রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি সংবাদ, অনেক প্রশ্ন

একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর। সংবাদটিতে উচ্চশিক্ষার সঙ্কটের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। অনেক মেধাবি ছাত্র যে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না, তার একটি করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে ওই প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করা হলেও, এ চিত্র প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই দেখা যাবে- আসন সংখ্যার চাইতে অতিরিক্ত আবেদনকারী। যদিও তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি। এ বছর (২০১১-১২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ হাজার ৩১টি আসনের বিপরীতে ফরম বিতরণ করা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৭৩টি। ফলে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪২ জন শিক্ষার্থীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। এদের মাঝে কেউ কেউ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে বটে, কিন্তু একটা বড় অংশেরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার কোনো সুযোগ থাকবে না। তাহলে এরা যাবে কোথায়? যাদের সমর্থ আছে, তারা যাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই, তারা যাবে কলেজগুলোতে। দু'একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে, বাকিগুলো মানহীন। নেই যোগ্য শিক্ষক, নেই অবকাঠামোগত সুবিধা। কলেজ শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, আর কোথাও কোথাও অযোগ্য শিক্ষকদের দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। আর কলেজগুলোতে রয়েছে শিক্ষক সঙ্কট। কোনো কোনো কলেজে অনার্স কোর্স চালু হয়েছে। কিন্তু পাঠদান করার শিক্ষক নেই। অনেক কলেজে আবার আমি জানি যেখানে শিক্ষকরা বাধ্য করেন ছাত্রছাত্রীদের কোচিং করতে। তিনি কলেজে ক্লাস না নিয়ে নিজ বাড়িতে কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন। ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হচ্ছে ওই কোচিং সেন্টারে যেতে। ঢাকায় এসে খিলক্ষেত মার্কেট থেকে এরা নোট বই বা গাইড বই কিনে নিয়ে যাচ্ছে, আর ওটা দিয়েই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। উচ্চ শিক্ষা যে আজ কোন পর্যায়ে গেছে, তা চিন্তা করে অাঁতকে উঠতে হয়। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি আসনের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ৩৬ জন ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রী। আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে 'ভর্তিযুদ্ধ'। জাহাঙ্গীরনগরে শুরু হবে ৮ অক্টোবর।
এবার দশটি বোর্ডের মোট পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। পাসের হার এবার ৭৫ দশমিক শূন্য আট। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৯ হাজার ৭৬৯ জন ছাত্রছাত্রী, যা গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার ৭৬৫ জন বেশি। আর সব মিলিয়ে বিভিন্ন গ্রেডে পাস করেছে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬১ জন। এরা কোথায় যাবে? কোথায় পড়বে? এদের একটা বড় অংশের ঠাঁই হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা আস্থার জায়গা এখনো আমাদের জন্য তৈরি করতে পারেনি। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়তো শুধুমাত্র সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে! মাননীয় রাষ্ট্রপতি, এমনকি শিক্ষামন্ত্রীও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে কথা বলছেন। মাননীয় রাষ্ট্রপতি শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে যখন বলেন, তখন আমরা আমজনতা তার বক্তব্য শুনে উৎফুলি্লত হচ্ছি। কিন্তু তিনি কী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বাণিজ্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন? কেন এখনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল' গঠন করা হলো না, যারা শিক্ষার মান নির্ধারণ করবে? নামসর্বস্ব একটি সার্টিফিকেট, শিক্ষার মানোন্নয়নের কোনো পরিচয় হতে পারে না। আমরা আশঙ্কা করছি এইচএসসি পাস করা অনেক তরুণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আদৌ কোনো সুযোগ না পেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে এবং এক সময় নামসর্বস্ব একখানা সার্টিফিকেটের অধিকারী সে হবে! ওই সার্টিফিকেট দেখিয়ে সে চাকরি পাবে, এই নিশ্চয়তা সমাজ তাকে দেবে না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো ভালো ভালো শিক্ষক রয়েছে। অনেকেই শুধু 'টাকার জন্য' বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করেন। তরুণ শিক্ষার্থীরা যাতে করে নামসর্বস্ব সার্টিফিকেটের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে ঝুঁকে না পড়ে, সে জন্য নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো নেয়া যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে 'দ্বিতীয় শিফট' চালু করা যায়। এ ক্ষেত্রে 'দ্বিতীয় শিফট' এ যারা পড়বে তারা অতিরিক্ত ভর্তি ফি দিয়ে পড়বে। বিভাগের শিক্ষকদের এ জন্য অতিরিক্ত সম্মানীর ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে একদিকে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবেন, অন্যদিকে ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের আমরা 'দ্বিতীয় শিফট'-এর ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে পারবো। দ্বিতীয় শিফটের জন্য ইউজিসি একটি নীতিমালা তৈরি করবে এবং প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তা অনুসরণ করবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর 'দ্বিতীয় ক্যাম্পাস' চালু করা সম্ভব। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কিংবা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের 'দ্বিতীয় ক্যাম্পাস' বিভাগের অন্যত্র চালু করা সম্ভব। একজন প্রো-ভিসির পরিচালনায় তা চালু হতে পারে। মূল ক্যাম্পাসের শিক্ষকরাই সেখানে নিয়মিতভাবে শিক্ষা নিতে পারেন। প্রয়োজনে কিছু তরুণ শিক্ষককে নিযোগ দেয়া যেতে পারে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ভেঙে ৭টি বিভাগীয় শহরে ৭টি পুরনো কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চালু করা যেতে পারে। কোনো কোনো কলেজে ভালো শিক্ষক আছেন। এদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো সম্ভব। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে রয়েছে, তা শুধু সার্টিফিকেটসর্বস্ব একটি তরুণ প্রজন্মের জন্ম দিচ্ছে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে নতুন ক্যাম্পাস, 'দ্বিতীয় শিফট' চালুর বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের মেধা আছে। এরা প্রতিভাবান। উচ্চ শিক্ষা এদের অধিকার। এদের মেধাকে ব্যবহার করার স্বার্থেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা চাই না যে জিপিএ-৫ পেয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছিল, তার ওই স্বপ্ন ভেঙে যাক। উচ্চশিক্ষা তাদের অধিকার। আমাদের সংবিধান এই অধিকার তাদের দিয়েছেন। এই অধিকার থেকে আমরা তাদের বঞ্চিত করতে পারি না। তাদের সবার আগ্রহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তথা মেডিকেল কলেজগুলোর দিকে। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ৩৫টি। মেডিকেল কলেজের সংখ্যাও বেড়েছে। শোনা যাচ্ছে সরকার আরো ৩টি মেডিকেল কলেজ চালু করবে। এখন যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এতে করে শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়েছে কতটুকু? নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। কিন্তু পড়াচ্ছেন কারা? আমি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি, যেখানে কোন 'অধ্যাপক' নেই। এমনকি সহযোগী অধ্যাপকও ছিল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোনো কোনো বিভাগে যদি আদৌ অধ্যাপক না থাকেন, যদি সহযোগী অধ্যাপকও না থাকেন, তাহলে ওই বিভাগের উচ্চ শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তো থাকবেই। অভিযোগে আছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক এর পদ বিজ্ঞপিত হলেও, যোগ্য আবেদনকারী খুঁজে পাওয়া যায় না। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি হয়েছে। সেখানকার রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে কোনো অধ্যাপক নেই। দু'দিন আগ পর্যন্ত সেখানে সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত ছিল না। এখন অবশ্যই পদোন্নতির মাধ্যমে দু'জন সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন। নতুন লোক প্রশাসন বিভাগ চালু করা হয়েছে। সেখানে অতিসম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে একজন সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন। অধ্যাপক নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিভাগে আমি আমার বিভাগের কথা বলতে পারি। আমার বিভাগে ৯ জন প্রভাষক কর্মরত। ৯ জন প্রভাষককে দিয়ে বিভাগের মানোন্নয়ন কিভাবে সম্ভব? অথচ আমার বিভাগে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। সেখানে নিয়মিত ক্লাস হওয়ার কথা।
আমার আশঙ্কা হয় আমরা কোনো 'মেধাশূন্য' জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি কী না! একদিকে যেমনি শিক্ষার গুণগত মানের অবনতি ঘটছে, অন্যদিকে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্য প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এই প্রবণতা পদ না হলে এ জাতি মেধাশূন্য জাতিতেই পরিণত হবে।
একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয়েছে এবং তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। কিন্তু হাজার হাজার জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রী যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করে এবং এক পর্যায়ে আদৌ কোনো সুযোগে পায় না- এই বিষয়টি কি শিক্ষানীতি প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তারা ভেবে দেখেছেন? আমার মনে হয় না তারা এটা ভেবে দেখেছেন। ভেবে দেখলে শিক্ষানীতিতে এর প্রতিফলন থাকতো। বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী এইচএসসি পাস করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু তারপরও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিত। শুধু একখানা সার্টিফিকেটের জন্য একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, এটা হতে পারে না। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই।দৈনিক যায় যায় দিন, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ ইং।
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment