সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার জন্ম হয়। বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা হচ্ছে নয়া বিশ্বব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা যেখানে কমে এসেছিল, সেখানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিতে দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে দেশগুলো এমন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, যা কিনা নয়া বিশ্বব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। একুশ শতকে এসে সেই ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। জন্ম হয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি নতুন, কিন্তু এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বিপুল এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা মূলত গড়ে ওঠে পাশাপাশি দুটি বা তিনটি রাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে। সেখানে পুরো রাষ্ট্রটি জড়িত থাকে না, জড়িত থাকে কিছু অঞ্চল। আর অঞ্চল ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশ সার্ক কিংবা বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় জড়িত থাকলেও বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএমের মতো উপ-আঞ্চলিক সংস্থায় নিজেকে জড়িত করেছে। বিবিআইএন (BBIN) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা প্রথম জানা যায় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ ঘোষণাপত্রটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ৪১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে উভয় প্রধানমন্ত্রী বিবিআইএনের আওতায় বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি খাতে সহযোগিতার সুযোগ কাজে লাগাতে সম্মত হয়েছেন। এই বিবিআইএন হচ্ছে ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা বাস সার্ভিস। যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিসও চালু হবে। কলকাতা-খুলনার মধ্যে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনও এরই মধ্যে চালু হয়েছে। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহনে এখন এই সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এর সবই হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। গত ১৫ জুন (২০১৫) বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর ভুটানের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে এ চারটি দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের সময় ভুটান এতে রাজি হয়েছে। কেননা, ভুটানের সংসদ আপত্তি তুলেছিল। সংসদে তা অনুমোদিত হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমে আমরা প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোট নিয়েও আলোচনা করতে পারি। বিসিআইএম (BCIM) হচ্ছে অন্য একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই জোটে আছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাত বোন রাজ্যগুলো) ও মিয়ানমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তাঁর চীন সফরের সময় এই বিসিআইএম করিডরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটিকে একসময় ‘কুনমিং উদ্যোগ’ বলা হতো। চীন ২০০৩ সালে এ ধরনের একটি সহযোগিতার কথা প্রথম বলেছিল, যা পরবর্তী সময়ে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই জোটটি কার্যকর হলে কুনমিং (চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। এর ফলে চীনা পণ্যের দাম কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে আসিয়ানে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার, যার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। বিসিআইএম জোটের সম্ভাবনা বিশাল। কারণ এই চারটি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহূত জমি (মিয়ানমার) ও সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে ভবিষ্যতে, যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে এই জোট। বলাই বাহুল্য, এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ শতাংশ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলারে। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ২৮৮ কোটি মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশে। পূর্বে কুনমিং আর পশ্চিমে কলকাতা। মাঝখানে মিয়ানমারের মিন্দানাও ও ঢাকা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে এতে করে ভবিষ্যতে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়া সহজ হয় এবং তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ানের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। আমরাও এ সুযোগটি নিতে পারি।
কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। বিবিআইএন জোট যদি সফল হয়, তাহলে জোটভুক্ত চারটি দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে। সিলেট হয়ে উঠতে পারে অন্যতম একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। একই কথা প্রযোজ্য বিসিআইএমের ক্ষেত্রেও। সড়কপথ যদি প্রশস্ত হয়, যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ তথা কৃষি ও মত্স্যসম্পদ ব্যবহার করে তা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে আমাদের অর্থনীতিতে। তাই কানেকটিভি ব্যবহার করতে হবে আমাদের সবার স্বার্থে। আমরা দেখতে চাই আমাদের স্বার্থ। কানেকটিভিটি ব্যবহার করে কোনো একটি দেশ লাভবান হবে, তা হতে পারে না। আমরাও চাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করে আমাদের পণ্য নেপাল ও ভুটান যাক। সড়কপথে আমরা যেতে চাই কুনমিংয়ে। কিন্তু এ জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা যদি গড়ে ওঠে, তাহলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে—এটি বলার আর অপেক্ষা রাখে না। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে একটি বড় সমস্যা ভারতকে নিয়ে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এখন পুরোপুরিভাবে দ্বিপক্ষীয়তার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অর্থাৎ ভারত উন্নয়ন ও সম্পর্ক রক্ষা করে দ্বিপক্ষীয়তার আলোকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে কিংবা নেপালের সঙ্গে ভারতের যে সমস্যা, তা ভারত সমাধান করতে চায় দ্বিপক্ষীয়তার আলোকে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুপক্ষীয়তা। বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএম বহুপক্ষীয়তার আলোকেই রচিত। ভারত এতে এখন সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু এর পূর্ণ বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে যখন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশের সমস্যা এই মুহূর্তে দুটি। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এই সমস্যা দুটির সমাধান সম্ভব। এই সমস্যা দুটি হচ্ছে পানি ও জ্বালানি। জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থাৎ বিবিআইএনের আলোকে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে এ অঞ্চলে। ভুটান ও নেপালে বিপুল জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এ খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও ভারতের সম্মতি পাওয়া না গেলে তা বাংলাদেশে আনা যাবে না। সুতরাং বাংলাদেশের বিনিয়োগ তখনই কাজে লাগবে যখন উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বাংলাদেশে আসবে। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত এ ব্যাপারে রাজি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী গত ২২ এপ্রিল ঢাকায় বিমসটেক সচিবালয়ে বিমসটেক নেটওয়ার্ক অব পলিসি থিংক ট্যাংকসের (বিএনপিটিটি) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার যথেষ্ট ভবিষ্যৎ রয়েছে। তিনি বিমসটেকের পাশাপাশি বিবিআইএন ও বিসিআইএমের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গড়ার কথা বলেন (কালের কণ্ঠ, ২৩ এপ্রিল)। এটিই হচ্ছে আসল কথা। সার্ক এখন অকার্যকর। শেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। একসময় সার্ক যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল, তা ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকেই আমাদের উন্নয়ন ও প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
Daily Kalerkontho
30.04.2017
0 comments:
Post a Comment