রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

http://www.alokitobangladesh.com/epaper/pages/get_image/65969

উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে কেন গুরুত্ব দিতে হবে


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুটান সফরের পর উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা আরো শক্তিশালী হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর এবং এর পরপরই ভুটান সফর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় যে যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছিল তার ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই অনুচ্ছেদে ভুটান, বাংলাদেশ আর ভারতের সমন্বয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের পর যে ২৬ দফা যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে পারস্পরিক স্বার্থে বিদ্যুৎ ও পানিসম্পদ খাতে সহযোগিতা জোরদারে দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিকভাবে কাজ করার ব্যাপারে দুই দেশ সম্মত হয়েছিল। বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের নেতারা পরবর্তী সময়ে কোনো উপলক্ষে একত্রিত হলে সেখানেই ত্রিদেশীয় সহযোগিতায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বাংলাদেশের প্রচণ্ড জ্বালানি চাহিদা রয়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হবে। বাংলাদেশকে বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ (বা এলডিসি) হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন গতিধারার কারণে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আংকটাড মনে করে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে উন্নয়নশীল দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আংকটাডের এলডিসি রিপোর্ট ২০১৬ সালে এ কথা প্রাক্কলন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০১৮ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে বের হয়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। ২০২১ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে বের হওয়ার জন্য যে তিনটি বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়, তা সন্তোষজনকভাবে বজায় রাখতে সক্ষম হবে দেশটি। ফলে খুব সংগত কারণেই বাংলাদেশকে তার উন্নয়নের গতিধারা ধরে রাখতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন হবে বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুতের চাহিদা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে মেটাতে পারছে না। প্রয়োজন বিদ্যুৎ আমদানির তথা যৌথভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে আমরা সেই বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারি। এ জন্যই প্রধানমন্ত্রী ভারত ও ভুটান সফরের সময় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার জন্ম হয়। বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা হচ্ছে নয়া বিশ্বব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা যেখানে কমে এসেছিল, সেখানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিতে দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে দেশগুলো এমন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, যা কিনা নয়া বিশ্বব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। একুশ শতকে এসে সেই ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। জন্ম হয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি নতুন, কিন্তু এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বিপুল এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা মূলত গড়ে ওঠে পাশাপাশি দুটি বা তিনটি রাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে। সেখানে পুরো রাষ্ট্রটি জড়িত থাকে না, জড়িত থাকে কিছু অঞ্চল। আর অঞ্চল ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশ সার্ক কিংবা বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় জড়িত থাকলেও বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএমের মতো উপ-আঞ্চলিক সংস্থায় নিজেকে জড়িত করেছে। বিবিআইএন (BBIN) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা প্রথম জানা যায় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ ঘোষণাপত্রটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ৪১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে উভয় প্রধানমন্ত্রী বিবিআইএনের আওতায় বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি খাতে সহযোগিতার সুযোগ কাজে লাগাতে সম্মত হয়েছেন। এই বিবিআইএন হচ্ছে ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা বাস সার্ভিস। যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিসও চালু হবে। কলকাতা-খুলনার মধ্যে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনও এরই মধ্যে চালু হয়েছে। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহনে এখন এই সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এর সবই হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। গত ১৫ জুন (২০১৫) বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর ভুটানের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে এ চারটি দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের সময় ভুটান এতে রাজি হয়েছে। কেননা, ভুটানের সংসদ আপত্তি তুলেছিল। সংসদে তা অনুমোদিত হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমে আমরা প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোট নিয়েও আলোচনা করতে পারি। বিসিআইএম (BCIM) হচ্ছে অন্য একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই জোটে আছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাত বোন রাজ্যগুলো) ও মিয়ানমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তাঁর চীন সফরের সময় এই বিসিআইএম করিডরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটিকে একসময় ‘কুনমিং উদ্যোগ’ বলা হতো। চীন ২০০৩ সালে এ ধরনের একটি সহযোগিতার কথা প্রথম বলেছিল, যা পরবর্তী সময়ে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই জোটটি কার্যকর হলে কুনমিং (চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। এর ফলে চীনা পণ্যের দাম কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে আসিয়ানে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার, যার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। বিসিআইএম জোটের সম্ভাবনা বিশাল। কারণ এই চারটি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহূত জমি (মিয়ানমার) ও সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে ভবিষ্যতে, যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে এই জোট। বলাই বাহুল্য, এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ শতাংশ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলারে। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ২৮৮ কোটি মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশে। পূর্বে কুনমিং আর পশ্চিমে কলকাতা। মাঝখানে মিয়ানমারের মিন্দানাও ও ঢাকা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে এতে করে ভবিষ্যতে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়া সহজ হয় এবং তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ানের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। আমরাও এ সুযোগটি নিতে পারি।
কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। বিবিআইএন জোট যদি সফল হয়, তাহলে জোটভুক্ত চারটি দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে। সিলেট হয়ে উঠতে পারে অন্যতম একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। একই কথা প্রযোজ্য বিসিআইএমের ক্ষেত্রেও। সড়কপথ যদি প্রশস্ত হয়, যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ তথা কৃষি ও মত্স্যসম্পদ ব্যবহার করে তা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে আমাদের অর্থনীতিতে। তাই কানেকটিভি ব্যবহার করতে হবে আমাদের সবার স্বার্থে। আমরা দেখতে চাই আমাদের স্বার্থ। কানেকটিভিটি ব্যবহার করে কোনো একটি দেশ লাভবান হবে, তা হতে পারে না। আমরাও চাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করে আমাদের পণ্য নেপাল ও ভুটান যাক। সড়কপথে আমরা যেতে চাই কুনমিংয়ে। কিন্তু এ জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা যদি গড়ে ওঠে, তাহলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে—এটি বলার আর অপেক্ষা রাখে না। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে একটি বড় সমস্যা ভারতকে নিয়ে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এখন পুরোপুরিভাবে দ্বিপক্ষীয়তার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অর্থাৎ ভারত উন্নয়ন ও সম্পর্ক রক্ষা করে দ্বিপক্ষীয়তার আলোকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে কিংবা নেপালের সঙ্গে ভারতের যে সমস্যা, তা ভারত সমাধান করতে চায় দ্বিপক্ষীয়তার আলোকে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুপক্ষীয়তা। বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএম বহুপক্ষীয়তার আলোকেই রচিত। ভারত এতে এখন সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু এর পূর্ণ বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে যখন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশের সমস্যা এই মুহূর্তে দুটি। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এই সমস্যা দুটির সমাধান সম্ভব। এই সমস্যা দুটি হচ্ছে পানি ও জ্বালানি। জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থাৎ বিবিআইএনের আলোকে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে এ অঞ্চলে। ভুটান ও নেপালে বিপুল জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এ খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও ভারতের সম্মতি পাওয়া না গেলে তা বাংলাদেশে আনা যাবে না। সুতরাং বাংলাদেশের বিনিয়োগ তখনই কাজে লাগবে যখন উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বাংলাদেশে আসবে। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত এ ব্যাপারে রাজি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী গত ২২ এপ্রিল ঢাকায় বিমসটেক সচিবালয়ে বিমসটেক নেটওয়ার্ক অব পলিসি থিংক ট্যাংকসের (বিএনপিটিটি) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার যথেষ্ট ভবিষ্যৎ রয়েছে। তিনি বিমসটেকের পাশাপাশি বিবিআইএন ও বিসিআইএমের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গড়ার কথা বলেন (কালের কণ্ঠ, ২৩ এপ্রিল)। এটিই হচ্ছে আসল কথা। সার্ক এখন অকার্যকর। শেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। একসময় সার্ক যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল, তা ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকেই আমাদের উন্নয়ন ও প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
Daily  Kalerkontho
30.04.2017

কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধ কি আসন্ন?



