রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ঢাকা-দিল্লি যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে????

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের পর গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও নয়াদিল্লি থেকে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে মোট ৬৫টি দফা রয়েছে। এই দফাগুলো যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে বেশ ভালোভাবে কিছু কথা বলা হয়েছে, আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ের ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক কথা বলা হয়নি। ইশতেহারে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা মূলত কূটনৈতিক ভাষা। মনমোহনের সফরের ব্যাপারে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু যৌথ ইশতেহারের বক্তব্য থেকে আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং আমাদের হতাশই করবে। বলা হয়েছে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টনে অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির লক্ষ্যে এ পর্যন্ত যেসব মুখ্য ও টেকনিক্যাল বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে দুই প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং চুক্তি স্বাক্ষরে আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে দু’দেশের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়ছে বলেও যৌথ ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে রয়েছে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি। এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়নি ‘মুখ্য ও টেকনিক্যাল বিষয়ে’ কী সমঝোতা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে মমতা ব্যানার্জির সম্মতি ছাড়া ওই ‘মুখ্য ও টেকনিক্যাল’ বিষয় অকার্যকর। যে সমঝোতা হয়েছিল, তা কাজে আসবে না। মনে রাখতে হবে মমতা ব্যানার্জি ভারতীয় স্বার্থকেই দেখবেন। আর মনমোহনেরও প্রয়োজন রয়েছে মমতাকে। সুতরাং আগামী ৩ মাসের মধ্যে আমি কোনো চুক্তির সম্ভাবনা দেখছি না। এছাড়া বিভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের ব্যাপারে যৌথ নদী কমিশনে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাবার কথাও বলা হয়েছে। এটাও সময়ক্ষেপণ করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে সড়ক, রেল ও নৌপথে ট্রানজিটের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করার কথাও বলা হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। এতে লাভ ভারতের। বাংলাদেশকে ট্রানজিট দেয়ার কথা (নেপাল ও ভুটান) ইশতেহারে উল্লেখ থাকলেও, ভারত তার রাস্তাঘাট উন্নয়নের কোনো অর্থ ব্যয় করবে কিনা তা উল্লেখ নেই। ভারত তার স্বার্থে অবকাঠামো নির্মাণে (ট্রানজিটের জন্য) বাংলাদেশকে ঋণ (যা বাংলাদেশকে উচ্চসুদে পরিশোধ করতে হবে) দেবে, সে কথাটা ইশতেহারে উল্লেখ আছে। পণ্য, সেবা, তথ্য, অভিজ্ঞতা ও সংস্কৃতি বিনিময়ের কথা ইশতেহারে উল্লেখ রয়েছে। এতে করে এসব সেক্টর ভারতীয়দের জন্য আমরা উন্মুক্ত করে দিলাম কিনা, সেটা বড় প্রশ্ন এখন। মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় যেসব চুক্তি, সমঝোতা ও প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা যৌথ ইশতেহারে উল্লেখ থাকলেও তিনবিঘা করিডোর খোলা রাখার বিষয়টি যৌথ ইশতেহারে নেই। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও পত্র-পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছে ভারতের বিজেপির বিরোধিতার কথা। এখন এই সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হয়, কিংবা এটা নিয়ে কোনো জটিলতা তৈরি হয় কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা অত্যন্ত সাদামাটা ধরনের। এজন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাংলাদেশ সফরের প্রয়োজন ছিল না। যেমন বলা যেতে পারে বাঘ রক্ষার প্রটোকল, সুন্দরবন সুরক্ষা, টেলিভিশন সম্প্রচার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ফ্যাশন টেকনোলজি, মৎস্য খাতে সহযোগিতা, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি ও জেএনইউ) মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক। এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীই যথেষ্ট। মনমোহন সিংয়ের মতো একজন প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসার প্রয়োজন ছিল না। উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তি কিংবা নেপালকে ট্রানজিট দিতে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও আরো কথা রয়েছে। নেপালকে ট্রানজিট দেয়া সম্পর্কিত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এখন আবার একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো।
উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ট্রানজিট সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেনি এবং এতে করে আমাদের কেউ কেউ উৎসাহিত হতে পারেন বটে। কিন্তু সহযোগিতা চুক্তিটি যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে পরোক্ষভাবে এতে ট্রানজিটের কথাই বলা হয়েছে। চুক্তিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রকারান্তরে ট্রানজিটেরই নামান্তর। উন্নয়ন সহযোগতিা চুক্তিতে বলা হয়ছে উপআঞ্চলিক সহযোগিতার কথা। বলা হয়েছে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার কথা, বিশেষ করে সমুদ্রবন্দর। এই চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। এতে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ দূর করার ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে ভূ-খণ্ড ব্যবহার করার সম্ভাবনাও এতে করে তৈরি হলো। এই চুক্তিতে ভারত অদূর ভবিষ্যতে তার স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে। চুক্তিতে যে ভাষা ও বক্তব্য রয়েছে, তার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আমার ধারণা ভারতের আমলারা অত্যন্ত সুকৌশলে এ ধরনের ‘শব্দ’ ও ‘বক্তব্য’ ব্যবহার করে পরোক্ষভাবে ট্রানজিট আদায় করে নিল। কেননা, তারা ভালো করে জানেন সরাসরি ট্রানজিট সংক্রান্ত কোনো চুক্তি এ দেশের জনগণ মানবে না। বিরোধী দলের প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে ট্রানজিটের ব্যাপারে। উপরন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে সরাসরি ট্রানজিট সংক্রান্ত একটি চুক্তি করে আওয়ামী লীগকে একটি ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিতে চায় না নয়াদিল্লি। তাই পরোক্ষভাবে তারা এটা আদায় করে নিল। এজন্য উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সংসদে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হাওয়াও জরুরি। বিএনপি এখন সংসদে গিয়ে এই চুক্তিটির ব্যাখ্যা দাবি করতে পারে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের কোনো নিরাপত্তা চুক্তি নেই। ১৯৭২ সালের মার্চে স্বাক্ষরিত মৈত্রী চুক্তির (যার ধরন ছিল অনেকটা সামরিক ও চুক্তির ৮, ৯, ১০নং ধারা ছিল স্পর্শকাতর) মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর (১৯৯৭), কোনো পক্ষই আর চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়নি।
এই চুক্তিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা এবং ভারত এটিই চায়। ট্রানজিট বা করিডোরের যে কথা বলা হয়েছে, সেটা বাহ্যত উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্যই চাওয়া হচ্ছে। ভারত কিন্তু আজই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা চাচ্ছে না। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া বাংলাদেশ সফরের সময় (জানুয়ারি ১৯৯৭) এটা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে, ভারত ও বাংলাদেশ ৪টি দেশ নিয়ে (বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপাল) একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনে রাজি হয়েছে। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে তখন রাখা হয়েছিল উন্নয়নের চতুর্ভুজ বা ঝড়ঁঃয অংরধহ এৎড়ঃিয ছঁধফৎধহমষব (ঝঅএছ)। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কাঠমাণ্ডুতে  অনুষ্ঠিত চারদেশীয় পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকে ঝঅএছ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ঝঅএছ এ সদস্য ভারতবর্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যকে। দীর্ঘদিন উন্নয়নের চতুর্ভুজ নিয়ে তেমন কিছু শোনা না গেলেও, মনমোহনের ঢাকা সফরের মধ্যদিয়ে এই ধারণাটি আবার সামনে চলে আসলো।
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে স্কুলে আধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপনের পাশাপাশি লোক প্রশাসন কেন্দ্র ও মিলিটারি ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি এবং পুলিশ একাডেমিতে আইটি সেন্টার স্থাপনের বিষয়টিও যৌথ ইশতেহারে রয়েছে। স্কুলে ল্যাব স্থাপন করার সিদ্ধান্ত ভালো। মিলিটারি ইন্সটিটিউট, পুলিশ একাডেমি কিংবা লোক প্রশাসন কেন্দ্রে ভারতীয় সহযোগিতা আমরা নিতে পারি। কিন্তু ভারতীয় প্রশিক্ষকের আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে এখন যোগ্য প্রশিক্ষক রয়েছেন। সার্ককে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। অথচ সার্ক এর মূল সমস্যা তো ভারতকে নিয়ে। একমাত্র ভুটান বাদে সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশের সাথেই ভারতের সমস্যা রয়েছে। সমস্যাটি মূলত ভারতের আধিপত্যবাদী নীতিকে কেন্দ্র করে। ভারত যদি তার নীতিতে পরিবর্তন না আনে, তাহলে সার্ক শক্তিশালী হবে না। ইশতেহারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের সম্প্রসারণে ভারতের দাবির প্রতি (অর্থাৎ স্থায়ী সদস্যপদ) বাংলাদেশ সমর্থন জানিয়েছে। এই সমর্থন নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। কেননা স্থায়ী সদস্যপদে যে যোগ্যতা দরকার, অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক আধিপত্যবাদী নীতি পরিত্যাগ করা, বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্বদান ইত্যাদি ভারত এখনও অর্জন করতে পারেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের দাবিদার এখন জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকাও। বাংলাদেশ শুধুমাত্র ভারতের দাবিকে সমর্থন করতে পারে না। ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করার কথাও ইশতেহারে রয়েছে। এটা খারাপ নয়। কিন্তু ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা আদৌ বিনিয়োগে উৎসাহী নন, তারা চান তাদের পণ্য বিক্রি। বাংলাদেশ বাহ্যত ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ হচ্ছে বিশাল একটি বাজার। ভারত এই সুবিধাই নিয়েছে। অথচ বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণাও আমি যৌথ ইশতেহারে খুঁজে পাইনি। বিটিভির সাথে ভারতীয় দূরদর্শনের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইশতেহারেও আছে কথাটা। কিন্তু বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো যাতে ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রচার হয়, সে ব্যাপারে ভারতীয় উদ্যোগের কথা ইশতেহারে নেই। যদিও বিষয়টি বেসরকারি পর্যায়ের, তবুও এখানে ভারত সরকারের কোনো ভূমিকা নেই, তা বলা যাবে না। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং যৌথ ইশতেহারে যেসব কথা বলা হয়েছে, তাতে মূলত ভারতীয় স্বার্থই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাপ্তি এখানে তুলনামূলক বিচারে কম। বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি, যা পূরণ হয়নি। রাষ্ট্রীয় সফরের পর সাধারণত যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয়। এটা এক ধরনের রেওয়াজ ও বাধ্যবাধকতাও বটে। এই ইশতেহারেও বাংলাদেশের জন্য কোনো আশার বাণী নেই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com 

0 comments:

Post a Comment