলে ইরান সরকার অভিযোগ করেছিল। ইরান সরকার সরাসরি অভিযোগ করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ওই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ইরান সরকার ওই বিক্ষোভ দমন করতে পেরেছিল বটে, কিন্তু সেটি নানা প্রশ্ন রেখে গেছে। ওই ঘটনার মধ্য দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কটি সামনে চলে এসেছিল। ইরানের ভূমিকা, বিশেষ করে ইয়েমেনে ইরানের ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখছে সৌদি আরব। শঙ্কা তৈরি হয়েছে সৌদি রাজপরিবারেও। ইরানের এই ভূমিকাকে সৌদি আরব যেমনি পছন্দ করছে না, ঠিক তেমনি পছন্দ করছে না যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। ফলে এ অঞ্চলে সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল একটি অলিখিত অ্যালায়েন্স গড়ে উঠছে। এখন ট্রাম্পের ছয় জাতি পারমাণবিক সমাঝোতাকে অস্বীকার করা নতুন করে এ অঞ্চলে উত্তেজনার জন্ম দেবে। ওই সমাঝোতা চুক্তিতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চুক্তিতে উল্লেখ আছে, ইরান আগামী ১০ বছর কোনো পারমাণবিক কর্মসূচি হাতে নিতে পারবে না। তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক নজরদারিতে থাকবে। ওই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইরানের যে সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল, ইরানকে তা ফেরত দেওয়া হয়। ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এ অঞ্চলে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছিল। এখন ট্রাম্পের ওই চুক্তি বাতিলের হুমকি নতুন করে এ অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে পারে। সৌদি আরবও পারমাণবিক কর্মসূচি হাতে নিতে পারে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে—এই অভিযোগ তুলে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল করার দাবিসংবলিত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর অন্তত এসংক্রান্ত আরো ছয়টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল এবং ইরান ওই কর্মসূচি বাতিল না করায় ২০১০ সালে জাতিসংঘ ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার সম্পদ জব্দসহ দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। উল্লেখ্য, ২০০৬ সাল থেকেই ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি) আলোচনা চলে আসছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি বিজয়ী হলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। ফলে এই ছয় জাতির আলোচনা আরো গতি পায়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং এপ্রিলে (২০১৫) সুইজারল্যান্ডের লুজানে একটি খসড়া চুক্তিতে ইরান ও  ছয় জাতি উপনীত হয়। ওই বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এই খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। জুলাইয়ে (২০১৫) চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অন্তত একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছিল। আর তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই সম্পর্ক আরো উন্নত করার প্রয়োজন ছিল। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে, প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে এখনো ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর দীর্ঘ ৪৪৪ দিন রেভল্যুশনারি স্টুডেন্টস কর্তৃক তেহরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেওয়ার ঘটনার স্মৃতি একটি ‘ক্ষতচিহ্ন’ হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনাটা অত সহজ ছিল না। এরপর যোগ হয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ওই ঘটনার দীর্ঘ ৩৬ বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এই দেশ দুটিকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। এর ফলে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’ ইসরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিস্টদের কেউ কেউ মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় জঙ্গিবাদী রাজনীতির উত্থান ঠেকাতে ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে তাঁদের ইরানের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে বারাক ওবামা স্বীকার করেছিলেন, তিনি গোপনে ইরানি সমর্থন চেয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। প্রতি উত্তরে খামেনিও গোপনে তাঁকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আইএস (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গিদের ঠেকাতে ওবামা খামেনিরই সমর্থন চেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইয়েমেনে ‘হুতি বিদ্রোহ’ প্রমাণ করেছিল, সেখানেও একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনে ইরানের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। কেননা হুতিরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ আছে হুতি বিদ্রোহীরা ইরান থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকে, যদিও ইরান বারবার তা অস্বীকার করে আসছে। ২০১৫ সালের পর কেটে গেছে আরো দুই বছর। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসেনি। বরং নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। ইরানে সাম্প্রতিক সময়ে যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা নতুন একটি মাত্রা। এই বিক্ষোভ বা অসন্তোষ শেষ পর্যায়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, বলা মুশকিল। তবে ইরান সরকারকে কোনো গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উত্খাত করা যাবে না। সরকারের পেছনে জনসমর্থন যেমনি আছে, ঠিক তেমনি সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে রেভল্যুশনারি গার্ড। সুতরাং সরকার উত্খাতের কাজটি খুব সহজ হবে না।
ইরানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশকে মেলানো যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ ইন্ধনে, আর্থিক সহযোগিতায় আরব বসন্ত (২০১১) হয়েছিল। মিসর, তিউনিসিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে সরকারের পরিবর্তন হয়েছিল। তিউনিসিয়ায় জাইন এল আবিদিন বেন আলী, হোসনি মোবারক (মিসর), মুয়াম্মার গাদ্দাফি (লিবিয়া), আলী আবদুল্লাহ সালেহ (ইয়েমেন) উত্খাত হয়েছিলেন। কুয়েত, মরক্কো ও জর্দানে সাংবিধানিক সংস্কার আনা হয়েছিল। সিরিয়ায় সরকার উত্খাত হয়নি সত্য, কিন্তু দেশটি ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশ্ব দেখেছে, সেখানে আইএসের উত্থান (২০১৪), আর পতন (২০১৭)। ‘আরব বসন্ত’-এর সঙ্গে ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর একটি সম্পর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে কোথাও কোথাও ওই নীতি অনুসরণ করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে এই নীতি অনুসরণ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ভুল করবে। ইরানের সঙ্গে অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাকে মেলানো যাবে না। ইরানের সমাজে শিয়া ধর্মীয় সংস্কৃতির একটা বড় প্রভাব রয়েছে।
ইরান বিপ্লবের (১৯৭৯) পর ইরান একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছে। জাতি হিসেবে এখানে বিভক্তি কম। রাজনৈতিক নেতৃত্বও ‘ভেলায়েতি ফাকিহ’ বা ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। ফলে যখনই ইরানে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ বেড়েছে, তখনই সরকারের পক্ষে একটি শক্তিশালী পক্ষ অবস্থান নিয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর যে বিক্ষোভ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তা শেষ পর্যন্ত দমন করা গেছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হয়েছে, তা হচ্ছে ওই বিক্ষোভের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিলের বিষয়টির কোনো যোগসূত্র আছে কি না? পারমাণবিক চুক্তি বাতিলের ‘হুমকি’ নিংসন্দেহে ইরান সরকারের ওপর এক ধরনের ‘চাপ’। এবং এটাও ঠিক, ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ আয়োজন করে বিক্ষোভকারীরা সরকারের ওপর একটা ‘চাপ’ সৃষ্টি করেছিল। সুতরাং এই দুয়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র থাকাটাই স্বাভাবিক।
ইরানে ব্যাপক বিক্ষোভ আর ট্রাম্পের একটি ‘টুইট বার্তা’ প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক যে রাজনীতি, তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে এখন ইরান। একসময় সিরিয়ার ক্ষেত্রে ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর ধারণা অনুসরণ করেছিল ওবামা প্রশাসন। এ কারণে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী শক্তিগুলোকে আর্থিক ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অভিযোগ আছে, আইএসের উত্থানের পেছনেও যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল। কিন্তু সিরীয় সংকটে রাশিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ (বিমান হামলা) পুরো দৃশ্যপট বদলে দেয়। সিরিয়ার আসাদ সরকার জীবন পায়। এমনকি রাশিয়া সিরীয় সংকটে এক ধরনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছে। সিরিয়ায় ২০১৪ সাল থেকে যে গৃহযুদ্ধ চলে আসছিল, তা এখন অনেকটা সমাপ্তির দিকে। ফলে হোয়াইট হাউস প্রশাসনের জন্য ইরানে একটি ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করা প্রয়োজন ছিল। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ট্রাম্প তাঁর এক টুইট বার্তায় ইরানে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেখার জন্য তৈরি থাকার জন্য ইরানি জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন! স্পষ্টতই এটা একটা মেসেজ, ট্রাম্প প্রশাসন ইরানে নতুন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেখতে চায়! ইরানে জানুয়ারির প্রথম দিকে বিক্ষোভ চলার সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই টুইট বার্তাটি প্রেরণ করেছিলেন। ইরানে বিক্ষোভকারীরা যখন সরকার পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হলো, তখন সামনে এলো পারমাণবিক চুক্তির বিষয়টি।
আপাতত ওই চুক্তিটি ট্রাম্প বাতিল করলেন না বটে, কিন্তু বললেন, এটাই শেষ সুযোগ। এরপর তিনি আর চুক্তিটি অনুমোদন করবেন না। তিনি আপত্তি জানিয়েছেন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির। বলেছেন, ইউরোপীয় মিত্রদের দায়িত্ব অনেক বেশি। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়ে দিয়েছে, ইরান চুক্তিটি যথাযথভাবে মেনে চলছে। গেল সপ্তাহে ইইউর সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএর ৯টি রিপোর্টের কথা তুলে ধরে বলেন, সমাঝোতা ঠিকমতো কাজ করছে। ইইউ আবারও পরমাণু চুক্তির প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে এবং একই সঙ্গে এই চুক্তির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
পারস্য উপসাগরের রাজনীতি এখন এক ধরনের স্থিতিশীলতার দিকে এগোচ্ছে। আইএস সেখান থেকে উত্খাত হওয়ার পর ধীরে ধীরে রাজনীতিতে স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে। এমন এক পরিস্থিতিতে ইরান পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে যদি কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়, তাহলে তা কারো জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে  না।
Daily Kalerkontho
21.1.2018

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কতটুকু দূর