বিশ্ব কি দ্বিতীয় আরেকটি ‘কোরীয় যুদ্ধ’ প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে? এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন ইউএসএস মিশিগানের উপস্থিতি, জাপান সাগরে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস কার্ল ভিনসন মোতায়েন, আর গত ২৬ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী THAAD (Terminal High Altitude Area Defense) মোতায়েনের পর জল্পনাকল্পনা বেড়েছে, যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ায় অভিযান পরিচালনা করতে পারে! যদিও বিষয়টি অত সহজ নয়। যে কোনো সামরিক অভিযান এ অঞ্চলে পারমাণবিক যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। ইতিমধ্যেই উত্তর কোরিয়ার দেশরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল পার্ক ইয়ং সিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘উসকানিতে’ এ অঞ্চলে পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে বলে হুমকি দিয়েছেন। উত্তর কোরিয়া সীমান্তবর্তী উনসান শহরে বড় ধরনের সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছে। সব মিলিয়ে একটা টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে এ অঞ্চলে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বুধবার হোয়াইট হাউসে সিনেট সদস্যদের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফলে একদিকে উত্তর কোরিয়ার হুমকি, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমরসজ্জা- সব মিলিয়ে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে কোরীয় উপদ্বীপ অঞ্চলে।

ট্রাম্প তার দায়িত্ব গ্রহণের একশ’ দিনের মাথায় এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন। যুদ্ধ না আলোচনা কোনটি বেছে নেবেন তিনি এখন? এখানে বলা ভালো, এ অঞ্চলে আবার যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়বে প্রতিটি দেশে। প্রথম কোরীয় যুদ্ধে (১৯৫০-৫৩) দক্ষিণ কোরিয়ার ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪০৫ জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর উত্তর কোরিয়ায় প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৩। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। মার্কিন নাগরিকের মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার ৫৭৪। চীন ছিল উত্তর কোরিয়ার পক্ষে। চীনা নাগরিক মারা গিয়েছিল ১ লাখ ৫২ হাজার। ৬৭ বছর পর নতুন করে যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর ফলে মৃতের সংখ্যাও বাড়তে পারে। চীন সব পক্ষকে সংযত আচরণ করতে বলেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কোনো ডেমোক্রেটদলীয় কংগ্রেস সদস্যও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘ঠাণ্ডা মাথায়’ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই দেশটি রয়েছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে ৮ম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর পর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। তখন থেকেই আলোচনা শুরু হয় কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা সম্ভব। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী দেশটি অবিলম্বে তার ইয়ংবাইওনের (ণড়হমনুড়হ) পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা উত্তর কোরিয়া ৬ থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এর পর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া সফর করেন এবং সেখানে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক গ্রাম পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এটি ছিল এ অঞ্চলের গত ৫৩ বছরের রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে দুই কোরিয়ার নেতারা আর কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি।

স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা এবং দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনঃএকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে ‘দুই কোরিয়ার পুনঃএকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার’ জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।

কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া ছিল চীন ও জাপানের উপনিবেশ। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে এবং জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দু’ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী এবং অপর অংশে সোভিয়েত বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেঁধে যায়। জাতিসংঘ এ যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সেন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় দু’বছর পর, ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এর পর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে।

১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি বলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গত ৭০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে দু’বার- ১৯৯৪ সালে কিম উল সুং-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। এর পর দীর্ঘদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ২০১১ সালে তার ছোট সন্তান কিম জং উনকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে নানা কারণে উন বিতর্কিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তার আস্থা কম। প্রচলিত আইনকানুন তিনি মানেন না। কিছুটা খ্যাপাটে স্বভাবের মানুষ তিনি। বালকসুলভ চেহারা। ধারণা করা হয় মধ্য ত্রিশের ঘরে তার বয়স। কিন্তু প্রচণ্ড হিংস্র প্রকৃতির তিনি। নিজের সৎ ভাইকে পর্যন্ত ‘খুন’ করতে দ্বিধা করেননি। এমনকি তাকে পরিপূর্ণ সম্মান না দেয়ায় সিনিয়র জেনারেল ও দেশরক্ষা মন্ত্রীকে পর্যন্ত ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠিয়েছিলেন তিনি। সুতরাং পশ্চিমা বিশ্ব তার সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রশ্নে আলোচনা করলে কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এমনকি দুই কোরিয়ার মধ্যে পুনঃএকত্রীকরণের আলোচনার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, এটা এক ধরনের ‘প্রক্সি ওয়ার’। এই ‘প্রক্সি ওয়ারে’ একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মার্কিন যুদ্ধজাহাজ যখন কোরীয় উপদ্বীপের আশপাশে অবস্থান করছে ঠিক তখনই উত্তর কোরীয় সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেছে রাশিয়া। লন্ডনের ডেইলি মেইল জানিয়েছে, পুতিনের আশঙ্কা যদি ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালান, তাহলে দেশটির নাগরিকদের একটা বিশাল অংশ শরণার্থী হয়ে রাশিয়ায় ঢুকে পড়তে পারে। এর আগে চীন তার উত্তর কোরীয় সীমান্তে ১ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছিল। এর অর্থ হচ্ছে, শরণার্থী ঠেকাতে চীন ও রাশিয়া তাদের নিজ নিজ সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করলেও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি একটি ‘হুমকি’; অর্থাৎ যুদ্ধ যদি শুরু হয়, তাহলে তারা উত্তর কোরিয়ার পক্ষেই দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যে নিন্দা প্রস্তাব এনেছিল, রাশিয়া তাতে ভেটো দিয়েছে। বলা ভালো, এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র

পরীক্ষা চালিয়েছে।

কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সিউল সফরের পরও দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা সংকট কাটেনি। এদিকে একদল মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘মানসিক রোগী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বস্তুত একজন ব্যক্তি (ডোনাল্ড ট্রাম্প) যখন গত ১২ এপ্রিল মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াল স্ট্রিটের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সমগ্র কোরিয়াকে চীনের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেন, তখন ইতিহাস সম্পর্কে তার অজ্ঞতার চেয়ে তার মানসিক সুস্থতার বিষয়টিই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনও অনেকটা একই মানসিকতার মানুষ। ফলে তাদের দু’জনের কারণে কোরীয় উপদ্বীপে যে কোনো সময় ‘যুদ্ধ’ শুরু হয়ে যেতে পারে! ভয়টা হচ্ছে, ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের উন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই দক্ষিণ কোরিয়ায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। চীন উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও চীনের সংযত আচরণের আহ্বান কিম জং উন কতটা শুনবেন, সেটিও একটা প্রশ্ন। অতীতে উত্তর কোরিয়া যুক্তি দেখিয়েছিল, তাদের পারমাণবিক প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে জ্বালানির চাহিদা মেটানো। সেক্ষেত্রে পশ্চিম বিশ্ব উত্তর কোরিয়াকে অতিরিক্ত জ্বালানি সরবরাহ করেছিল। খাদ্যশস্য সরবরাহ করেছিল। এরপর উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের জন্য খুলে দিয়েছিল। এখন তেমনই একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে হয়তো। পশ্চিমা বিশ্ব যদি আবার খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহের আশ্বাস দেয়, আমার ধারণা, সেক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচি ‘আপাতত’ পরিত্যাগ করতে পারে!

কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। এমনিতেই উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রটির বহির্বিশ্বে তেমন কোনো মর্যাদা নেই (বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা হ্যাকিংয়ে উত্তর কোরিয়ার নাম এসেছে)। রাষ্ট্রটিকে Sopranos State হিসেবে উল্লেখ করা হয় (দেখুন, Sheena Chestnut, International Security, 23 July 2007)। উল্লেখ্য, যে রাষ্ট্র ও শাসকবর্গ ক্রিমিনাল তৎপরতার সঙ্গে জড়িত, তাদের Sopranos State হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর অর্থ হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া একটি মর্যাদাহীন রাষ্ট্র। তাকে যদি আরও ‘চাপের’ মধ্যে রাখা হয়, তাহলে দেশটি আরও অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। এখন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় THAAD মোতায়েন করেছে (একটি ‘থাড’ ব্যাটারি স্থাপনের ব্যয় ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার)। সঙ্গত কারণেই উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপ্তি বাড়াবে। ফলে আপাতত যদি উত্তেজনা হ্রাসও পায়, এক ধরনের আস্থাহীনতার সংকট থেকে যাবে। তাই উত্তর কোরিয়াকে চাপে না রেখে বরং আলোচনার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান করা মঙ্গলজনক। একইসঙ্গে মার্কিন সাবমেরিন ইউএসএস মিশিগান ও বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ কার্ল ভিনসনকে যদি প্রত্যাহার করে না নেয়া হয়, তাহলেও আস্থা ফিরে আসবে না। যুদ্ধ যে কোনো সমাধান নয়, এ উপলব্ধিটুকু যদি উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের মধ্যে থাকে, তাহলে তা সবার জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে।
Daily Jugantor
28.04.2017
 

কোরীয় উপদ্বীপের উত্তেজনার কি আদৌ অবসান ঘটবে


প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে কোরীয় উপদ্বীপে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখা অব্যাহত রেখেছে। মঙ্গলবার উত্তর কোরিয়া তার সেনাবাহিনীর ৮৫তম জন্মবার্ষিকী পালন করেছে। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে টানটান উত্তেজনা ছিল। বলা হয়েছিল, উত্তর কোরিয়া এদিন ৬ষ্ঠ পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাবে! কিন্তু উত্তর কোরিয়া তা করেনি। কিন্তু উত্তর কোরিয়াকে ‘চাপে’ রাখার জন্য বিমানবাহী জাহাজ কার্ল ভিনসনকে যুক্তরাষ্ট্র জাপান সফরে মোতায়েন করেছে। এই বহরে যোগ হয়েছে পারমাণবিক ডুবোজাহাজ ইউএসএস মিশিগান। এমনি এক পরিস্থিতিতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফোনালাপ হয়েছে। উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে দেশ দুটি একমত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এক ধরনের ‘যুদ্ধের’ মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দুটি সংবাদ আমি উল্লেখ করতে চাই। অলিভিয়া আলপারস্ট্রাইন ঙঃযবৎড়িৎফং.ড়ৎম-এ (২০ এপ্রিল) লিখেছেন, ওং ঞৎঁসঢ় ঞধশরহম টং ঃড় ডধৎ ঊাবৎুযিবৎব? অর্থাৎ ট্রাম্প কি আবারও যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যাচ্ছেন? এ ধরনের মন্তব্য আমি আরও পেয়েছি। বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে ট্রাম্প ওয়াদা করেছিলেন, তিনি আর যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো যুদ্ধে জড়াবেন না। কিন্তু উত্তর কোরিয়া ও ইরান নিয়ে তার যেসব মন্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়টি, বিখ্যাত সংবাদ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। এপ্রিল ২২-২৮ সংখ্যায় ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন হচ্ছে, ঐধহফষব রিঃয বীঃৎবসব পধৎব। ছবি আছে উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের। প্রতিবেদনের হেডিং দেখেই বোঝা যায়, কী বলতে চাচ্ছে ইকোনমিস্ট। মোদ্দা কথা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সতর্ক আচরণ করা! এটা বলা হচ্ছে এ কারণে যে, উত্তর কোরিয়ার বর্তমান নেতা উন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সংলাপ ইত্যাদি বোঝেন না অথবা বুঝতে চান না। অনেকটা ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের তিনি। যা কিছু তিনি করে বসতে পারেন। অনেকদিন ধরেই উত্তর কোরিয়া বলে আসছে, তারা ৬ষ্ঠ পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাবে। বিশ্বের ঘোষিত ৮ম পারমাণবিক ‘শক্তিধর’ দেশ হচ্ছে উত্তর কোরিয়া। ২০০৬, ২০০৯, ২০১৩ আর ২০১৬ সালে মোট ৫টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় উত্তর কোরিয়া। গত ১২ এপ্রিল উন তার দাদা ও উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কিম উল সুং-এর ১০৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ব্যাপক সমরসজ্জার প্রদর্শন করেন। এর পরই শুরু হয় উত্তেজনা, যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে।
উনের মতোই চরিত্র অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের। তিনি যা বোঝেন তাই করেন। অতীতে যা বলেছিলেন, এখন তাতে পরিবর্তন আনছেন। ট্রাম্পের অতিসাম্প্রতিক কিছু ভূমিকা নতুন করে একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র কী আবারও ‘বিশ্ব পুলিশের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে? দায়িত্ব নেওয়ার আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি বৈশ্বিক রাজনীতিতে সামরিকভাবে আর যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িত করবেন না! কিন্তু সেই অবস্থান থেকে তিনি বেরিয়ে আসছেন বলে মনে হয়। ২৯ জানুয়ারি তিনি ইয়েমেনে আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৪ এপ্রিল সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর রাসায়নিক হামলায় শতাধিক বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যুর পর তিনি সিরীয় বিমানঘাঁটিতে ৫৯টি টমহক মিসাইল হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর আফগানিস্তানে ১৩ এপ্রিল ‘সব বোমার জননী’ (মাদার অব অল বম্বস, ওজন ৯.৮ টন। দৈর্ঘ্য ৯.১ মিটার। ৮.৪৮ টন এইচ ৬ বিস্ফোরক) ব্যবহৃত হয় আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে। সোমালিয়ায় আলশাবাব জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘আফ্রিকম’ সেনা কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছেন। মেসেজটি স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক উপস্থিতি বহাল রাখতে চাইছে। ফলে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে তার যে একটি ‘আগ্রাসী’ ভূমিকা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে উত্তর কোরিয়া নিয়ে একটা ‘ভয়’ও আছে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার যে কোনো ‘পরিকল্পনা’ হিতে বিপরীত হতে পারে। এ অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার হাতে রয়েছে বিশাল সমরাস্ত্র। যেখানে উত্তর কোরিয়ার হাতে রয়েছে ৯৪৪টি যুদ্ধবিমান, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার হাতে রয়েছে ১৪৫১টি, হেলিকপ্টারের সংখ্যা উত্তর কোরিয়ার ২০২টি, আর দক্ষিণ কোরিয়ার ৬৭৯টি, ট্যাংক রয়েছে উত্তর কোরিয়ার ৪২০০টি, আর দক্ষিণ কোরিয়ার ২৩৮১টি, সাবমেরিন উত্তর কোরিয়ার ৭০টি, আর দক্ষিণ কোরিয়ার ১৫টি, ফ্রিগেট উত্তর কোরিয়ার ৩টি, দক্ষিণ কোরিয়ার ১১টি। ডেস্ট্রয়ার আছে দক্ষিণ কোরিয়ার ১২টি। আর সেনাবাহিনীর সংখ্যা উত্তর কোরিয়ার যেখানে ৭ লাখ, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার ৬ লাখ ২৫ হাজার। সামরিক খাতে উত্তর কোরিয়ার বাজেট হলো ৭৫০ কোটি ডলার, আর দক্ষিণ কোরিয়ার ৩৩২০ কোটি ডলার। তুলনামূলক বিচারে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘অবস্থান’ ভালো হলেও উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জন করেছে, যা দক্ষিণ কোরিয়া এখনো পারেনি। পাঠকদের এখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের সামরিক শক্তিরও একটা তুলনা দিই। বাংলাদেশসহ কোরীয় উপদ্বীপ, জাপান, এমনকি চীনও যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের আওতায়। মোট ২৬টি দেশ এর প্রভাব বলয়ের আওতায়। বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে বাস করে। চীন, জাপান ও ভারতের মতো বড় অর্থনীতি এই কমান্ডের নিয়ন্ত্রিত এলাকার মাঝে রয়েছে। এই কমান্ডের (মোট ৬ কমান্ডের ১টি) আওতায় রয়েছে ৫টি বিমানবাহী জাহাজ, ১ লাখ ৩ হাজার মেরিন ও ১১০০ যুদ্ধবিমান। যে কোনো ‘যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের ‘অবস্থান’ যে শক্তিশালী, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। শেষ মুহূর্তে যুদ্ধ হয়তো হবে না কিংবা দ্বিতীয় আরেকটি কোরীয় যুদ্ধ হয়তো আমরা প্রত্যক্ষ করব না, কিন্তু এ অঞ্চলে উত্তেজনা থাকবেই। কিম জং উন উত্তেজনা জিইয়ে রেখে কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে চান। চীনের অবস্থানও অনেকটা তেমনিÑ উত্তর কোরিয়াকে সাহায্য করা। অতীতেও এমনটি হয়েছিল। তবে মনে রাখতে হবে, বিশ্বের ৮ম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হচ্ছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির পারমাণবিক কর্মকা-কে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তবে এটা আমাদের ভুললে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবাজ জেনারেলরা সব সময়ই যুদ্ধ চান। যুদ্ধ মানেই এক ধরনের ব্যবসা। যুদ্ধ হলে অস্ত্রের চাহিদা বাড়ে আর যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্রের ব্যবসা করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মানেই হচ্ছে যুদ্ধ অর্থনীতি। তাই ট্রাম্প যতই প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকুন না কেন, যুদ্ধে তাকে যেতেই হবে! আগামীতে অনেকগুলো ‘সম্ভাবনা’র জন্ম হচ্ছে, যেখানে যুদ্ধ শরু হয়ে যেতে পারে। এক. সিরিয়া ও ইরান, দুই. দক্ষিণ চীন সাগর তথা জাপান সাগর, তিন. ভারত মহাসাগর। তিনটি অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ছে, আর প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষভাবে হোক যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে পারমাণবিক সমঝোতা হয়েছিল, তা ট্রাম্প এখন মানতে চাইছেন না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ট্রাম্প ওই সমঝোতাটি এখন বাতিল করতে চাচ্ছেন। অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন দাবি করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার জন্য ইরান দায়ী। টিলারসনের অভিযোগÑ ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক ও লেবানন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থহানি ঘটাচ্ছে। টিলারসনের মতে, ইরানের উদ্বেগজনক এবং উস্কানিমূলক কর্মকা- সন্ত্রাস ও সহিংসতা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং ওই অঞ্চলে বিভিন্ন দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। প্রায় একই সময় সৌদি আরব সফররত মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস মন্তব্য করেছেন, ইয়েমেন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে হলে ইরানের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রভাব এড়াতে হবে। এ ধরনের বক্তব্য থেকে এটা এখন স্পষ্ট হচ্ছে যে, অচিরেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান নতুন করে এক ধরনের ‘বিতর্ক’ ও উত্তেজনায় জড়িয়ে যাবে। তাতে করে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক সমঝোতা ভেস্তে যেতে পারে! ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতি নিয়ে উৎকণ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র।
অনেকেই এটা বলার চেষ্টা করছেন যে, এটা এক ধরনের ‘প্রক্সি ওয়ার’, এই প্রক্সি ওয়ারে একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রয়েছে চীন ও রাশিয়া। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মার্কিন যুদ্ধজাহাজ যখন কোরীয় উপদ্বীপের আশপাশে অবস্থান করছে, ঠিক তখনই একটা সংবাদ এলো যে, উত্তর কোরীয় সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেছে রাশিয়া। লন্ডনের ডেইলি মেইল জানিয়েছে, পুতিনের আশঙ্কা যদি ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে দেশটির নাগরিকদের একটা বিশাল অংশ শরণার্থী হয়ে রাশিয়ায় ঢুকে পড়তে পারে। এর আগে চীন তার উত্তর কোরীয় সীমান্তে ১ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছিল। এর অর্থ হচ্ছে, শরণার্থী ঠেকাতে চীন ও রাশিয়া তাদের নিজ নিজ সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করলেও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘হুমকি’Ñ অর্থাৎ যুদ্ধ যদি শুরু হয়, তাহলে তারা উত্তর কোরিয়ার পক্ষে গিয়েই দাঁড়াবে। ইতোমধ্যে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যে নিন্দা প্রস্তাব এনেছিল, রাশিয়া তাতে ভেটো দিয়েছে। বলা ভালো, এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে।
কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা এখনো আছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সিউল সফরের পরও দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা সংকট কাটেনি। এদিকে একদল মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একজন ‘মানসিক রোগী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এমনি একজন ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন গত ১২ এপ্রিল মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াল স্টিটের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পুরো কোরিয়াকে চীনের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেন, তখন ইতিহাস সম্পর্কে তার অজ্ঞতার চেয়ে মানসিক সুস্থতাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। কিম জং উনও অনেকটা একই মানসিকতার মানুষ। ফলে এদের দুজনের কারণে কোরীয় উপদ্বীপে যে কোনো সময় ‘যুদ্ধ’ শুরু হয়ে যেতে পারে! ভয়টা হচ্ছে এখানে যে, ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের উন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই দক্ষিণ কোরিয়ায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। ফলে এই মুহূর্তে যা করণীয় তা হচ্ছে পুনরায় ৬ জাতি আলোচনা শুরু করা। প্রয়োজনে উত্তর কোরিয়াকে আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে তার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া। জাতিসংঘ এই কাজটি করতে পারে। তাতে করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা হ্রাস পেতে পারে।
Daily Amader Somoy
27.04.2017

একটি মহাসমাবেশ, একটি উক্তি ও কিছু প্রশ্ন


বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ইসলামী আন্দোলন একটি মহাসমাবেশ করেছে গত ২১ এপ্রিল। একটি জাতীয় দৈনিক ওই সমাবেশের বিশাল এক ছবিও ছেপেছে। তাতে শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যায়। ওই সমাবেশে বক্তৃতা করেন চরমোনাইর আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম। সরকার যখন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের যখন বিচার করছেন, তখন এ ধরনের এক বিশাল সমাবেশ নানা প্রশ্নের জন্ম দেয় বৈ-কি! কেননা চরমোনাইর প্রয়াত পীর ও সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীমের বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। দ্বিতীয়ত, সরকার ইসলামী আন্দোলনকে এ সমাবেশ করতে অনুমতি দিয়েছিল; কিন্তু বিএনপি চাইলেই কী তখন এ সময়ের একটি সমাবেশের অনুমতি পাবে? ইসলামী আন্দোলনের সভায় ঘোষণা দেয়া হয়েছে, রোজার আগেই সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত 'গ্রিক মূর্তি' অপসারণের। যদি অপসারণ করা না হয়, তাহলে ১৭ রমজান সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে এবং ঈদের পর সুপ্রিম কোর্ট ঘোরাও করা হবে (যুগান্তর ২২ এপ্রিল)। একইদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন কওমির ছাত্র-শিক্ষকরা জঙ্গি হতে পারে না। তিনি বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামী পার্টির জঙ্গিবিরোধী সমাবেশে বক্তৃতা করছিলেন (মানবকণ্ঠ, ২২ এপ্রিল) এ ধরনের বক্তব্যও আমার কাছে কিছুটা নতুন। কেননা একাধিক আওয়ামী লীগ তথা শরিক ১৪ দলের নেতাদের মুখ থেকে আমরা শুনেছি, কিংবা টিভি টকশোতে সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবীদের মুখ থেকেও আমরা শুনেছি যে, কাওমি মাদ্রাসাগুলো জঙ্গি তৈরির কারখানা। দু'তিনদিন আগেও (সম্ভবত ২০ এপ্রিল) ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির এক অনুষ্ঠানে সরকার সমর্থক জাসদ নেতা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেছেন মাওলানা শফী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। এর অর্থ পরিষ্কার, সরকার যখন ইসলামপন্থিদের সঙ্গে এক ধরনের 'সমাঝোতায়' গেছে, কওমি মাদ্রাসার 'দাওরায়ে হাদিস'কে যখন মাস্টার্সের সমমান হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন সরকার সমর্থকদের কেউ কেউ এর বিরোধিতা করছেন। অধ্যাপক আনোয়ারের বক্তব্য, সে কথাই প্রমাণ করে। তবে প্রধানমন্ত্রী আল্লামা শফীর নেতৃত্বাধীন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার শীর্ষ স্থানীয় আলোমদের সঙ্গে গত ১১ এপ্রিল যে বৈঠকটি করেছিলেন। তা ছিল একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ সংগঠনটির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পর্ক আছে। তিনি শুধু মিলিতই হননি বরং হেফাজত গ্রিক ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়ার যে দাবি করেছে তারপ্রতি সমর্থন জানান। তিনি হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের আশ্বাস দেন যে, এ ব্যাপারে তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে এই যে, সমঝোতা, তা প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের আগের অবস্থারের ঠিক উল্টো। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় এক মহাসমাবেশ ডেকেছিল। ওই মহাসমাবেশ নানা কারণে 'বিতর্কিত' হয়েছিল। হেফাজতের কর্মীরা ঢাকায় তা-ব চালিয়েছিল। তাদের কর্মীরা বায়তুল মোকাররম এলাকায় ফুটপাতের দোকানে থাকা কোরআন শরীফ পুড়িয়েছিল বলে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। ওই মহাসমাবেশ সরকার উৎখাতে এক ষড়যন্ত্র ছিল বলেও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠে বিএনপির বিরুদ্ধেও। বেগম জিয়া হেফাজতের মহাসমাবেশের প্রতি তার সমর্থন জানিয়েছিল এবং ওই সময় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থানত হেফাজতের নেতাকর্মীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে সিনিয়র নেতৃত্বকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি জাতীয় পার্টিও তাদের সমর্থন জানিয়েছিল। সরকার শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীদের বিরুদ্ধে 'কঠোর ব্যবস্থা' নিলে শেষ পর্যন্ত হেফাজতের মহাসমাবেশ প- হয়ে যায় (অপারেশন সিকিউর শাপলা)। ওই অভিযানে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও, লন্ডনের ইকোনমিস্ট ৫০ জন ও টেলিগ্রাক ৩৬ জন (২১ মে ২০১৩) মৃত্যুর দাবি করেছিল। যদিও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সরকার তখন হেফাজতে ইসলামির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। যা আজো চলমান। শুধু তাই নয়, ওই সময় শাপলা চত্বরে অবস্থানরতদের বিরুদ্ধে অভিযান 'লাইভ সম্প্রচার'-এর অভিযোগে দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্ক কখনো ভালো ছিল না। হেফাজতের আমির শাহ্ আহমেদ শফীকে, 'তেঁতুল হুজুর', কিংবা হেফাজত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এমন অভিযোগ বারবার সরকারের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। এখন দেখা গেল সরকার তাদের সঙ্গেই সমাঝোতা করছে। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব? হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। ২০১০ সালে জন্ম নেয়া এ সংগঠনটি মূলত কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররাই এ সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত। সংগঠনটি তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠন না হলেও, তাদের কর্মকা- রাজনৈতিক। তাদের যে ১৩ দফা দাবি, তার মাঝেও আছে রাজনীতি। এ সংগঠনটি গড়ে ওঠে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারি মাদ্রাসা ও এর প্রিন্সিপাল আল্লামা শাহ আহমেদ শফীকে কেন্দ্র করে। আল্লামা শফীর প্রচুর মুরিদ আছেন, দেশজুড়ে। এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাদ্রাসাশিক্ষকরা তার ছাত্র। বিদেশেও তার মুরিদ আছে। তাকে কেন্দ্র করে এবং তাকে সামনে রেখে হেফাজত সংগঠিত হয় এবং এক সময় একটি বড় সংগঠনে পরিণত হয়। ২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকায় সমাবেশ ডেকে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ সংগঠনটিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। সরকার এই সংগঠনটিকে হাতে রাখার উদ্দেশে আল্লামা শফির ছেলে আনাস মাদানিকে ব্যবহার করে। অভিযোগ আছে মাদানি সরকারের কাছ থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এখন সরকার হেফাজতের সঙ্গে যে সমাঝোতায় গেছে, তার পেছনে ধর্মীয় কারণ কতটুকুই বা আছে, তার চেয়ে বেশি আছে রাজনৈতিক কারণ। সরকার মূলত এখন জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য সরকারবিরোধী ইসলাম পছন্দ দলগুলোর বিকল্প হিসেবে হেফাজত ইসলামকে ব্যবহার করবে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলোর তেমন কোনো 'অবস্থান' না থাকলেও হেফাজতের একটা বিশাল জনসমর্থন রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে রয়েছে অনেক মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষক এবং ছাত্ররা হেফাজতের সমর্থক। হেফাজতের ডাকে এরা সাড়া দেয়। বলা হয় প্রায় ১৪ লাখ ছাত্রছাত্রী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। আর এদের আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। ফলে বিশাল এক জনগোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামীর সমর্থক হয়ে পড়েছে। সুতরাং সরকার অত্যন্ত সুকৌশলে আগামী নির্বাচনকে বিবেচনা করে হেফাজতে ইসলামীর সঙ্গে একটি 'সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে। সরকারের টার্গেট মূলত ইসলামিক দলগুলোকে আস্থায় নেয়া। পাঠক, স্মরণ করতে পারেন ২০১৬ সালেও সরকার হেফাজত মজলিসের সঙ্গে ৫ দফা চুক্তি করেছিল। সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অভিযোগ সরকার ইসলামপন্থিদের খুশি করার জন্যই সংবিধানে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' রেখেছিল। সংবিধানের প্রথম ভাগে ২(ক)তে বলা হয়েছে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম...'। আবার দ্বিতীয়ভাগের ৮(১)-এ বলা হয়েছে 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের পরিচালনায় মূলনীতি বলে গণ্য হবে।' একদিকে রাষ্ট্রধর্ম, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা এটা যে সাংঘর্ষিক, সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এটা বার বার বলার চেষ্টা করছেন; কিন্তু সরকারপ্রধান চেয়েছেন, ইসলামপন্থিদের সমর্থন নিশ্চিত করতে। যে কারণে দেখা যায় পাঠ্যপুস্তকেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল। শুধু হেফাজত সমর্থকদের খুশি করার জন্য। একসময় বিএনপি তথা ২০ দল হেফাজতে ইসলামীর আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। এখন সেটা ইতিহাস। হেফাজতে ইসলাম এখন আর বিএনপি তথা ২০ দলের সঙ্গে নেই।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের 'সমঝোতা' নিয়ে ১৪ দলের অনেকেই নাখোশ হয়েছেন। তিনজন মন্ত্রীর মন্তব্য তাও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাতে তারা যে অসন্তুষ্ট, তা প্রকাশিত হয়েছে। রাশেদ খান মেনন বলেছেন, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমাঝোতার ফলে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন তার কাছে এটা বোধগম্য নয়, কেন সরকার হেফাজতের সঙ্গে সমাঝোতা করল। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর মন্তব্যও অনেকটা তেমনি। হেফাজত বাংলা নববর্ষ পালনের বদলে হিজরি নববর্ষ পালনের যে আহ্বান জানিয়েছে, তার সমালোচনা করে তার ভাষায় 'তেঁতুল হুজুর'দের কর্মকা-ের তিনি সমালোচনা করেন। ইতিমধ্যে সোস্যাল মিডিয়ায় একদিকে সরকারের যেমনি সমালোচনা করা হয়েছে, অন্যদিকে ওই তিন মন্ত্রীও সমালোচিত হয়েছেন। মন্ত্রিসভায় তাদের থাকার যৌক্তিকতা নিয়েও এখন প্রশ্ন রাখা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, তাকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বলেই ধরে নেয়া হয়, বলেছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের এই 'সমাঝোতা' এ দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটাবে। তাবে গণজাগরণ মঞ্চ এ ব্যাপারে কোনো কর্মসূচি দেয়নি। ইমরান এইচ সরকারের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে ধরা পড়েনি।
হেফাজতের পর চরমোনাইর পীরের সমাবেশ করতে দেয়া প্রমাণ করে সরকার ইসলামপন্থিদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় যাচ্ছে। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তবে ইসলামী আন্দোলন একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইসলামী আন্দোলন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে নেই। আবার হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেও সরাসরি বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। জোটগত কোনো অাঁতাতও নেই। উপরে উলি্লখিত দুটি ঘটনা প্রমাণ করে সরকার ইসলাম পছন্দ কিছু দলের সঙ্গে একটি সহনীয় অবস্থানে যাচ্ছে। মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকারের এ অবস্থান। এই অবস্থান শেষ পর্যন্ত একটি নির্বাচনী 'অাঁতাত'-এ পরিণত হয় কি-না, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
বলা ভালো নির্বাচনী রাজনীতিতে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা হেফাজত ও ইসলামী আন্দোলন কোনো ফ্যাক্টর নয়। এদের সমাবেশে লোকজন হয় বটে, কিন্তু ভোটের সময় মানুষের মনে পছন্দ মূলত দুটি বা তিনটি বড় দলের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই হেফাজতের সঙ্গে 'সমাঝোতা' কিংবা ইসলামী আন্দোলনকে ঢাকায় সমাবেশ করতে দেয়া রাজনীতির ময়দানে যে বিতর্ক বাড়াবে, তা অস্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই।
Daily Jai Jai Din24.04.2017

