রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি মহাসমাবেশ, একটি উক্তি ও কিছু প্রশ্ন


বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ইসলামী আন্দোলন একটি মহাসমাবেশ করেছে গত ২১ এপ্রিল। একটি জাতীয় দৈনিক ওই সমাবেশের বিশাল এক ছবিও ছেপেছে। তাতে শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যায়। ওই সমাবেশে বক্তৃতা করেন চরমোনাইর আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম। সরকার যখন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের যখন বিচার করছেন, তখন এ ধরনের এক বিশাল সমাবেশ নানা প্রশ্নের জন্ম দেয় বৈ-কি! কেননা চরমোনাইর প্রয়াত পীর ও সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীমের বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। দ্বিতীয়ত, সরকার ইসলামী আন্দোলনকে এ সমাবেশ করতে অনুমতি দিয়েছিল; কিন্তু বিএনপি চাইলেই কী তখন এ সময়ের একটি সমাবেশের অনুমতি পাবে? ইসলামী আন্দোলনের সভায় ঘোষণা দেয়া হয়েছে, রোজার আগেই সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত 'গ্রিক মূর্তি' অপসারণের। যদি অপসারণ করা না হয়, তাহলে ১৭ রমজান সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে এবং ঈদের পর সুপ্রিম কোর্ট ঘোরাও করা হবে (যুগান্তর ২২ এপ্রিল)। একইদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন কওমির ছাত্র-শিক্ষকরা জঙ্গি হতে পারে না। তিনি বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামী পার্টির জঙ্গিবিরোধী সমাবেশে বক্তৃতা করছিলেন (মানবকণ্ঠ, ২২ এপ্রিল) এ ধরনের বক্তব্যও আমার কাছে কিছুটা নতুন। কেননা একাধিক আওয়ামী লীগ তথা শরিক ১৪ দলের নেতাদের মুখ থেকে আমরা শুনেছি, কিংবা টিভি টকশোতে সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবীদের মুখ থেকেও আমরা শুনেছি যে, কাওমি মাদ্রাসাগুলো জঙ্গি তৈরির কারখানা। দু'তিনদিন আগেও (সম্ভবত ২০ এপ্রিল) ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির এক অনুষ্ঠানে সরকার সমর্থক জাসদ নেতা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেছেন মাওলানা শফী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। এর অর্থ পরিষ্কার, সরকার যখন ইসলামপন্থিদের সঙ্গে এক ধরনের 'সমাঝোতায়' গেছে, কওমি মাদ্রাসার 'দাওরায়ে হাদিস'কে যখন মাস্টার্সের সমমান হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন সরকার সমর্থকদের কেউ কেউ এর বিরোধিতা করছেন। অধ্যাপক আনোয়ারের বক্তব্য, সে কথাই প্রমাণ করে। তবে প্রধানমন্ত্রী আল্লামা শফীর নেতৃত্বাধীন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার শীর্ষ স্থানীয় আলোমদের সঙ্গে গত ১১ এপ্রিল যে বৈঠকটি করেছিলেন। তা ছিল একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ সংগঠনটির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পর্ক আছে। তিনি শুধু মিলিতই হননি বরং হেফাজত গ্রিক ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়ার যে দাবি করেছে তারপ্রতি সমর্থন জানান। তিনি হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের আশ্বাস দেন যে, এ ব্যাপারে তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে এই যে, সমঝোতা, তা প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের আগের অবস্থারের ঠিক উল্টো। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় এক মহাসমাবেশ ডেকেছিল। ওই মহাসমাবেশ নানা কারণে 'বিতর্কিত' হয়েছিল। হেফাজতের কর্মীরা ঢাকায় তা-ব চালিয়েছিল। তাদের কর্মীরা বায়তুল মোকাররম এলাকায় ফুটপাতের দোকানে থাকা কোরআন শরীফ পুড়িয়েছিল বলে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। ওই মহাসমাবেশ সরকার উৎখাতে এক ষড়যন্ত্র ছিল বলেও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠে বিএনপির বিরুদ্ধেও। বেগম জিয়া হেফাজতের মহাসমাবেশের প্রতি তার সমর্থন জানিয়েছিল এবং ওই সময় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থানত