রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে ভারত

তার পিতা প্রদত্ত নাম অজয় সিং বিসট। কিন্তু এ নামটি এখন আর কেউ স্মরণ করেন না। তিনি এখন যোগী আদিত্যনাথ, ভারতের উত্তর প্রদেশের নয়া মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার নিয়োগ, অতীতে তার মুসলিমবিদ্বেষ, বাবরি মসজিদের স্থানে বিতর্কিত রাম মন্দির নির্মাণের ঘোষণা এবং সর্বোপরি হিন্দু যুব বাহিনী গঠন করে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণা শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বেই বড় ধরনের আলোচনার ঝড় তুলেছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের দায়িত্ব নিয়েছেন ১৯ মার্চ। এরই মাঝে একাধিক ঘটনা ঘটেছে, যা ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চরিত্রকে পুরোপুরি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কৈশোর বয়সেই অজয় সিং বিসট উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে ২২ বছর বয়সে উত্তরখ- রাজ্য থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নেয়ার পর উগ্র হিন্দুত্ববাদ তাকে বাধ্য করেছিল নিজের জন্ম নাম পরিবর্তন করে যোগী আদিত্যনাথ নাম ধারণ করে গোরক্ষপুর মন্দিরের তৎকালীন অধ্যক্ষ অভয়দীয়ানাথের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে। সেই থেকে অজয় সিং বিসট নামটি হারিয়ে গিয়েছিল। একসময় গুরু অভয়দীয়ানাথের মৃত্যুর পর তিনি খুব অল্পবয়সেই গোরক্ষপুর মন্দিরের অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তরুণ বয়সে আরএসএসের সঙ্গে তার সম্পর্ক, উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রসারে তার নিরলস প্রচেষ্টা তাকে পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে আসে। ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এখন অবধি পাঁচ-পাঁচবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার উগ্র হিন্দুত্ববাদের নীতি অনেক আগেই নরেন্দ্র মোদিকে আকৃষ্ট করেছিল। যে কারণে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মোদি উপেক্ষা করেছিলেন শুধু একটি কারণে, আর তা হচ্ছে তাকে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী করা। যোগী আদিত্যনাথ সদ্য নির্বাচিত উত্তর প্রদেশ বিধানসভার সদস্যও নন। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণায় মোদি যোগী আদিত্যনাথকে সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়েও দেননি। তিনি জানতেন কী করবেন। মোদি যে ‘নতুন ভারত’ উপহার দিতে চাচ্ছেন, যোগী আদিত্যনাথ সেখানে তার অন্যতম সহযোগী। মোদির হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি, বিশেষ করে ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় চরিত্রকে ভেঙে তিনি ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। এক্ষেত্রে যোগী আদিত্যনাথের মতো ‘নেতা’ তার দরকার। আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশে অনেক কসাইখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। তার দেখাদেখি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতেও একই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। আদিত্যনাথ সূর্যকে পূজা করার পক্ষপাতি। তিনি বলেছেন, যারা সূর্যকে দেবতা মেনে পূজা করবে না, তাদের সাগরে নিক্ষেপ করতে হবে। তিনি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ তাজমহলকেও ভেঙে ফেলতে চান। কারণ তার মতে, সেখানে ‘তেজো মহালয়’ নামে একটা রামমন্দির ছিল। তিনি নিজ এলাকায় উর্দু বাজারের নামকরণ করেছেন হিন্দু বাজার, আর আলীনগরকে করেছিলেন আর্থনগর। বদলে যাচ্ছে ভারত। নবরূপে এক ‘হিন্দু ভারতের’ জন্ম হচ্ছে ভারতে।
যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ একটি মেসেজ দিল এখন। নয়া মুখ্যমন্ত্রীর মুসলমানবিরোধী নানা বক্তব্যের কারণে মুসলমানরা এখন সেখানে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকবেন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মায়াবতীর বহুজন সমাজপতি পার্টির নেতা ও সাবেক বিধানসভার সদস্য মোহাম্মদ সামী খুন হয়েছেন। এটা একটা স্পষ্ট বার্তা। কট্টরপন্থীদের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন মুসলমান নেতারা। বলা ভালো, উত্তর প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ হচ্ছেন মুসলমান। এবারে ৪০৩টি আসনের বিধানসভায় ২৫ জন হচ্ছেন মুসলমান বিধায়ক। বিজেপি ৩১২টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। বিজেপি একজন মুসলমানকেও প্রার্থী হিসেবে দাঁড়া করায়নি। তবে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ একজন মুসলমান বিজেপি নেতাকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন সাবেক ক্রিকেটার মহসিন রেজা। বিশ্বজুড়েই এক ধরনের উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম হয়েছে। ইউরোপে মুসলমান তথা ইসলামবিদ্বেষী একটি মনোভাব সেখানকার নির্বাচনী রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প স্বয়ং এ ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবকে উসকে দিয়ে এক ধরনের ‘শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়েছেন। মোদির ভারতে আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়ে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতিকেই তিনি উসকে দিলেন। এ হিন্দুত্ববাদ হবে তার ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ট্রাম্পকার্ড। এটা স্পষ্ট, তিনি যোগী আদিত্যনাথকে আগামীতে ব্যবহার করবেন। চলতি বছরই ছত্তিশগড়, গুজরাট, রাজস্তান, হিমাচল ও মধ্যপ্রদেশে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এসব নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি যোগী আদিত্যনাথকে ব্যবহার করবেন। মোদি-অমিত শাহ-আদিত্যনাথ জুটি আগামীতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে। এখন আদিত্যনাথের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাম জন্মভূমি আন্দোলন নতুন একটি মাত্রা পাবে। দায়িত্বগ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি অযোধ্যায় রামায়ণ মিউজিয়াম গড়তে ২০ একর জমি বরাদ্দ করেছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় আদিত্যনাথ বলেছিলেন, রাজ্যের সমাজবাদী পার্টি সরকার উন্নয়ন করেছে শুধু কবরস্থানগুলোর। কিন্তু বিজেপি সরকার বলে রামমন্দিরও প্রতিষ্ঠা করবে। গেল বছর জুনে তিনি রামমন্দির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, যেখানে অযোধ্যার বিতর্কিত স্থাপনা ভেঙে ফেলা থেকে কেউ আটকাতে পারেনি, তো মন্দির তৈরি কে আটকাবে। একজন কট্টরপন্থী হিন্দু নেতা যখন ক্ষমতায় আসার আগেই রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং তিনি ও তার দল যখন ক্ষমতায় যায়, তখন একটা আশঙ্কা থাকেই। উত্তরপ্রদেশ সরকার যদি বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, তা বিতর্ক শুধু বাড়াবেই না, বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট করবে। চতুর্থত ভারতের রাজনীতিতে বহুত্ববাদের চর্চা দীর্ঘদিন ধরেই স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভারত এ বহুত্ববাদের চর্চা থেকে বেরিয়ে আসছে। হিন্দুত্ববাদ ও যোগী আদিত্যনাথের ‘পুরো পৃথিবীতে গেরুয়া ঝা-া উড়ানোর’ সিদ্ধান্ত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলতে পারে। আদিত্যনাথ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে এখন উসকে দিতে পারেন। কট্টরপন্থী চিন্তাচেতনা আরও বাড়তে পারে। উত্তরপ্রদেশ থেকেই মোদি তার ‘নয়া ভারতের’ যাত্রা শুরু করলেন। ২০১৯ সালের পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন তার টার্গেট, সন্দেহ নেই তাতে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ছত্তিশগড়, গুজরাট, রাজস্তান, হিমাচল ও মধ্যপ্রদেশে। এসব রাজ্যে বিজেপি কী করে, সেটাই দেখার বিষয়। যে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হয়ে গেল, সেখানে বিজেপির সাফল্যে মোদি খুশি। তার সামনে আছে ২০২২ সালের ভারত, যখন ভারত রাষ্ট্রটির বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৭৫ বছরে। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে তার দল বিজেপি পেয়েছিল ৩২৫ আসন, গোয়ায় ১৪, উত্তরখ-ে ৫৭ আর মণিপুরে ২২। পাঞ্জাবে কোনো আসন পায়নি বিজেপি। এ পাঁচটি রাজ্যের সঙ্গে একমাত্র পাঞ্জাবেই কংগ্রেস সরকার গঠন করতে পেরেছে। বিজেপি সরকার গঠন করেছে উত্তরপ্রদেশ, গোয়া, উত্তরখ- ও মণিপুরে। এর সঙ্গে গোয়া আর মণিপুরে কোয়ালিশন সরকার। সুতরাং পরবর্তী পাঁচটি বিধানসভার নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে। চিন্তা করা যায়, ১৯৮৪ সালের লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র দুইটি আসন। ১৯৮৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮টিতে। আর ১৯৯১ সালে বিজেপি পায় ১১৭টি। ১৯৯৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬০টিতে। ওই সময় স্বল্প সময়ের জন্য বিজেপি সরকারও গঠন করেছিল (১৬ মে- ২৮ মে, ১৯৯৭), তবে ১৯৯৮ সালের দ্বাদশ লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিজেপি সরকার গঠন করেছিল। সেই বিজেপি এখন ক্ষমতায়। স্বপ্ন দেখছে ২০১৯ এবং ২০২৪ সালেও ক্ষমতায় থাকার। তাই হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিতে ‘প্রমোট’ করছে বিজেপি এবং মোদি। তিনি নতুন ভারতের ‘উত্থান’ ঘটাতে চান। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বিজেপির সদর দফতরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ কথাই বলেছিলেন। আর তাই বেছে নিয়েছেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। অনেকেই এখন থেকে যোগী আদিত্যনাথকে মোদির বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর ২০২৪ সালের যে নির্বাচন হবে, তখন যদি বিজেপি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে, তাহলে আদিত্যনাথ হবেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। যদিও সময়টা অনেক লম্বা, আরও ৭ বছর বাকি। ওই সময় আদিত্যনাথের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে মাত্র ৫১। এরই মধ্যে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জন করবেন। ৫১ বছর বয়স ভারতীয় রাজনীতির জন্য খুব বেশি নয়। মোদি এভাবেই উঠে এসেছিলেন আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে, গুজরাট থেকে নয়াদিল্লি। আদিত্যনাথের শুরুটা হলো উত্তরপ্রদেশ থেকে। ওই সময় ভারতের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, কিংবা ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আদৌ বদলে যাবে কিনা, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু যোগী আদিত্যনাথের উত্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মণিপুরে বিজেপির সরকার গঠন ভারতে নতুন করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। এরই মধ্যে আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে ‘গোরক্ষা’ কর্মসূচির আওতায় রামপুরে দুইটি কসাইয়ের দোকান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ উত্তরপ্র্রদেশের অযোধ্যায় বিতর্কিত বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণের ঘোষণা দিলেও দেশটির সুপ্রিমকোর্ট ২১ মার্চ বলেছেন, দুইপক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করুক। উচ্চ আদালতে ৬ বছর ধরে রামমন্দির সমস্যার সমাধানে একটি মামলা বিচারাধীন। বিজেপি নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামীর দায়ের করা একটি পিটিশনে শুনানি শেষে সুপ্রিমকোর্ট এ মন্তব্য করলেন। কিন্তু রামমন্দির আন্দোলনের নেতা এবং এখন মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ, তাকে দাবিয়ে রাখবে কে?
বদলে যাচ্ছে ভারত। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত এখন পরিচিতি পাচ্ছে হিন্দু রাষ্ট্র ভারত হিসেবে। একজন মোদি একজন যোগী আদিত্যনাথ বদলে দিচ্ছেন ভারতের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় চরিত্র। আমাদের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়।
Daily Alokito Bangladesh
02.04.2017

0 comments:

Post a Comment