প্রতিটি দেশই তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। ভারতও তাই করবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করতে পারি না। সুতরাং ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ অনেক বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে এবার। এর একটি হচ্ছে পানি ব্যবস্থাপনা। যেহেতু ভারতেও পানি সংকট আছে, সে কারণে অববাহিকার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি। এতে পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আগামীতে পানি সমস্যা একটা ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। চীন ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি তিব্বতে। ব্রহ্মপুত্র নদটি তিব্বত থেকে অরুণাচল ও আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ব্রহ্মপুত্রের চীনা নাম হচ্ছে ণধৎষঁহম তধহমনড়. এই নদের উপশাখা ঢরধনঁয়ঁ-তে চীন খধষযড় ঐুফৎড়বষবপঃৎরপ চৎড়লবপঃ করেছে। এতে চীন সরকার ব্যয় করছে ৭৪০ মিলিয়ন ডলার। এ প্রজেক্টে বিশাল এক এলাকা নিয়ে একটি রিজার্ভিয়ার গড়ে তোলা হচ্ছে, যা শেষ হবে ২০১৯ সালে। এ রিজার্ভিয়ারে ২৯৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ধরে রাখা হবে। এর মাধ্যমে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ কাজ করা হবে। একই সঙ্গে বছরে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতের। ফলে ভারতের জন্যও একটি সংকট তৈরি হচ্ছে। এটা সমাধানের জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পানি নিয়ে এশিয়ায় যুদ্ধ হতে পারেÑ এমন আশঙ্কাও ব্যক্ত করা হচ্ছে। প্রশ্ন আছে সাফটা নিয়ে। সাফটার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে গেছে। সাফটা বা দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। এখন ট্রেড লিবারেলাইজেশন প্রোগ্রামের কার্যকারিতার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কার্যত সাফটা এখন অকার্যকর। বাংলাদেশী পণ্যের ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে এটা কোনো ভালো খবর নয়। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তার চীন সফরের সময় বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এ অর্থনৈতিক করিডোর চীনের ইউনান রাজ্যের কুনমিংয়ের সঙ্গে কক্সবাজারকে সংযুক্ত করবে। চীন যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তাতে যে ছয়টি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে এই বিসিআইএম করিডোর তার একটি। ক্রমবর্ধমান ভারত-চীন দ্বন্দ্বে প্রস্তাবিত বিসিআইএম করিডোর এখন কাগজে-কলমে থেকে যেতে পারে! এতে বাংলাদেশের স্বার্থও ক্ষুণœ হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। এই বিসিআইএম করিডোরের সঙ্গে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রশ্নটিও পরোক্ষভাবে জড়িত। একসময় বাংলাদেশ উদ্যোগ নিলেও তা এখন পরিত্যক্ত। বাংলাদেশ এখন পটুয়াখালীর পায়রাতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে, সেখানে ভারতীয় একটি কোম্পানি এটি করছে। চীন এই প্রকল্পেও জড়িত হতে চায়। এতে ভারতের সম্মতি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ভারতের দুইটি মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে বাংলাদেশে উদ্বেগ রয়েছে। এ দুইটি মহাপরিকল্পনা হচ্ছেÑ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ। মোদির ঢাকা সফরের সময় যৌথ ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। অথচ গেল বছর ১৬ জুলাই বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বিবিসি বাংলার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতে নদী সংযোগের বিতর্কিত পরিকল্পনার আওতায় এবারে মানস-সংকোস-তিস্তা-গঙ্গাকে যুক্ত করার প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে ঘোষণা করেছে সে দেশের সরকার। এটা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের পানিশূন্যতার মধ্যে পড়বে। অথচ এ সিদ্ধান্ত যৌথ ঘোষণার ২১ দফার পরিপন্থী। একই কথা প্রযোজ্য টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারেও। ভারত এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
এ ধরনের মহাপরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ নং অনুচ্ছেদ, ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নং নীতি এবং রামসার কনভেনশনের বরখেলাপ। এমনকি ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদের বরখেলাপেরও শামিল। ফলে বাংলাদেশের জনগণের যে উৎকণ্ঠা, তা প্রধানমন্ত্রী তার নয়াদিল্লি সফরে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে ‘শেয়ার’ করতে পারেন।
ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতের অবস্থান ২ দশমিক ৮ ভাগ হলেও (২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার) ২০৫০ সালে ভারত হবে দ্বিতীয় অর্থনীতির (চীন প্রথম, যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয়) দেশ। প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার তাদের এক গবেষণায় আমাদের এ তথ্যটি দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স কিংবা ইতালির অবস্থান হবে ভারতের অনেক নিচে। তাই সংগতকারণেই ভারতের অর্থনীতি থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। কিন্তু সম্পর্ক যেন হয় সমতার ভিত্তিতে, যা জাতিসংঘের চার্টারে উল্লেখ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে নানা ‘প্রশ্ন’ উত্থাপিত হয়েছে। বেশ কিছু সমস্যার এখনও কোনো সমাধান হয়নি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য ঘাটতি (২০১৫-১৬ সালে ৪ হাজার ৭৬১ বিলিয়ন ডলার) তা কমিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ এখন অবধি পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের তৃতীয় অথবা চতুর্থ বাজার। বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী বছরে ১৫ বিলিয়ন অর্থাৎ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ ভারতে গোপন পথে পাচার হয়ে যায়। বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না। বাংলাদেশী পণ্য, বিশেষ করে জুট কার্পেট, গাড়ির ব্যাটারি ও মেলামাইনের ভারতে বাজার থাকলেও ভারতীয় কাস্টমস এসব পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে যাচ্ছে। ফলে ভারতীয় আমদানিকারকরা বাংলাদেশী পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এর আগে ভারতের পক্ষ থেকে যে ৫১৩টি পণ্যের ছাড় দেয়া হয়েছে, তার মাঝে ৩৫০টি পণ্য বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবেই রফতানি করা সম্ভব নয়। ভারত পণ্যের শুল্কহার না কমালেও বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কহার ধার্য করা হতো শতকরা ৩০০ ভাগ। ১৯৯৪-৯৫ সালে তা কমিয়ে আনা হয় ৬০ ভাগে। এখন শুল্কহার কমতে কমতে শতকরা মাত্র ৪৫ দশমিক ৫ ভাগে দাঁড়িয়েছে। ভারত বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে ট্রানজিট ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি বারবার সম্পৃক্ত করেছে। এরই মধ্যে ভারত ট্রানজিট তথা ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা নিচ্ছে। ট্রানজিটের জন্য যে ‘ফি’ নির্ধারণ করা হয়েছে (১৯২ ডলার), তা আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক কম। ভারত এখন তার সাতবোন রাজ্যের পণ্য আমদানি-রফতানির জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে চাইছে। ধারণা করছি, প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের সেই সক্ষমতা কি আছে? দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম সমগ্র দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে। এর জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড-শেড, গুদাম, অফডক, সড়কসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা মোটেই পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট নয়। বর্তমান সময়ে বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানিমুখী কনটেইনার ওঠানামা, পরিবহন করা হচ্ছে বছরে ২১ লাখ ৮৯ হাজার টিইইউএস কনটেইনার (২০ ফুট সাইজের ইউনিট হিসেবে)। বছর বছর কনটেইনার ওঠানামার প্রবৃদ্ধিও ব্যাপক। বর্তমানে ৪০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার রাখা সম্ভব হচ্ছে বন্দরের ইয়ার্ডগুলোতে। সামগ্রিকভাবে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটি সমগ্র দেশের আমদানি ও রফতানিমুখী পণ্য হ্যান্ডলিং ও পরিবহনের প্রয়োজন সামাল দিতে গিয়েই প্রতিনিয়ত চাপে রয়েছে। এ অবস্থায় ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশের জন্য ট্রানজিট সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত অবকাঠামো বাস্তবিক অবস্থাতেই অক্ষম। ভারতীয় পণ্যের জন্য প্রস্তাবিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরটি ছিল উত্তম। কিন্তু তা হচ্ছে না। কানেকটিভিটির আওতায় আমাদের সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন করা হবে ভারতীয় ঋণে। রেলপথ, সড়কপথ, মংলা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি খাতে ট্যারিফ কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যয় হবে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালের এ রিপোর্ট যখন বাস্তবায়িত হবে, তখন ব্যয়ের হার অনেক বাড়বে। ভারতের পণ্য পরিবহন সর্বোচ্চ ৭৬ ভাগ সাশ্রয় হবে। বিআইডিসির গবেষক কে এ এম মুরশিদ এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ লাভ সীমিত।
আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, আমরা যখন ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দাবি করছি, তখন আমাদের জন্য আরও একটি খারাপ খবর হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশী পাটজাত পণ্যের ওপর এন্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করেছে। বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে পাট এবং পাটজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভারত টনপ্রতি ৮ থেকে ৩৫০ ডলার ডিউটি আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে ভারতীয় পাটজাত পণ্য আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এতে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের সময় এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত হবে এবং আমরা একটা সমাধান খুঁজে পাব। ভারতের সঙ্গে আমরা সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। এক্ষেত্রে ভারতের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে এলেই বুঝতে পারব আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে।
Daily Alokito bangladesh
09.04.2017
0 comments:
Post a Comment