হেফাজতের নেতাকর্মীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে সিনিয়র নেতৃত্বকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি জাতীয় পার্টিও তাদের সমর্থন জানিয়েছিল। সরকার শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীদের বিরুদ্ধে 'কঠোর ব্যবস্থা' নিলে শেষ পর্যন্ত হেফাজতের মহাসমাবেশ প- হয়ে যায় (অপারেশন সিকিউর শাপলা)। ওই অভিযানে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও, লন্ডনের ইকোনমিস্ট ৫০ জন ও টেলিগ্রাক ৩৬ জন (২১ মে ২০১৩) মৃত্যুর দাবি করেছিল। যদিও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সরকার তখন হেফাজতে ইসলামির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। যা আজো চলমান। শুধু তাই নয়, ওই সময় শাপলা চত্বরে অবস্থানরতদের বিরুদ্ধে অভিযান 'লাইভ সম্প্রচার'-এর অভিযোগে দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্ক কখনো ভালো ছিল না। হেফাজতের আমির শাহ্ আহমেদ শফীকে, 'তেঁতুল হুজুর', কিংবা হেফাজত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এমন অভিযোগ বারবার সরকারের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। এখন দেখা গেল সরকার তাদের সঙ্গেই সমাঝোতা করছে। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব? হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। ২০১০ সালে জন্ম নেয়া এ সংগঠনটি মূলত কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররাই এ সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত। সংগঠনটি তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠন না হলেও, তাদের কর্মকা- রাজনৈতিক। তাদের যে ১৩ দফা দাবি, তার মাঝেও আছে রাজনীতি। এ সংগঠনটি গড়ে ওঠে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারি মাদ্রাসা ও এর প্রিন্সিপাল আল্লামা শাহ আহমেদ শফীকে কেন্দ্র করে। আল্লামা শফীর প্রচুর মুরিদ আছেন, দেশজুড়ে। এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাদ্রাসাশিক্ষকরা তার ছাত্র। বিদেশেও তার মুরিদ আছে। তাকে কেন্দ্র করে এবং তাকে সামনে রেখে হেফাজত সংগঠিত হয় এবং এক সময় একটি বড় সংগঠনে পরিণত হয়। ২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকায় সমাবেশ ডেকে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ সংগঠনটিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। সরকার এই সংগঠনটিকে হাতে রাখার উদ্দেশে আল্লামা শফির ছেলে আনাস মাদানিকে ব্যবহার করে। অভিযোগ আছে মাদানি সরকারের কাছ থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এখন সরকার হেফাজতের সঙ্গে যে সমাঝোতায় গেছে, তার পেছনে ধর্মীয় কারণ কতটুকুই বা আছে, তার চেয়ে বেশি আছে রাজনৈতিক কারণ। সরকার মূলত এখন জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য সরকারবিরোধী ইসলাম পছন্দ দলগুলোর বিকল্প হিসেবে হেফাজত ইসলামকে ব্যবহার করবে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলোর তেমন কোনো 'অবস্থান' না থাকলেও হেফাজতের একটা বিশাল জনসমর্থন রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে রয়েছে অনেক মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষক এবং ছাত্ররা হেফাজতের সমর্থক। হেফাজতের ডাকে এরা সাড়া দেয়। বলা হয় প্রায় ১৪ লাখ ছাত্রছাত্রী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। আর এদের আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। ফলে বিশাল এক জনগোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামীর সমর্থক হয়ে পড়েছে। সুতরাং সরকার অত্যন্ত সুকৌশলে আগামী নির্বাচনকে বিবেচনা করে হেফাজতে ইসলামীর সঙ্গে একটি 'সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে। সরকারের টার্গেট মূলত ইসলামিক দলগুলোকে আস্থায় নেয়া। পাঠক, স্মরণ করতে পারেন ২০১৬ সালেও সরকার হেফাজত মজলিসের সঙ্গে ৫ দফা চুক্তি করেছিল। সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অভিযোগ সরকার ইসলামপন্থিদের খুশি করার জন্যই সংবিধানে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' রেখেছিল। সংবিধানের প্রথম ভাগে ২(ক)তে বলা হয়েছে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম...'