রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পোস্টমর্টেম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুল আলোচিত ভারত সফরের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে কতটুকু? এই সফরের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু দেখা যাবে ফলাফলে ভারতের পাল্লাটা ভারি, আমাদের পাল্লাটা অত ভারি নয়। ৩৪টি চুক্তি তথা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু তা কি গতানুগতিক নয়? আমাদের অগ্রাধিকার ছিল অনেকগুলো। তিস্তা চুক্তি না হোক, সমঝোতা হবে। পাটের ওপর ভারত যে শতকরা ১২ ভাগ হারে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক কিংবা তৈরি পোশাকে যে শতকরা ৩০ ভাগ হারে কাউন্টার ভেইলিং শুল্কারোপ করেছে, তা প্রত্যাহার করা হবে। যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন সে কথা। কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি নেই। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। শুধু ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ৪৭৬ কোটি ডলার। এই ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেছেন, ভারতের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাংলাদেশ নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেয়া। কিন্তু ভারতীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সেখানে নেই অথচ বিনিয়োগ হলে তাতে বাণিজ্য ঘাটতি কমত। ভারতীয় উদ্যোক্তারা মূলত ভারতীয় পণ্য বিক্রি করতে চান। তারা বিনিয়োগ করতে চান না। তিস্তা চুক্তি হবে না-এটা আমরা আগেই জেনেছিলাম। মমতা ব্যানার্জি তার আপত্তি অব্যাহত রেখেছিলেন-এটা আমরা জানতাম। মমতাকে ‘বাগে’ আনার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। অনেকের মনে থাকার কথা মমতা ঢাকায় আসার আগে প্রশ্ন তুলেছিলেন বাংলাদেশ আত্রাই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে! আর এবার বললেন বাংলাদেশকে তোর্সা ও জলঢাকা নদী থেকে পানি দেয়া যেতে পারে। কেননা এ দুটিসহ মোট ৪টি নদীতে পানি আছে। কিন্তু তিস্তায় পানি দেয়া যাবে না। যদিও প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন তার সরকারের আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে। কিন্তু কিভাবে হবে, আমরা তা জানি না। মোদি বলেছেন বটে। কিন্তু তা কাগজ-কলমে থেকে যাবে কিনা, প্রশ্ন সেখানেই।
তবে যারা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ সম্পর্কেও ধারণা রাখেন। এই ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা স্বীকার করে নিতে দেশগুলোকে বাধ্য করা। এটা একটা ধারণা মাত্র। এই ধারণা ভারতের নীতি-নির্ধারকরা যেমনি মনে করেন, ঠিক তেমনি অনেক ভারতীয় বিশ্লেষকও তা মনে করেন। এক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রে সরকারের পরিবর্তন হলেও এই নীতি-আদর্শের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিন সংযোজিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় বিশ্লেষকরা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে এই ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ কথাটাই আবার আমাদের মনে করিয়ে দিল। ভারতের বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া দেখে এটা মনে হয়েছে যে, তারা চান না বাংলাদেশ নৌবাহিনী শক্তিশালী হোক।
কোনো কোনো বিশ্লেষক এমন কথাও বলেছেন যে, ভারতের উচিত এখন বাংলাদেশ সীমান্তে মিসাইল ব্যাটারি কমানো এবং নতুন নতুন নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা। এই সাবমেরিন সংগ্রহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া শুরু করলেও ভারতের বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এটাকে ‘অ্যাক্ট অব প্রোভোকেশন’ হিসেবে দেখছেন। চীন এই সাবমেরিন সরবরাহ করে ‘ভারতকে ঘিরে ফেলার’ চিন্তা করছে, এমন মন্তব্যও আছে ভারতীয় বিশ্লেষকদের মধ্যে অথচ এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বাংলাদেশের নৌবাহিনী ভারতীয় নৌবাহিনীকে, যাদের রয়েছে ১৫টি সাবমেরিন (যার মাঝে ১টি আবার পারমাণবিক শক্তিচালিত) চ্যালেঞ্জ করার আদৌ কোনো ক্ষমতা রাখে না। সে কারণেই যে প্রশ্নটি এসে যায় তা হচ্ছে ভারতীয় মানসিকতার। ভারতীয় নীতিনির্ধারক তথা বিশ্লেষকরা চান না পার্শবর্তী দেশগুলোর সশস্ত্র বাহিনী শক্তিশালী হোক।
আসলে জওহরলাল নেহরুও স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতকে একটি বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে দেখার। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের পরেই চতুর্থ বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে কল্পনা করেছিলেন। পরবর্তীতে ভারতীয় বিশ্লেষকদের অনেকেই এ ধারণাটি শুধু এগিয়ে নিয়েই যাননি বরং সরাসরি মন্তব্য করেছিলেন, এ অঞ্চলে অন্য কোনো শক্তির কর্তৃত্ব ভারত সহ্য করে নেবে না। এ অঞ্চলের দেশগুলোকে ভারতকে ‘মান্য’ করতে হবে। এখানে আমরা রক্ষণশীল বিশ্লেষক তথা স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে সুব্রোমোনিয়াম, বলদেব রাজ, ভবানী সেনগুপ্তর, অথবা নিহাল সিংয়ের মন্তব্যগুলো উল্লেখ করতে পারি। সুব্রোমোনিয়াম তার একটি লেখায় ১৯৭২ সালেই উল্লেখ করেছিলেন, বাংলাদেশে নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার প্রশ্নটি সরাসরি ভারতের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। তার ভাষায় ভারতই এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে (Economic of political weekly, 6 may 1972)। ভবানী সেনগুপ্ত তার The India Doctrine (India Today, 31 August, 1983) নামে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত প্রবন্ধে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন ‘এ অঞ্চলে অন্য কেউ কর্তৃত্ব করুক, এটা ভারত চাইবে না।’ এ অঞ্চলের সব ‘নিরাপত্তা’ দেবে ভারত। আমরা যদি ভারতীয় নীতি-নির্ধারক, বিশেষ করে রাজীব গান্ধী থেকে শুধু করে অতি সম্প্রতি সুষমা স্বরাজ্যের বক্তব্য বিশ্লেষণ করি, তাতে একই সুর আমরা খুঁজে পাব। রাজীব গান্ধী শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন (জুলাই, ১৯৮৭)। উদ্দেশ্য ছিল একটাই-অন্য কোনো দেশ যাতে শ্রীলঙ্কায় ‘নাক’ গলাতে না পারে। পরবর্তীতে নির্বাচনে চীনাপন্থি প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে হেরে গিয়েছিলেন-কারণ তিনি ছিলেন কিছুটা চীনঘেঁষা এবং অভিযোগ ছিল হামকানতোতা গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা সাবমেরিন ঘাঁটি গেড়েছিল। ভুবনেশ্বরে (উড়িষ্যা) ইন্ডিয়ান ওমেন রীমের এক সম্মেলন হয়েছিল ২০১৫ সালের মার্চে। ওই অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, ভারত এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি সহ্য করবে না। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। ভারত চায় না চীন এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াক। বাংলাদেশের সাবমেরিন সংগ্রহের সঙ্গে এ প্রশ্নটি জড়িত। ভারতের উৎকণ্ঠা আছে।
২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর এই সাবমেরিন দুটি বাংলাদেশের কাছে সরবরাহ করা হয়েছিল। এর ঠিক দু’সপ্তাহের মাথায় ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্কর বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেটা ছিল কোনো ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। তবে একটা বিষয় আমার কাছে এখনো অস্পষ্ট। বাংলাদেশ এই সাবমেরিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সম্ভবত ২০১৪ সালে। গত প্রায় এক বছরের ওপরে বাংলাদেশি নাবিক ও কমান্ডিং অফিসাররা চীনে প্রশিক্ষণে ছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তা অজানা নয়। এখন ভারতীয় সরকার কিংবা বিশ্লেষকরা যেভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয় বরং তা দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করতে পারে। একজন ভারতীয় নেভির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদপত্রে এর প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ভারত প্রয়োজনে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্র সীমানাবর্তী ভারতীয় এলাকায় মিসাইল ব্যাটারি বসাবে। নতুন নৌঘাঁটি করার কথাও তিনি বলেছেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আছে কিনা জানি না, কিন্তু এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত (?) দু’ দেশের বন্ধুত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার শামিল। সংবাদপত্রে (ভারতীয়) বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক একজন হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর একটি বক্তব্য দেখলাম। তিনি এটাকে ‘অর্থের অপচয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ভারতীয় কর্মকর্তা তথা নীতি-নির্ধারকদের মাঝে এক ধরনের ‘নিচু মানসিকতা’ কাজ করে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ‘এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের’ মধ্যে রাখতে চায় ভারত, এটাকেই কিনা বিশ্লেষকরা ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই যে মানসিকতা, তাতে কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বর্তমান বিজেপি সরকারের কোনো পার্থক্য নেই।
বাংলাদেশ তার নৌবাহিনীর জন্য সাবমেরিন সংগ্রহ করেছে, তা শুধু একটাই কারণে। আর তা হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, সমুদ্রে আমাদের সম্পদের গ্যারান্টি দেয়া এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আসরে নৌবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। একই সঙ্গে আরো একটি বিষয় আমাদের নীতি-নির্ধারকরা বিবেচনায় নিয়েছেন, তা হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের কাছেই এখন সাবমেরিন আছে। বাংলাদেশ এখন এই কাতারে শরিক হলো মাত্র। ২০১৫+ সালে মিয়ানমার রাশিয়া থেকে সাবমেরিন সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত আর্থিক বিষয়টির সমাধান না হওয়ায় সেই পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। তবে পাকিস্তান নেভি মিয়ানমারের ক্রুদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, এমন খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। পাকিস্তান তাদের পুরনো টাইপের দুটি সাবমেরিন মিয়ানমারের কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিল। ২০১৬ সালে ভিয়েতনাম তাদের নৌবাহিনীতে ৬টি সাবমেরিন সংযোজন করেছে। মালয়েশিয়ার নেভি ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফ্রান্সের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয় করেছে। ইন্দোনেশিয়ার অনেক আগে থেকেই সাবমেরিন ছিল। ২০২০ সালের মধ্যে তাদের বহরে মোট ১২টি সাবমেনি সংযোজিত হবে। ইতোমধ্যে পুরনো টাইপের দুটি সাবমেরিনের বদলে নতুন দুটি সাবমেরিন বহরে যুক্ত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো কিন্তু কেউই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে না। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা এখন নির্ধারিত। সমুদ্রে এখন আমাদের সীমান্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায় আমাদের পক্ষে। এতে বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার বেশি টেরিটোরিয়াল সি, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশের সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর অধিকার পেয়েছে। এই সম্পদকে রক্ষা করতে হলে দরকার শক্তিশালী নৌবাহিনী। পাঠক, ২০০৮ সালের একটি পরিস্থিতির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। ওই সময় গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের নৌবাহিনী ও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। মিয়ানমার তার গভীর সমুদ্রে এ-৩ ও এ-১ ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইও কোম্পানিকে ব্যবহার করেছিল। দাইও কোম্পানি বাংলাদেশের সীমানার ভেতরেও ঢুকে অনুসন্ধান কাজ চালাচ্ছিল। বাংলাদেশের নৌবাহিনী তখন চ্যালেঞ্জ করেছিল। একপর্যায়ে সংঘর্ষের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। পরে মিয়ানমারের নৌবাহিনী সরে গেলেও দাইও তাদের কাজ বন্ধ করে দিলে উত্তেজনার অবসান ঘটেছিল। মিয়ানমারের এ-৩ ও এ-১ ব্লকের পাশাপাশি আমাদের রয়েছে ব্লক ১২, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইওর সহযোগী অপর একটি সংস্থার, সঙ্গে পেট্রোবাংলা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এক্ষেত্রে ‘বড় জটিলতা’ এড়াতে হলে আমাদের শক্তিশালী নৌবাহিনী দরকার। সাবমেরিন এক্ষেত্রে যুদ্ধ করবে না বরং যে কোনো সম্ভাব্য আক্রমণকে ‘নিউট্রাল’ করতে পারবে। আমাদের নৌবাহিনী ও তাদের অফিসাররা তাদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন অতীতে। বিএনএস ওসমান ও বিএনএস মধুমতি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় লেবাননে মোতায়েন করা হয়েছিল। এখন সাবমেরিন সংযোজনের ফলে তাদের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়ল। এটা বাংলাদেশের জন্য আরো সম্মান বয়ে আনবে। বাংলাদেশের এই গর্বের জায়গাটাকে আমরা ধরে রাখতে চাই। শুধু নৌবাহিনী কেন? এখন সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও আরো শক্তিশালী করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কেউ যদি আক্রমণ করে, তাহলে যেন তার সমুচিত জবাব দিতে পারি, সে প্রস্তুতি আমাদের থাকবে।’ এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। আমরা শান্তিবাদী দেশ। আমরা শান্তি চাই। কিন্তু যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত আক্রমণ চ্যালেঞ্জ ও রোধ করার সক্ষমতা আমাদের থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাতে প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটা আগেও ছিল। এখন এটি আইনি দলিলে পরিণত হলো। অস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত একটি চুক্তিও হয়েছে। কিন্তু তাতে বলা হয়েছে প্রয়োজন হলেই বাংলাদেশ ওই অর্থ ব্যবহার করে ভারতীয় অস্ত্র তথা সরঞ্জাম কিনবে। আমাদের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে যদি এ ধরনের অস্ত্রের প্রয়োজন হয়, আমরা অবশ্যই তা কিনব।
ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতের অবস্থান ২ দশমিক ৮ ভাগ হলেও ২০৫০ সালে ভারত হবে দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ। তখন চীন থাকবে প্রথম অবস্থানে। আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে তৃতীয়। আমাদের সৌভাগ্য যে দুটি বড় অর্থনীতির দেশই আমাদের প্রতিবেশী। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশী হলেও ভারত আমাদের প্রতিবেশী। সুতরাং আমাদের উন্নয়নে এই দুটি দেশের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতিতে তাই এই দুটি দেশকেই তিনি প্রাধান্য দিচ্ছেন। তিনি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছেন। তিনি চীনে গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৬ সালে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৫ সালে। এখন প্রধানমন্ত্রী ভারত গেলেন। প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সুতরাং ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে ভারতের সহযোগিতা তিনি চেয়েছিলেন। চীনের ও ভারতের সহযোগিতায় আমরা আগামীতে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করতে পারব বলে আশা করছি। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে অনেক কিছুই আমরা পাইনি বটে; কিন্তু দু’দেশকে আরো কাছে নিয়ে এলো। ভারতের নেতারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব তাদের প্রয়োজন। এখন বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারত যদি আরো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তা আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল।
Daily Manobkontho
11.04.2017

0 comments:

Post a Comment