ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর শেষ হয়েছে গত ৭ সেপ্টেম্বর। এই সফর নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। আমাদের কিছু কিছু পত্রপত্রিকা, বিশ্লেষক ও সরকারি মহল যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, মনমোহনের সফরের পর এই উচ্ছাস এখন আর থাকল না। এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ খুব একটা পেয়েছে বলে মনে হয় না। তবে ভারতের প্রাপ্তিটাও যে খুব বেশি তাও মনে হয় না। এটা একটা সাদামাটা সফর। যে চুক্তি, সমঝোতা ও প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা নিয়েও কথা আছে। তিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও ভারতে বিজেপির বিরোধিতায় এই সিদ্ধান্তকে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। এটা ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা, ২০১০ সালের জানুয়ারি) নয়াদিলি্ল সফরের পেরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর। এটা এক ধরনের প্রটোকল। প্রটোকল অনুসরণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই যে সফর, তাকে সফল বলা যাবে না। বাংলাদেশ চেয়েছিল তিস্তার পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এবং উত্তরবঙ্গের মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একটি চুক্তির ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছালেও (বাংলাদেশ পানির ৪৮ ভাগ, ভারত ৫২ ভাগ) শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির মুখে কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভব হলো না। এটাকে মনমোহন সিং দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, বাংলাদেশের ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সামনে চলে এলো। মমতার ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এখন তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশ ট্রানজিটে সম্মতিপত্র দেয়নি। তবে যে সমঝোতা হয়েছে, তাতে নেপালকে ট্রানজিট দিতে সম্মত হয়েছে ভারত।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি যেমনি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভারত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের বিষয়টি। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার নয়াদিলি্ল সফরের সময় একটা সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু খুঁটিনাটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ভারত থেকে আমরা এখন ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনবো। এই বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশ ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানিকে কমিশন বাবদ ইউনিট প্রতি ৪ পয়সা করে মাসে ৭ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। এটা মূলত এক ধরনের দালালি ফি। শুধু তাই নয়, ভারত সীমান্তের যত দূর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে বাংলাদেশকে ততবেশি সঞ্চালন ফি (হুইলিং চার্জ) দিতে হবে। ভারতে খুচরা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ২ রুপি। বাংলাদেশ এখন কত টাকায় বিদ্যুৎ কিনবে (প্রতি ইউনিট), তা স্পষ্ট নয়। কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসবে, তাও আমরা জানি না। বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো জটিলতা হলে, তা কোন আইনে হবে, কোথায় মীমাংসা হবে, তাও স্পষ্ট নয়। উপরন্তু ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনতে আমাদের অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ আনতে আমাদের যে বিনিয়োগ ওই বিনিয়োগ দিয়ে আমরা স্থানীয়ভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতাম। কিছুদিন আগে খুলনা এবং চট্টগ্রামে কয়লা ভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্যও একটি চুক্তি হয়েছে। এই কয়লা আসবে ভারত থেকে, যা অত্যন্ত নিকৃষ্টমানের। এখানে যে প্রশ্নটি করা যায়, তা হচ্ছে যেখানে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচুর কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে এবং তা উত্তোলিতও হচ্ছে, সেখানে কয়লানীতি প্রণয়ন না করে কেন আমরা ভারতীয় কয়লার ওপর নির্ভরশীল হলাম? এই নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না।
ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সুন্দরবনের সুরক্ষা, বাঘরক্ষা, বিটিভি ও দূরদর্শনের সম্প্রচার বিনিময় ইত্যাদি যেসব চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে, তা আমার বিবেচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার বিবেচনায় যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা বা চুক্তি হওয়া উচিত ছিল তা হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে একটি সমঝোতা, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় স্থান পায়নি। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভারতকে উদ্যোগী হতে হবে স্পষ্ট করে। ট্যারিফ, প্যারা ট্যারিফের নামে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা চলবে না। এই ট্যারিফ কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারত কখনো নেয়নি। বাণিজ্য ঘাটতি একটি বড় বাধা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির যে পরিমাণ, তার প্রায় অর্ধেক ভারতের সঙ্গে।
