রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দেশ সাংঘাতিক সমস্যার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে ( দৈনিক ডেসটিনিকে দেয়া একটি বিশেষ সাক্ষাতকারে ড. তারেক শামসুর রেহমান)

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেছেন, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা সংলাপ খুবই জরুরি। সংলাপের মাধ্যমে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নয়; ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের একটা রূপরেখা করা দরকার। কারণ দেশ বর্তমানে সাংঘাতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দৈনিক ডেসটিনিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন।
ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটা অংশ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলও সরকারের একটা অংশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা পরস্পর শত্রু মনোভাবাপন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য এটা ভালো নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোডমার্চের পর খালেদা জিয়া একটা লাইন স্পষ্ট করে নিয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না।
তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই মূহূর্তে সংবিধানের বাইরে আমরা কেউ নই। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। এই সংবিধান অনুসরণ করেই আমাদের নির্বাচনে যেতে হবে। সংবিধান অনুসরণ করে সংবিধানই আমাকে বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এখানেই হচ্ছে, বিরোধী দলের আপত্তি এবং সরকারি অধীনে নির্বাচন হলে তারা নির্বাচনে যাবে না।
তিনি বলেন, নির্বাচন হতে দুবছর এখনও বাকি। এই দুবছরে কি হবে তা আমরা জানি না। কিন্তু খালেদা জিয়ার বক্তব্য যদি আমরা ধরে নিই তাহলে বুঝতে হবে তারা তত্ত্বাবধায়ক

সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না।
ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, বিএনপিকে ছাড়া যদি নির্বাচন হয় সে নিরর্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। '৯৬ সালেও একটা নির্বাচন হয়েছিল। সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। সেই সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটোই অনিবার্যভাবে একটি শক্তি। একটি শক্তিকে বাদ দিয়ে রাজনীতি পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। তবে এই দুই বড় দলের মাঝে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের যদি ঘাটতি থাকে তাহলে দেশে সংকটের সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানে নেই। কিন্তু যে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে এ ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে সেখানে একটি অংশে বলা আছে পরবর্তী দশম ও এগারোতম দুটি সংসদ নির্বাচন এ ব্যবস্থার অধীনে করা যায়। কিন্তু সে ব্যাপারে সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে। তাহলে এখানে একটা সুযোগ আছে, সংসদ যদি চায় তাহলে এ ব্যবস্থা পুনঃপরিবর্তন করা সম্ভব। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না রেখে বিকল্প ব্যবস্থা। এরমধ্যে একটি হল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। এটাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও বলা যেতে পারে। প্রশ্নটা হল এই ব্যবস্থা কিভাবে গঠিত হবে। এখানেও বিভিন্ন ফর্মুলা আছে। একটা হতে পারে বর্তমান যিনি প্রধান বিচারপতি তাকে রেখেই নির্বাচন করা। তিনি (প্রধান বিচারপতি) নির্বাচন পরিচালনা করবেন। অথবা হতে পারে সংসদ থেকে দেশের তিনজন গুণী ব্যক্তির সমন্বয়ে একটা কমিটি গঠন করে দেওয়া; যারা শুধু নির্বাচন সম্পন্ন করবে। তাদের বলে দেওয়া হবে দ্বায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন করা; অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারবে না। এখানে কোনো মন্ত্রীর দরকার নেই। শুধুমাত্র সচিবরা যেভাবে আছেন তারা তাদের সেভাবে সহযোগিতা করবে। এরকম বেশ কিছু ফর্মুলা আলোচনার মধ্যে থেকে বের হয়ে আসতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির যে রোডমার্চ তা সরকারের কাছে একটা ম্যাসেজ পেঁৗছে দিয়েছে। তা হল খুব শিগগিরই সরকার ও বিরোধী দল সংলাপে বসবে। সরকার বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে একটা পথ বের করবে। এক্ষেত্রে দেশের একজন গুণী ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন। যেমন হতে পারে ব্যারিস্টার রফিকুল হক; যিনি বিরোধী দল ও সরকারি দুই দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য। যেমন করেই হোক একটা ফর্মুলা বের করতে হবে। যে ফর্মুলার অধীনে আমরা একটি নির্বাচন চাই। যে নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে কমিশনকে শক্তিশালী করেও একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা যাবে না। দেশের সংস্কৃতি এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে নির্বাচন কমিশনে যারাই আসবেন তারাই সরকারের বন্ধু হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে লক্ষ্য করি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক আমলা এবং বেসামিরিক আমলা এদের মধ্যে এক ধরনের নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার ঝোঁক থাকে। কেউ আওয়ামী লীগের সমর্থন করে; কেউ বিএনপির। এরা সবাই এক ধরনের সুযোগ সন্ধানীতে কাজ করে। এমনও দেখেছি অনেক সচিব কবিতা লিখেও সরকারের মনরঞ্জনের চেষ্টা করে। যাতে ভবিষ্যতে একটা পদ সে পায়। সচিবরাও এখন নিরপেক্ষ নন। তারাও দলীয়তার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এ কারণে সরকার এসব আমলাদের একজনকে বেছে নেবে তা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এমন কোনো পদ্ধতিতে পেঁৗছতে পারিনি যেখানে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারবে। নির্বাচন কমিশন অতীতে হয়েছিল; কিন্তু গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখনও তাই হবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সরকারের নতুন করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে হবে। এ নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যাবে না। কারণ যারা নিয়োগ পাবে তারা বিরোধী দলের কাছে সরকারের লোক বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে একটা স্বাধীন কমিশন গঠন করা ভালো। কিন্তু স্বাধীন কমিশন করতে হলে একটা কৌশল ঠিক করতে হবে। এমনও হতে পারে যে, একটা সার্চ কমিটি গঠন করা। এ কমিটিতে তিন বা পাঁচ জন নির্বাচন কমিশনার থাকবে। সংসদ নির্ধারণ করে দিতে পারে যে সার্চ কমিটিতে কারা থাকবেন। অবশ্য নিরপেক্ষ লোক হতে হবে। সেখানে সরকারি আমলা আসবে এমন নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নামি একজন গুণী এবং এনজিও ব্যক্তিত্বও আসতে পারেন। তাদের দায়িত্বটাও হবে শুধুমাত্র নির্বাচন পরিচালনা করা। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আমাদের দরকার। সার্চ কমিটি গঠন করে নিরপেক্ষ লোকদের এ কমিশনে বসাতে হবে। নতুবা আবার একই জটিলতার মধ্যে পড়তে হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের দেওয়া যাবে না। কারণ ভারতে নির্বাচন কমিশন অনেক শক্তিশালী। এতই শক্তিশালী যে, মন্ত্রীকে পর্যন্ত জেলে পাঠাতে পারে। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। কারণ তারা নিজস্ব কোনো ক্যাডার সিস্টেম এখনও উন্নয়ন করেনি। তারা (নির্বাচন কমিশন) এখনও অর্থের জন্য সরকারের বাজেট বরাদ্দের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। সরকারের মতো যদি কাজ না করে তাহলে অর্থ বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে আমাদের সদিচ্ছা থাকলে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন করার জন্য সংসদে আইন করাও সম্ভব। অতীতে কোনো সরকারই এটা করেনি। এখনও করবে বলে মনে হয় না।
তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে মহাজোট সরকার অবস্থান নেওয়ায় বিরোধী দলের কাছে তাদের কোনো ফর্মুলা গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু সরকারের ফর্মুলাই মহাজোটের অন্য শরিকরা সংসদে প্রস্তাব দিতে পারে, যা সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতেও পারে।

0 comments:

Post a Comment