রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

এই সমঝোতার পরিণতিতে জাতি কী পাবে?


কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের ‘সমঝোতার’ পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই ‘সমঝোতার’ শেষ কোথায়? শুধু ‘দাওরায়ে হাদিস’কে মাস্টার্সের (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান দিয়েই কি এ সমঝোতা শেষ হবে? নাকি এই সমঝোতা একটি স্থায়ী ভিত্তি পাবে? গত ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিনিয়র আলেমদের উপস্থিতিতে বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান হিসেবে ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর খুব দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করে। ফলে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া হল। একইসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট ভবনের সামনে যে গ্রিক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে, হেফাজতে ইসলাম যা সরিয়ে নেয়ার দাবি করে আসছিল, তার প্রতিও প্রধানমন্ত্রী সমর্থন জানান। তিনি হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের আশ্বাস দেন, এ ব্যাপারে তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন।

হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে এই যে ‘সমঝোতা’, তা প্রধানমন্ত্রীর তথা সরকারের আগের অবস্থানের ঠিক উল্টো। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় এক মহাসমাবেশ ডেকেছিল। ওই সমাবেশ নানা কারণে ‘বিতর্কিত’ হয়েছিল। হেফাজতের কর্মীরা ঢাকায় তাণ্ডব চালিয়েছিল। তাদের কর্মীরা বায়তুল মোকাররম এলাকায় ফুটপাতের দোকানে থাকা কোরআন শরিফ পুড়িয়েছিল বলে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। ওই মহাসমাবেশ সরকার উৎখাতের এক ষড়যন্ত্র ছিল বলেও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠে বিএনপির বিরুদ্ধেও। খালেদা জিয়া হেফাজতের মহাসমাবেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং ওই সময় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থানরত হেফাজতের নেতা-কর্মীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে দলের সিনিয়র নেতাদের সেখানে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি জাতীয় পার্টিও তাদের সমর্থন জানিয়েছিল। সরকার শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ (‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’) নিলে শেষ পর্যন্ত হেফাজতের মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। ওই অভিযানে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট ৫০ ও টেলিগ্রাফ ৩৬ জনের (২১ মে ২০১৩) মৃত্যুর দাবি করেছিল। যদিও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার তখন হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, যা আজও চলমান। শুধু তাই নয়, ওই সময় শাপলা চত্বরে অবস্থানরতদের বিরুদ্ধে অভিযান ‘লাইভ সম্প্রচারের’ অভিযোগে দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্ক কখনও ভালো ছিল না। হেফাজত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে- এমন অভিযোগ বারবার সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। এখন দেখা গেল সরকার তাদের সঙ্গেই সমঝোতা করছে। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব?

হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। ২০১০ সালে জন্ম নেয়া এ সংগঠনটি মূলত কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্র্রিক। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররাই এ সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত। সংগঠনটি তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠন না হলেও তাদের কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক। তাদের যে ১৩ দফা দাবি, তার মাঝেও আছে রাজনীতি। সংগঠনটি গড়ে ওঠে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা ও এর প্রিন্সিপাল আল্লামা শাহ আহমেদ শফীকে কেন্দ্র করে। আল্লামা শফীর প্রচুর মুরিদ আছেন দেশজুড়ে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মাদ্রাসা শিক্ষকরা তার ছাত্র। বিদেশেও তার মুরিদ আছে। তাকে কেন্দ্র করে এবং তাকে সামনে রেখে হেফাজত সংগঠিত হয় এবং একসময় একটি বড় সংগঠনে পরিণত হয়। ২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকায় সমাবেশ ডেকে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠনটিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। সরকার এ সংগঠনটিকে হাতে রাখার উদ্দেশ্যে আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে ব্যবহার করে। অভিযোগ আছে, মাদানী সরকারের কাছ থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এখন সরকার হেফাজতের সঙ্গে যে সমঝোতায় গেছে, তার পেছনে ধর্মীয় কারণ যতটুকু না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে রাজনৈতিক কারণ। সরকার মূলত এখন জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য সরকারবিরোধী ইসলাম-পছন্দ দলের বিকল্প হিসেবে হেফাজতে ইসলামকে ব্যবহার করছে।

দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলোর তেমন কোনো ‘অবস্থান’ না থাকলেও হেফাজতের একটা বিশাল জনসমর্থন রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে রয়েছে অনেক মাদ্রাসা। এসব মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষক ও ছাত্ররা হেফাজতের সমর্থক। হেফাজতের ডাকে এরা সাড়া দেয়। বলা হয়, প্রায় ১৪ লাখ ছাত্রছাত্রী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। আর এদের আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। ফলে বিশাল এক জনগোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের সমর্থক হয়ে পড়েছে। সুতরাং সরকার অত্যন্ত সুকৌশলে আগামী নির্বাচনের কথা বিবেচনা করে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একটি ‘সুসম্পর্ক’ গড়ে তুলতে চাইছে। সরকারের টার্গেট মূলত ইসলামী দলগুলোকে আস্থায় নেয়া। পাঠক, স্মরণ করতে পারেন ২০০৬ সালেও সরকার খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে ৫ দফা চুক্তি করেছিল। সরকার সমর্থক বুদ্ধিবীজীদের একটা বড় অভিযোগ, সরকার ইসলামপন্থীদের খুশি করার জন্যই সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বহাল রেখেছিল। সংবিধানের প্রথম ভাগে ২(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম...’। আবার দ্বিতীয় ভাগের ৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের পরিচালনায় মূলনীতি বলিয়া গণ্য হইবে।’ একদিকে রাষ্ট্রধর্ম, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা- এটা যে সাংঘর্ষিক, সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এটা বারবার বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সরকারপ্রধান চেয়েছেন ইসলামপন্থীদের সমর্থন নিশ্চিত করতে। যে কারণে দেখা যায় পাঠ্যপুস্তকেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল শুধু হেফাজত সমর্থকদের খুশি করার জন্য। একসময় বিএনপি তথা ২০ দল হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। এখন সেটা ইতিহাস। হেফাজতে ইসলাম এখন আর বিএনপি তথা ২০ দলের সঙ্গে নেই।

তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের ‘সমঝোতা’ নিয়ে ১৪ দলের অনেকেই নাখোশ হয়েছেন। তিনজন মন্ত্রীর মন্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাতে তারা যে অসন্তুষ্ট, তা প্রকাশিত হয়েছে। রাশেদ খান মেনন বলেছেন, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার ফলে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, তার কাছে এটা বোধগম্য নয় কেন সরকার হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করল। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর মন্তব্যও অনেকটা তেমনি। হেফাজত বাংলা নববর্ষ পালনের বদলে হিজরি নববর্ষ পালনের যে আহ্বান জানিয়েছে, তিনি তার সমালোচনা করে তার ভাষায় ‘তেঁতুল হুজুর’দের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন। ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় একদিকে সরকারের যেমন সমালোচনা করা হয়েছে, অন্যদিকে ওই তিন মন্ত্রীও সমালোচিত হয়েছেন। মন্ত্রিসভায় এখন তাদের থাকার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রাখা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, যাকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বলেই ধরে নেয়া হয়, বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের এই ‘সমঝোতা’ এ দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটাবে। তবে গণজাগরণ মঞ্চ এ ব্যাপারে কোনো কর্মসূচি দেয়নি। ইমরান এইচ সরকারের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে পড়েনি।

হেফাজতের সঙ্গে এই ‘সমঝোতার’ পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, প্রশ্ন হচ্ছে, এর ফলে জাতি কী পাবে? সরকারপ্রধানের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এই ঘোষণা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় বিতর্কের সৃষ্টি করবে। ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে, কওমি স্বীকৃতি বাতিলের দাবিতে সুন্নিরা মাঠে নামবে। সুন্নিরা দাবি তুলেছে, আলীয়া ও কওমি মাদ্রাসা একত্রিত করে একটা বোর্ড গঠন করা হোক। দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান দেয়ায় শিক্ষার মান নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠবে। কওমি মাদ্রাসা ও এর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে প্রশ্ন আছে। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও কওমি মাদ্রাসা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কওমি মাদ্রাসা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না। এখানে কী পড়ানো হয়, কারা এখানে পড়ান, তারও নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। তবে আলীয়া মাদ্রাসা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। এদের জন্য আলাদা শিক্ষা বোর্ডও আছে। অন্যদিকে কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করে কিছু ব্যক্তি। ওইসব ব্যক্তির কেউ কেউ আবার রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত। সরকারের কোনো অনুদান এখানে নেই। ব্যক্তি সাহায্যের ওপরই এসব মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। বর্তমানে নিবন্ধনকৃত কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৫ হাজার। কিন্তু অভিযোগ আছে, এ সংখ্যা ৬০ হাজারের কাছাকাছি। বেসরকারিভাবে ৬টি বোর্ড বা ‘বেফাকুল মালারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে এই কওমি মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হয়। এদের শিক্ষা কার্যক্রম ভারতের বিখ্যাত দেওবন্দের (দারুল উলুম দেওবন্দ) অনুসরণে পরিচালিত হয়। কওমি মাদ্রাসা আধুনিকীকরণ নিয়ে ২০০৬ সালেই একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের ফলে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে নতুন করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। যতদূর জানা যায়, এই কমিটি ৬ ধাপে (প্রাইমারি, জুনিয়র সার্টিফিকেট, এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স ও মাস্টার্স সমমান) কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব করেছিল। একইসঙ্গে এই শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ও ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা অন্তর্ভুক্ত করারও প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখন দাওরায়ে হাদিস পর্যায়ে যারা অধ্যয়ন করেছেন, তাদের সাধারণ শিক্ষা, বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় মাস্টার্সের স্বীকৃতি পেলেও তারা সমাজ জীবনে কতটুকু অবদান রাখতে পারবে, এ প্রশ্ন থাকলোই।