যুক্তরাষ্ট্র কি পুনরায় যুদ্ধে ফিরছে

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ তথাকথিত নাইন-ইলেভেন’র ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। প্রথমে আফগানিস্তান (২০০১) ও পরে ইরাক দখল করে নিয়েছিলেন। সেই দখলিস্বত্ব খোদ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনেনি। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান নামক দেশটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর ২০০৩ সালে বুশ ইরাক দখল করার নির্দেশ দিলেন। যুক্তি ছিল, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়েছিল, ইরাকের কাছে এ ধরনের অস্ত্র ছিল না। কিন্তু ইরাক আগ্রাসনের ফলে দেশটি ধ্বংস হয়ে যায়। এর পরের ঘটনা লিবিয়া নিয়ে। সেটা ২০১১ সালে। ততদিনে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিয়েছেন বুশ। ক্ষমতায় ওবামা, যিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি অনিশ্চিত বুশের মতো লিবিয়ায় মার্কিন সেনা পাঠাননি। কিন্তু তিনি বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং মার্কিনি বিমান হামলায় গাদ্দাফির সরকারের পতন ঘটেছিল। এরপর অবশ্য ওবামা সামরিকভাবে আর কোথাও মার্কিন সেনাবাহিনীকে জড়িত করেননি। তবে তার শাসনামলেই সিরীয় সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। ওবামা বুশের মতো অত যুদ্ধংদেহী ছিলেন না। পেন্টাগনের যুদ্ধবাজ জেনারেলদের কিছুটা হলেও নিবৃত্ত করতে পেরেছিলেন। তিনিই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের। সাধারণত ডেমোক্র্যাটরা কিছুটা শান্তিবাদী হন আর রিপাবলিকানরা হন যুদ্ধবাজ। ওবামা ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট, আর বুশ ছিলেন রিপাবলিকান দলীয়। এখন হোয়াইট হাউসে আবার একজন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব নিয়েছেন ২০ জানুয়ারি। তিনি এরই মধ্যে ক্ষমতা নেয়ার ১০০ দিন পূরণ করেছেন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা একটি বিষয় খুব গভীরভাবে লক্ষ করছেন। আর তা হচ্ছে, ট্রাম্প তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসছেন। নির্বাচনের আগে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীকে বিশ্বের অন্যত্র ব্যবহার করবেন না। ন্যাটোকে তিনি সেকেলে হিসেবেও অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক বোমা (ষষ্ঠ) বিস্ফোরণের সম্ভাবনা এবং কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর পরই যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে তিন-তিনটি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে। উত্তর কোরিয়া হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বোমা হামলার। এখন টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে কোরীয় উপদ্বীপে। এ উত্তেজনা শেষ অবধি একটি যুদ্ধের জন্ম দেবে কিনা, এ মুহূর্তে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সেখানে ছুটে গেছেন। তিনি দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সফর করেছেন। চীন ও রাশিয়া মার্কিন জাহাজগুলোর ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম বলছে, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এক ধরনের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেছে। এ ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ রয়েছে তিন শক্তিÑ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া। চীন ও রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার সমর্থক।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই উত্তর কোরিয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে অষ্টম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয়, কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা সম্ভব। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইঅনের (ণড়হমনুড়হ) পারমাণবিক চুক্তিটি বন্ধ করে দেয়। যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা, উত্তর কোরিয়া ৬ থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুক্তিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান এবং সেখানে উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক গ্রাম পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলের ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক। এর আগে আর দুই কোরিয়ার নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে ‘দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টা’র জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে এবং জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দুই ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী এবং অপর অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্র্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে যায়। জাতিসংঘ এ যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব দেয়। কিন্তু যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় ২ বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এরপর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুইটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিবলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ৭০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে দুইবারÑ ১৯৯৪ সালে কিম উল সুংয়ের মৃত্যুর পর তার ছেলে কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন কিম জং ইল অসুস্থ ছিলেন। তার মৃত্যুর পর (২০১১) তার ছোট সন্তান কিম জং উনকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। উন অনেকটা খেপাটে স্বভাবের। স্বৈরাচারী। তিনি যা বোঝেন, তাই করেন। তার হাতে সাবেক দেশরক্ষামন্ত্রীও মারা গেছেন।
উনের মতোই চরিত্র অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের। তিনি যা বোঝেন তাই করেন। অতীতে যা বলেছিলেন, এখন তাতে পরিবর্তন আনছেন। ট্রাম্পের অতি সাম্প্রতিক কিছু ভূমিকা নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও ‘বিশ্ব পুলিশের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে? দায়িত্ব নেয়ার আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, বৈশ্বিক রাজনীতিতে সামরিকভাবে আর যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িত করবেন না! কিন্তু সেই অবস্থান থেকে তিনি বেরিয়ে আসছেন বলেই মনে হয়। ২৯ জানুয়ারি তিনি ইয়েমেনে আল কায়দা সংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৪ এপ্রিল সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর রাসায়নিক হামলায় শতাধিক বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যুর পর তিনি সিরীয় বিমান ঘাঁটিতে ৫৯টি টমহক মিসাইল হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর আফগানিস্তানে ১৩ এপ্রিল ‘সব বোমার জননী’ (মাদার অব অল বম্বস, ওজন ৯.৮ টন। দৈর্ঘ্য ৯.১ মিটার। ৮.৪৮ টন এইচ ৬ বিস্ফোরক) ব্যবহৃত হয় আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে। সোমালিয়ায় আল শাবাব জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘আফ্রিকম’ সেনা কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছেন। মেসেজটি স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক উপস্থিতি বহাল রাখতে চাইছে। ফলে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে তার যে একটি ‘আগ্রাসী’ ভূমিকা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে উত্তর কোরিয়া নিয়ে একটা ‘ভয়’ও আছে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেয়ার যে কোনো ‘পরিকল্পনা’ হিতে বিপরীত হতে পারে। এ অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার হাতে রয়েছে বিশাল সমরাস্ত্র। যেখানে উত্তর কোরিয়ার হাতে রয়েছে ৯৪৪টি যুদ্ধ বিমান, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার হাতে রয়েছে ১ হাজার ৪৫১টি। হেলিকপ্টারের সংখ্যা উত্তর কোরিয়ার ২০২টি, আর দক্ষিণ কোরিয়ার ৬৭৯টি। ট্যাঙ্ক রয়েছে উত্তর কোরিয়ার ৪ হাজার ২০০টি আর দক্ষিণ কোরিয়ার ২ হাজার ৩৮১টি। সাবমেরিন উত্তর কোরিয়ার ৭০টি আর দক্ষিণ কোরিয়ার ১৫টি। ফ্রিগেট উত্তর কোরিয়ার ৩টি, দক্ষিণ কোরিয়ার ১১টি। ডেস্ট্রয়ার আছে দক্ষিণ কোরিয়ার ১২টি। আর সেনাবাহিনীর সংখ্যা উত্তর কোরিয়ার যেখানে ৭ লাখ, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার ৬ লাখ ২৫ হাজার। সামরিক খাতে উত্তর কোরিয়ার বাজেট হলো ৭৫০ কোটি ডলার, আর দক্ষিণ কোরিয়ার ৩ হাজার ৩২০ কোটি ডলার। তুলনামূলক বিচারে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘অবস্থান’ ভালো হলেও, উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জন করেছে, যা দক্ষিণ কোরিয়া এখনও পারেনি। পাঠকদের এখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের সামরিক শক্তিরও একটা তুলনা দিই। বাংলাদেশসহ কোরীয় উপদ্বীপ, জাপান, এমনকি চীনও যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের আওতায়। মোট ৩৬টি দেশ এর প্রভাব বলয়ের আওতায়। বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে বাস করে। চীন, জাপান এবং ভারতের মতো বড় অর্থনীতি এ কমান্ডের নিয়ন্ত্রিত এলাকার মাঝে রয়েছে। এ কমান্ডের (মোট ৬ কমান্ডের ১টি) আওতায় রয়েছে ৫টি বিমানবাহী জাহাজ, ১ লাখ ৩ হাজার মেরিন ও ১ হাজার ১০০ যুদ্ধবিমান। যে কোনো ‘যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের ‘অবস্থান’ যে শক্তিশালী, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। শেষ মুহূর্তে যুদ্ধ হয়তো হবে না কিংবা দ্বিতীয় আরেকটি কোরীয় যুদ্ধ হয়তো আমরা প্রত্যক্ষ করব না, কিন্তু এ অঞ্চলে উত্তেজনা থাকবেই। কিম জং উন উত্তেজনা জিইয়ে রেখে কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে চান। চীনের অবস্থানও অনেকটা তেমনিÑ উত্তর কোরিয়াকে সাহায্য করা। অতীতেও এমনটি হয়েছিল। তবে মনে রাখতে হবে, বিশ্বের অষ্টম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হচ্ছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির পারমাণবিক কর্মকা-কে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
Daily Alokito Bangladesh
23.04.2017

এই সমঝোতার পরিণতিতে জাতি কী পাবে?


কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের ‘সমঝোতার’ পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই ‘সমঝোতার’ শেষ কোথায়? শুধু ‘দাওরায়ে হাদিস’কে মাস্টার্সের (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান দিয়েই কি এ সমঝোতা শেষ হবে? নাকি এই সমঝোতা একটি স্থায়ী ভিত্তি পাবে? গত ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিনিয়র আলেমদের উপস্থিতিতে বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান হিসেবে ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর খুব দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করে। ফলে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া হল। একইসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট ভবনের সামনে যে গ্রিক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে, হেফাজতে ইসলাম যা সরিয়ে নেয়ার দাবি করে আসছিল, তার প্রতিও প্রধানমন্ত্রী সমর্থন জানান। তিনি হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের আশ্বাস দেন, এ ব্যাপারে তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন।

হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে এই যে ‘সমঝোতা’, তা প্রধানমন্ত্রীর তথা সরকারের আগের অবস্থানের ঠিক উল্টো। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় এক মহাসমাবেশ ডেকেছিল। ওই সমাবেশ নানা কারণে ‘বিতর্কিত’ হয়েছিল। হেফাজতের কর্মীরা ঢাকায় তাণ্ডব চালিয়েছিল। তাদের কর্মীরা বায়তুল মোকাররম এলাকায় ফুটপাতের দোকানে থাকা কোরআন শরিফ পুড়িয়েছিল বলে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। ওই মহাসমাবেশ সরকার উৎখাতের এক ষড়যন্ত্র ছিল বলেও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠে বিএনপির বিরুদ্ধেও। খালেদা জিয়া হেফাজতের মহাসমাবেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং ওই সময় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থানরত হেফাজতের নেতা-কর্মীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে দলের সিনিয়র নেতাদের সেখানে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি জাতীয় পার্টিও তাদের সমর্থন জানিয়েছিল। সরকার শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ (‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’) নিলে শেষ পর্যন্ত হেফাজতের মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। ওই অভিযানে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট ৫০ ও টেলিগ্রাফ ৩৬ জনের (২১ মে ২০১৩) মৃত্যুর দাবি করেছিল। যদিও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার তখন হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, যা আজও চলমান। শুধু তাই নয়, ওই সময় শাপলা চত্বরে অবস্থানরতদের বিরুদ্ধে অভিযান ‘লাইভ সম্প্রচারের’ অভিযোগে দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্ক কখনও ভালো ছিল না। হেফাজত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে- এমন অভিযোগ বারবার সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। এখন দেখা গেল সরকার তাদের সঙ্গেই সমঝোতা করছে। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব?

হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। ২০১০ সালে জন্ম নেয়া এ সংগঠনটি মূলত কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্র্রিক। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররাই এ সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত। সংগঠনটি তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠন না হলেও তাদের কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক। তাদের যে ১৩ দফা দাবি, তার মাঝেও আছে রাজনীতি। সংগঠনটি গড়ে ওঠে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা ও এর প্রিন্সিপাল আল্লামা শাহ আহমেদ শফীকে কেন্দ্র করে। আল্লামা শফীর প্রচুর মুরিদ আছেন দেশজুড়ে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মাদ্রাসা শিক্ষকরা তার ছাত্র। বিদেশেও তার মুরিদ আছে। তাকে কেন্দ্র করে এবং তাকে সামনে রেখে হেফাজত সংগঠিত হয় এবং একসময় একটি বড় সংগঠনে পরিণত হয়। ২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকায় সমাবেশ ডেকে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠনটিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। সরকার এ সংগঠনটিকে হাতে রাখার উদ্দেশ্যে আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে ব্যবহার করে। অভিযোগ আছে, মাদানী সরকারের কাছ থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এখন সরকার হেফাজতের সঙ্গে যে সমঝোতায় গেছে, তার পেছনে ধর্মীয় কারণ যতটুকু না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে রাজনৈতিক কারণ। সরকার মূলত এখন জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য সরকারবিরোধী ইসলাম-পছন্দ দলের বিকল্প হিসেবে হেফাজতে ইসলামকে ব্যবহার করছে।

দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলোর তেমন কোনো ‘অবস্থান’ না থাকলেও হেফাজতের একটা বিশাল জনসমর্থন রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে রয়েছে অনেক মাদ্রাসা। এসব মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষক ও ছাত্ররা হেফাজতের সমর্থক। হেফাজতের ডাকে এরা সাড়া দেয়। বলা হয়, প্রায় ১৪ লাখ ছাত্রছাত্রী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। আর এদের আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। ফলে বিশাল এক জনগোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের সমর্থক হয়ে পড়েছে। সুতরাং সরকার অত্যন্ত সুকৌশলে আগামী নির্বাচনের কথা বিবেচনা করে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একটি ‘সুসম্পর্ক’ গড়ে তুলতে চাইছে। সরকারের টার্গেট মূলত ইসলামী দলগুলোকে আস্থায় নেয়া। পাঠক, স্মরণ করতে পারেন ২০০৬ সালেও সরকার খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে ৫ দফা চুক্তি করেছিল। সরকার সমর্থক বুদ্ধিবীজীদের একটা বড় অভিযোগ, সরকার ইসলামপন্থীদের খুশি করার জন্যই সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বহাল রেখেছিল। সংবিধানের প্রথম ভাগে ২(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম...’। আবার দ্বিতীয় ভাগের ৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের পরিচালনায় মূলনীতি বলিয়া গণ্য হইবে।’ একদিকে রাষ্ট্রধর্ম, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা- এটা যে সাংঘর্ষিক, সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এটা বারবার বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সরকারপ্রধান চেয়েছেন ইসলামপন্থীদের সমর্থন নিশ্চিত করতে। যে কারণে দেখা যায় পাঠ্যপুস্তকেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল শুধু হেফাজত সমর্থকদের খুশি করার জন্য। একসময় বিএনপি তথা ২০ দল হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। এখন সেটা ইতিহাস। হেফাজতে ইসলাম এখন আর বিএনপি তথা ২০ দলের সঙ্গে নেই।

তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের ‘সমঝোতা’ নিয়ে ১৪ দলের অনেকেই নাখোশ হয়েছেন। তিনজন মন্ত্রীর মন্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাতে তারা যে অসন্তুষ্ট, তা প্রকাশিত হয়েছে। রাশেদ খান মেনন বলেছেন, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার ফলে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, তার কাছে এটা বোধগম্য নয় কেন সরকার হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করল। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর মন্তব্যও অনেকটা তেমনি। হেফাজত বাংলা নববর্ষ পালনের বদলে হিজরি নববর্ষ পালনের যে আহ্বান জানিয়েছে, তিনি তার সমালোচনা করে তার ভাষায় ‘তেঁতুল হুজুর’দের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন। ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় একদিকে সরকারের যেমন সমালোচনা করা হয়েছে, অন্যদিকে ওই তিন মন্ত্রীও সমালোচিত হয়েছেন। মন্ত্রিসভায় এখন তাদের থাকার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রাখা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, যাকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বলেই ধরে নেয়া হয়, বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের এই ‘সমঝোতা’ এ দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটাবে। তবে গণজাগরণ মঞ্চ এ ব্যাপারে কোনো কর্মসূচি দেয়নি। ইমরান এইচ সরকারের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে পড়েনি।

হেফাজতের সঙ্গে এই ‘সমঝোতার’ পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, প্রশ্ন হচ্ছে, এর ফলে জাতি কী পাবে? সরকারপ্রধানের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এই ঘোষণা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় বিতর্কের সৃষ্টি করবে। ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে, কওমি স্বীকৃতি বাতিলের দাবিতে সুন্নিরা মাঠে নামবে। সুন্নিরা দাবি তুলেছে, আলীয়া ও কওমি মাদ্রাসা একত্রিত করে একটা বোর্ড গঠন করা হোক। দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান দেয়ায় শিক্ষার মান নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠবে। কওমি মাদ্রাসা ও এর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে প্রশ্ন আছে। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও কওমি মাদ্রাসা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কওমি মাদ্রাসা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না। এখানে কী পড়ানো হয়, কারা এখানে পড়ান, তারও নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। তবে আলীয়া মাদ্রাসা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। এদের জন্য আলাদা শিক্ষা বোর্ডও আছে। অন্যদিকে কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করে কিছু ব্যক্তি। ওইসব ব্যক্তির কেউ কেউ আবার রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত। সরকারের কোনো অনুদান এখানে নেই। ব্যক্তি সাহায্যের ওপরই এসব মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। বর্তমানে নিবন্ধনকৃত কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৫ হাজার। কিন্তু অভিযোগ আছে, এ সংখ্যা ৬০ হাজারের কাছাকাছি। বেসরকারিভাবে ৬টি বোর্ড বা ‘বেফাকুল মালারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে এই কওমি মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হয়। এদের শিক্ষা কার্যক্রম ভারতের বিখ্যাত দেওবন্দের (দারুল উলুম দেওবন্দ) অনুসরণে পরিচালিত হয়। কওমি মাদ্রাসা আধুনিকীকরণ নিয়ে ২০০৬ সালেই একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের ফলে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে নতুন করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। যতদূর জানা যায়, এই কমিটি ৬ ধাপে (প্রাইমারি, জুনিয়র সার্টিফিকেট, এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স ও মাস্টার্স সমমান) কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব করেছিল। একইসঙ্গে এই শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ও ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা অন্তর্ভুক্ত করারও প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখন দাওরায়ে হাদিস পর্যায়ে যারা অধ্যয়ন করেছেন, তাদের সাধারণ শিক্ষা, বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় মাস্টার্সের স্বীকৃতি পেলেও তারা সমাজ জীবনে কতটুকু অবদান রাখতে পারবে, এ প্রশ্ন থাকলোই।

এমনিতেই দেশে উচ্চশিক্ষা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রায় একশ’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর হাজার হজার মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরুচ্ছে। এর উপরে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সার্টিফিকেট পাওয়াটাই হল পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হল কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস। এর ফলে উচ্চশিক্ষায় সার্টিফিকেটের এক মহাবিস্ফোরণ ঘটবে! এরা সমাজ জীবনে, রাষ্ট্র কাঠামোয় কোনো অবদান রাখতে পারবে না। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কোনো পরামর্শ নেয়া হয়নি। অথচ উচ্চশিক্ষা প্রসারে মঞ্জুরি কমিশনের একটি ভূমিকা রয়েছে। স্পষ্টতই কওমি শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর তথা এদের নেতৃত্বদানকারী হেফাজতে ইসলামের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্যই এই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চশিক্ষাকে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার যৌক্তিকতা আছে কিনা, সে ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের মতামত নেয়া উচিত ছিল। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান দেয়া আর যাই হোক, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখবে না। বরং নানা জটিলতা তৈরি করবে।

ইতিমধ্যে কওমি মাদ্রাসার সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটির সভায় নতুন একটি শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে আল হাইয়াতুল উলাইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। এ বোর্ডের অধীনেই নেয়া হবে পরীক্ষা। কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট বাকি ৬টি শিক্ষা বোর্ড নতুন বোর্ডের অধীনে থাকবে। কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী ১৫ মে থেকে ‘দাওরায়ে হাদিস’ অর্থাৎ মাস্টার্সের পরীক্ষা শুরু হবে। আমি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখেছি সেখানে দাওরায়ে হাদিসের কোনো সিলেবাস নেই। তবে অন্যত্র সীমিত পরিসরে সিলেবাস আছে, যেখানে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। প্রশ্ন আরও আছে। কোনো বোর্ড এমএ ডিগ্রি দিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে এমএ ডিগ্রি দিতে পারে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, যা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে জড়িত করে এমএ পরীক্ষা নেয়া যেত। বোধকরি আল্লামা শফীরা এটি চাননি। তারা নিজেরা নিজেরা এমএ ডিগ্রি দেবেন। সেখানে কোন কোর্স থাকবে, পরীক্ষার সময় কতুটুকু হবে, ক’টি বিষয় পরীক্ষার আয়োজন করা হবে, এসবের সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা নেই। আমি অবাক হলাম, উচ্চশিক্ষার তদারককারী প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকেও দেখলাম না কোনো ভূমিকা পালন করতে। উচ্চশিক্ষা প্রসারে সরকার যেখানে আন্তরিক, সেখানে মঞ্জুরি কমিশনের ভূমিকা নেই। প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে একটি কাগুজে সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সরকার কওমি মাদ্রাসাকে আধুনিকীকরণ করতে চায়, এটি ভালো। কিন্তু এর শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে উচ্চশিক্ষায় বড় বিপর্যয় ঘটবে। এখনও সময় আছে। কওমি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে আনা হোক। নিন্ম তথা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা নবগঠিত বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে।
Daily  Jugantor
20.04.2017

কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা বাড়ছে




কোরীয় উপদ্বীপে নতুন করে উত্তেজনা বাড়ছে। এরই মধ্যে উত্তর কোরিয়া সমুদ্রে সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য একাধিক স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র হামলারও হুমকি দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। গেল বছর উত্তর কোরিয়া দু-দুবার ভূগর্ভে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আভাস অনুযায়ী ষষ্ঠ আরেকটি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে উত্তর কোরিয়া। যদিও সর্বশেষ একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের উৎকণ্ঠা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। এমনকি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সেখানে ছুটে গেছেন। ১০ দিনের এশিয়া সফরে তিনি এখন এ অঞ্চল সফর করছেন। দক্ষিণ কোরিয়া সফরের সময় তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ওবামার সময় উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তথা Strategic patience, অর্থাৎ ‘কৌশলগত ধৈর্যধারণ’, তা এখন পরিত্যক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা কমান্ডাররা এখন উত্তর কোরিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছেন। বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎফরে উত্তর কোরিয়ার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হান সং রিযল জানিয়েছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা সাপ্তাহিক, মাসিক, এমনকি সারা বছর চলতে থাকবে। উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের দাদা কিম উল সুংয়ের ১০৫তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে উত্তর কোরিয়া ব্যাপক সমরসজ্জা প্রদর্শন করে আসছে, যা বিদেশি গণমাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে। এর অংশ হিসেবেই ষষ্ঠ পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে উত্তর কোরিয়া! এটা তারা আগেই ঘোষণা দিয়েছিল। উত্তর কোরিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলার হুমকি এ অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে এক ধরনের নিরাপত্তা সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্যেই ঘোষণা করেছে, তারা দক্ষিণ কোরিয়ায় মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, যা THAAD নামে পরিচিত, তা মোতায়েন করবে। এ অঞ্চলে উত্তেজনা আদৌ কোনো বড় ধরনের সংঘর্ষের জন্ম দেবে কি না বলা মুশকিল। তবে উত্তর কোরিয়াকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে ছয় জাতি আলোচনা কার্যত ব্যর্থ। উত্তর কোরিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র এখন বাহ্যত তিন জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া) আলোচনায় উৎসাহী।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই উত্তর কোরিয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে অষ্টম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয় কিভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণমুক্ত করা সম্ভব। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইয়নের (Yongbyon) পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা উত্তর কোরিয়া ছয় থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান এবং সেখানে উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক গ্রাম পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলের গত ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে আর দুই কোরিয়ার নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে ‘দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার’ জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। এক লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র দুই কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা চার কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দুই ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী ও অন্য অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যে উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে যায়। জাতিসংঘ এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় দুই বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এরপর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিবলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গত ৭০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে দুবার, ১৯৯৪ সালে কিম উল সুংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন কিম জং ইল অসুস্থ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখন তাঁর ছোট সন্তান কিম জং উনকে সেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি যদি দায়িত্ব পালনকালে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের উদ্যোগে নেন, সেটা হবে একুশ শতকের শুরুতে একটি বড় ধরনের ঘটনা। তবে যেকোনো মুহূর্তে সংঘর্ষ সেখানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। উত্তর কোরিয়া তাদের প্রধান পারমাণু স্থাপনা ছাড়াও গোপনে আরো কয়েকটি স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে উত্তর কোরিয়া আরো পরমাণু পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনাও করছে। এ জন্য তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে। এ হারে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলে আগামী (২০১৭) মে মাস নাগাদ প্রয়োজনীয় এক হাজার মিটার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শেষ হবে। এর অর্থ হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া আরেকটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে। এতে করে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। যুদ্ধ হবে কি না বলা মুশকিল। কেননা উত্তর কোরিয়া যেখানে বড় ধরনের খাদ্য সংকটের মুখে, সেখানে তারা এত বড় ঝুঁকি কি নেবে? উত্তেজনা জিইয়ে রেখে তারা সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। এর মধ্যেই উত্তর কোরিয়া সেখানে একটি হাইড্রোজেন বোমারও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার বড় বন্ধু চীন। চীন যদি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে উত্তর কোরিয়া ‘একা’ হয়ে পড়বে। তখন আলোচনায় যাওয়া ছাড়া তার কোনো বিকল্প থাকবে না। উত্তর কোরিয়া বারবার বলে আসছে, তার পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ও দক্ষিণ কোরিয়া এই কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না। একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও একই সঙ্গে ষষ্ঠ পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের হুমকিতে এ অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী উত্তর কোরিয়াগামী বিমানের সব ফ্লাইট বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে চীন। উত্তর কোরিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান কিম জং উনের ভূমিকার ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন পশ্চিমা বিশ্ব। উন কিছুটা খ্যাপাটে ধরনের। নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তিনি নিজ আত্মীয়স্বজন, সত্ভাইকে ‘খুন’ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি তাঁকে পরিপূর্ণ সম্মান না দেওয়ায় সিনিয়র জেনারেল ও সাবেক দেশরক্ষামন্ত্রীকে পর্যন্ত তিনি ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠিয়েছিলেন। এমন একজন খ্যাপাটে ব্যক্তি কি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ কিংবা কোরিয়ার একত্রীকরণের পক্ষে কোনো আলোচনায় মিলিত হবেন, এটা বিশ্বাস করা যায় না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কিছু ভূমিকা নতুন করে আবার প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও ‘বিশ্ব পুলিশের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে? দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, বৈশ্বিক রাজনীতিতে সামরিকভাবে আবার যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িত করবেন না তিনি! কিন্তু সেই অবস্থান থেকে তিনি বেরিয়ে আসছেন বলেই মনে হয়। ২৯ জানুয়ারি তিনি ইয়েমেনে আল-কায়েদাসংশ্লিষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৪ এপ্রিল সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর রাসায়নিক হামলায় শতাধিক বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যুর পর তিনি সিরীয় বিমান ঘাঁটিতে ৫৯টি টমাহক মিসাইল হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর আফগানিস্তানে ১৩ এপ্রিল সব বোমার ‘জননী’ (মাদার আর অল বোম্বস, ওজন ৯.৮ টন, দৈর্ঘ্য ৯.১ মিটার, ৮.৪৮ টন এইচ৬ বিস্ফোরক) ব্যবহূত হয় আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে। সোমালিয়ায় আল শাবাব জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আফ্রিকান সেনা কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছেন। মেসেজটি স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক উপস্থিতি বহাল রাখতে চাইছে। ফলে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে তার যে একটি ‘আগ্রাসী’ ভূমিকা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে উত্তর কোরিয়া নিয়ে একটা ‘ভয়’ও আছে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার যেকোনো ‘পরিকল্পনা’ হিতে বিপরীত হতে পারে। এ অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই চীন সব পক্ষকে ‘শান্ত’ থাকার আহ্বান জানিয়েছে এবং আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার কথাও বলছে চীন। এখন দেখার পালা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়।
Daily Kalerkontho
19.04.2017