এটা মোটামুটিভাবে একরকম নিশ্চিত, চলতি বছরের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছিল ১২ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারির ৯০ দিন আগে যে-কোনো একদিন এই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বিএনপির মতো একটি বড় দল কি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে? বিএনপি নির্বাচন করতে চায়; কিন্তু তাদের দাবি একটি সহায়ক সরকার। আর সরকারের বক্তব্য, নির্বাচন হবে সংবিধান মোতাবেক, যেখানে বলা আছেÑ ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই একটি সরকার থাকবে, যারা তিন মাস ‘রুটিন ওয়ার্ক’ করবেন। বিএনপির আপত্তি এখানেই। বিএনপি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোনো নির্বাচনে যেতে চাচ্ছে না। আবার এখন পর্যন্ত কোনো সহায়ক সরকারের ধারণাও উপস্থাপন করছে না। তবে মিডিয়ায় তারা বলছেন, প্রয়োজনের সময় তারা এই ধারণা দেবেন। তবে কবে দেবেন, তা বলেননি। চলতি বছরটি শুরু হলো একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, যা ছিল সংবিধানসম্মত। কিন্তু নির্বাচনের পরদিন এবং নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যে সহিংস ঘটনা জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল, সেই বিএনপির রাজনীতিকে তা একটা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। বিএনপি একধরনের ইমেজ-সংকটের মুখে পড়েছিল। সেই থেকে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ৫ জানুয়ারিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে পালন করে আসছেÑ যেখানে আওয়ামী লীগ পালন করে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে; বিএনপি পালন করে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতেও আমরা এটা প্রত্যক্ষ করলাম। এতে একধরনের অনিশ্চয়তা থাকলইÑ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর চলমান রাজনীতি এখন কোন দিকে মোড় নেবে? এটা সত্য, সাধারণ মানুষ সহিংসতা পছন্দ করে না। সহিংস আন্দোলন করে যে সরকারের পতন ঘটানো যায় না, সরকারের চার বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা এর বড় প্রমাণ। সরকারপ্রধান তার চার বছরের কর্মকা-ের একটা ফিরিস্তি দিয়েছেন গত ১২ জানুয়ারির ভাষণে। তিনি উন্নয়ন কর্মকা-ের কথা বলেছেন। বুঝতে বাকি থাকে না, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উন্নয়নের এই কর্মকা- একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রাক্কালে সম্পন্ন করবে। কিন্তু বছরের শুরুতে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দুটি বড় দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে একটি হতাশার জায়গা তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী যেমন ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ ব্যাখ্যা দেননি, তেমনই বিএনপিও ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ধারণা করা যায়, ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ সময় একটি ছোট মন্ত্রিসভা থাকবে। ওই মন্ত্রিসভায় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর প্রতিনিধি থাকবে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে একটি ছোট মন্ত্রিসভা থাকবে। যদিও প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলেননি; তবে এটা ভালো হয়, যারাই মন্ত্রিসভায় থাকবেন তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। এতে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে। বিএনপি সহায়ক সরকারের কোনো রূপরেখা দেয়নি। এটা বিএনপি দিক। ফলে আলোচনার পরিসর আরও বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে জট খুলতে পারে। যদিও সিনিয়র মন্ত্রীরা বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপের কোনো সুযোগ নেই, তারপরও ‘পর্দার অন্তরালে’ একধরনের ‘সংলাপ’ হতে পারে। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করছে সংবিধান ও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর।মূল কথা হচ্ছে, আমরা একটি ভালো জাতীয় নির্বাচন চাই। আর এর জন্য প্রয়োজন সব দলের অংশগ্রহণ। ২০১৪ সালে জানুয়ারির নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য খুব ভালো খবর নয়। সরকারের জন্যও এটি কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। আরও একটি কথাÑ সিল মারা কিংবা ভোটকেন্দ্র দখলের যে সংস্কৃতি আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করে আসছি কিংবা বিরোধী দলের প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার যে ‘রাজনীতি’ আমরা দেখেছি, এই প্রবণতা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায়। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব তাই অনেক বেশি। ইসিকে প্রমাণ করতে হবে তারা নির্বাচনের আগে ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ দেবেন; নির্বাচনে মাস্তানতন্ত্র বন্ধ করবেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে। কোনোখানেই কোনো সহিংসতা হয়নি। সব দল এই নির্বাচন দুটির ফলাফল মেনে নিয়েছে। ফলে কিছুটা হলেও একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ইসি সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে কতটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করবে, প্রশ্ন সেখানেই। আমরা বারবার বলে আসছি, সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, ক্ষমতা প্রয়োগ করতে নির্বাচন কমিশন ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকে। সংবিধানের ১১৮(৪) ধারা নিয়ে একটি ব্যাখ্যা আছে। এই ধারায় বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন’ এবং সংবিধানের ১২৬ ধারায় বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ এটাই হচ্ছে আসল কথা। নির্বাচনের তিন মাস আগে সব প্রশাসন চলে যায় নির্বাচন কমিশনের হাতে। অর্থাৎ ডিসি, এসপি, ওসিরা থাকেন নির্বাচন কমিশনের আওতায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা কী বলে? জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা থাকেন জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন নয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে, আর জেলা প্রশাসকরা নিয়ন্ত্রিত হন মন্ত্রণালয় থেকে। এক্ষেত্রে প্রায়ই সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রতিফলিত হয়। আরও একটা কথাÑ সংসদ বিলুপ্ত না করেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর অর্থ কী? সংসদ সদস্যরা নিজেদের অবস্থান ঠিক রেখেই প্রার্থী হবেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অর্থাৎ যিনি এখনও এমপি, তিনি প্রার্থী হবেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এক্ষেত্রে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার একটা অভিযোগ থেকেই যাবে। স্থানীয় প্রশাসন একজন এমপিকে অস্বীকার করতে পারে না। এমপিকে তারা সমীহ করে। এমপি স্থানীয় রাজনীতির প্রধান ব্যক্তি। এমপির কথাকে গুরুত্ব দিয়ে স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন অন্য কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। এক্ষেত্রে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে! পৃথিবীর সব দেশে সাধারণত নিজেদের জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েই নির্বাচনটি হয়। ভারত এর বড় উদাহরণ। সংসদ বহাল রেখে কোনো নির্বাচনই হয় না। এটা অবশ্য ঠিক, ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকেন; কিন্তু তার কোনো ‘নির্বাহী কর্তৃত্ব’ থাকে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংবিধানের এই ধারা নিয়ে বিতর্ক আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান পরস্পরবিরোধী।চলতি বছরটি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে থাকবে বারবার। দুটি বড় দলই তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। এক্ষেত্রে জট কীভাবে খুলবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আস্থার সম্পর্কটি এখন তলানিতে অবস্থান করছে। আস্থার সম্পর্কটি জরুরি এ কারণে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেক অংশে দুই দল নির্ভর হয়ে পড়েছে। একদলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকে। আওয়ামী লীগ বড় দল। ইউনিয়ন পর্যায়ে এই দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি আছে। অপরদিকে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির একটা সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্ত আর সুবিধাবাদিতার রাজনীতির কারণে জাতীয় পার্টি একটি অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। পাঠক লক্ষ করলে দেখবেন, এই দলটির জন্মের পর থেকে যতবার ভাঙনের মুখে পড়েছে, অন্য কোনো দল এতবার ভাঙনের মুখে পড়েনি। অতীতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান কিংবা কাজী জাফর আহমেদÑ যারাই দল থেকে (জাতীয় পার্টি) বেরিয়ে গেছেন, তারা রাজনীতির প্রশ্নের চেয়ে সুবিধাবাদিতার কারণেই দল থেকে বেরিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মূল ধারা ধরে রেখেছেন বটে; কিন্তু তার অবর্তমানে দল কয় টুকরায় বিভক্ত হয়, সেটাই দেখার বিষয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপিতে ভাঙন এসেছে। তবে তারা কেউই সুবিধা করতে পারেননি। আবদুর রাজ্জাকের মতো নেতা আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে বাকশাল নিয়ে সংগঠিত হতে চেষ্টা করেছিলেন; পারেননি। মূলধারায় ফিরে এসেছিলেন। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ওবায়দুর রহমান কিংবা মান্নান ভূঁইয়া চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু সফল হননি। আর নাজমুল হুদা একবার বেরিয়ে গেছেন, আবার ফিরে গেছেন, এখন আবার দলের বাইরে। তার গ্রহণযোগ্যতা কিংবা ক্যারিশমা কোনোটাই নেই। ফলে মুজিব কিংবা জিয়া পরিবারের বাইরে গিয়ে কেউই সফল হবেন না।আরও একটা কথাÑ তা হচ্ছে তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার ব্যর্থতা। বারবার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু সফলতা আসেনি। আমরা যদি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৯১) থেকে নবম জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব জাতীয় সংসদ নির্বাচন দুটি বড় দল নির্ভর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এটাই সৌন্দর্য। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। সাধারণ মানুষের সমর্থন যদি না থাকত, তাহলে এত দীর্ঘ সময় দলটি ক্ষমতায় থাকতে পারত না। আবার গত ৯ বছর বিএনপির মতো একটি বড় দল ক্ষমতার বাইরে। ক্ষমতার বাইরে থাকা সত্ত্বেও দলটি পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়েনি। দলের অনেক শীর্ষ নেতা বয়সের ভারে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেনÑ এটা সত্য। এক্ষেত্রে ‘নয়া নেতৃত্ব’ও আসছে না। তবে ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে দলটি ভেঙে যেতে পারে! নির্বাচন বয়কট কোনো রাজনীতি হতে পারে না। সুতরাং দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবেÑ এটাই সবার প্রত্যাশা। চলতি বছর নির্বাচনী বছর। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেছে। কিন্তু আরও কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে সব দলের মাঝে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এই আস্থার সম্পর্কই একটা সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। এটাই বাস্তবতা।আমরা চাই, জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেÑ এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তাই সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। সেই ‘দায়িত্ব’ সিইসি কীভাবে পালন করেন, আমরা তার অপেক্ষায় থাকলাম। তবে একটা বিষয়ে বোধহয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজনÑ আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহু মন্ত্রী বারবার বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যে সরকার থাকবে, তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা সংবিধানসম্মতভাবেই নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনা করবেন। এক্ষেত্রে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচনটি যদি সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে সব দলের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য একটি মন্ত্রিসভা থাকা ভালো। বিএনপি বড় দল। দলটিকে আস্থায় নেওয়া প্রয়োজন। না হলে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। আমরা বারবার রাজনীতিবিদদের কাছে ফিরে যাই। তাদের দূরদর্শিতা, মেধা, জ্ঞান আমাদের আগামীতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ‘উপহার’ দেবেÑ এ প্রত্যাশা আমাদের।
Daily Alokito Bangladesh
21.1.2018

শিক্ষাজগতে দুদকের প্রবেশ যেন অর্থবহ হয়

গত ১০ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকের শীর্ষ সংবাদ ছিল এরকম : সাড়ে ৮ হাজার ভুয়া পিএচইডির তদন্তে দুদক। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের ধরতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ সনদ বাণিজ্যের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করছে সংস্থাটি। ওই প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্যও ছাপা হয়েছে (মানবজমিন)। আমি নিজে ওই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, দুদকের তথ্যমতে দেশে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী রয়েছেন! এ ধরনের একটি সংবাদ জেনে একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। পিএইচডি ডিগ্রি নিছক একটি সাধারণ ডিগ্রি নয়। এটি অর্জন করতে হলে প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণার প্রয়োজন হয়। এটি এমন একটি গবেষণা, যা কোনো একটি তত্ত্বের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয়। যারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পিএইচডি ডিগ্রি নেন, তারা ল্যাবে কাজ করেন। যারা সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি নেন, তারা সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যেসব তত্ত্ব রয়েছে, তা প্রয়োগ করে তাদের নিজ নিজ গবেষণা সম্পন্ন করেন এবং নতুন নতুন ফলাফল উপস্থাপন করেন। এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ। শুধু পত্রিকার কাটিং, যে কোনো গ্রন্থে প্রকাশিত তথ্য উল্লেখ করে (কোনো কোনো ক্ষেত্রে কপি করে) গবেষণা সম্পন্ন করা যায় না। গবেষণার একটি পদ্ধতি আছে। আমরা যখন ইউরোপে পিএইচডি গবেষণায় জড়িত ছিলাম, তখন রুশ ভাষা শিখতে আমাকে মস্কো পাঠিয়েছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ আমার গবেষণার বিষয় ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি। সত্তরের দশকের এ পররাষ্ট্রনীতি বুঝতে এবং আর্কাইভ ও ডকুমেন্ট দেখতে আমার মস্কো যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। শুধু তাই নয়, লাইব্রেরিতে আমাদের সবার জন্য ছোট ছোট কক্ষ ছিল, যেখানে আমাদের সারাদিন পড়ে থাকতে হতো।
প্রবাসে যারাই গবেষণা করেছেন, তাদের সবার অভিজ্ঞতাই এমন। আর গবেষণার কাজটি এমনই যে, কখনও-সখনও তা ৭-৮ বছরও লেগে যায়। পিএইচডি গবেষণা অত সহজ নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যারা পিএইচডি ডিগ্রি নিচ্ছেন, কিংবা পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন, তাদের অনেকে নিজেরাই নিজেদের বিতর্কিত করছেন। আমার দুঃখ লাগে যখন দেখি সমাজের উচ্চশ্রেণীর কিছু শিক্ষিত মানুষ এটি জেনেও না জানার ভান করছেন। অনলাইনে পাওয়া ডিগ্রি যে ব্যবহার করা যায় না, এবং এটি যে ফৌজদারি অপরাধতুল্য, তা তারা জানেন। তারপরও তারা এ ডিগ্রি ব্যবহার করে চলেছেন। একজন সাবেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার কথা জানি। তিনি যে প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন, তা যে অবৈধ বা ভুয়া, তা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেও তিনি দিনের পর দিন ওই ডিগ্রি ব্যবহার করে চলেছেন। আরেকজনের কথা জানি। তিনি একটি বড় এনজিওর প্রধান। তাকে ফিলিপাইনের একটি প্রতিষ্ঠান সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি দিয়েছে। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও বটে। ওই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে অনুসন্ধান চালানো হয়, আমি ইউজিসির প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, এভাবে পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করা যায় না। এমনকি তিনি নিজেকে অধ্যাপক হিসেবে পরিচয় দেন, এটিও অবৈধ। এ ধনের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীর সংখ্যা অনেক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব দেখার কি কেউ নেই? প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভূমিকা তাহলে কী? এক্ষেত্রে ইউজিসির চেয়ারম্যানের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে। ওই প্রতিবেদকের কাছে ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে নোটিশ দিতে দিতে হয়রান হয়ে গেছি। এটি ফৌজদারি অপরাধ। কারণ এ সনদ দেয়া ও নেয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন হয়।’ তিনি দুদকের অনুসন্ধানকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং ভুয়া সনদধারীদের সবাইকে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এ বক্তব্যের পেছনে কিছুটা সত্যতা আছে, কিছুটা তথ্য বিভ্রান্তিও রয়েছে। ইউজিসি আইনে সরাসরি ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের ধরার কোনো বিধান নেই। তবে ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি কাজ করে- আর তা হচ্ছে বিদেশে নেয়া ডিগ্রির সমমান নির্ধারণ করে। আমরা যখন ইউজিসিতে ছিলাম, তখন এ ধরনের অনেক ডিগ্রির (পিএইচডিসহ) সমমান আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একাধিক বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন কি তা হয়?
এখানে যে বিষয়টি লক্ষ করা যাচ্ছে তা হল এক ধরনের শৈথিল্য। অর্থাৎ যার ওপর যে দায়িত্বটি বর্তেছে, অথবা যিনি যে কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনি সেই কাজটি করছেন না, অথবা করতে অপারগ। যেসব শিক্ষা সচিব সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ছিলেন বা আছেন, তাদের তো উচিত ছিল এ বিষয়টি নিয়ে ভাবার। তারা কি তা ভেবেছেন? কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কি ইউজিসিকে নির্দেশ দিয়েছেন? দেননি। এর পেছনে কারণ আছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে একাধিক সচিব রয়েছেন, যারা এ ধরনের ডিগ্রি নিয়েছেন। শিক্ষা সচিব তাই তার সহকর্মীদের বিরক্ত করতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে অ্যামেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, কালচারাল ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে যেখান থেকে এসব অবৈধ পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়। আমাদের সচিবদের অনেকে নামের আগে ডক্টরেট ডিগ্রি ব্যবহার করে থাকেন। তারা ভালো করেই জানেন এ ডিগ্রির কোনো বৈধতা নেই। গবেষণা না করে, কোনো ধরনের লাইব্রেরি কিংবা ফিল্ডওয়ার্ক না করে যে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়া যায় না, এটা বোঝার জ্ঞান নিশ্চয়ই শীর্ষ আমলাদের আছে।
আমি ইউজিসির চেয়ারম্যানের ভূমিকায় হতাশ। সারা দেশের প্রায় ১৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেসরকারিসহ) দেখভাল করার দায়িত্ব যার এবং যিনি দিকনির্দেশনা দেবেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তিনি তার দায়িত্বে পুরোপুরি মনোনিবেশ করছেন না। একটি গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী কেউ তার মূল দায়িত্বের বাইরেও কাজ করতে পারেন, তবে মূল দায়িত্বের প্রতিই তার সর্বাধিক মনোযোগ থাকা উচিত বলে মনে করি। ইউজিসির দায়িত্ব অনেক এখন। শুধু অবৈধ পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের আইনের আওতায় আনতে দুদককে সহযোগিতাই নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষার দিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। ইউজিসির চেয়ারম্যানের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের ক্ষেত্রেও কথাটা সমানভাবে প্রযোজ্য। উপাচার্যদের জন্যও একটি নীতিমালা দরকার। ইউজিসি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ কাজটি করেনি।
উপাচার্যদের কর্মকাণ্ডও মনিটর করা প্রয়োজন। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (রংপুর) পরপর দু’জন উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, সেক্ষেত্রে ইউজিসির বক্তব্য কী? একজন উপাচার্যের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির তদন্ত করছে দুদক। যে কাজটি করার কথা ইউজিসির, সে কাজটি করছে দুদক। তারপরও কথা থেকে যায়। ওই তদন্তের অগ্রগতি কতদূর? দ্বিতীয় যে উপাচার্য দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তার দুর্নীতি সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন তিনি নাশতার জন্য ব্যয় করতেন সাত হাজার টাকা- এটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট। আর ভর্তি পরীক্ষায় ডিউটি না করেও তিনি উত্তোলন করেছিলেন (৩ বছরে) ১৬ লাখ টাকা। এটি ছিল তদন্ত কমিটির রিপোর্ট। দুদক কি তার বিরুদ্ধেও তদন্ত করছে? রাষ্ট্রের টাকা মানেই তো জনগণের টাকা। এ টাকা যিনি নয়ছয় করেন, তিনি শিক্ষক হতে পারেন, তবে দুর্নীতিবাজ।
পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। যে প্রতিবেদনটির কথা উল্লেখ করেছিলাম, সেখানে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি মন্তব্য আছে। তার মন্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুধু বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত মুনাফার উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে তারা এদের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। এটি মোটেও সুখকর নয়। অধ্যাপক ইসলাম একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। আমাদের মতো অনেক শিক্ষকের শিক্ষক তিনি। কোনোদিন তিনি উপাচার্য হননি। সারা জীবন ছাত্র পড়িয়েছেন আর লেখালেখি করেছেন। একজন শিক্ষকের এটাই তো মূল কাজ। তার মতো একজন সিনিয়র শিক্ষক যখন এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। তিনি মিথ্যা বলেননি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এটাই এখন চিত্র। আমি অবাক হয়ে যাই- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে যা হচ্ছে, তা দেখার কেউ নেই! আইনগতভাবে বৈধ, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এ ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন আছে। ছুটি না নিয়ে, লাইব্রেরিতে না গিয়ে, ফিল্ডওয়ার্ক না করে কী করে পিএইচডি করা যায়, আমি জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এটা দেয় না। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেয়। এটা দিতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির মান প্রশ্নের মুখে পড়েছে। থিসিসগুলো পড়ে দেখা যেতে পারে, যেখানে ‘মেথডোলজি’ বলতে কিছু নেই! ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’-এর নাম আর যাই হোক, পিএইচডি হতে পারে না। আমার বিভাগে কোনো একদিন ক্লাস না করেও বছরের সারাটা সময় চাকরি করেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়া যায়! প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি এর অনুমোদনও দেন। এরই নাম উচ্চশিক্ষা! আর উচ্চশিক্ষা পরিচালনার ভার যাদের হাতে ন্যস্ত, তারা ব্যস্ত থাকেন রাজনৈতিক তথা ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের চেষ্টায়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে ৯ বছর। তাদের অনেক অর্জনের একটা হচ্ছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। সরকারপ্রধানের উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু যাদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তারা যোগ্য নন। উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চাই আমরা। একটা শক্তিশালী তরুণসমাজ আমাদের আছে, যারা বিসিএসের নামে ‘সোনার হরিণ’ খুঁজে বেড়ায়। অথচ তাদের আমরা দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে পারতাম। এজন্য দরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, দরকার দক্ষ শিক্ষা প্রশাসক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হচ্ছে একেকটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে। বাবা-মা, সন্তান, সন্তানের স্বামী বা স্ত্রী- সবাই আজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! তারা এত বেশি মেধাসম্পন্ন যে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে আবেদন করতে ভয় পান! এই যে শিক্ষাব্যবস্থা, এ ব্যবস্থায় যে জনশক্তি তৈরি হবে, তা দেশটিকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে কোনো অবদান রাখবে না।
ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে দুদক। আমি দুদককে স্বাগত জানাই। কিন্তু আমার শঙ্কা হচ্ছে প্রভাবশালীদের চাপে শেষ পর্যন্ত না এ অভিযানটি কাগজ-কলমেই থেকে যায়। দুদক জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরেই এ কাজটি শেষ করুক। কাজটি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে করতে পারিনি। ইউজিসিতে থেকে পারিনি। পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। দুদক একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক- আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
Daily Jugantor
19.01.2018

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে কি শুরু করেছে?


বাংলাদেশে গেল সপ্তাহে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের বলে দেয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামীতে এ ধরনের প্রভাব আরও বাড়বে। অসময়ে বন্যা হবে। উত্তরাঞ্চলে খরার প্রবণতা দেখা দেবে। ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়বে। লবণপানির আগ্রাসন বাড়বে। বড় বড় শহরে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি
গেল সপ্তাহে বাংলাদেশজুড়ে যে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়, তাতে সে প্রশ্নটিই আবার আলোচনায় নতুন মাত্রা পেল, তা হচ্ছেÑ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে কি শুরু করেছে? পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ছিল ৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, বিশ্বজুড়েই বৈরী আবহাওয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা যে জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত, তা আর কাউকে বলে দিতে হবে না। জলবায়ু পরিবর্তন রোধকল্পে ২০১৫ সালে প্যারিসে একটি চুক্তি হয়েছিল, যা কপ-২১ নামে পরিচিত। পরে জাতিসংঘে ২০১৬ সালে ১৭০টি দেশ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে তা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করে। কিন্তু এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই চুক্তিটি মানতে অস্বীকার করছেন। বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এ কারণে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। সাহারা মরুভূমিতেও এখন বরফ পড়ছে। কানাডায় তাপমাত্রা নেমে গেছে মাইনাস ৩০ ডিগ্রির নিচে। প্যারিসে ও পরে জাতিসংঘে একটি চুক্তি হয়েছিল বটে, তবে বিভক্তি আছে। বিশ্বের দেশগুলো এখনও বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একেক গ্রুপের একেক এজেন্ডা রয়েছে। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১ এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এই দেশগুলোর, অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ ভাগ; কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশিÑ শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭ এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ; কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগরপারের দেশগুলো, যারা বিশ্বে জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ ভাগ, তাদের দাবি ছিল ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা ‘রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন’ হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্বজনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের, আর মাত্র ৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ, জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা বিশ্বের মাত্র ৫ ভাগ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে; কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে, এই হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিতÑ এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সেই প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়। সে কারণে এই দুটি দেশের কাছ থেকে ‘কমিটমেন্ট’ আশা করেছিল বিশ্ব; কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিলÑ ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চাইতে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল, তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত দুই দেশই বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এ শতাব্দীতেই। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৪৯০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে।
২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ। ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়, তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ১৯৯০ সালের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৭ শতাংশ, জাপানের ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা ছিল। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সব দেশকে ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজকলমেই থেকে গিয়েছিল। তবে প্যারিসে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সেই চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গেল ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অনত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ আগামীতে উদ্বাস্তু হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন ‘কপ’ সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। অতীতে ‘কপ’ (COP) এর দোহা সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা হবে, যাতে এই দেশগুলো জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে। উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের, যেখান থেকে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার। বলা হয়েছিল, জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় পশ্চিমা বিশ্ব উন্নয়নশীল বিশ্বকে প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিও রাখেনি পশ্চিমা বিশ্ব। ফলে প্যারিসে যে সমঝোতা হয়েছিল (২০১৫), তা নিউইয়র্কে একটি চুক্তি সময়ের মধ্য দিয়ে কতটুকু কার্যকরী হবে, সে প্রশ্ন থাকলই। মার্কিন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরিবেশবাদী আল গোর নিজে একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেনÑ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ ২ থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে অনত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। এর অর্থ প্রচুর মানুষ হারাবে তাদের বসতি, তাদের পেশা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে নোনা পানির আগ্রাসন; সেই সঙ্গে ধানের আবাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ২ কোটি কৃষক-জেলে পেশা হারিয়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এসে নতুন নতুন বস্তি গড়ে তুলবে। রিকশা চালানোর জীবন বেছে নেবে। সৃষ্টি হবে একটি শ্রেণির, যারা শহরে মানুষের ভাষায় ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’। এই ‘জলবায়ু উদবাস্তু’দের নিয়ে রাজনীতি হবে! বিদেশে অর্থ সাহায্য চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে প্রাপ্ত সাহায্যের ব্যবহার নিয়ে নানা অনিয়মের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই সরকার এমন অনিয়ম রোধ করতে পেরেছে। এখন বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এই চুক্তি কতটুকু কার্যকরী হয়, তা নিয়ে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই গেল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। একাধিক গবেষণায় তা প্রমাণিতও। ৩ বছর আগে একটি শঙ্কার কথা আমাদের জানিয়েছিল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি। বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এ ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট ২০১৪ ঢাকায় এডিবির এই রিপোর্টটি উপস্থাপন করা হয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, বরং জাতিসংঘের রিপোর্টেও এ ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতি বছরই জলবায়ু পরবর্তনসংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা কপ বা ‘কমিটি অব দ্য পার্টিস’ নামে পরিচিত, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের যারাই পরিবেশমন্ত্রী থাকেন, তারা ঘটা করে ‘কপ’ সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরই মধ্যে নাসা আরও একটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। নাসা আশঙ্কা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে, তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। আল গোর তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেনÑ বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় এরই মধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক বনমন্ত্রী হাসান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন এন্টার্কটিকায় শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্বসম্প্রদায় এখনও কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি সিদ্ধান্ত, যেখানে তিনি বলেছেন, তিনি জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। এখন যদি জলবায়ু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র না থাকে, তাহলে জলবায়ু চুক্তিটি একটি প্রশ্নের মুখে থাকবেই।