এমনিতেই দেশে উচ্চশিক্ষা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রায় একশ’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর হাজার হজার মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরুচ্ছে। এর উপরে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সার্টিফিকেট পাওয়াটাই হল পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হল কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস। এর ফলে উচ্চশিক্ষায় সার্টিফিকেটের এক মহাবিস্ফোরণ ঘটবে! এরা সমাজ জীবনে, রাষ্ট্র কাঠামোয় কোনো অবদান রাখতে পারবে না। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কোনো পরামর্শ নেয়া হয়নি। অথচ উচ্চশিক্ষা প্রসারে মঞ্জুরি কমিশনের একটি ভূমিকা রয়েছে। স্পষ্টতই কওমি শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর তথা এদের নেতৃত্বদানকারী হেফাজতে ইসলামের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্যই এই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চশিক্ষাকে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার যৌক্তিকতা আছে কিনা, সে ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের মতামত নেয়া উচিত ছিল। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান দেয়া আর যাই হোক, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখবে না। বরং নানা জটিলতা তৈরি করবে।

ইতিমধ্যে কওমি মাদ্রাসার সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটির সভায় নতুন একটি শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে আল হাইয়াতুল উলাইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। এ বোর্ডের অধীনেই নেয়া হবে পরীক্ষা। কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট বাকি ৬টি শিক্ষা বোর্ড নতুন বোর্ডের অধীনে থাকবে। কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী ১৫ মে থেকে ‘দাওরায়ে হাদিস’ অর্থাৎ মাস্টার্সের পরীক্ষা শুরু হবে। আমি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখেছি সেখানে দাওরায়ে হাদিসের কোনো সিলেবাস নেই। তবে অন্যত্র সীমিত পরিসরে সিলেবাস আছে, যেখানে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। প্রশ্ন আরও আছে। কোনো বোর্ড এমএ ডিগ্রি দিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে এমএ ডিগ্রি দিতে পারে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, যা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে জড়িত করে এমএ পরীক্ষা নেয়া যেত। বোধকরি আল্লামা শফীরা এটি চাননি। তারা নিজেরা নিজেরা এমএ ডিগ্রি দেবেন। সেখানে কোন কোর্স থাকবে, পরীক্ষার সময় কতুটুকু হবে, ক’টি বিষয় পরীক্ষার আয়োজন করা হবে, এসবের সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা নেই। আমি অবাক হলাম, উচ্চশিক্ষার তদারককারী প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকেও দেখলাম না কোনো ভূমিকা পালন করতে। উচ্চশিক্ষা প্রসারে সরকার যেখানে আন্তরিক, সেখানে মঞ্জুরি কমিশনের ভূমিকা নেই। প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে একটি কাগুজে সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সরকার কওমি মাদ্রাসাকে আধুনিকীকরণ করতে চায়, এটি ভালো। কিন্তু এর শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে উচ্চশিক্ষায় বড় বিপর্যয় ঘটবে। এখনও সময় আছে। কওমি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে আনা হোক। নিন্ম তথা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা নবগঠিত বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে।
Daily  Jugantor
20.04.2017

0 comments:

Post a Comment