ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান কয়েক দিন আগে নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যেসব চুক্তি হবে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান তুলে ধরা। ঢাকায় ফিরে এসে তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তির ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বিবিসির বাংলা বিভাগকে জানিয়েছেন, তিস্তা নদীর ওপর নির্ভরশীল জমি ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে পানি ভাগাভাগি করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বণ্টনের এই যে 'নীতি', তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে? অতীতে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল (১৯৯৬), তখন ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। কেননা, ১৯৭৭ সালের পর গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তি ছিল না। চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সেটা ছিল ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি। কিন্তু পানির হিস্যা কি নিশ্চিত হয়েছে? পরিসংখ্যান ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বলে, চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা, সেই পরিমাণ পানি আমরা পাচ্ছি না। আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে, চুক্তি স্বাক্ষরের আগে আমরা সব কিছু বিবেচনায় নিই না।
ফারাক্কায় যে পরিমাণ পানি থাকে, সেটাই ভাগাভাগি হয়। কিন্তু ভারত তো ফারাক্কা পয়েন্টে পানি পেঁৗছার আগে উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়। তখন সংগত কারণেই পানি কম পাওয়া যায়, আর সেটাই ভাগ-বাটোয়ারা হয়। তার পরও যতটুকু পানি আমাদের পাওয়ার কথা, সেই পরিমাণ পানিও আমরা পাচ্ছি না। এখন তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে যে চুক্তিটি হতে যাচ্ছে, তাতে একটা আশঙ্কা থেকেই গেল যে এই চুক্তিতেও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। আরো আশঙ্কার কারণ, সরকার কী ধরনের চুক্তি হতে যাচ্ছে, কী পরিমাণ পানি আমরা পাব, সেটিও উল্লেখ করছে না। এমনকি সংসদেও বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি। সরকারের কোনো 'থিংকট্যাংক'-এর পক্ষ থেকে ও কোনো 'টকশো'তেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি, যাতে করে এ সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা পেতে পারি। ফলে জাতিকে এক ধরনের অন্ধকারে রেখেই আমরা একটা চুক্তি করতে যাচ্ছি। আরো একটা কথা এখানে বলা দরকার। মহাজোট সরকারের ক্ষমতায় আসা (২০০৯) ও প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিলি্ল সফরের (২০১০) আগে দীর্ঘ চার বছর যৌথ নদী কমিশনের কোনো সভা হয়নি। এমনকি ৪০ বার বৈঠক বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। তারপর হঠাৎ করেই সচিবপর্যায়ে বৈঠক হলো, তখন বলা হলো (৫ জানুয়ারি, ২০১০), তিস্তার পানি বণ্টনে ঢাকা-নয়াদিলি্ল মতৈক্য। মনমোহনের সফরের আগে আমাদের পানিসম্পদ সচিব নয়াদিলি্ল গেলেন এবং চূড়ান্ত করলেন সেই চুক্তির রূপরেখা। কিন্তু আমরা সেই অন্ধকারেই থেকে গেলাম। ঢাকায় কোথাও আলোচনা হলো না তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে। এখন মনমোহনের সফরের একদিন আগে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী ঢাকায় আসবেন চুক্তিটি স্বাক্ষরের জন্য।
আমাদের জন্য তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৭ সালের আগ পর্যন্ত তিস্তা নদীই ছিল উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী। কিন্তু পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুঁয়েমি, ঢিলেমি ও হঠকারিতার ফলে তিস্তা এখন রুক্ষ হয়ে উঠেছে। নদীর তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালু আর পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তার বুকজুড়ে এখন শুষ্ক মৌসুমে কেবল বালু আর বালু। অন্যদিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙনে ফি বছর ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে ভিখারি হয়ে পড়ে। ১৯৮৫ সালে তিস্তার উৎসমুখে এবং তিস্তার ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের মাত্র ৬৫ কিলোমিটার উজানে ভারত গজলডোবা নামক স্থানে ব্যারাজ নির্মাণ করে। এর ফলে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পটি সেচ প্রদানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই প্রকল্পের উপকৃত এলাকা সাত লাখ ৫০ হাজার হেক্টর। এ অঞ্চলে প্রবাহিত বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, দেওনাই, চাড়ালকোটা, বুড়িখোড়া, বাগযোগড়া ও ঘাঘটের এখন দুঃসময়। এর প্রধান নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে এখন পানিশূন্য। ফলে এ অঞ্চলের প্রধান সেচনির্ভর ইরি-বোরো চাষাবাদ এখন হুমকির মুখে, যা কি না আমাদের খাদ্য সংকটকে ঘনীভূত করছে এবং খাদ্যনিরাপত্তাকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তিস্তা নদী এখন শুধু নামে আছে। পানি নেই বললেই চলে। ভরাট হয়ে গেছে ৬৫ কিলোমিটার নদী। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সালে এ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে।
১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ, ৩৯ শতাংশ ভারত ও ২৫ শতাংশ নদীর জন্য রাখার একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে ২০ শতাংশ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ভারত সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে উল্টো তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের বেশি_এ দাবি তুলে বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমান ভাগ পেতে পারে না বলে যুক্তি দেখিয়েছিল। এখন দুটি প্রস্তাবের কথা শোনা যাচ্ছে। একটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পাবে ২৫ ভাগ। অন্যদিকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পাবে ৪৮ ভাগ আর ভারত পাবে ৫২ ভাগ এবং এ প্রস্তাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতি আছে বলে ভারতীয় একটি পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে। কিন্তু কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ভারত তিস্তা ব্যারাজের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য চাপ দিয়েছিল এবং সর্বশেষ এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ শতাংশ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে হঠকারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল (নয়া দিগন্ত, ৬ মে, ২০০৮)। এই যখন পরিস্থিতি, তখন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, 'নদীর ওপর নির্ভরশীল জমি ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে' তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি হবে। এ কারণেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের স্বার্থ এতে করে কতটুকু রক্ষিত হবে। 'নদীর ওপর নির্ভরশীল জমি ও জনসংখ্যা' কিভাবে নির্ধারিত হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ভারতের অবস্থানটা আমরা জানি। শেষ পর্যন্ত কি ভারতের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে আমরা চুক্তিটি করতে যাচ্ছি? ধারণা করছি, চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমরা বিস্তারিত জানতে পারব। কিন্তু তত দিনে তো করার কিছুই থাকবে না। আন্তর্জাতিকভাবে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর হুট করে সেই চুক্তি বাতিল করা যায় না। এতে আন্তর্জাতিক আসরে একটি দেশের (এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ) ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। বাংলাদেশের কোনো সরকারের পক্ষেই ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাতিল করা সম্ভব নয়। অতীতে বিএনপি সরকারও পারেনি। তারা চুক্তির সমালোচনা করেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার নিয়ে যে চুক্তি হবে, তা নিয়েও কথা আছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় আমরা এ ধরনের কথা শুনেছিলাম। আমরা রাজি হয়েছিলাম, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমে সুপেয় পানির জন্য একটি শোধনাগার নির্মাণ করতে ফেনী নদী থেকে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ভারতকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু এতে করে, অর্থাৎ ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে মুহুরি সেচ প্রকল্পের আওতাধীন চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার ইরি সেচ হুমকির মুখে থাকবে। ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে নদীর নিচু এলাকায় বাংলাদেশের নদী ও তীরবর্তী বিশাল অংশ শুকিয়ে যাবে। প্রত্যাহারকৃত পানি দিয়ে ভারত তার সেচ প্রকল্পগুলো শুরু করতে পারবে। এই বর্ষাকালেও ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরনো মহাসড়কের শুভপুর ব্রিজ এলাকায় ফেনী নদীর প্রশস্ততা ১০০ মিটারের কমে নেমে এসেছে। শীতকালে পানি তলানিতে গিয়ে পেঁৗছবে। সৃষ্টি হবে বালুচরের।
তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি আমরা অবশ্যই চাই। কিন্তু তাতে যেন বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়। শুধু তিস্তা নদীর পানি বণ্টন কেন, দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর পানির হিস্যার ব্যাপারে একটি দীর্ঘস্থায়ী চুক্তি হওয়া উচিত। আমরা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও আতঙ্কিত। অতিসম্প্রতি মণিপুর ও আসামের মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মিত হবে। পিটাইমুখ বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ১২ জুলাই, ২০১১ ভারতের নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের চেয়ারম্যান প্রেমাচান্দ পঙ্কজও বাঁধ নির্মাণের সত্যতা স্বীকার করেছেন। অথচ আমাদের বারবার বলা হয়েছে, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। সুতরাং একটা বড় প্রশ্ন থেকেই গেল। মণিপুর ও আসাম তাদের নিজ স্বার্থেই বাঁধটি নির্মাণ করছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী পু লালথানওয়ালা মনমোহনের সঙ্গে ঢাকায় আসছেন। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ এ প্রশ্নটি দুজন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থাপন করতে পারে। বলা ভালো, বাঁধটি নির্মিত হলে মণিপুর হারাবে চার হাজার ৭৬০ হেক্টর বাগান, দুই হাজার ৫৩ হেক্টর ধানি জমি, ১৭৮.২১ বর্গকিলোমিটার বনভূমি। আর আসাম, মণিপুর ও মিজোরাম একত্রে হারাবে মোট ৩১১ হাজার হেক্টর জমি। আর বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রীষ্মকালে ৯৪৬ কিলোমিটার এলাকা মরুভূমির মতো শুকনো থাকবে এবং বর্ষাকালে হঠাৎ পানি ছাড়লে ব্যাপক বন্যা হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও যখন আমরা বাঁধ নির্মাণের কথা শুনি, তখন আমাদের আশঙ্কাটা বাড়ে বৈকি! মনমোহন সিং ঢাকায় এসে টিপাইমুখ নিয়ে কী কথা বলেন, আমরা শুনতে চাই। কোনো চুক্তি যখন জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে না, সেই চুক্তি করে কোনো লাভ নেই। গঙ্গার পানি চুক্তি করে (১৫ বছর পর) আমরা এখন লাভ-লোকসানের হিসাব কষতে পারি। পাল্লাটা যে আমাদের দিকে, তা বোধ হয় জোর দিয়ে বলা যাবে না। এখন তিস্তা নদীর পানির ভাগ-বাটোয়ারা হতে যাচ্ছে, কিন্তু তিস্তার পানি চুক্তি গঙ্গার পানি চুক্তির মতোই হয় কি না_সেটাই দেখার বিষয়।
ফারাক্কায় যে পরিমাণ পানি থাকে, সেটাই ভাগাভাগি হয়। কিন্তু ভারত তো ফারাক্কা পয়েন্টে পানি পেঁৗছার আগে উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়। তখন সংগত কারণেই পানি কম পাওয়া যায়, আর সেটাই ভাগ-বাটোয়ারা হয়। তার পরও যতটুকু পানি আমাদের পাওয়ার কথা, সেই পরিমাণ পানিও আমরা পাচ্ছি না। এখন তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে যে চুক্তিটি হতে যাচ্ছে, তাতে একটা আশঙ্কা থেকেই গেল যে এই চুক্তিতেও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। আরো আশঙ্কার কারণ, সরকার কী ধরনের চুক্তি হতে যাচ্ছে, কী পরিমাণ পানি আমরা পাব, সেটিও উল্লেখ করছে না। এমনকি সংসদেও বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি। সরকারের কোনো 'থিংকট্যাংক'-এর পক্ষ থেকে ও কোনো 'টকশো'তেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি, যাতে করে এ সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা পেতে পারি। ফলে জাতিকে এক ধরনের অন্ধকারে রেখেই আমরা একটা চুক্তি করতে যাচ্ছি। আরো একটা কথা এখানে বলা দরকার। মহাজোট সরকারের ক্ষমতায় আসা (২০০৯) ও প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিলি্ল সফরের (২০১০) আগে দীর্ঘ চার বছর যৌথ নদী কমিশনের কোনো সভা হয়নি। এমনকি ৪০ বার বৈঠক বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। তারপর হঠাৎ করেই সচিবপর্যায়ে বৈঠক হলো, তখন বলা হলো (৫ জানুয়ারি, ২০১০), তিস্তার পানি বণ্টনে ঢাকা-নয়াদিলি্ল মতৈক্য। মনমোহনের সফরের আগে আমাদের পানিসম্পদ সচিব নয়াদিলি্ল গেলেন এবং চূড়ান্ত করলেন সেই চুক্তির রূপরেখা। কিন্তু আমরা সেই অন্ধকারেই থেকে গেলাম। ঢাকায় কোথাও আলোচনা হলো না তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে। এখন মনমোহনের সফরের একদিন আগে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী ঢাকায় আসবেন চুক্তিটি স্বাক্ষরের জন্য।
আমাদের জন্য তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৭ সালের আগ পর্যন্ত তিস্তা নদীই ছিল উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী। কিন্তু পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুঁয়েমি, ঢিলেমি ও হঠকারিতার ফলে তিস্তা এখন রুক্ষ হয়ে উঠেছে। নদীর তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালু আর পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তার বুকজুড়ে এখন শুষ্ক মৌসুমে কেবল বালু আর বালু। অন্যদিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙনে ফি বছর ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে ভিখারি হয়ে পড়ে। ১৯৮৫ সালে তিস্তার উৎসমুখে এবং তিস্তার ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের মাত্র ৬৫ কিলোমিটার উজানে ভারত গজলডোবা নামক স্থানে ব্যারাজ নির্মাণ করে। এর ফলে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পটি সেচ প্রদানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই প্রকল্পের উপকৃত এলাকা সাত লাখ ৫০ হাজার হেক্টর। এ অঞ্চলে প্রবাহিত বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, দেওনাই, চাড়ালকোটা, বুড়িখোড়া, বাগযোগড়া ও ঘাঘটের এখন দুঃসময়। এর প্রধান নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে এখন পানিশূন্য। ফলে এ অঞ্চলের প্রধান সেচনির্ভর ইরি-বোরো চাষাবাদ এখন হুমকির মুখে, যা কি না আমাদের খাদ্য সংকটকে ঘনীভূত করছে এবং খাদ্যনিরাপত্তাকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তিস্তা নদী এখন শুধু নামে আছে। পানি নেই বললেই চলে। ভরাট হয়ে গেছে ৬৫ কিলোমিটার নদী। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সালে এ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে।
১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ, ৩৯ শতাংশ ভারত ও ২৫ শতাংশ নদীর জন্য রাখার একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে ২০ শতাংশ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ভারত সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে উল্টো তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের বেশি_এ দাবি তুলে বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমান ভাগ পেতে পারে না বলে যুক্তি দেখিয়েছিল। এখন দুটি প্রস্তাবের কথা শোনা যাচ্ছে। একটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পাবে ২৫ ভাগ। অন্যদিকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পাবে ৪৮ ভাগ আর ভারত পাবে ৫২ ভাগ এবং এ প্রস্তাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতি আছে বলে ভারতীয় একটি পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে। কিন্তু কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ভারত তিস্তা ব্যারাজের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য চাপ দিয়েছিল এবং সর্বশেষ এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ শতাংশ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে হঠকারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল (নয়া দিগন্ত, ৬ মে, ২০০৮)। এই যখন পরিস্থিতি, তখন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, 'নদীর ওপর নির্ভরশীল জমি ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে' তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি হবে। এ কারণেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের স্বার্থ এতে করে কতটুকু রক্ষিত হবে। 'নদীর ওপর নির্ভরশীল জমি ও জনসংখ্যা' কিভাবে নির্ধারিত হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ভারতের অবস্থানটা আমরা জানি। শেষ পর্যন্ত কি ভারতের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে আমরা চুক্তিটি করতে যাচ্ছি? ধারণা করছি, চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমরা বিস্তারিত জানতে পারব। কিন্তু তত দিনে তো করার কিছুই থাকবে না। আন্তর্জাতিকভাবে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর হুট করে সেই চুক্তি বাতিল করা যায় না। এতে আন্তর্জাতিক আসরে একটি দেশের (এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ) ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। বাংলাদেশের কোনো সরকারের পক্ষেই ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাতিল করা সম্ভব নয়। অতীতে বিএনপি সরকারও পারেনি। তারা চুক্তির সমালোচনা করেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার নিয়ে যে চুক্তি হবে, তা নিয়েও কথা আছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় আমরা এ ধরনের কথা শুনেছিলাম। আমরা রাজি হয়েছিলাম, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমে সুপেয় পানির জন্য একটি শোধনাগার নির্মাণ করতে ফেনী নদী থেকে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ভারতকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু এতে করে, অর্থাৎ ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে মুহুরি সেচ প্রকল্পের আওতাধীন চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার ইরি সেচ হুমকির মুখে থাকবে। ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে নদীর নিচু এলাকায় বাংলাদেশের নদী ও তীরবর্তী বিশাল অংশ শুকিয়ে যাবে। প্রত্যাহারকৃত পানি দিয়ে ভারত তার সেচ প্রকল্পগুলো শুরু করতে পারবে। এই বর্ষাকালেও ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরনো মহাসড়কের শুভপুর ব্রিজ এলাকায় ফেনী নদীর প্রশস্ততা ১০০ মিটারের কমে নেমে এসেছে। শীতকালে পানি তলানিতে গিয়ে পেঁৗছবে। সৃষ্টি হবে বালুচরের।
তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি আমরা অবশ্যই চাই। কিন্তু তাতে যেন বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়। শুধু তিস্তা নদীর পানি বণ্টন কেন, দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর পানির হিস্যার ব্যাপারে একটি দীর্ঘস্থায়ী চুক্তি হওয়া উচিত। আমরা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও আতঙ্কিত। অতিসম্প্রতি মণিপুর ও আসামের মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মিত হবে। পিটাইমুখ বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ১২ জুলাই, ২০১১ ভারতের নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের চেয়ারম্যান প্রেমাচান্দ পঙ্কজও বাঁধ নির্মাণের সত্যতা স্বীকার করেছেন। অথচ আমাদের বারবার বলা হয়েছে, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। সুতরাং একটা বড় প্রশ্ন থেকেই গেল। মণিপুর ও আসাম তাদের নিজ স্বার্থেই বাঁধটি নির্মাণ করছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী পু লালথানওয়ালা মনমোহনের সঙ্গে ঢাকায় আসছেন। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ এ প্রশ্নটি দুজন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থাপন করতে পারে। বলা ভালো, বাঁধটি নির্মিত হলে মণিপুর হারাবে চার হাজার ৭৬০ হেক্টর বাগান, দুই হাজার ৫৩ হেক্টর ধানি জমি, ১৭৮.২১ বর্গকিলোমিটার বনভূমি। আর আসাম, মণিপুর ও মিজোরাম একত্রে হারাবে মোট ৩১১ হাজার হেক্টর জমি। আর বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রীষ্মকালে ৯৪৬ কিলোমিটার এলাকা মরুভূমির মতো শুকনো থাকবে এবং বর্ষাকালে হঠাৎ পানি ছাড়লে ব্যাপক বন্যা হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও যখন আমরা বাঁধ নির্মাণের কথা শুনি, তখন আমাদের আশঙ্কাটা বাড়ে বৈকি! মনমোহন সিং ঢাকায় এসে টিপাইমুখ নিয়ে কী কথা বলেন, আমরা শুনতে চাই। কোনো চুক্তি যখন জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে না, সেই চুক্তি করে কোনো লাভ নেই। গঙ্গার পানি চুক্তি করে (১৫ বছর পর) আমরা এখন লাভ-লোকসানের হিসাব কষতে পারি। পাল্লাটা যে আমাদের দিকে, তা বোধ হয় জোর দিয়ে বলা যাবে না। এখন তিস্তা নদীর পানির ভাগ-বাটোয়ারা হতে যাচ্ছে, কিন্তু তিস্তার পানি চুক্তি গঙ্গার পানি চুক্তির মতোই হয় কি না_সেটাই দেখার বিষয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment