রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সংসদে আলোচনা ছাড়া ট্রানজিট নয়। দৈনিক ডেসটিনির সাথে বিশেষ সাক্ষাতকারে ড. তারেক শামসুর রেহমান।

সরকারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে বহুল আলোচিত ট্রানজিট নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের বিভ্রান্তি। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান দৈনিক ডেসটিনির সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন।
ডেসটিনি : বাংলাদেশের আখাউড়া দিয়ে কয়েক চালান ট্রানজিট পণ্য ভারতে গেছে। প্রথমে পরীক্ষামূলক বলা হলেও এখন সরাসরি ট্রানজিট পণ্য যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য পরিষ্কার যে, ট্রানজিট নিয়ে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলক বলা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে সরাসরি ট্রানজিট দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হল কোনোরকম হিসাব-নিকাশ না করে, পরিবেশগত ও শুল্কের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে সরকার কেন ট্রানজিট দিচ্ছে? জনগণকে অন্ধকারে রেখে সরকার এই ট্রানজিট কেন দিচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারছি না। সরকার ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের সঙ্গে অন্য কোনো শর্ত যুক্ত করেছে কি না এ বিষয়ে সন্দেহ দেখা যাচ্ছে। ট্রানজিটকে বহুমাত্রিক যোগাযোগের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করার কথা থাকলেও সরকার ভুটান ও নেপালের ট্রানজিট কার্যকর না করে কোনোরকম সুযোগ-সুবিধা ও লিখিত চুক্তি ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিটের সুযোগ করে দিল। এটা একপক্ষীয় ট্রানজিট হয়েছে। ভারত তার সুবিধার জন্য এ কাজটি অতি সূক্ষ্মভাবে বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে। এ ট্রানজিট আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। কেননা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিকে উপেক্ষা করে ভারত ওই ট্রানজিট নিয়েছে। পররাষ্ট্র নীতির আওতায় শুল্ক নির্ধারণ, পরিবেশগত বিষয় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ভারতের সঙ্গে কোনো আলোচনা ও চুক্তি হয়নি।
এই ট্রানজিটের ফলে ভারতের ৪২ চাকার পণ্য পরিবহনের ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এর জন্য নতুন করে রাস্তা তৈরি করতে হচ্ছে, অনেক খাল ভরাট করে দেওয়া হয়েছে ফলে পানির স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ট্রানজিট নিয়ে জনমনে সংশয় ও সন্দেহ বাড়ছে। মানুষের মনে ভারত বিরোধিতার জন্ম হয়েছে, যার প্রভাবে দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। ট্রানজিট নিয়ে সরকারের উচিত ছিল জাতীয় সংসদে আলোচনা করা। জাতীয় সংসদকে পাশ কাটিয়ে ট্রানজিট দেওয়া ঠিক হবে না। সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে স্পর্শকাতর বিষয়টি সুরাহা হওয়া উচিত।
ডেসটিনি : সরকারের তরফে প্রথমে বলা হয়েছে এটা পরীক্ষামূলক। এরপর ফি নির্ধারণ করা হবে। এখন বলা হচ্ছে ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী পণ্য যাচ্ছে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ভারত যদি ট্রানজিটের দাবি করে থাকে তবে ৪০ বছর পরে এসে কেন তারা এ দাবি করছে? এতদিনে কেন তারা ট্রানজিট নিয়ে কোনো কথা উচ্চারণ করল না? কেন এতদিন পরে এসে ভারত ট্রানজিটের সুযোগ নিতে চায়? এতদিন দাবি না জানিয়ে যখনই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এসেছে তখনই অতি দ্রুততার সঙ্গে ট্রানজিটের বিষয়টি নিয়ে ভারত উঠেপড়ে লাগল। এখন আমাদের বুঝতে হবে এর মধ্যে ভারতের কোনো দুরভিসন্ধিমূলক বিষয় রয়েছে, নতুন কোনো চক্রান্ত রয়েছে এই ট্রানজিটের মধ্যে। ভারতের উদ্দেশ্য যে সৎ নয় তা পরিষ্কার।
সত্যিকার অর্থে ১৯৭২ সালের নৌ প্রটোকল অনুষায়ী যদি ওই ট্রানজিট দেওয়া হয়ে থাকে তবে সরকারের উচিত অতি দ্রুত তা সংসদে উপস্থাপন করা। জাতিকে জানানো উচিত যে আসলে ৭২ সালের চুক্তিতে কী ছিল?
ট্রানজিট নিয়ে একধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটা করে ট্রানজিট আদায় করা কোনো যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। আমি মনে করি, স্পর্শকাতর এই বিষয়টি জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ট্রানজিট। সে কারণে ট্রানজিট নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা প্রয়োজন। আমি দুঃখজনকভাবে লক্ষ করেছি ট্রানজিট নিয়ে মহাজোটের শরিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারাও স্ববিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে_ এটা মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ অথচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বাদ রেখেই সরকারের দুজন উপদেষ্টা এ কাজটি করেছেন। আর এর মধ্যদিয়ে আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও মন্ত্রী প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমনকি ট্রানজিট নিয়ে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও উল্লেখ নেই।
ডেসটিনি : ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশের সফরের সময় তিস্তা চুক্তি না হওয়ার কারণে ট্রানজিট দেওয়া হয়নি বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে ট্রানজিটের মাধ্যমে পণ্য যাচ্ছে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : এটা পরিষ্কার যে, ভারতের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট আদায় করে নেওয়া। ওই সময় তিস্তা চুক্তির কথা বলে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিকে আড়াল করার পলিসি নিয়েছিল ভারত। এটা ছিল ট্রানজিট আদায়ের ক্ষেত্রে ভারতের একটি ভাঁওতাবাজি; কেননা ভারতের নীতিনির্ধারকরা জানত তিস্তা চুক্তি নিয়ে আদৌ কিছু হবে না। মূলত জনগণের দৃষ্টি তিস্তার দিকে ধাবিত করে ট্রানজিট আদায় করার একটি কৌশল করেছিল ভারত এবং এতে তারা সফল হয়েছে।
ডেসটিনি : অনেকে বলেছেন এভাবে পণ্য যেতে থাকলে ভারতীয় পণ্যের জন্য উল্টো আমাদের ভর্তুকি দিতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে ভারতীয় পণ্য সরবরাহ কার স্বার্থে?

ড. তারেক শামসুর রেহমান : ট্রানজিট লিখিত বা অলিখিত যাই হোক_ এই ট্রানজিট বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ভারসাম্য আরও বাড়াবে, কেননা ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং ওই পণ্যের দাম বাংলাদেশের পণ্যের চেয়ে কম হবে। প্রাণ ও স্কয়ারের যেসব পণ্য এখন ভারতে যাচ্ছে তার অর্ডার কমে যাবে। এতে করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে।
ডেসটিনি : বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার বলেছেন ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ফি দিয়েই পণ্য যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে এর প্রতিবাদ করা হয়নি। যদি ফি পেয়ে থাকে, আর এটি যদি সত্যি হয় এ ব্যাপারে সরকার জনগণকে পরিষ্কার করে জানাচ্ছে না কেন?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : আমি এ বিষয় নিয়ে কনফিউজড। ট্রানজিট নিয়ে ৭২ সালে চুক্তিতে কী আছে, কতটুকু আছে তা স্পষ্ট নয়। সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে। যদি ধরে নেওয়া হয় ৭২ সালের চুক্তি ঠিক, তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ওই চুক্তি ঠিক কি না তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
ডেসটিনি : বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে ভারতের এক অংশ থেকে অন্য অংশে পণ্য পরিবহনকে ট্রানজিট বলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হবে?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : এটাকে আমি ট্রান্সশিপমেন্ট বলব।
ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে এবং জনগণের মধ্যে একধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ট্রানজিট রয়েছে, বাংলাদেশেও ট্রানজিন হতে পারে তবে তা অবশ্যই জনমতকে উপেক্ষা করে নয়। এর জন্য জনমত নেওয়া প্রয়োজন, কেননা জনগণের স্বার্থের সঙ্গে এটা জড়িত। স্বচ্ছতার খাতিরে সরকারের উচিত ট্রানজিটের পুরো বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা করা।

0 comments:

Post a Comment