বাংলাদেশে গেল সপ্তাহে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের বলে দেয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামীতে এ ধরনের প্রভাব আরও বাড়বে। অসময়ে বন্যা হবে। উত্তরাঞ্চলে খরার প্রবণতা দেখা দেবে। ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়বে। লবণপানির আগ্রাসন বাড়বে। বড় বড় শহরে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি। এজন্য আমরা আদৌ দায়ী নই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সুতরাং কপ-২১ এ যে সিদ্ধান্তটি হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন জরুরি ছিল। কিন্তু তাতে এখন অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করা না গেলে বাংলাদেশের মতো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যদি বৈদেশিক সাহায্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল থাকি, তাহলে আমরা ভুল করব। নিজস্ব উৎস ব্যবহার করে, নিজস্ব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে, গ্রিন এনার্জি ব্যবহার করে, দেশীয় বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করে আমরা নিজ উদ্যোগে উষ্ণতা রোধকল্পে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারি। আমাদের এ ব্যর্থতা সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। সারা বিশ্বেই কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উপাদনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেশকিছু দেশ (যেমন জার্মানি)। অথচ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কয়লানির্ভর এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার। এক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা ভেবে দেখা উচিত ছিল। সোলার এনার্জি বিশ্বে জনপ্রিয় হলেও আমরা এর ব্যবহার বাড়াতে পারিনি। সুতরাং চলতি বছরের শুরুতে অতিরিক্ত শীত পড়ার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, তা মনে করিয়ে দিল। সুতরাং পরিবেশ বিপর্যয় রোধে এখনই দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
Daily Alokito bangladesh
14.01.2018

চলতি বছরটি কেমন যাবে


অনেক শঙ্কা, অনেক উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে আমরা ২০১৭ সালটি পার করলাম। এখন কেমন হবে ২০১৮ সালটি? এই অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, সম্ভাব্য যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড—এসবই কি বজায় থাকবে ২০১৮ সালে? বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০১৭ সালের অনেক ঘটনা ২০১৮ সালের বিশ্বরাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। তবে বেশ কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি, ভেনিজুয়েলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি, চীনের বিশ্বভূমিকা, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি, বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা, এমনকি রোহিঙ্গা পরিস্থিতির দিকে লক্ষ থাকবে পর্যবেক্ষকদের।
ইরান সংকট চলতি বছর বিশ্বরাজনীতিতে বড় ধরনের আলোচিত বিষয় হয়ে থাকবে। পাঠক, নিশ্চয়ই আপনাদের স্মরণ আছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত বছর স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে ছয় জাতির যে সমঝোতা হয়েছিল (জুলাই ২০১৫) তা তিনি মানেন না। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, ওই সমঝোতার মধ্য দিয়ে ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি; যদিও সমঝোতায় আগামী ১০ বছর ইরান কোনো পারমাণবিক কর্মসূচি হাতে নেবে না এবং তাদের সব পরমাণুকেন্দ্র আন্তর্জাতিক নজরদারিতে থাকবে—এ রকম একটি শর্ত ছিল। ইসরায়েল প্রথম থেকেই এই সমঝোতার বিরোধিতা করে আসছিল। এখন ট্রাম্প এই বিরোধিতায় যোগ দিলেন। ট্রাম্প যে নয়া নিরাপত্তা স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করেছেন তার অন্যতম টার্গেট হচ্ছে ইরান। সুতরাং চলতি বছর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরানকে কেন্দ্র করেই ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আবর্তিত হবে। এরই মধ্যে জেরুজালেমে ইসরায়েলের রাজধানী স্থানান্তরে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এবং এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-সৌদি-আরব অ্যালায়েন্স মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা এনে দিয়েছে। ইরানকে নিয়ে একদিকে যেমন সৌদি আরবের একটি ‘ভয় ও শঙ্কা’ রয়েছে, ঠিক তেমনি ইসরায়েলের ইরানকে নিয়ে ‘শঙ্কা ও ভয়’ রয়েছে। ফলে এখানে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। গেল বছর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে কতগুলো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে, যার প্রভাব ২০১৮ সালেও থেকে যাবে। প্রথমত, সিরিয়া সংকটে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ আসাদ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়া-রাশিয়া অ্যালায়েন্স গড়ে ওঠে, যাতে যোগ দেয় ইরান।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রাশিয়া-সিরিয়া-ইরান ঐক্য অন্যতম একটি পক্ষ, যা কিনা ২০১৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। সিরিয়া ও ইরাক আইএসমুক্ত হয়েছে। এ অঞ্চলে আইএসের সর্বশেষ ঘাঁটি থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস উত্খাত হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে আইএস জঙ্গিরা তাহলে গেল কোথায়? এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র আইএস জঙ্গিদের সিরিয়া ও ইরাক থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে! রাতারাতি হাজার হাজার জঙ্গি ‘হাওয়া’ হয়ে যাবে না। তারা নিশ্চয়ই অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৮ সালে আইএস জঙ্গিরা কোথায় তাদের জঙ্গি তৎপরতা শুরু করে সেদিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। এ ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনা আছে। ইউরোপে ২০১৮ সালেও সীমিত জঙ্গি আক্রমণের ধারা (লোন উলফ) লক্ষ করা যাবে। মধ্য এশিয়ায় (তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান) জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাবে। আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আইএসের কর্তৃত্বে চলে যাবে। সিরিয়া-ইরাক থেকে আইএস জঙ্গিদের এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। মিয়ানমারের রাখাইনে আইএসের তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
গেল বছর উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়েছিলেন। চলতি বছর উত্তর কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে যায় সেদিকে লক্ষ থাকবে অনেকের। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো মহল থেকে উত্তর কোরিয়ায় একটি সামরিক অভ্যুত্থানকে উৎসাহিত করা, সীমিত কমান্ডো আক্রমণের মধ্য দিয়ে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিককেন্দ্র ধ্বংস করে দেওয়া ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। তবে এ ধরনের কোনো ‘সিদ্ধান্ত’ শুধু আঞ্চলিক রাজনীতি নয়, বরং বিশ্বরাজনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বড় ধরনের কোনো ‘ঝুঁকি’ নেবেন বলে মনে হয় না। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সরাসরি ‘সংলাপ’ হচ্ছে সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। কিন্তু চলতি ২০১৮ সালে এ ধরনের সম্ভাবনা কম। গেল বছর উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ বড় ধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। কিন্তু দেখা গেছে, সেই অবরোধ উপেক্ষা করে চীন উত্তর কোরিয়াকে জ্বালানি তেল সরবরাহ করেছে। রাশিয়ার ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট নয়। ফলে চীন ও রাশিয়ার সহযোগিতা ছাড়া উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আওতায় আনা সম্ভব নয়। উত্তর কোরিয়ার এই পারমাণবিক কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রকে প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক উপস্থিতি তথা সামরিক কার্যক্রম বাড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্যাসিফিক কর্মসূচিকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছে। আর এ জন্যই তারা এশিয়া-প্যাসিফিকের নাম দিয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক তৎপরতা বাড়াবে। এই সামরিক কর্মসূচিতে তারা অস্ট্রেলিয়াকেও জড়িত করেছে। গেল বছর ইউরোপে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে, যার প্রভাব চলতি বছরও থাকবে। ব্রিটেন লিসবন চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে আসার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। গেল ডিসেম্বর মাসেই ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেনকে কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে (অর্থের পরিমাণ ৪০ থেকে ৬০ বিলিয়ন ইউরো)। ২০১৯ সালে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। জার্মানিতে গেল বছর যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়, তাতে বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের দল বিজয়ী হলেও সরকার গঠনে সেখানে জটিলতা রয়ে গেছে। ডিসেম্বরে এসেও সরকার গঠনের কাজটি সম্পন্ন হয়নি। মে মাসে ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ম্যাখোঁ বিজয়ী হয়েছিলেন। সেটা ছিল একটি বড় ধরনের ঘটনা। সেপ্টেম্বর মাসে কাতালোনিয়ায় গণভোটে স্পেন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পক্ষে রায় পড়লেও তা স্পেন স্বীকার করে নেয়নি, বরং কাতালোনিয়া সরকারকে বরখাস্ত করে। ডিসেম্বরের নির্বাচনে ওই বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই আবার বিজয়ী হয়। অস্ট্রিয়ার নির্বাচনে উগ্রপন্থীরা বিজয়ী হয়ে সেখানে সরকার গঠন করেছে। জুন মাসে মন্টিনেগ্রো ২৯তম সদস্য হিসেবে ন্যাটোতে যোগ দেয়। এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত ব্যাপক হারে সিরীয় ও ইরাকি অভিবাসীদের ইউরোপে প্রবেশের কারণেই ওই দক্ষিণপন্থী প্রবণতা বেড়েছে। এটি ২০১৮ সালের রাজনীতিতেও বড় প্রভাব ফেলবে। ইতালিতে (মার্চ) যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাতে দক্ষিণপন্থীরা প্রভাব ফেলতে পারে।
গেল বছর দক্ষিণ এশিয়ায়ও অনেক সংবাদ বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। তবে বলা হয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই শরিফকে সরে যেতে হয়েছিল। ২০১৮ সালে সেখানে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে শরিফ ব্যক্তিগতভাবে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। নেপালে সংসদীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল ডিসেম্বর মাসেই। এতে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) ও মাওবাদীদের জোট বিজয়ী হয়েছে। তবে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তারা সেখানে সরকার গঠন করতে পারেনি। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ গুজরাট রাজ্য সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ডিসেম্বরেই। মোদির বিজেপি সেখানে আবারও বিজয়ী হয়। এর মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যে ‘গেরুয়া বিপ্লব’-এর সূচনা করেছিলেন, তা অব্যাহত রাখলেন। ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে এখন বিজেপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালে বিজেপি যেখানে সাতটি রাজ্যে বিজয়ী হয়েছিল (কংগ্রেস ১৩টিতে) সেখানে ২০১৭ সালে বিজেপির হাতে রয়েছে ১৯টি রাজ্য, আর কংগ্রেসের মাত্র চারটি রাজ্য। এর অর্থ মোদির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এই জনপ্রিয়তা নিয়েই ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদি ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে দল তথা জোটের নেতৃত্ব দেবেন। অন্যদিকে কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন রাহুল গান্ধী, যা ছিল অনেকটা প্রত্যাশিত। গত তিন বছরে ভারতে ধর্মবিদ্বেষ আরো শক্তিশালী হয়েছে। চলতি বছরও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। এটা সত্য, বিজেপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল। নোট বাতিল, জিএসটি, গোরক্ষাসহ একাধিক ইস্যু; অন্যদিকে দলিত সম্প্রদায়ের একটি অংশ নানা কারণে বিজেপি সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু দেখা গেল গুজরাট ও হিমাচলের বিধানসভা নির্বাচনে এসব ইস্যু আদৌ ভোটারদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। চলতি বছর কর্ণাটক, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্য প্রদেশে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তখন দেখতে হবে বিজেপি গুজরাট ও হিমাচলের নির্বাচনের ফলাফল (২০১৭) অন্য চারটি রাজ্যে নিয়ে যেতে পারে কি না। নিঃসন্দেহে রাহুল গান্ধীর জন্য আগামী দিনগুলো হবে চ্যালেঞ্জের।
চলতি বছর দুটি দেশের দিকে লক্ষ থাকবে অনেকের। একটি হচ্ছে ভেনিজুয়েলা, অন্যটি কিউবা। ভেনিজুয়েলায় তেলের বড় রিজার্ভ (২৯৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ব্যারেল, প্রতিদিনের সরবরাহ প্রায় ২৫ লাখ ব্যারেল) থাকা সত্ত্বেও দেশটি কার্যত এখন একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে। মাদুরোর অর্থনৈতিক নীতি সেখানে বড় ধরনের সংকটের সৃষ্টি করেছে। মাদুরো সংবিধান পরিবর্তন করে দিন দিন কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে পারে! চলতি বছর সেখানে গণ-অসন্তোষ পরিস্থিতিকে কোথায় নিয়ে যায় সেদিকে লক্ষ থাকবে অনেকের। একই কথা প্রযোজ্য কিউবার ক্ষেত্রেও। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে তাতে এসেছে বড় অনিশ্চয়তা। ট্রাম্প সেখানে আরো সংস্কার চান। সুতরাং কিউবার দিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। কেননা চলতি বছরের মার্চে রাহুল কাস্ত্রো ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা স্থগিত করেছেন।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৫টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছিল। পরে ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটি অনুমোদিত হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রও তখন এই চুক্তি অনুমোদন করেছিল এবং জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাতে স্বাক্ষর করেছিল। এটা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার কমাতে হবে। প্যারিস চুক্তিতে সেভাবেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন ট্রাম্প বলছেন, তিনি এই চুক্তি মানেন না। তিনি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের কথাও বলেছেন। ফলে সত্যি যদি যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে বিশ্বের তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা আদৌ সম্ভব হবে না। ভুলে গেলে চলবে না ‘জ্বালানি’ একটা বিশাল ব্যবসা। ট্রাম্প নিজে ব্যবসায়ী। তিনি যা করছেন, তা ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই করছেন। আজ উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারে ট্রাম্প যেসব কথাবার্তা বলছেন, তা শুধু বিজ্ঞানীদের গবেষণাকেই অস্বীকার করছে না, বরং বিশ্বকে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়ার শামিল। চলতি বছর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনা অব্যাহত থাকবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা থাকবে প্রশ্নের মুখে।
বৃহৎ শক্তির মধ্যে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয় সেদিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গেল বছরে চীন সফরের পরও চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যে ‘সংকট’ তা চলতি বছরও অব্যাহত থাকবে। চীনের বাণিজ্যনীতি নিয়ে ট্রাম্প নানা কথা বললেও গেল বছর তিনি চীনা পণ্যের ওপর কোনো অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেননি, যা তিনি ওয়াদা করেছিলেন। চলতি বছর এ ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা কী হবে, সে ব্যাপারেও লক্ষ থাকবে অনেকের। যুক্তরাষ্ট্র টিপিপি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে; কিন্তু নাফটা, কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কিংবা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়নি। ট্রাম্প বারবার বলে আসছেন এমন চুক্তি ও সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্র ‘উপকৃত’ হচ্ছে না। ফলে চলতি বছর ট্রাম্প এসব ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেন সেদিকেও দৃষ্টি থাকবে সবার। মোদ্দা কথা, ট্রাম্প চলতি বছর আরো আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারেন। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরো অবনতি হতে পারে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ইঙ্গিত দিলেন ট্রাম্প। সব মিলিয়ে চলতি বছর বিশ্বরাজনীতিতে নানা উত্থান-পতন লক্ষ করা যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরো কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বাড়বে।
Daily Kalerkontho
7.1.2018

ইরানে ব্যাপক বিক্ষোভ ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা



২৯ ডিসেম্বর থেকে ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে সরকারবিরোধী যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা এনে দিয়েছে। সিরিয়া ও ইরাক থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস উৎখাতের পরও সেখানে সংকট কাটেনি। ট্রাম্পের জেরুজালেমসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ইরানে নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হলো। এ ইরানি বিক্ষোভের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার টুইট বার্তায় ইরানে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেখার জন্য তৈরি থাকতে বলেন! এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট কোনো মেসেজ দিলেন কি না, তা স্পষ্ট না হলেও এটা সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে ইরান নিয়ে তিনি নানা মন্তব্য করেছেন। ২০১৫ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যে ছয় জাতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা তিনি মানবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। এখন এ বিক্ষোভের সঙ্গে ট্রাম্পের টুইট বার্তাকে অনেকে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
এরই মধ্যে ইরানে বিক্ষোভে মারা গেছেন ২২ ব্যক্তি। সরকার সমর্থকরাও বিক্ষোভ দমনে মাঠে নেমেছেন। সরকার সমর্থকরা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এমনকি ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিও বলেছেন, ইরানের সাম্প্রতিক এ বিক্ষোভে ‘শত্রুপক্ষের’ ইন্ধন ছিল। যদিও তিনি কোনো দেশ বা কোনো পক্ষকে ‘শত্রুপক্ষ’ হিসেবে উল্লেখ করেননি। তবে ইরানি জনগণ ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রকেই ‘শত্রুপক্ষ’ হিসেবে মনে করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে তিনি ইরানের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমনকি তিনি গোপনে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনিকে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। খামেনি এর জবাবও দিয়েছিলেন। ফলে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন উঠেছে। নিঃসন্দেহে এ সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের আগে ইরানকে বলা হতো ‘পারস্য অঞ্চলের পুলিশ’। অর্থাৎ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত ইরান। রেজা শাহ পাহলভি ছিলেন তখন ইরানের রাজা। ইরানি বিপ্লবে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর দীর্ঘদিন ইরান আঞ্চলিক রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ অঞ্চলে ইরানি প্রভাব বাড়ছে। ইরান ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। সিরিয়ার আসাদ সরকার ও লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীকেও ইরান সাহায্য করছে। ইরান সৌদি রাজবংশকে উৎখাত করতে পারে, তখন একটা আশঙ্কা সৌদি রাজপরিবারে তৈরি হয়েছিল। ইরানের এ ভূমিকাকে সৌদি যেমন পছন্দ করছে না, ঠিক তেমনই পছন্দ করছে না যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলও। ফলে এ অঞ্চলে সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল একটি অলিখিত অ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে ইরানের বিরুদ্ধে। ইরানি বিক্ষোভ এখন ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তিকেও প্রশ্নের মুখে রাখল। এ চুক্তির ভবিষ্যৎ কী, তা-ও এখন বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে। বলা ভালো, গত জানুয়ারিতে (২০১৭) ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এ পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিটি তখন থেকেই প্রশ্নের মুখে আছে। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ইরান চুক্তিটি ঠিকঠাক মানছে না। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি এটা নিশ্চিত করেছিলেন ওই চুক্তিটি তিনি মানবেন না। এরই ধারাবাহিকতায় তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ২১ মে রিয়াদে তিনি যখন আরব-আমেরিকান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, তখনও তিনি তার এ ইরানবিরোধী মনোভাব আবারও স্পষ্ট করেছিলেন। রিয়াদে তিনি বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সন্ত্রাস ছাড়ানোর জন্য ইরান দায়ী! ফলে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির যে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা তখন থেকেই বড় প্রশ্নের মুখে আছে। বলা ভালো, ওই সমঝোতা চুক্তিতে (২০১৫) ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এতে দেখা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারবে না। তাদের পরমাণু কেন্দ্রে চলবে নজরদারি। অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে এবং তেহরান শর্ত ভাঙলে ৬৫ দিনের মধ্যে ফের কিছু নিষেধাজ্ঞা বহাল হবে। একই সঙ্গে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে কতটা এগিয়েছে, তা তদন্ত করবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ। ফের আইএইএ ইরানবিরোধী হলে তা মেটাবে একটি সালিশি বোর্ড। এ চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইরানের যে সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল, তা ইরানকে ফেরত দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আংশিক প্রত্যাহার করার ফলে ইরান তার যাত্রীবাহী বিমান সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১০ বছর পর ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আরও গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ করতে পারবে। কিন্তু এরপরও নিষেধাজ্ঞা ছিল।
নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের রাজনীতির জন্য ওই চুক্তিটি উত্তেজনা হ্রাস করতে সাহায্য করার কথা। ওবামা প্রশাসনের ওপর ইসরাইলি প্রশাসনের প্রচ- একটা ‘চাপ’ থাকা সত্ত্বেও ওবামা প্রশাসন এ ধরনের শর্তে রাজি হয়েছিল। ফলে আলোচনায় বাকি বৃহৎ শক্তিগুলোও রাজি হয়েছিল। ওবামার জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট ছিলÑ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টার এবং প্রায় ১০০ জন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক ওবামাকে সমর্থন। কংগ্রেস সদস্যদের বিরোধিতার মুখেও তিনি এ সমঝোতাকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তী সময়ে ১১টি ইরানি কোম্পানি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ইরানবিরোধী একটা অবস্থান নিয়েছেন। সৌদি আরবের সঙ্গে প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলারের একটি আন্তঃচুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। রিয়াদ ঘোষণায় ৩৪ হাজার সেনাবাহিনীর একটি বাহিনী গঠনের কথাও বলা হয়েছিল। ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আংশিক উঠে গিয়েছিল; কিন্তু নতুন করে নিষেধাজ্ঞা ও মানবাধিকার সম্পর্কিত অভিযোগ রয়েছে। ইরানের অবস্থা অনেকটা ফাঁদে পড়ার মতো। ইরান পুরোপুরিভাবে ‘মুক্ত’ হচ্ছে না! নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক প্রশ্নের মুখে আছে। বলতে দ্বিধা নেই, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরিভাবে উঠে গেলে ইরান এ অঞ্চলে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, যা ইসরাইল ও সৌদি আরব কারোই পছন্দ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অন্যতম ফ্যাক্টর হচ্ছে ইসরাইল। পারমাণবিক চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটা একটা ঐতিহাসিক ভুল।’ ইসরাইলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ চুক্তির কোনো কোনো ধারা নিয়ে সমালোচনাও করেছেন। ফলে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার ওই চুক্তির প্রশংসা এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এ চুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছেÑ এ অভিযোগ তুলে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির কর্মসূচি বাতিল করার দাবিসংবলিত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর অন্তত এ সংক্রান্ত আরও ছয়টি প্রস্তাব পরে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং ইরান ওই কর্মসূচি বাতিল না করায় ২০১০ সালে জাতিসংঘ ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার সম্পদ জব্দসহ দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। উল্লেখ্য, ২০০৬ সাল থেকেই ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি) আলোচনা চলে আসছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি বিজয়ী হলে পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। ফলে এ ছয় জাতি আলোচনা আরও গতি পায়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং এপ্রিলে (২০১৫) সুইজারল্যান্ডের লুজানে একটি খসড়া চুক্তিতে ইরান ও ছয় জাতি উপনীত হয়। ওই বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এ খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। জুলাই (২০১৫) মাসে খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অন্তত একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছিল; আর তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ সম্পর্ক আরও উন্নত করার প্রয়োজন ছিল। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে, প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে এখনও ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর দীর্ঘ ৪৪৪ দিন রেভোল্যুশনারি স্টুডেন্টস কর্তৃক তেহরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেওয়ার ঘটনার স্মৃতি একটি ‘ক্ষতচিহ্ন’ হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনাটা অত সহজ ছিল না। এরপর যোগ হয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ওই ঘটনার দীর্ঘ ৩৬ বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এ দেশ দুটিকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। এর ফলশ্রুতিতেই ওই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’ ইসরাইলের আপত্তি সত্ত্বেও। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় জঙ্গিবাদী রাজনীতি উত্থানেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে তাদের ইরানের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, গেল নভেম্বর মাসে (২০১৪) বারাক ওবামা স্বীকার করেছিলেন, তিনি গোপনে ইরানি সমর্থন চেয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। প্রত্যুত্তরে খামেনিও তাকে একটি গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আইএস (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গিদের ঠেকাতে ওবামা খামেনির সমর্থন চেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইয়েমেনে ‘হুথি বিদ্রোহ’ প্রমাণ করেছিল, সেখানেও একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনে ইরানের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। কেননা হুথিরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ আছে, হুথি বিদ্রোহীরা ইরান থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকেÑ যদিও ইরান বারবার তা অস্বীকার করে আসছে। ২০১৫ সালের পর কেটে গেছে আরও দুবছর। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসেনি; বরং নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। ইরানে সাম্প্রতিক যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা নতুন একটি মাত্রা। এ বিক্ষোভ বা অসন্তোষ শেষ পর্যায়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, বলা মুশকিল। তবে ইরান সরকারকে কোনো গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করা যাবে না। সরকারের পেছনে জনসমর্থন যেমন আছে, ঠিক তেমনই সরকাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে রেভোল্যুশনারি গার্ড। সুতরাং সরকার উৎখাতের কাজটি খুব সহজ হবে না। তবে এটা সত্য, ইরানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। কিছু পরিসংখ্যান দিই। ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার সময় (২০০৬ থেকে ২০১৫) অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ২০১৫ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৪ ভাগ। কিন্তু অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর (২০১৬) জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৩ ভাগে। কিন্তু ২০১৭-১৮ সালে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২ ভাগে। মুদ্রাস্ফীতি ২০১৩ সালে ছিল ৩১ ভাগ। ইরানি মুদ্রার (রিয়াল) মান কমে গিয়েছিল শতকরা ৪৫০ ভাগ। ২০১৬ সালে মুদ্রাস্ফীতি অবশ্য কমে এসে দাঁড়ায় ১১ ভাগে। ইরানি জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক, যাদের বয়স ৩০-এর নিচে, এদের মাঝে বেকারত্বের হার শতকরা ২৬ দশমিক ৭ ভাগ। বিশ্বব্যাংকের মতে, দারিদ্র্য ২০০৯ থেকে ২০১৩ সময়সীমায় শতকরা ৮ ভাগ হারে হ্রাস পায়। কিন্তু ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ১০ দশমিক ৫ ভাগ হারে। ৮২ লাখ মানুষের প্রতিদিনের আয় ৫ দশমিক ৫০ ডলারের নিচে (২০১৪)। আর শতকরা ২ ভাগ মানুষ জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১ দশমিক ৯০ ডলারের নিচে নিত্যদিন আয় করে। ফলে এ অর্থনৈতিক দুরবস্থা যে বর্তমান বিক্ষোভের জন্য দায়ী, তা অস্বীকার করা যাবে না। পরিস্থিতি এখন যেদিকেই যাক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য ইরানে স্থিতিশীলতা জরুরি। এই স্থিতিশীলতা যদি বিঘিœত হয়, তাহলে তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে যাবে। এতে জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরও উৎসাহিত হবে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এখনও উত্তপ্ত। ইরানের বিক্ষোভ তাতে নতুন একটি মাত্রা যোগ করল। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইরানে সরকার পরিবর্তনের ডাক দেয়নি সত্য; কিন্তু রাশিয়া এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। তুরস্কও যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে। সব মিলিয়ে ইরানের বর্তমান পরিস্থিতি ইরানকে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। বেশ কিছুদিন ইরান আলোচনায় থাকবে বলেই আমার ধারণা।
Daily Alokito  Bangladesh
7.1.2018

আস্থার সম্পর্ক ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হয় না

বছরের শুরুতেই রাজনীতির মাঠ জমজমাট। আকার-ইঙ্গিতে সরকারের মন্ত্রীরা জানিয়ে দিয়েছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য অনেক আগে থেকেই নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে শুরু করে দিয়েছেন। যশোরের জনসভায় তিনি আবারও নৌকার পক্ষে ভোট চাইলেন ৩১ ডিসেম্বর। সক্রিয় হয়েছেন খালেদা জিয়াও। ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে ২ জানুয়ারি তিনি বলেছেন, সরকার চাইলেও নির্বাচনের বাইরে রাখতে পারবে না বিএনপিকে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যখন নানা হিসাব-নিকাশ চলছে, ঠিক তখনই খালেদা জিয়ার এ মন্তব্য বিএনপির নেতাকর্মীদের আশাবাদী করবে নিঃসন্দেহে।
চলতি বছর নির্বাচনী বছর। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনসহ রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে চলতি বছরটি থাকবে নির্বাচনী আমেজে ভরা। রাজনীতি আবর্তিত হবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। তাই ইতিমধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন, অনেকগুলো সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। কেমন হবে এ নির্বাচন, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে কিনা, জাতীয় পার্টির ভূমিকাই বা কী হবে- এসব বিষয় নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই।
জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে তৃতীয় শক্তি। সর্বশেষ রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিপুল বিজয় জাতীয় পার্টিকে আবারও আলোচনার পাদপ্রদীপে নিয়ে এসেছে। জাতীয় পার্টি আগামীতে সরকারে থাকবে, নাকি বিরোধী দলে থাকবে- এ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। জাতীয় পার্টি প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, অতীতে কোনো সরকারই জাতীয় পার্টির প্রতি সদয় আচরণ করেনি। জাতীয় পার্টি সরকারে থাকলেও তিনি সরকারের অনেক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। সুতরাং একটা প্রশ্ন উঠবেই- একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কিংবা পরে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে? জাতীয় পার্টি কি সরকারে থাকবে? নাকি বিরোধী দলে থাকবে? জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটাও দেখার বিষয়। সরকারে যোগ দিলেও জাতীয় পার্টি ১৪ দলীয় জোটে নেই। সঙ্গত কারণেই তাই প্রশ্ন উঠবে- জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তি কী হবে?
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, রসিক নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় পার্টির নেতা ও কর্মীদের উজ্জীবিত করেছে। ইসির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য এটা একটি প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এর মধ্যে কি বড় কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়েছে? এর জবাব সম্ভবত না-বাচক। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসেনি। রসিক নির্বাচনের পর ৫৬টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সেসব নির্বাচন ভালো হয়নি। রাতে কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপারে সিল মারা, ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেয়া- এই যে সংস্কৃতি, এ সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটা হবে মূল সমস্যা।
এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ন্যূনতম ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সফলতা আসবে না। প্রসঙ্গক্রমে রসিক নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। এই নির্বাচনটি ভালো হয়েছে। সত্যিকার অর্থেই এটাকে ভালো বলা যায়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বিজয়ী হয়েছেন। হেরে গেছেন সদ্য বিদায়ী মেয়র সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু, যিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন এবং প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে তার অবস্থান তৃতীয়।
এই নির্বাচনে ব্যক্তি মোস্তাফিজার রহমান বিজয়ী হয়েছেন বটে, তবে ‘বিজয়ী’ হয়েছে নির্বাচন কমিশনও। তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারল। নির্বাচন কমিশন নিয়ে যে গুজব, শঙ্কা ছিল- রংপুরে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করে তারা তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। তাদের ওপর মানুষের আস্থা এখন আরও বাড়বে। তবে তাদের যেতে হবে অনেক দূর। নির্বাচন কমিশন যদি রসিক নির্বাচন নিয়ে অতিরিক্ত আস্থাশীল হয়ে ওঠে, তাহলে তারা ভুল করবে। তাদের কাজ এখনও অনেক বাকি। জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন আয়োজনের ‘কঠিন’ কাজটি তাদের সম্পন্ন করতে হবে।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর এখন রসিক নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হল। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন একটি ধন্যবাদ পেতেই পারে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হল- এই নির্বাচন কি কোনো বার্তা দিয়ে গেল? রসিক নির্বাচন স্থানীয় সরকারের একটি নির্বাচন। সাধারণত স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা, প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজ নির্বাচনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অতীতে অন্তত দুটি নির্বাচনে- নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজ তাদের বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল। অর্থাৎ একজন ভালো, সৎ এবং গণমানুষের সঙ্গে যার সম্পর্ক রয়েছে- এমন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলে তিনি নির্বাচনে ভালো করেন এবং বিজয়ী হন। আইভি ও সাক্কু এর বড় প্রমাণ। এখন একই কাতারে যোগ দিলেন মোস্তফা। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি একটি মেসেজ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা এ মেসেজটি ধারণ করতে পারেন।
মূলকথা হচ্ছে, আমরা একটি ভালো জাতীয় নির্বাচন চাই। আর ভালো নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন সব দলের অংশগ্রহণ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য খুব ভালো খবর নয়। সরকারের জন্যও এটি কোনো ভালো কিছু বয়ে আনবে না। আরও একটি কথা। সিলমারা কিংবা ভোট কেন্দ্র দখলের যে সংস্কৃতি আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করে আসছি কিংবা বিরোধী দলের প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেয়ার যে ‘রাজনীতি’ আমরা দেখেছি, এই প্রবণতা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায়।
এ ক্ষেত্রে ইসির করণীয় আছে। ইসি এ ক্ষেত্রে বেশ কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। যেমন, স্থানীয়ভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি একটি ‘পর্যবেক্ষক টিম’ গঠন করতে পারে, যাদের কাজ হবে নির্বাচন কেন্দ্রগুলো মনিটর করা এবং সরাসরি কেন্দ্রে রিপোর্ট করা। মিডিয়ার মাধ্যমে যেখান থেকেই জাল ভোট, কেন্দ্র দখলের খবর আসবে- সেখানে ওই কেন্দ্র নয়, বরং পুরো নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা। মনোনয়নপত্র একই সঙ্গে স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ে গ্রহণ করা। এতে করে প্রার্থীর পক্ষে একাধিক জায়গায় মনোনয়নপত্র জমা দেয়া যাবে। মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেয়ার খবর এলে ওই এলাকার নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। সংসদ নির্বাচনে ভোট গণনায় যদি প্রার্থীরা সমানসংখ্যক ভোট পান, তাহলে লটারির পরিবর্তে সেখানে পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং কোনো প্রার্থী যদি ৫০ ভাগের নিচে ভোট পেয়ে বিজয়ী হন, তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা যাবে না। সেখানেও পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের নিয়ম আছে। সংসদ সদস্যের যোগ্যতার প্রশ্নে ন্যূনতম যোগ্যতা ‘যুগোপযোগী’ হওয়া উচিত। দেশে উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে। যারা দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন, তারা যদি ‘শিক্ষিত’ না হন- তাহলে সঠিক ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করবেন কীভাবে? এতে করে সংসদ সদস্যরা বেশি মাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে আছেন। আমলারা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন। বর্তমান আইনে সুবিধাবাদী ও ধান্দাবাজ ঊর্ধ্বতন আমলা, সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা অবসরের তিন বছর পর নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। এটা একটি দুর্বল আইন। এটা পরিবর্তন করে ন্যূনতম ৫ বছর করা প্রয়োজন। অর্থাৎ একজন আমলা ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যাবেন এবং ৬৫ বছর বয়সে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে শর্ত থাকবে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ওই সংসদীয় এলাকায় দল তাকে মনোনয়ন দেবে। এটা না হলে দেখা যাবে, সুযোগসন্ধানী আমলারা সচিবালয়ে থাকাকালীন মন্ত্রণালয়ের প্রভাব খাটিয়ে তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। এতে পরোক্ষভাবে সরকারকে ব্যবহার করা হবে। পাঁচ বছরের একটি গ্যাপ থাকলে এ কাজটি তিনি করতে পারবেন না।
এখন সময় এসেছে নির্বাচন কমিশনের এটা প্রমাণ করার যে, তারা সত্যি সত্যিই ‘স্বাধীন’। বেশ ক’জন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, একাধিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক বলার চেষ্টা করছেন, নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে। না হলে যে ‘বির্তক’ নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার যাত্রা শুরু করেছিল, সেই ‘বিতর্ক’ আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। আমাদের সংবিধানের ১১৮(৪) ধারায়ও স্পষ্ট করে বলা আছে- ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন’ এবং সংবিধানের ১২৬-এ বলা আছে- ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’
এটাই হচ্ছে আসল কথা। নির্বাচনের তিন মাস আগে সব প্রশাসন চলে যায় নির্বাচন কমিশনের হাতে। অর্থাৎ ডিসি, এসপি, ওসিরা থাকেন নির্বাচন কমিশনের আওতায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা কী বলে? জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা থাকেন জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন নয়। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে, আর জেলা প্রশাসকরা ‘নিয়ন্ত্রিত’ হন মন্ত্রণালয় থেকে। এ পরিস্থিতিতে প্রায় ক্ষেত্রেই সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রতিফলিত হয়।
আমরা চাই, জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে- এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তাই সঙ্গত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয়, এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। সেই ‘দায়িত্ব’ সিইসি কীভাবে পালন করেন, আমরা তা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। তবে একটা বিষয়ে বোধহয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহু মন্ত্রী বারবার বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যে সরকার থাকবে, তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকারপ্রধান থাকলে সেই সরকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিএনপি সেই প্রশ্নই তুলেছে।
এটা ঠিক, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ওই সরকারে যোগ দেয়নি। কিন্তু ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কি বিএনপিকে সেরকম একটি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে? সেটা কীভাবে সম্ভব? ২০১৪ সালে বিএনপি সংসদে ছিল। কিন্তু এখন তো তারা সংসদে নেই। তাহলে মন্ত্রিসভায় বিএনপি অন্তর্ভুক্ত হবে কীভাবে? বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিএনপি একটি ফ্যাক্টর। বিএনপিকে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। বিএনপি বড় দল। জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এ দলটির প্রতি। বিগত নির্বাচনগুলোর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব, ৩২ থেকে ৩৬ ভাগ জনগণের সমর্থন রয়েছে দলটির প্রতি। সুতরাং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দলটিকে নিয়ে আসতে হবে। এতে করে একদিকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়বে, তেমনি ক্ষমতাসীন দলও উপকৃত হবে। গণতন্ত্রের জন্য দুটি বড় দলের মাঝে (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) ‘অস্থার সম্পর্ক’ থাকা দরকার। তা না হলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না।
চলতি বছরটি শুরু হল অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। পাশাপাশি মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে নতুন বছর যাত্রা শুরু করল, যদিও এতে চমক নেই তেমন একটা। বিতর্কিত মন্ত্রীরা সবাই রয়ে গেছেন। ধারণা করছি, বর্তমান মন্ত্রিসভা নিয়েই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে যাবেন। এ ক্ষেত্রে নবনিযুক্ত মন্ত্রীরা তাদের ‘যোগ্যতা’ দেখানোর সুযোগ পাবেন কম। যেহেতু চলতি বছরই ‘নির্বাচনী বছর’, তাই আমরা আশা করব ন্যূনতম ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ‘ঐক্য’ প্রতিষ্ঠিত হবে, রাজনৈতিক দলগুলো সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলবে না; নেতারা পরস্পর আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকবেন এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করবেন। নতুন বছরে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
Daily Jugantor
5.1.2018