২০১০-১১ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার, যা এর আগের বছরে ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ঘাটতির পরিমাণ দিনে দিনে বাড়লেও ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যেমন বাংলাদেশের মেলামাইনের চাহিদা ভারতে থাকলেও বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের প্রায় ৩২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। ভারত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের কোটা ৮০ লাখ পিস থেকে বাড়িয়ে ১ কোটিতে উন্নীত করলেও অশুল্কের কারণে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা উৎসাহী হচ্ছেন না। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত সিমেন্টের ওপর অতিরিক্ত ১৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। ভারত আগামী ৩ বছরের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২২৪টি পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করার অনুমতি চেয়েছে। কিন্তু এখন ভারতে বাংলাদেশি ৪৬টি পণ্য শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশাধিকারের অনুমতি দেয়া হলো বাংলাদেশকে। ৪৮০টি পণ্যের অনুমতি দেয়া হয়নি। দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার কথা। বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বল্পোন্নত। এ জন্য বাংলাদেশের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু ভারত সেই সুবিধা বাংলাদেশকে কখনোই দেয়নি। মনমোহনের সফরের সময় এই অশুল্ক বাধা নিয়ে আদৌ কোনো আলোচনা হলো না। যেখানে আমাদের স্বার্থ জড়িত, সেই বিষয়গুলো নিয়ে যদি আলোচনা নাই হয়, তাহলে এই সফরকে আমরা সফল বলতে পারি না।
টিপাইমুখ নিয়ে আদৌ আলোচনার কোনো সুযোগ ছিল না। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছিলেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। কিন্তু সম্প্রতি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের চেয়ারম্যান প্রেমাচান্দ পংকোজ। তিনি বাঁধ নির্মাণের সত্যতা স্বীকার করেছেন। বাঁধটি নির্মিত হলে পুরো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রীষ্মকালে ৯৪৬ কি.মি. এলাকা মরুভূমির ন্যায় শুকনো থাকবে। এই বিষয়টি যৌথ ইশতেহারে বা আলোচনায় থাকা উচিত ছিল। টিপাইমুখ বাঁধ আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ট্রানজিট নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। তবে ট্রানজিটের কাঠামোর ব্যাপারে সমঝোতা প্রয়োজন। অর্থাৎ কীভাবে ট্রানজিট চলবে, এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা। ভারত ১৫টি রুটে (নদীপথ, সড়কপথ ও রেল যোগাযোগ) ট্রানজিট চাচ্ছে। ভারত থেকে ঋণ নিয়ে ভারতের জন্যই আমরা অবকাঠামো তৈরি করে দিচ্ছি। ওই ঋণ (১০০ কোটি ডলার) সুদমুক্ত নয়। আমাদের অবকাঠামো ভারত ব্যবহার করবে। আমাদের স্বার্থ এখানে নেই। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী নয়াদিলি্ল সফর করে এসে আমাদের জানিয়ে দিলেন নতুন করে ট্রানজিট চুক্তি করার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা ১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে ভারত এই ট্রানজিট সুবিধা পেতে পারে। ড. রিজভীর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। যদি ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ট্রানজিট প্রাপ্তির সুযোগ থাকতো, তাহলে ভারত অনেক আগেই এই সুযোগ গ্রহণ করতো। অন্তত গওহর রিজভীর বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করতো না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর ৪ জন মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে এসেছিলেন তরুণ গগৈ আসাম, মানিক সরকার ত্রিপুরা, মুকুল সাংমা মেঘালয়, পু লাল থানওয়ালা মিজোরাম)। এতেই বোঝা যায় ভারতের স্বার্থ কোথায়। ভারত বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে চায়। এ ধরনের উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। ভারতের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। মনমোহনের সফরের মধ্য দিয়ে সব প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, এটা সত্য। কিন্তু দুদেশের সম্পর্ককে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। আস্থার সম্পর্কটা আরো দৃঢ় হয়েছে। এখন এই সম্পর্কটাকে আরো সামনে নিয়ে যেতে হবে। ভারত যদি সম্পর্ক উন্নয়নে আন্তরিক হয় ও দুদেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধানে উদ্যোগী হয়, তাহলে আগামীতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তা বড় একটা অবদান রাখবে।
দৈনিক যায় যায় দিন, শনিবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ২৬ ভাদ্র ১৪১৮ ১১ শাওয়াল
ড. তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি যেমনি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভারত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের বিষয়টি। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার নয়াদিলি্ল সফরের সময় একটা সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু খুঁটিনাটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ভারত থেকে আমরা এখন ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনবো। এই বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশ ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানিকে কমিশন বাবদ ইউনিট প্রতি ৪ পয়সা করে মাসে ৭ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। এটা মূলত এক ধরনের দালালি ফি। শুধু তাই নয়, ভারত সীমান্তের যত দূর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে বাংলাদেশকে ততবেশি সঞ্চালন ফি (হুইলিং চার্জ) দিতে হবে। ভারতে খুচরা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ২ রুপি। বাংলাদেশ এখন কত টাকায় বিদ্যুৎ কিনবে (প্রতি ইউনিট), তা স্পষ্ট নয়। কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসবে, তাও আমরা জানি না। বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো জটিলতা হলে, তা কোন আইনে হবে, কোথায় মীমাংসা হবে, তাও স্পষ্ট নয়। উপরন্তু ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনতে আমাদের অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ আনতে আমাদের যে বিনিয়োগ ওই বিনিয়োগ দিয়ে আমরা স্থানীয়ভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতাম। কিছুদিন আগে খুলনা এবং চট্টগ্রামে কয়লা ভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্যও একটি চুক্তি হয়েছে। এই কয়লা আসবে ভারত থেকে, যা অত্যন্ত নিকৃষ্টমানের। এখানে যে প্রশ্নটি করা যায়, তা হচ্ছে যেখানে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচুর কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে এবং তা উত্তোলিতও হচ্ছে, সেখানে কয়লানীতি প্রণয়ন না করে কেন আমরা ভারতীয় কয়লার ওপর নির্ভরশীল হলাম? এই নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না।
ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সুন্দরবনের সুরক্ষা, বাঘরক্ষা, বিটিভি ও দূরদর্শনের সম্প্রচার বিনিময় ইত্যাদি যেসব চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে, তা আমার বিবেচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার বিবেচনায় যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা বা চুক্তি হওয়া উচিত ছিল তা হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে একটি সমঝোতা, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় স্থান পায়নি। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভারতকে উদ্যোগী হতে হবে স্পষ্ট করে। ট্যারিফ, প্যারা ট্যারিফের নামে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা চলবে না। এই ট্যারিফ কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারত কখনো নেয়নি। বাণিজ্য ঘাটতি একটি বড় বাধা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির যে পরিমাণ, তার প্রায় অর্ধেক ভারতের সঙ্গে।
২০১০-১১ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার, যা এর আগের বছরে ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ঘাটতির পরিমাণ দিনে দিনে বাড়লেও ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যেমন বাংলাদেশের মেলামাইনের চাহিদা ভারতে থাকলেও বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের প্রায় ৩২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। ভারত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের কোটা ৮০ লাখ পিস থেকে বাড়িয়ে ১ কোটিতে উন্নীত করলেও অশুল্কের কারণে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা উৎসাহী হচ্ছেন না। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত সিমেন্টের ওপর অতিরিক্ত ১৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। ভারত আগামী ৩ বছরের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২২৪টি পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করার অনুমতি চেয়েছে। কিন্তু এখন ভারতে বাংলাদেশি ৪৬টি পণ্য শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশাধিকারের অনুমতি দেয়া হলো বাংলাদেশকে। ৪৮০টি পণ্যের অনুমতি দেয়া হয়নি। দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার কথা। বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বল্পোন্নত। এ জন্য বাংলাদেশের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু ভারত সেই সুবিধা বাংলাদেশকে কখনোই দেয়নি। মনমোহনের সফরের সময় এই অশুল্ক বাধা নিয়ে আদৌ কোনো আলোচনা হলো না। যেখানে আমাদের স্বার্থ জড়িত, সেই বিষয়গুলো নিয়ে যদি আলোচনা নাই হয়, তাহলে এই সফরকে আমরা সফল বলতে পারি না।
টিপাইমুখ নিয়ে আদৌ আলোচনার কোনো সুযোগ ছিল না। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছিলেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। কিন্তু সম্প্রতি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের চেয়ারম্যান প্রেমাচান্দ পংকোজ। তিনি বাঁধ নির্মাণের সত্যতা স্বীকার করেছেন। বাঁধটি নির্মিত হলে পুরো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রীষ্মকালে ৯৪৬ কি.মি. এলাকা মরুভূমির ন্যায় শুকনো থাকবে। এই বিষয়টি যৌথ ইশতেহারে বা আলোচনায় থাকা উচিত ছিল। টিপাইমুখ বাঁধ আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ট্রানজিট নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। তবে ট্রানজিটের কাঠামোর ব্যাপারে সমঝোতা প্রয়োজন। অর্থাৎ কীভাবে ট্রানজিট চলবে, এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা। ভারত ১৫টি রুটে (নদীপথ, সড়কপথ ও রেল যোগাযোগ) ট্রানজিট চাচ্ছে। ভারত থেকে ঋণ নিয়ে ভারতের জন্যই আমরা অবকাঠামো তৈরি করে দিচ্ছি। ওই ঋণ (১০০ কোটি ডলার) সুদমুক্ত নয়। আমাদের অবকাঠামো ভারত ব্যবহার করবে। আমাদের স্বার্থ এখানে নেই। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী নয়াদিলি্ল সফর করে এসে আমাদের জানিয়ে দিলেন নতুন করে ট্রানজিট চুক্তি করার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা ১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে ভারত এই ট্রানজিট সুবিধা পেতে পারে। ড. রিজভীর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। যদি ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ট্রানজিট প্রাপ্তির সুযোগ থাকতো, তাহলে ভারত অনেক আগেই এই সুযোগ গ্রহণ করতো। অন্তত গওহর রিজভীর বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করতো না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর ৪ জন মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে এসেছিলেন তরুণ গগৈ আসাম, মানিক সরকার ত্রিপুরা, মুকুল সাংমা মেঘালয়, পু লাল থানওয়ালা মিজোরাম)। এতেই বোঝা যায় ভারতের স্বার্থ কোথায়। ভারত বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে চায়। এ ধরনের উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। ভারতের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। মনমোহনের সফরের মধ্য দিয়ে সব প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, এটা সত্য। কিন্তু দুদেশের সম্পর্ককে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। আস্থার সম্পর্কটা আরো দৃঢ় হয়েছে। এখন এই সম্পর্কটাকে আরো সামনে নিয়ে যেতে হবে। ভারত যদি সম্পর্ক উন্নয়নে আন্তরিক হয় ও দুদেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধানে উদ্যোগী হয়, তাহলে আগামীতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তা বড় একটা অবদান রাখবে।
দৈনিক যায় যায় দিন, শনিবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ২৬ ভাদ্র ১৪১৮ ১১ শাওয়াল
ড. তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment