রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনা দরকার

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এখন আলোচনার অন্যতম বিষয়। জোট সরকারের আমলে ২০০৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিয়োগ পাওয়া ৮২১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট তাদের চাকরিচ্যুত করে। এ চাকরিচ্যুতকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের নিয়োগ ও উচ্চ আদালত কর্তৃক তাদের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করা নতুন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎকে সামনে নিয়ে এলো এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত ওই নিয়োগের বিষয়টি সম্পর্কে আমার ধারণা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে থাকাকালে আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করেছি এবং একটি সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও জমা দেওয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে চাকরিচ্যুত ৮২১ জনের কিছু করার আছে বলেও আমার মনে হয় না। কেননা নিয়োগের ক্ষেত্রে ভুয়া বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। এটা নিয়ে একজন প্রভাষকের মামলাও হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এখন হাইকোর্ট তাদের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এ রায় সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা যাবে না; কিন্তু যেটা ভালো হতো, শোভন হতো তা হচ্ছে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা। তাহলে সব ধরনের বিতর্ক এড়ানো যেত। আপিল বিভাগের একটি রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও ভালো হতো, তাহলে কারও কিছু বলার সুযোগ থাকত না। গত প্রায় ৭ বছর ধরে অনেকে কাজ করেছেন, প্রমোশনও পেয়েছেন। তাদের পরিবার-পরিজন, সন্তানও আছে। তারা এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লেন। তাদের অনেকেরই আজ সরকারি চাকরির বয়স নেই। তারা এখন কোথায় যাবেন? এ মানবিক দিকটি বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপিল বিভাগে যেতে পারত।
এখন আদালতের একটি রায় হয়েছে। ওই রায়কে সামনে রেখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন কারও কিছু বলার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রশাসন চালাতে হলে নতুন করে লোক নিয়োগ করতে হবে। সমস্যাটা হবে এখানেই। এখানে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দলীয় বিবেচনায় লোক নিয়োগের অভিযোগ উঠবে। কেননা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক তথা কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় একাধিক সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। এ কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শঙ্কিত।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মূলত একটি সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কলেজগুলোতে অনার্স কোর্স চালু হয়েছে; কিন্তু অনার্স পড়ানোর যোগ্য শিক্ষক সেখানে নেই। আমি পিরোজপুর কলেজের এক সময় ছাত্র ছিলাম। সেখানে এখন বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স রয়েছে। শিক্ষকরা সেখানে ক্লাস নেন না। ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করেন কোচিং করতে। ব্যাচে ব্যাচে ছাত্রছাত্রীরা কোচিং করে। ইংরেজির মতো বিষয়ে অনার্স রয়েছে। শিক্ষক মাত্র একজন। তিনি আদৌ ক্লাস নেন না। অথচ ওই কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শাখা আছে। ডিগ্রিও রয়েছে। তারপর অনার্স। একজন শিক্ষক যদি আদৌ ক্লাস না নেন তাহলে ছাত্রছাত্রীরাই-বা কী করবে? তাদের ভরসা ঢাকার নিলক্ষেতের গাইডবই। যখন এ নিবন্ধটি লিখছি তখন চোখ আটকে গেল একটি প্রতিবেদনের ওপর। একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে উলিপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের কথা। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ও ১৯৮৭ সালে জাতীয়করণকৃত এ কলেজটিতে শিক্ষক মাত্র ৮ জন। ইংরেজি, গণিত, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিজ্ঞান বিষয়ে কোনো শিক্ষক নেই। উলিপুর কলেজের এ চিত্র পাওয়া যায় অন্যত্রও। শিক্ষক নেই। অথচ অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। ছাত্রদের ভরসা ওই গাইডবই। এভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ অনার্স গ্র্যাজুয়েট আমরা তৈরি করছি। অথচ এ সমাজে এত অনার্স গ্র্যাজুয়েটের আদৌ প্রয়োজন নেই। এ বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবেন না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত আফতাব আহমেদ এক তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশকিছু 'শিক্ষক' নিয়োগ দিয়েছিলেন; কিন্তু যিনি শিক্ষক, তিনি তো ছাত্র পড়াবেন। না, যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'শিক্ষক' তারা ছাত্র পড়ান না। তাদের কাজ হচ্ছে ডিগ্রি, অনার্স (৪ পার্ট) ও মাস্টার্সের প্রশ্নপত্র তৈরি করা, শত শত উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন কলেজে যাওয়া। শুধু প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষক কি তার দায়িত্ব শেষ করতে পারেন! বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্যোগী হয়েছিলাম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক উপাচার্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন তথাকথিত \'শিক্ষকদের\' দিয়ে বিভিন্ন কলেজে অনার্স পর্যায়ে পাঠদান। শিক্ষকরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল তারা \'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক\', তারা কলেজে কেন যাবেন? তারা কলেজের ছাত্রদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে রাজি (কেননা এর সঙ্গে সম্মানীর প্রশ্ন জড়িত), ক্লাস নিতে রাজি নন। ওই উপাচার্য আমাকে তার অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছিলেন। আজ আদালত ওই শিক্ষকদের কাউকে যদি চাকরিচ্যুতির আদেশ দেন, তাহলে যুক্তি হিসেবে সেটাই সঠিক। যিনি ছাত্র পড়াবেন না তিনি শিক্ষক হতে পারেন না। শুধু উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন নেই।
আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বান জানাই। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তার পক্ষে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া দুরূহ। সিদ্ধান্তটি নিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তগুলো প্রধানমন্ত্রী বিবেচনায় নিতে পারেন। এক. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামো ভেঙে ৭টি বিভাগীয় শহরে ৭টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। এখানে সরকারের তেমন বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে না। কেননা বিভাগীয় শহরে অবস্থিত ৭টি পুরনো কলেজকে সামনে রেখে, ওইসব কলেজকে কেন্দ্র করেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অবকাঠামো রয়েছে। ল্যাবও রয়েছে। পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকও রয়েছেন। সুতরাং কিছু কিছু বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা সম্ভব। প্রয়োজনে একেকজন জাতীয় নেতার নামে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। দুই. গাজীপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবকাঠামো রয়েছে, সেখানে পূর্ণাঙ্গ একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা। সেখানে পোস্টগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের পোস্টগ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তিন. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামো ভেঙে দিলেও সেখানে কর্মরত শিক্ষক তথা কর্মচারীদের চাকরি হারানোর ভয় থাকবে না। কেননা তাদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আত্তীকরণ ঘটবে। সুতরাং অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই।
আজ সময় এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা করার। আমার দুঃখ হয়, যারাই মঞ্জুরি কমিশনে চেয়ারম্যান কিংবা সদস্য হয়ে আসেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে কেউ ভাবেন না। শক্ত হাতে কেউ একটা সিদ্ধান্ত নেন না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীর যথেষ্ট আস্থাভাজন। তিনি পারতেন একটি সিদ্ধান্ত নিতে; কিন্তু সুবিধাভোগীদের চাপের মুখে তিনি নতি স্বীকার করেছিলেন। এখন উচ্চ আদালতের একটি রায়ের আলোকে তিনি বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারেন। আজ আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে শুধু একটি সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্র হিসেবে রেখে দেব, নাকি সত্যিকার অর্থেই জ্ঞান ও মেধা চর্চার একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করব। এটা করতে হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো ভেঙে দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment