রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন ও কিছু কথা

লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতনের মধ্য দিয়ে সেখানে সব 'সমস্যার' সমাধান হয়েছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়াতে, যেখানে একটি জাতীয় 'ঐকমত্য' প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি ছিল, সেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি দশ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর যে সূচনা করেছিল, সেই যুদ্ধেরও অবসান হয়নি। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর এটা ধরে নেয়া হয়েছিল যে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর অবসান ঘটবে। কেননা ওবামা প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে নতুন এক শান্তির বাণী শুনিয়েছিলেন। ২০০৯ সালের কায়রো ভাষণে ওবামা মুসলমানদের আস্থা অর্জনের জন্য 'নতুন এক রাজনীতির' কথা ঘোষণা করেছিলেন। সারা বিশ্বের মুসলমানরা সেদিন আশ্বস্ত হয়েছিল। ওবামা শান্তির জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল ওবামা তার পূর্বসূরি বুশের চেয়ে কোনো অংশে কম যান না। ইরাকের মতো লিবিয়াতে তিনি মার্কিন সেনা পাঠাননি সত্য, কিন্তু তিনি মার্কিন যুদ্ধ-বিমানকে বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রায় ছয় মাস 'যুদ্ধের' পর গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হলো। বিদ্রোহীদের অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল ওবামা প্রশাসন। গাদ্দাফি উৎখাত হলেন, তাও জনগণের ভোটে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রাসী সামরিক অভিযানের মুখে। তাই তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শেষ হয়ে গেছে_ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্রেই বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওবামা প্রশাসন 'নতুন এক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'র সূচনা করেছেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক ঙঢ়বহ ঝড়পরবঃু ঋড়ঁহফধঃরড়হ তাদের একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'র মাত্রা কমেনি বরং বেড়েছে। রবার্ট ড্রাইফুস (জড়নবৎঃ উৎবুভঁংং) ওই প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে আমাদের জানিয়েছেন যে বর্তমানে আফগানিস্তানে প্রতি রাতে নূ্যনতম ১৯ বার 'রাতের অপারেশন' পরিচালিত হয়, যা আগের চেয়ে অনেক বেশি। গত তিন মাসে ১৭০০ বার 'রাতের অপারেশন' পরিচালিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আফ্রিকায় যুদ্ধের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। এ কথাটাও স্বীকার করেছেন আফ্রিকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত অঋজওঈঙগ-এর ফোর্স কমান্ডার জেনারেল কার্টার হাম। তাদের টার্গেট এখন সোমালিয়ার আল-সাহার, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার অষ-ছধবফধ রহ ওংষধসরপ গধমৎবন এবং নাইজেরিয়ার ইড় কড় ঐধৎধস গ্রুপ, যাদের সঙ্গে আল-কায়দার একটা সম্পর্ক আছে বলে ধরে নেয়া হয় (জড়নবৎঃ উৎবুভঁংং-এর প্রবন্ধ ঘধঃরড়হ ড়ভ ঈযধহমব, ২২ ঝবঢ়ঃবসনবৎ)। সুতরাং 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শেষ হচ্ছে না। বুশ এটাকে ব্যবহার করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। ওবামাও দ্বিতীয়বারের জন্য (২০১২) এটা ব্যবহার করবেন তার নিজ স্বার্থে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের স্বার্থে নয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গত ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার দশম বার্ষিকী পালিত হয়েছে। দুজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট (একজন বর্তমান, একজন সাবেক) নিউইর্য়কের গ্রাউন্ড জিরোতে ফুল দিয়ে ওই সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণ করেছেন। বিবিসির বাংলা বিভাগ গত ১২ সেপ্টেম্বর রাতে তাদের একটি 'ফোন-ইন' অনুষ্ঠানে বাংলাদেশিদের মতামত জানতে চেয়েছিল। যারা প্রশ্ন করেছেন তাদের প্রায় সবারই জিজ্ঞাসা ছিল আসলে নাইন-ইলেভেনের উদ্দেশ্য কী ছিল? কারা এই নাইন-ইলেভেন সংঘটিত করেছিল? এ ধরনের প্রশ্ন যে শুধু বাংলাদেশিদের মাঝেই জেগেছে, তা নয়। বরং খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও এ প্রশ্ন উঠেছে। অনেক প্রবন্ধ, অনেক গ্রন্থ ইতিমধ্যে পশ্চিমা বিশ্বে লেখা হয়েছে। আজো হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি লেখাতেই টার্গেট করা হয়েছে মুসলমানদের। চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে। তবে যারা নোয়াম চমস্কি, ফিনিয়ান কানিংহাম কিংবা মিচেল চসুডোভস্কির লেখার সঙ্গে পরিচিত, তারা দেখেছেন কীভাবে গভীরে প্রবেশ করে তারা অনুসন্ধান করেছেন কেন নাইন-ইলেভেন ঘটলো কিংবা যারা নাইন-ইলেভেন সংঘটিত করেছিল, তারা আসলে কারা, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল।
এটা সত্য আল-কায়েদা স্বীকার করেছিল তারা নাইন-ইলেভেন সংঘটিত করেছিল। কিন্তু অনেক প্রশ্নেরই আমরা আর কোনো জবাব কোনোদিন খুঁজে পাব না। কেননা যিনি জবাব দিতে পারতেন, সেই আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন এখন আর বেঁচে নেই। মার্কিন কমান্ডোরা গত ২ মে ভোররাতে অ্যাবোটাবাদের একটি বাড়ি রেড করে তাকে হত্যা করে। তারপর কোনো ধরনের ডিএনএ টেস্ট ছাড়াই তার মৃতদেহ আরব সাগরে ভাসিয়ে দেয়। একজন মুসলমান হিসেবে, মৃতদেহের প্রতি যে সম্মান দেখানোর কথা, সেই সম্মানও দেখানো হয়নি ওসামা বিন লাদেনের ক্ষেত্রে। ওসামা বিন লাদেনের উত্থান ও মৃত্যু নিয়েও নানা কথা আছে। একসময় ওসামা বিন লাদেনদের তৈরি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের প্রয়োজন ছিল লাদেনদের। একসময় এই লাদেনরাই অস্ত্র তুলে নিল মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছিল, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইর্য়কের বিশ্ব-বাণিজ্য সংস্থার সদর দফতরে (যা টুইন টাওয়ার নামে পরিচিত) বোমা হামলার জন্য ওসামা বিন লাদেন ও তার সংগঠন আল-কায়েদা জড়িত। লাদেনকে আফগানিস্তান আশ্রয় দিয়েছে এই অভিযোগ তুলে মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলা হলো। অক্টোবরে তালেবানরা উৎখাত হলেন কাবুল থেকে, আর ২২ ডিসেম্বর সেখানে হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছে আফগানিস্তান। কিন্তু ওসামা বিন লাদেনকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না! পাওয়া গেল ২০১১ সালের ২ জুন ভোরবেলায়। ঙঢ়বৎধঃরড়হ এবৎড়হরসড় হত্যা করলো ওসামাকে, যিনি কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই দুই স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের নিয়ে অ্যাবোটাবাদের একটি বাসায় বসবাস করতেন। এটাও কী সম্ভব? সারা বিশ্বের গোয়েন্দারা যাকে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে খুঁজছে, তাকে কি না পাওয়া গেল একটি বাড়িতে, পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে, একাকী। হাতের কাছে একটি কালাসনিকভ রাইফেলও ছিল না, অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িতে, যাকে মার্কিন নৌ বাহিনীর কমান্ডোরা নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করেছিল, তিনি কী আসলেই ওসামা বিন লাদেন ছিলেন? এটা একটা ওয়ান মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। তবে বস্টনের এষড়নধষ চড়ংঃ ৪ মের (২০১১) সংখ্যায় ওসামাকে নিয়ে কতগুলো ছবি ছেপেছিল। একটি ছবি আছে ৫ বছরের পুরনো। সিআইএ কর্তৃক সরবরাহকৃত ওই ছবিতে দেখানো হয়েছে অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িটি। নিচে ক্যাপশনে বলা হয়েছে_ সিআইএ পাঁচ বছর ধরেই ওই বাড়িটিকে টার্গেট করেছে, যেখানে তাদের ধারণা ওসামা বিন লাদেন লুকিয়ে থাকতে পারেন। সংগত কারণেই তাই প্রশ্ন ওঠে সিআইএ এত দীর্ঘ সময় কেন নিল ওসামাকে হত্যা করার জন্য। ৫ বছর তো দীর্ঘ সময়। সিআইএ কী এতদিন অপেক্ষা করে কোনো 'অপারেশন' এর জন্য? আরো প্রশ্ন আছে। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের ধরে এনে তার বিচার করেছে যুক্তরাষ্ট্র (যেমন পানামার নরিয়েগা)। হেগে আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। ওসামা বিন লাদেন যদি সত্যি সত্যিই মানবতার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তার বিচার যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আদালতে হতে পারতো। নিদেন পক্ষে হেগে সেই বিচার হতে পারতো। কিন্তু তাকে হত্যা করা হলো। তার ছবিও প্রকাশ করা হলো না। এটা একটা 'সাজানো নাটক' কিনা, ইতিহাস সেটাই বিচার করবে একদিন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই পৃথিবীতে ওসামা বিন লাদেন নামে কেউ বেঁচে নেই, যিনি আসল কথাটা বলতে পারবেন।
সুতরাং 'ওয়ান-ইলেভেন' এ কী হয়েছিল, এটা মানুষ জানলেও, এর নেপথ্যের কারণ মানুষ আর কোনোদিনই জানবে না। ওবামা প্রশাসন ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের যে ঘোষণা দিয়েছে, তাও এখন প্রশ্নের মুখে। বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দীন রব্বানীর মৃত্যুর পর এ প্রশ্ন এখন উঠেছে। লিবিয়ায় গেল মার্চে যে 'যুদ্ধের' সূচনা করেছিলেন ওবামা, তা সেপ্টেম্বরে এসে একটা পরিণতি পেয়েছে, এটা সত্য, কিন্তু 'যুদ্ধ' লিবিয়ায় থামবে না। সিরিয়ায়ও লিবিয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রয়েছে ইয়েমেন, তারপর সোমালিয়া। লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ নাইজারে, যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও রয়েছে। নাইজার 'আরেকটি পাকিস্তান'-এ পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রথমত, গাদ্দাফির সমর্থকদের নাইজারে আশ্রয় নেয়া (সম্ভবত গাদ্দাফিও সেখানে আছেন)। দ্বিতীয়ত, নাইজারের প্রাকৃতিক সম্পদ (তেল ও ইউরেনিয়াম)_ এ দুটো কারণে নাইজারের রাজনীতি আগামীতে উত্তপ্ত হবে এবং এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী একটি অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে।
'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'র সূচনা করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এখনো তাদের মূল টার্গেট মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল। সুতরাং লাদেনের মৃত্যু কিংবা গাদ্দাফির পতন_ এটাই শেষ নয়। নতুন নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সেখানে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা উৎপাদন শিল্প তথা করপোরেট হাউসগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্যই যুদ্ধ দরকার। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। আফগানিস্তান ও ইরাক এর বড় প্রমাণ। গাদ্দাফির পতনই তাই শেষ কথা নয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment