রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইতিহাস গাদ্দাফিকে কীভাবে স্মরণ করবে?


লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে ইতিহাস এখন গাদ্দাফিকে কীভাবে স্মরণ করবে? একজন ডিক্টেটর হিসেবে, নাকি তৃতীয় বিশ্বের একজন 'বন্ধু' হিসেবে? গাদ্দাফির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তাকে হত্যা করা হয়েছে জাতিসংঘ বলছে, এই হত্যাকা-ের তদন্ত করতে হবে পশ্চিমা সংবাদপত্রে যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় সিরতে, তার নিজ শহরে তাকে জীবিত অবস্থাতেই 'ধরা' হয়েছিল তারপর তাকে হত্যা করা হয় এই হত্যাকা- নিয়েও রহস্য আছে শোনা যাচ্ছে পরস্পরবিরোধী কথা কিন্তু যেটা লক্ষ্য করার বিষয়, তা হচ্ছে তার এই মৃত্যুতে সারা লিবিয়াতেই এক ধরনের উল্লাস যদিও পরিস্থিতি গাদ্দাফির অনুকূলে নয় ফলে গাদ্দাফির মৃত্যুতে যে উল্লাস হবে, সেটাই স্বাভাবিক তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, দীর্ঘ ৪২ বছরের শাসনামলে গাদ্দাফি কী লিবিয়ার জন্য কিছুই করেননি? লিবিয়ার সম্পদ তেলকে ব্যবহার করে তিনি লিবিয়াকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন; কিন্তু মানুষের মাঝে অসন্তোষ, অসমতা দূর করতে পারেননি তিনি তিনি যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিলেন (জনগণের রাষ্ট্র), তার ফল জনগণ পায়নি তার সন্তানেরা অনেক ক্ষমতা ভোগ করতেন তার তথাকথিত 'জনগণের রাষ্ট্র' এ জনগণের তেমন কোনো অংশগ্রহণ ছিল না তিনি সব সময় বলতেন জনগণ তাকে ভালোবাসে; কিন্তু সেই জনগণ তার পক্ষে এসে দাঁড়ায়নি বিদ্রোহী বাহিনীকে তিনি বলতেন 'ইঁদুর' আর সেই 'ইঁদুর'দের হাতেই তার মৃত্যু হল

তিনি আফ্রিকার অনেক দেশকেই সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু চরম দুঃসময়ে কোনো দেশই তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এমনকি তাঁকে কেউ আশ্রয় দিতেও চায়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে এই পরিণতিই বহন করতে হল। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। লিবিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই অনেকেই সন্দিহান। দেশটি ঐক্যবদ্ধ থাকবে কি-না, সেটাও একটা প্রশ্ন। গেল নভেম্বরে তিউনেসিয়ায় গ্র্যাজুয়েট ফল বিক্রেতা বত্তকুজিজির নিজের শরীরে আগুন লাগানোর মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বে যে পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন, তাতে সর্বশেষ সংযোজিত হল লিবিয়ার নাম। তিউনেসিয়ার বেন আলি, মিসরের হোসনি মুবারক, আর লিবিয়ার গাদ্দাফি এখন ইতিহাসের অংশ। তবে পার্থক্যটা হল বেন আলি ও হোসনি মুবারক বেঁচে আছেন। দু'দেশেই তাদের দুর্নীতির বিচার হচ্ছে। আর গাদ্দাফি বেঁচে নেই। আর মিলটা হলো গণতন্ত্র এখানে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এখন গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়ার রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে কি-না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটিও সহজ হবে না। কেননা লিবিয়ায় একটি সংবিধান প্রণয়ন, কোনো ধরনের সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে এবং দল ব্যবস্থা প্রবর্তন করার ব্যাপারে অন্তবর্তী জাতীয় কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রয়োজন, যা খুব সহজ নয়। উপরন্তু কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে পারে। অস্ত্র উদ্ধার করা হবে একটি বড় কাজ। এই অস্ত্র ইতিমধ্যে আল-কায়েদার হাতে পেঁৗছে গেছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। ইসলামিক জঙ্গিরা গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় অন্যতম একটি শক্তিরূপে আবির্ভূত হতে পারে। এরা গাদ্দাফি উৎখাতে অংশ নিয়েছে। বিশেষ করে ওংষধসরপ ঋরমযঃরহম এৎড়ঁঢ় কিংবা অনফবষ ঐধশরস ইবষযধফল এৎড়ঁঢ়-এর ভূমিকা লক্ষ্য রাখার মতো। গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। গোত্র ও উপজাতীয়ভাবে লিবিয়া বিভক্ত। এ ক্ষেত্রে গাদ্দাফির নিজস্ব গোত্র প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠতে পারে। জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ বেকার। আর ৪০ ভাগ হচ্ছে তরুণ সমাজ। এরা একটি ফ্যাক্টর। এদের চাকরিতে নিয়োজিত করা হবে নতুন সরকারের প্রধান কাজ। গাদ্দাফি উৎখাতের ঘটনায় পশ্চিমাদের প্রভাব লিবিয়াতে বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের জবনঁরষফরহম অসবৎরপধহ উবভবহংব ংঃৎধঃবমু তে লিবিয়া একটি বড় ভূমিকা পালন করবে আগামী দিনে। লিবিয়া হচ্ছে আফ্রিকার 'গেটওয়ে'। লিবিয়া যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর শাদ, নাইজার এবং তিউনেশিয়া ও আলজেরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব। শাদ ও নাইজারে রয়েছে প্রচুর তেল ও ইউরেনিয়াম। ইউরোপ লিবিয়ার তেলের ওপর ৮৫ ভাগ নির্ভরশীল। বিশ্বের তেল রিজার্ভের ৩৫ ভাগ (৬০ বিলিয়ন ব্যারেল) রয়েছে লিবিয়ায়। লিবিয়ার গ্যাস এৎববংঃৎবধস চরঢ়বষরহব-এর মাধ্যমে যায় ইতালিতে। সুতরাং লিবিয়ার তেল ও গ্যাস আগামীতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। তেল ও গ্যাস বিক্রির পয়সায় এখন লিবিয়ার পুনর্গঠন হবে, আর ইরাকের মতো এ কাজ পাবে আমেরিকান কোম্পানিগুলো। লিবিয়ায় অব্যাহত ন্যাটোর বোমা বর্ষণ, গাদ্দাফিকে হত্যা একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সরকার পরিবর্তনে (যাদের যুক্তরাষ্ট্র মিত্র মনে করে না) এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা শক্তিগুলো। সিরিয়া ও ইরানে ন্যাটোর বিমান হামলার সম্ভাবনা এখন বাড়ল। জাতিসংঘকে ব্যবহার করে (সরকার উৎখাতের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না) যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা উন্নয়নশীল বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেবে। যুদ্ধ শুরু করার ক্ষেত্রে বুশের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী (২০০৮) ওবামার কোনো পার্থক্য থাকল না এখন। এভাবে একটি স্বাধীন দেশে ন্যাটোর বিমান বহর দিয়ে হামলা, আন্তর্জাতিক আইনে অনুমোদন করে না। লিবিয়া যুদ্ধ শুরু করার জন্য ওবামা নিজেও আজ যুক্তরাষ্ট্রে অভিযুক্ত। কেননা প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ শুরু করতে পারেন না। যুদ্ধ শুরু করার অধিকার কংগ্রেসের। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানও 'আগ্রাসী যুদ্ধের' বিরুদ্ধে। ১৯২৮ সালের কবষষড়মম-ইৎরধহফ চধপঃ ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কোনো যুদ্ধের অনুমোদন দেয় না। জাতিসংঘের সনদে যেখানে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ওবামা লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেছেন। অথচ শান্তির জন্য ওবামাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। গাদ্দাফি যদি মানবতার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ধিৎ ঞৎরনঁহধষ-এ তার বিচার হতে পারত। এখন লিবিয়াতে ন্যাটোর বিমান হামলা চালানোর অনুমতি দিয়ে এবং ঘধঃরড়হধষ ঞৎধহংরঃরড়হধষ ঈড়ঁহপরষ কে ক্ষমতা দখল করার সুযোগ করে দিয়ে ওবামা আজ নিজেই অপরাধী হলেন। লিবিয়ার পর সিরিয়া ও ইরান এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। এ দেশ দুটিতে যে কোনো সময় হামলা হতে পারে। আসলে ওবামার জন্য যুদ্ধটা দরকার ছিল। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দূরবস্থার মুখে 'যুদ্ধ অর্থনীতি' ওবামাকে একটি 'রাজনৈতিক জীবন' দিতে পারে।
গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি 'ইতিহাসের' অবসান ঘটল। গাদ্দাফি জীবদ্দশায় নিন্দা যেমনি কুঁড়িয়েছেন, তেমনি প্রশংসিতও হয়েছেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ তাকে বন্ধু মনে করত। যে ক'জন ব্যক্তি আন্তর্জাতিক আসরে উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে কথা বলতেন, গাদ্দাফি ছিলেন তাদের একজন। তার মৃত্যু নিঃসন্দেহে একজন 'বন্ধুকে' হারাল তৃতীয় বিশ্ব। তার এই মৃত্যু কাম্য ছিল না। তিনি যদি আগে সংস্কারটা শুরু করতেন, তাহলে তার পতন এভাবে হত না। তবে লিবিয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে গেল। তার মৃত্যু সেসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেবে না।
আগামী আট মাসের মধ্যে একটি নির্বাচনের কথা বলেছেন এনটিসির অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল। তিনি জানিয়েছেন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে একটি জাতীয় পরিষদ গঠন করা হবে, যারা দেশটির জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে; কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে না। ইতিমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে লিবিয়া আরেকটি সোমালিয়া অথবা আফগানিস্তানে পরিণত হতে পারে। এ ধারণা একেবারে অমূলক নয়। গৃহযুদ্ধের সুযোগে সোমালিয়া পরিণত হয়েছে একটি জঙ্গি রাষ্ট্রে। রাষ্ট্র এখন নিয়ন্ত্রণ করে আল-শাবাব নামে একটি জঙ্গি গোষ্ঠী। এখানে একটি সরকার আছে বটে; কিন্তু তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। আর আফগানিস্তানের ইতিহাস তো আমরা মোটমুটি সবাই জানি। আফগান যুদ্ধের সম্প্রতি ১০ বছর পার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ সেখানে কোন সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। বরং সেখানে একটি বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে এবং আগের চেয়েও তালেবানরা এখন আরও অনেক শক্তিশালী। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজলেও, সেই পথ তারা পাচ্ছে না। যদিও ২০১৪ সালের মধ্যে সেখান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলেছেন ওবামা। এখন আগামী দিনগুলোই বলবে ওবামার কথার সত্যতা কতটুকু।
গত ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়ায় বিমান আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র 'তৃতীয় যুদ্ধ' শুরু করেছিল। গাদ্দাফিকে হত্যা করার পর ন্যাটো তাদের অপারেশন বন্ধ ঘোষণা করেছে সত্য, কিন্তু এই 'যুদ্ধ' এখনই শেষ হবে না। 'যুদ্ধ' প্রলম্বিত হবে। আর গাদ্দাফির হত্যাকা- তাকে যদি ইতিহাসে একজন খলনায়ক থেকে নায়কে পরিণত করে, আমি অবাক হব না।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com


0 comments:

Post a Comment