। আবার দ্বিতীয়ভাগের ৮(১)-এ বলা হয়েছে 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের পরিচালনায় মূলনীতি বলে গণ্য হবে।' একদিকে রাষ্ট্রধর্ম, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা এটা যে সাংঘর্ষিক, সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এটা বার বার বলার চেষ্টা করছেন; কিন্তু সরকারপ্রধান চেয়েছেন, ইসলামপন্থিদের সমর্থন নিশ্চিত করতে। যে কারণে দেখা যায় পাঠ্যপুস্তকেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল। শুধু হেফাজত সমর্থকদের খুশি করার জন্য। একসময় বিএনপি তথা ২০ দল হেফাজতে ইসলামীর আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। এখন সেটা ইতিহাস। হেফাজতে ইসলাম এখন আর বিএনপি তথা ২০ দলের সঙ্গে নেই।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের 'সমঝোতা' নিয়ে ১৪ দলের অনেকেই নাখোশ হয়েছেন। তিনজন মন্ত্রীর মন্তব্য তাও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাতে তারা যে অসন্তুষ্ট, তা প্রকাশিত হয়েছে। রাশেদ খান মেনন বলেছেন, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমাঝোতার ফলে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন তার কাছে এটা বোধগম্য নয়, কেন সরকার হেফাজতের সঙ্গে সমাঝোতা করল। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর মন্তব্যও অনেকটা তেমনি। হেফাজত বাংলা নববর্ষ পালনের বদলে হিজরি নববর্ষ পালনের যে আহ্বান জানিয়েছে, তার সমালোচনা করে তার ভাষায় 'তেঁতুল হুজুর'দের কর্মকা-ের তিনি সমালোচনা করেন। ইতিমধ্যে সোস্যাল মিডিয়ায় একদিকে সরকারের যেমনি সমালোচনা করা হয়েছে, অন্যদিকে ওই তিন মন্ত্রীও সমালোচিত হয়েছেন। মন্ত্রিসভায় তাদের থাকার যৌক্তিকতা নিয়েও এখন প্রশ্ন রাখা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, তাকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বলেই ধরে নেয়া হয়, বলেছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের এই 'সমাঝোতা' এ দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটাবে। তাবে গণজাগরণ মঞ্চ এ ব্যাপারে কোনো কর্মসূচি দেয়নি। ইমরান এইচ সরকারের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে ধরা পড়েনি।
হেফাজতের পর চরমোনাইর পীরের সমাবেশ করতে দেয়া প্রমাণ করে সরকার ইসলামপন্থিদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় যাচ্ছে। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তবে ইসলামী আন্দোলন একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইসলামী আন্দোলন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে নেই। আবার হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেও সরাসরি বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। জোটগত কোনো অাঁতাতও নেই। উপরে উলি্লখিত দুটি ঘটনা প্রমাণ করে সরকার ইসলাম পছন্দ কিছু দলের সঙ্গে একটি সহনীয় অবস্থানে যাচ্ছে। মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকারের এ অবস্থান। এই অবস্থান শেষ পর্যন্ত একটি নির্বাচনী 'অাঁতাত'-এ পরিণত হয় কি-না, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
বলা ভালো নির্বাচনী রাজনীতিতে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা হেফাজত ও ইসলামী আন্দোলন কোনো ফ্যাক্টর নয়। এদের সমাবেশে লোকজন হয় বটে, কিন্তু ভোটের সময় মানুষের মনে পছন্দ মূলত দুটি বা তিনটি বড় দলের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই হেফাজতের সঙ্গে 'সমাঝোতা' কিংবা ইসলামী আন্দোলনকে ঢাকায় সমাবেশ করতে দেয়া রাজনীতির ময়দানে যে বিতর্ক বাড়াবে, তা অস্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই।
Daily Jai Jai Din24.04.2017

0 comments:

Post a Comment