রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই

বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধারণা বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৫টির মতো। আরও হবে। এক্ষেত্রে সরকার সব অর্থ বহন করবে তা হয় না এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা গ্রহণযোগ্যও নয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই
বিষয়টি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের একটি ধারা নিয়ে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ২৭(৪) ধারা মতে, এখন থেকে নিজস্ব আয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তার ব্যয় নির্বাহ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন আইনে বলা হয়েছিল, সরকার পাঁচ বছর পর্যন্ত ব্যয় নির্বাহ করবে। অবকাঠামো গড়ে তুলতে আর্থিক সহযোগিতা দেবে। সরকার তা দিয়েছেও। ওই পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। এখন আইন অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনো অর্থ দিতে পারে না। যদি অর্থ বরাদ্দ দিতে হয় তাহলে আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। সেটিও সম্ভব নয়। কেননা এর সঙ্গে দাতাদের একটা সম্পৃক্ততা আছে। অর্থমন্ত্রী কিংবা শিক্ষামন্ত্রী চাইলেও আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে তাদের পক্ষে করার কিছুই থাকবে না। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় ২৫ সেপ্টেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যা করল তা মেনে নেওয়া যায় না। আইন নিজের হাতে নিয়ে গাড়ি ভাংচুর করা, রাস্তা অবরোধ করা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের ক্ষোভ থাকতেই পারে এবং তার পেছনে যুক্তিও থাকতে পারে। কিন্তু এই ক্ষোভ ও দুঃখবোধ এভাবে প্রকাশ করা ঠিক নয়। ওইদিন আমার মতো শত শত মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। প্রেস ক্লাবের আশপাশের এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্যান্য রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছিল যানজট। অসুস্থ হয়ে আমাকে শ্যামলী থেকে মগবাজারে হাসপাতালে যেতে সময় লেগেছিল দু\'ঘণ্টা। সিরিয়াস রোগীদের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল, আমি এটা চিন্তাও করতে পারি না। সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি এসে যায় তা হচ্ছে, এই ভাংচুরের সংস্কৃতি থেকে আমরা কবে বের হয়ে আসতে পারব? কিছু হলেই গাড়ি ভাংচুর, রাস্তা অবরোধ_ এর নাম কি ছাত্ররাজনীতি? এই সংস্কৃতি তো ছাত্রদের মানসম্মান, ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করবে না।
ছাত্রদের হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হওয়ার পেছনে রয়েছে ২৫ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে তিনটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হয়েছে। জগন্নাথ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বতন্ত্র আইন রয়েছে। আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, নিজস্ব আয়েই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চলতে হবে। এখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাঁচ বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও বাকি দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দেওয়া হয়েছে দশ বছরের সময়সীমা। কেননা জগন্নাথ পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, বাকি দুটি নতুন। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় (কলেজ) হিসেবে জগন্নাথের যে আর্থিক ভিত্তি ছিল, নতুনদের তা ছিল না। সুতরাং কুমিল্লা ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (ত্রিশাল) বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এক কাতারে মেলানো যাবে না।
এখানে যারা ভর্তি হয়েছে তারা জেনেশুনেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। শিক্ষক হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা জেনেশুনেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। উপাচার্য মহোদয় ভালো করেই জানেন আইনে কী লেখা আছে। এখন তার কোনো বক্তব্যে ছাত্ররা যদি উত্তেজিত হয়ে ওঠে, এর দায়ভার তাকে নিতেই হবে। ছাত্রদের অভিভাবক হিসেবে তার উচিত ছিল ছাত্রদের নিবৃত্ত করা। গাড়ি ভাংচুর কোনো সমাধান নয়। গাড়ি ভাংচুর করলেই সরকার অর্থ বরাদ্দ করতে পারবে না। এখন গাড়ি ভাংচুর হলো, মানুষের ভোগান্তি হলো, সাধারণ মানুষ দোষ দিল ছাত্রদের। জগন্নাথের একটি \'ঐতিহ্য\' ছিল, যা ওই কলেজটিকে বারবার বদনামের ভাগীদার করেছে। এখানে ছাত্ররাজনীতি মানেই ছিল চাঁদাবাজি। ছাত্র ভর্তির পেছনে লাখ লাখ টাকা আয় করত ছাত্রনেতারা। এখানে আবার সরকারি ও বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের \'সহাবস্থান\' ছিল_ কে কতটি \'সিট\' পাবে তা অলিখিতভাবে তৈরি করাই থাকত। অধ্যক্ষ মহোদয়রা কখনোই ওই চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। আজ কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। কিন্তু ওই সংস্কৃতির কি পরিবর্তন হয়েছে? আমার মনে হয়_ না। আগের মতো ছাত্র ভর্তিতে চাঁদাবাজি হয়তো হয় না। কিন্তু কিছু যে হয় না, এর গ্যারান্টি আমাকে কে দেবে?
আইনে বলা হয়েছে, নিজস্ব আয়ে ব্যয় নির্বাহ করা। এটা সম্ভব। এ জন্য দরকার ডায়নামিক নেতৃত্ব। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উপাচার্যরা যদি দায়িত্ব না নেন তাহলে এভাবে বারবার ছাত্র অসন্তোষ দেখা দেবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে তা প্রমাণ করেছে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন অনুষদ। এখানে তারা নিজেদের শুধু ব্যয় নির্বাহই করে না, উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে তারা প্রচুর অর্থও জমা দেয়। উদ্যোগটা নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই। শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সম্ভাবনা আছে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের। শুরুতেই গলদ ছিল। যেসব বিষয়ের চাহিদা রয়েছে সেসব বিষয় যদি চালু করা হতো, তাহলে ছাত্ররা টাকা-পয়সা দিয়েই পড়ত। তা না করে ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিষয় চালু করে, অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়েছে মাত্র। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। বরং ব্যবসায় প্রশাসন, মিডিয়া স্টাডিজ কিংবা আইটি বিভাগ চালু করলে ছাত্রদের আকৃষ্ট করা যেত। এখনও সেই সুযোগ আছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমতিসাপেক্ষে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সম্ভব। পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি আছে। এ দেশের বেসরকারি খাত এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে। অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়কে \'সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্র\'-এ পরিণত করেছেন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা পুঁজি খাটাবেন যদি তাদের উৎসাহিত করা হয়। এ জন্য বড় প্রয়োজন উদ্যোগের। দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা জগন্নাথে উপাচার্য হয়েছেন তারা কখনও এদিকটা ভাবেননি। তারা অনেকটা \'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য\'দের মতো চাকরি করে গেছেন। তারা এটা কখনও ভাবেননি যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সেই অর্থে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়। এটা এক অর্থে সরকারি, অন্য অর্থে বেসরকারি। তৃতীয়ত, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে \'বিনিময় প্রোগ্রাম\' চালু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান বাড়ানো সম্ভব। সে সঙ্গে আর্থিক ভিত্তিও শক্তিশালী করা যায়। আসলে উদ্যোগটাই হলো আসল। এই উদ্যোগের বড় অভাব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যারা চালান তাদের। রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় কীভাবে বাড়ানো যায় এটা গত পাঁচ বছরে কেউ কখনও চিন্তা করেননি। এখন অহেতুকভাবে সরকারের ওপর \'চাপ\' সৃষ্টি করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি বিব্রত হয়েছেন। তার বিব্রত হওয়ারই কথা। তাকে এখন চাপের মুখে রেখে আইন পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। আইনটি পাস হয়েছিল সংসদে এবং পরিবর্তন যদি করতেই হয় তাহলে তা করতে হবে সংসদে। তবে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান ও অবকাঠামো উন্নয়নে যে সাহায্য দিয়েছিল তার অন্যতম শর্ত ছিল নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে তাহলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পারবে না কেন? আরও একটা কথা। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই এখন উচিত তাদের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করা। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও এই আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করা যায়। অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগও বন্ধ করা উচিত। এটা করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাংক থেকে আমরা আর কোনো আর্থিক সাহায্য পাব না। বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধারণা বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৫টির মতো। আরও হবে। এক্ষেত্রে সরকার সব অর্থ বহন করবে তা হয় না এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা গ্রহণযোগ্যও নয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই।
দৈনিক সমকাল,সোমবার | ৩ অক্টোবর ২০১১
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment